গীতবিতান

ি (১-১০০)
 

বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে।

স্থলে জলে নভতলে বনে উপবনে

নদীনদে গিরিগুহা-পারাবারে

নিত্য জাগে সরস সঙ্গীতমধুরিমা,

নিত্য নৃত্যরসভঙ্গিমা।–

 

নব বসন্তে নব আনন্দ, উৎসব নব।

অতি মঞ্জুল, অতি মঞ্জুল, শুনি মঞ্জুল গুঞ্জন কুঞ্জে-

শুনি রে শুনি মর্মর পল্লবপুঞ্জে,

পিককূজন পুষ্পবনে বিজনে,

মৃদু বায়ুহিলোলবিলোল বিভোল বিশাল সরোবর-মাঝে

কলগীত সুললিত বাজে।

শ্যামল কান্তার-’পরে অনিল সঞ্চারে ধীরে রে,

নদীতীরে শরবনে উঠে ধ্বনি সরসর মরমর।

কত দিকে কত বাণী, নব নব কত ভাষা, ঝরঝর রসধারা

 

আষাঢ়ের নব আনন্দ, উৎসব নব।

অতি গম্ভীর, অতি গম্ভীর নীল অম্বরে ডম্বরু বাজে,

যেন রে প্রলয়ঙ্করী শঙ্করী নাচে।

করে গর্জন নির্ঝরিণী সঘনে,

হেরো ক্ষুব্ধ ভয়াল বিশাল নিরাল পিয়ালতমালবিতানে

উঠে রব ভৈরবতানে।

পবন মল্লারগীত গাহিছে আঁধার রাতে,

উন্মাদিনী সৌদামিনী রঙ্গভরে নৃত্য করে অম্বরতলে।

দিকে দিকে কত বাণী, নব নব কত ভাষা, ঝরঝর রসধারা

 

আশ্বিনে নব আনন্দ, উৎসব নব।

অতি নির্মল, অতি নির্মল, অতি নির্মল উজ্জ্বল সাজে

ভুবনে নব শারদলক্ষ্মী বিরাজে।

নব ইন্দুলেখা অলকে ঝলকে

অতি নির্মল হাসবিভাসবিকাশ আকাশনীলাম্বুজ-মাঝে

শ্বেত ভুজে শ্বেত বীণা বাজে-

উঠিছে আলাপ মৃদু মধুর বেহাগতানে,

চন্দ্রকরে উল্লসিত ফুল্লবনে ঝিল্লিরবে তন্দ্রা আনে রে।

দিকে দিকে কত বাণী, নব নব কত ভাষা, ঝরঝর রসধারা

                 ২

কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন   দিয়ে যাও, শেষে   দাও মুছে। 

ওহে    চঞ্চল, বেলা  না যেতে খেলা   কেন তব যায় ঘুচে

চকিত চোখের অশ্রুসজল  বেদনায় তুমি ছুঁয়ে ছুঁয়ে চল-

        কোথা সে পথের শেষ   কোন্‌ সুদূরের দেশ

         সবাই তোমায় তাই পুছে

বাঁশরির ডাকে কুড়ি ধরে শাখে,   ফুল যবে ফোটে নাই দেখা।

তোমার লগন যায় যে কখন,  মালা গেঁথে আমি রই একা।

‘এসো এসো এসো’ আঁখি কয় কেঁদে। তৃষিত বক্ষ বলে ‘রাখি বেঁধে’।

            ধরা দিতে যদি নাই রুচে

 

                  ৩

একি  আকুলতা ভুবনে!  একি  চঞ্চলতা পবনে

একি  মধুরমদির রসরাশি  আজি  শূন্যতলে চলে ভাসি,

     ঝরে চন্দ্রকরে একি হাসি,  ফুল-  গন্ধ লুটে গগনে

একি  প্রাণভরা অনুরাগে   আজি বিশ্বজগতজন জাগে,

আজি  নিখিল নীলগগনে  সুখ- পরশ কোথা হতে লাগে।

সুখে  শিহরে সকল বনরাজি,  উঠে  মোহনবাঁশরি বাজি,

   হেরো পূর্ণবিকশিত আজি মম অন্তর সুন্দর স্বপনে

                     ৪

আজ  তালের বনের করতালি  কিসের তালে

পূর্ণিমাচাঁদ মাঠের পারে    ওঠার কালে

        না-দেখা কোন্‌ বীণা বাজে   আকাশ-মাঝে,

        না-শোনা কোন্ রাগ রাগিণী   শূন্যে ঢালে

ওর    খুশির সাথে কোন্ খুশির আজ  মেলামেশা,

কোন্  বিশ্বমাতন গানের নেশায়   লাগল নেশা।

       তারায় কাঁপে রিনিঝিনি  যে কিঙ্কিণী

       তারি কাঁপন লাগল কি ওর  মুগ্ধ ভালে

                  ৫

আঁধার কুঁড়ির বাঁধন টুটে   চাঁদের ফুল উঠেছে  ফুটে

         তার  গন্ধ কোথায়, গন্ধ কোথায় রে।

         গন্ধ আমার গভীর ব্যথায় হৃদয়-মাঝে লুটে

ও কখন যাবে সরে, আকাশ হতে পড়বে ঝরে।

         ওরে  রাখব কোথায়, রাখব কোথায় রে।

         রাখব ওরে আমার ব্যথায় গানের পত্রপুটে

                 ৬

   পূর্ণচাঁদের মায়ায় আজি ভাবনা আমার পথ ভোলে,

যেন সিন্ধুপারের পাখি তারা, যায় যায় যায় চলে

   আলোছায়ার সুরে   অনেক কালের সে কোন্ দূরে

         ডাকে   আয়  আয় আয় ব’লে

   যেথায় চলে গেছে আমার হারা ফাল্গুনরাতি

   সেথায় তারা ফিরে ফিরে খোঁজে আপন সাথি।

আলোছায়ায় যেথা  অনেক দিনের সে কোন্ ব্যথা

         কাঁদে হায়  হায়  হায়  বলে

                 ৭

   কত যে তুমি মনোহর মনই তাহা জানে,

   হৃদয় মম থরোথরো কাঁপে তোমার গানে

আজিকে এই প্রভাতবেলা  মেঘের সাথে রোদের খেলা,

   জলে নয়ন ভরোভরো চাহি তোমার পানে

   আলোর অধীর ঝিলিমিলি নদীর ঢেউয়ে ওঠে,

   বনের হাসি খিলিখিলি পাতায় পাতায় ছোটে।

আকাশে ওই দেখি কী যে- তোমার চোখের চাহনি যে।

   সুনীল সুধা ঝরোঝরো ঝরে আমার প্রাণে  

                                                       ৮

আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণ,
তাহারি
 মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,
বিস্ময়ে
 তাই জাগে আমার গান॥
অসীম
 কালের যে হিল্লোলে  জোয়ার-ভাঁটায় ভুবন দোলে
নাড়ীতে
 মোর রক্তধারায় লেগেছে তার টান,
বিস্ময়ে
 তাই জাগে আমার গান॥
ঘাসে
 ঘাসে পা ফেলেছি বনের পথে যেতে,
ফুলের
 গন্ধে চমক লেগে উঠেছে মন মেতে,
ছড়িয়ে
 আছে আনন্দেরই দান,
বিস্ময়ে
 তাই জাগে আমার গান।
কান
 পেতেছি, চোখ মেলেছি,  ধরার বুকে প্রাণ ঢেলেছি,
জানার
 মাঝে অজানারে করেছি সন্ধান,
বিস্ময়ে
 তাই জাগে আমার 
গান॥

                     

ব্যাকুল বকুলের ফুলে ভ্রমর মরে পথ ভুলে

          আকাশে কী গোপন বাণী  বাতাসে করে কানাকানি,

                      বনের অঞ্চলখানি  পুলকে উঠে দুলে দুলে

বেদনা সুমধুর হয়ে ভুবনে আজি গেল বয়ে।

          বাঁশিতে মায়া-তান পূরি  কে আজি মন করে চুরি,

                      নিখিল তাই মরে ঘুরি  বিরহসাগরের কূলে

                   ১০

নাই রস নাই, দারুণ দাহনবেলা।  খেলো খেলো তব নীরব ভৈরব খেলা

          যদি   ঝ’রে পড়ে পড়ুক পাতা,  ম্লান হয়ে যাক মালা গাঁথা,

                      থাক্ জনহীন পথে পথে  মরীচিকাজাল ফেলা

শুষ্ক ধুলায় খসে-পড়া ফুলদলে  ঘূর্ণি-আঁচল উড়াও আকাশতলে।

          প্রাণ যদি কর মরুসম তবে তাই হোক-হে নির্মম,

                      তুমি একা আর আমি একা,  কঠোর মিলনমেলা

                ১১

দারুণ অগ্নিবাণে রে  হৃদয় তৃষায় হানে রে

          রজনী নিদ্রাহীন,  দীর্ঘ দগ্ধ দিন

                      আরাম নাহি যে জানে রে

          শুষ্ক কাননশাখে  ক্লান্ত কপোত ডাকে

                      করুণ কাতর গানে রে

ভয় নাহি, ভয় নাহি।  গগনে রয়েছি চাহি।

          জানি ঝঞ্ঝার বেশে দিবে দেখা তুমি এসে

                      একদা তাপিত প্রাণে রে

                ১২

এসো এসো হে তৃষ্ণার জল,  কলকল্ ছলছল্-

ভেদ করি কঠিনের ক্রুর বক্ষতল  কলকল্ ছলছল্।

          এসো এসো উৎসস্রোতে  গূঢ় অন্ধকার হতে

          এসো হে নির্মল কলকল্ ছলছল্

রবিকর রহে তব প্রতীক্ষায়।

তুমি যে খেলার সাথি, সে তোমারে চায়।

          তাহারি সোনার তান  তোমাতে জাগায় গান,

          এসো হে উজ্জ্বল, কলকল্ ছলছল্

হাঁকিছে অশান্ত বায়,

‘আয়, আয়, আয়।’ সে তোমায় খুঁজে যায়।

          তাহার মৃদঙ্গরবে  করতালি দিতে হবে,

          এসো হে চঞ্চল, কলকল্ ছল্‌ছল্

মরুদৈত্য কোন্ মায়াবলে

তোমারে করেছে বন্দী পাষাণশৃঙ্খলে।

          ভেঙে ফেলে দিয়ে কারা  এসো বন্ধহীন ধারা,

          এসো হে প্রবল, কলকল্ ছলছল্

             ১৩

হৃদয় আমার, ওই বুঝি তোর বৈশাখী ঝড় আসে।

বেড়া-ভাঙার মাতন নামে উদ্দাম উল্লাসে

তোমার মোহন এল ভীষণ বেশে, আকাশ ঢাকা জটিল কেশে-

          বুঝি এল তোমার সাধনধন চরম সর্বনাশে

বাতাসে তোর সুর ছিল না, ছিল তাপে ভরা।

পিপাসাতে বুক-ফাটা তোর শুষ্ক কঠিন ধরা।

এবার জাগ্ রে হতাশ, আয় রে ছুটে  অবসাদের বাঁধন টুটে-

          বুঝি এল তোমার পথের সাথি বিপুল অট্টহাসে

                 ১৪

          এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।

তাপসনিশ্বাসবায়ে  মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,

          বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক

যাক পুরাতন স্মৃতি,  যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,

          অশ্রুবাষ্প সুদরে মিলাক

          মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,

          অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।

রসের আবেশরাশি শুষ্ক করি দাও আসি,

          আনো আনো আনো তব প্রলয়ের শাঁখ।

          মায়ার কুজ্টিজাল যাক দূরে যাক

                ১৫

নমো নমো, হে বৈরাগী।

          তপোবহ্নির শিখা জ্বালো জ্বালো,

                      নিবার্ণহীন নির্মল আলো

                                  অন্তরে থাক্ জাগি

                ১৬

মধ্যদিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি,

হে রাখাল, বেণু তব বাজাও একাকী

প্রান্তরপ্রান্তের কোণে রুদ্র বসি তাই শোনে,

মধুরের-স্বপ্নাবেশে-ধ্যানমগন-আঁখি-

হে রাখাল, বেনু যবে বাজাও একাকী

সহসা উচ্ছ্বসি উঠে ভরিয়া আকাশ

তৃষাতপ্ত বিরহের নিরুদ্ধ নিশ্বাস।

অম্বরপ্রান্তে যে দূরে  ডম্বরু গম্ভীর সুরে

জাগায় বিদ্যুতছন্দে আসন্ন বৈশাখী-

হে রাখাল, বেনু যবে বাজাও একাকী

                ১৭

          ওই বুঝি কালবৈশাখী

          সন্ধ্যা-আকাশে দেয় ঢাকি

ভয় কী রে তোর ভয় কারে,  দ্বার খুলে দিস চার ধারে-

শোন্ দেখি ঘোর হুঙ্কারে  নাম তোরই ওই যায় ডাকি

          তোর সুরে আর তোর গানে

          দিস সাড়া তুই ওর পানে।

যা নড়ে তায় দিক নেড়ে,  যা যাবে তা যাক ছেড়ে,

যা ভাঙা তাই ভাঙবে রে- যা রবে তাই থাক বাকি

                 ১৮

প্রখর তপনতাপে  আকাশ তৃষায় কাঁপে,

          বায়ু করে হাহাকার।

দীর্ঘপথের শেষে  ডাকি মন্দিরে এসে,

          ‘খোলো খোলো খোলো দ্বার

বাহির হয়েছি কবে  কার আহ্বানরবে,

এখনি মলিন হবে  প্রভাতের ফুলহার

বুকে বাজে আশাহীনা  ক্ষীণমর্মর বীণা,

জানি না কে আছে কিনা,  সাড়া তো না পাই তার।

আজি সারা দিন ধ’রে প্রাণে সুর ওঠে ভরে,

একেলা কেমন ক’রে  বহিব গানের ভার

                 ১৯

বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া আসে মৃদুমন্দ।

আনে আমার মনের কোণে সেই চরণের ছন্দ

          স্বপ্নশেষের বাতায়নে হঠাৎ-আসা ক্ষণে ক্ষণে

          আধো-ঘুমের-প্রান্ত-ছোঁওয়া বকুলমালার গন্ধ

বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া বহে কিসের হর্ষ,

যেন রে সেই উড়ে-পড়া এলো কেশের স্পর্শ।

          চাঁপাবনের কাঁপন-ছলে লাগে আমার বুকের তলে

          আরেক দিনের প্রভাত হতে হৃদয়দোলার স্পন্দ

               ২০

বৈশাখ হে, মৌনী তাপস, কোন্ অতলের বাণী

          এমন  কোথায় খুঁজে পেলে।

তপ্ত ভালের দীপ্তি ঢাকি মন্থর মেঘখানি

          এল গভীর ছায়া ফেলে

                      রুদ্রতপের সিদ্ধি এ কি ওই-যে তোমার বক্ষে দেখি,

                                  ওরই লাগি আসন পাতো হোমহুতাশন জ্বেলে

নিঠুর, তুমি তাকিয়েছিলে মৃত্যুক্ষুধার মতো

          তোমার রক্তনয়ন মেলে।

ভীষণ, তোমার প্রলয়সাধন প্রাণের বাঁধন যত

          যেন  হানবে অবহেলে।

                      হঠাৎ তোমার কণ্ঠে এ যে আশার ভাষা উঠল বেজে,

                                  দিলে তরুণ শ্যামল রূপে করুণ সুধা ঢেলে।

                      ২১

          শুষ্কতাপের দৈত্যপুরে দ্বার ভাঙবে ব’লে,

          রাজপুত্র, কোথা হতে হঠাৎ এলে চলে

সাত সমুদ্র-পারের থেকে   বজ্রস্বরে এলে হেঁকে,

          দুন্দুভি যে উঠল বেজে বিষম কলরোলে

          বীরের পদপরশ পেয়ে মূর্ছা হতে জাগে

          বসুন্ধরার তপ্ত প্রাণে বিপুল পুলক লাগে।

মরকতমণির থালা   সাজিয়ে গাঁথে বরণমালা,

          উতলা তার হিয়া আজি সজল হাওয়ায় দোলে

                ২২

হে তাপস, তব শুষ্ক কঠোর রূপের গভীর রসে

মন আজি মোর উদাস বিভোর কোন্ সে ভাবের বশে

          তব পিঙ্গল জটা  হানিছে দীপ্ত ছটা,

          তব দৃষ্টির বহ্নিবৃষ্টি অন্তরে গিয়ে পশে

                      বুঝি না, কিছু না জানি

          মর্মে আমার মৌন তোমার কী বলে রুদ্রবাণী।

দিগ্‌দিগন্ত দহি  দুঃসহ তাপ বহি

তব নিশ্বাস আমার বক্ষে রহি রহি নিশ্বসে

                      সারা হয়ে এলে দিন

সন্ধ্যামেঘের মায়ার মহিমা নিঃশেষে হবে লীন।

দীপ্তি তোমার তবে শান্ত হইয়া রবে,

তারায় তারায় নীরব মন্ত্রে ভরি দিবে শূন্য সে

                ২৩

          মধ্যদিনের বিজন বাতায়নে

ক্লান্তি-ভরা কোন্ বেদনার মায়া  স্বপ্নাভাসে ভাসে মনে-মনে

কৈশোরে যে সলাজ কানাকানি  খুঁজেছিল প্রথম প্রেমের বাণী

আজ কেন তাই তপ্ত হাওয়ায় হাওয়ায়  মর্মরিছে গহন বনে বনে

যে নৈরাশা গভীর অশ্রুজলে ডুবেছিল বিস্মরণের তলে

আজ কেন সেই বনযূথীর বাসে  উচ্ছ্বসিল মধুর নিশ্বাসে,

সারাবেলা চাঁপার ছায়ায় ছায়ায়  গুঞ্জরিয়া ওঠে ক্ষণে ক্ষণে

                 ২৪

তপস্বিনী হে ধরণী,  ওই-যে তাপের বেলা আসে-

তপের আসনখানি  প্রসারিল মৌন নীলাকাশে

          অন্তরে প্রাণের লীলা হোক তবে অন্তঃশীলা,

          যৌবনের পরিসর শীর্ণ হোক হোমাগ্নিনিশ্বাসে

যে তব বিচিত্র তান  উচ্ছ্বসি উঠিত বহু গীতে

এক হয়ে মিশে যাক  মৌনমন্ত্রে ধ্যানের শান্তিতে।

          সংযমে বাঁধুক লতা  কুসুমিত চঞ্চলতা,

          সাজুক লাবণ্যলক্ষ্মী  দৈন্যের ধূসর ধূলিবাসে

                    ২৫

          চক্ষে আমার তৃষ্ণা ওগো, তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে।

আমি    বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন, সন্তাপে প্রাণ যায় যে পুড়ে

ঝড় উঠেছে তপ্ত হাওয়ায়,  মনকে সুদূর শূন্যে ধাওয়ায়-

                      অবগুণ্ঠন যায় যে উড়ে

                      যে ফুল কানন করত আলো

                      কালো হয়ে সে শুকালো।

ঝরনারে কে দিল বাধা-  নিষ্ঠুর পাষাণে বাঁধা

                      দুঃখের শিখরচূড়ে

                      ২৬

          এসো শ্যামল সুন্দর,

আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা।

বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে

সে যে ব্যথিত হৃদয় আছে বিছায়ে

          তমালকুঞ্জপথে সজল ছায়াতে,

          নয়নে জাগিছে করুণ রাগিণী

বকুলমুকুল রেখেছে গাঁথিয়া,

বাজিছে অঙ্গনে মিলনবাঁশরি।

          আনো সাথে তোমার মন্দিরা

          চঞ্চল নৃত্যের বাজিবে ছন্দে সে-

          বাজিবে কঙ্কণ, বাজিবে কিঙ্কিণী,

          ঝঙ্কারিবে মঞ্জীর রুণু রুণু

                   ২৭

ওই আসে ওই   অতি ভৈরব হরষে

জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরভসে

ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা

শ্যামগম্ভীর সরসা।

গুরু গর্জনে নীল অরণ্য শিহরে,

উতলা কলাপী কেকাকলরবে বিহরে-

নিখিলচিত্তহরষা

ঘনগৌরবে আসিছে মত্ত বরষা

 

কোথা তোরা অয়ি তরুণী পথিকললনা,

জনপদবধূ তড়িতচকিতনয়না,

মালতীমালিনী কোথা প্রিয়পরিচারিকা,

কোথা তোরা অভিসারিকা।

ঘনবনতলে এসো ঘননীলবসনা,

ললিত নৃত্যে বাজুক স্বর্ণ রসনা,

আনো বীণা মনোহারিকা।

 

কোথা বিরহিণী, কোথা তোর অভিসারিকা

আনো মৃদঙ্গ মুরজ মুরলী মধুর,

বাজাও শঙ্খ, হুলুরব করো বধূরা-

এসেছে বরষা, ওগো নব-অনুরাগিণী,

ওগো প্রিয়সুখভাগিনী।

কুঞ্জকুটিরে অয়ি ভাবাকুললোচনা,

ভূর্জপাতায় নবগীত করো রচনা

মেঘমল্লাররাগিণী।

এসেছে বরষা, ওগো নব-অনুরাগিণী

 

কেতকীকেশরে কেশপাশ করো সুরভি,

ক্ষীণ কটিতটে গাঁথি লয়ে পরো করবী,

অঞ্জন আঁকো নয়নে।

তালে তালে দুটি কঙ্কণ কনকনিয়া

ভবনশিখরে নাচাও গণিয়া গণিয়া

স্মিতবিকশিত বয়নে-

কদম্বরেণু বিছাইয়া ফুলশয়নে

 

এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,

গগন ভরিয়া এসেছে ভুবনভরসা

দুলিছে পবনে সনসন বনবীথিকা,

গীতময় তরুলতিকা।

শতেক যুগের কবিদলে মিলি আকাশে

ধ্বনিয়া তুলিছে মত্তমদির বাতাসে

শতেক যুগের গীতিকা।

শতশতগীতমুখরিত বনবীথিকা

                ২৮

ঝরঝর বরিষে বারিধারা।

হায় পথবাসী, হায় গতিহীন, হায় গৃহহারা

ফিরে বায়ু হাহাস্বরে,  ডাকে কারে জনহীন অসীম প্রান্তরে-

রজনী আঁধারা

অধীরা যমুনা তরঙ্গ-আকুলা অকূলা রে,  তিমিরদুকূলা রে।

নিবিড় নীরদ গগনে  গরগর গরজে সঘনে,

চঞ্চলচপলা চমকে-নাহি শশীতারা

                ২৯

গহন ঘন ছাইল গগন ঘনাইয়া।

স্তিমিত দশ দিশি, স্তম্ভিত কানন,

সব চরাচর আকুল- কী হবে কে জানে

ঘোরা রজনী, দিকললনা ভয়বিভলা

চমকে চমকে সহসা দিক উজলি

চকিতে চকিতে মাতি ছুটিল বিজলি

থরথর চরাচর  পলকে ঝলকিয়া

ঘোর তিমিরে ছায় গগন মেদিনী

গুরুগুরু নীরদগরজনে স্তব্ধ আঁধার ঘুমাইছে,

সহসা উঠিল জেগে প্রচণ্ড সমীরণ- কড়কড় বাজ

                           ৩০

          হেরিয়া শ্যামল ঘন নীল গগনে

সেই  সজল কাজল আঁখি পড়িল মনে

          অধর করুণা-মাখা,  মিনতিবেদনা আঁকা

          নীরবে চাহিয়া থাকা বিদায়খনে

          ঝরঝর ঝরে জল, বিজুলি হানে,

          পবন মাতিছে বনে পাগল গানে,

          মার পরানপুটে  কোন্‌খানে ব্যথা ফুটে,

          কার কথা জেগে উঠে হৃদয়কোণে

 

৩১

শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীথযামিনী রে।

কুঞ্জপথে, সখি, কৈস যাওব অবলা কামিনী রে।

উন্মদ পবনে যমুনা তর্জিত, ঘন ঘন গর্জিত মেহ।

দমকত বিদ্যুত, পথতরু লুণ্ঠত, থরথর কম্পিত দেহ।

ঘন ঘন রিম্‌ঝিম‌্ রিম্‌ঝিম্ রিম্‌ঝিম্ বরখত নীরদপুঞ্জ।

শাল-পিয়ালে তাল-তমালে নিবিড়তিমিরময় কুঞ্জ।

কহ রে সজনী, এ দুরুযোগে কুঞ্জে নিরদয় কান

দারুণ বাঁশি কাহ বজায়ত সকরুণ রাধা নাম।

মোতিম হারে বেশ বনা দে, সীঁথি লগা দে ভালে।

উরহি বিলুণ্ঠিত শিথিল চিকুর মম বাঁধহ চম্পকমাল।

গহন রয়নমে ন যাও, বালা, নওলকিশোরক পাশ।

গরজে ঘন ঘন, বহু ডর পাওব, কহে ভানু তব দাস

                ৩২

মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে।

আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে

          কাজের দিনে নানা কাজে থাকি নানা লোকের মাঝে,

          আজ আমি যে বসে আছি তোমারি আশ্বাসে

তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,

কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা।

          দূরের পানে মেলে আঁখি  কেবল আমি চেয়ে থাকি,

          পরান আমার কেঁদে বেড়ায় দুরন্ত বাতাসে

                   ৩৩

আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, গেল রে দিন বয়ে।

বাঁধন-হারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে

          একলা বসে ঘরের কোণে  কী ভাবি  যে আপন-মনে,

          সজল হাওয়া যূথীর বনে  কী কথা যায় কয়ে

হৃদয়ে আজ ঢেউ দিয়েছে, খুঁজে না পাই কূল-

সৌরভে প্রাণ কাঁদিয়ে তোলে ভিজে বনের ফুল।

          আঁধার রাতে প্রহরগুলি  কোন সুরে আজ ভরিয়ে তুলি,

          কোন্ ভুলে আজ সকল ভুলি আছি আকুল হয়ে

 

                   ৩৪

আজ  বারি ঝরে ঝরঝর ভরা বাদরে,

আকাশ-ভাঙা আকুল ধারা কোথাও না ধরে

          শালের বনে থেকে থেকে ঝড় দোলা দেয় হেঁকে হেঁকে,

          জল ছুটে যায় একে বেঁকে মাঠের ‘পরে।

আজ  মেঘের জটা উড়িয়ে দিয়ে নৃত্য কে করে

ওরে  বৃষ্টিতে মোর ছুটেছে মন, লুটেছে এই ঝড়ে-

      বুক ছাপিয়ে তরঙ্গ মো কাহার পায়ে পড়ে।

অন্তরে আজ কী কলরোল, দ্বারে দ্বারে ভাঙল আগল-

হৃদয়-মাঝে জাগল পাগল আজি ভাদরে

আজ  এমন ক’রে কে মেতেছে বাহিরে ঘরে

                 ৩৫

          কাঁপিছে দেহলতা থরথর,

          চোখের জলে আঁখি ভরভর

দোদুল তমালেরই বনছায়া তোমারি নীল বাসে নিল কায়া,

          বাদল-নিশীথেরই ঝরঝর

          তোমারি আঁখি-’পরে ভরভর

          যে কথা ছিল তব মনে মনে

          চমকে অধরের কোণে কোণে।

নীরব হিয়া তব দিল ভরি  কী মায়া স্বপনে যে, মরি মরি,

          আঁধার কাননের মরমর

          বাদল-নিশীথের ঝরঝর

                ৩৬

আমার   দিন ফুরালো ব্যাকুল বাদলসাঁঝে

              গহন মেঘের নিবিড় ধারার মাঝে

          বনের ছায়ায় জলছলছল সুরে

          হৃদয় আমার কানায় কানায় পূরে।

          খনে খনে ওই গুরুগুরু তালে তালে

             গগনে গগনে গভীর মৃদঙ বাজে

কোন্‌     দূরের মানুষ যেন এল আজ কাছে,

             তিমির-আড়ালে নীরবে দাঁড়ায়ে আছে।

          বুকে দোলে তার বিরহব্যথার মালা

          গোপন-মিলন-অমৃতগন্ধ-ঢালা।

          মনে হয় তার চরণের ধ্বনি জানি-

             হার মানি তার অজানা জনের সাজে

                 ৩৭

বাদল-মেঘে মাদল বাজে     গুরুগুরু গগন-মাঝে

          তারি গভীর রোলে   আমার হৃদয় দোলে,

                      আপন সুরে আপনি ভোলে

কোথায় ছিল গহন প্রাণে      গোপন ব্যথা গোপন গানে-

          আজি সজল বায়ে   শ্যামল বনের ছায়ে

                      ছড়িয়ে গেল সকলখানে গানে গানে

                  ৩৮

ওগো  আমার শ্রাবণমেঘের খেয়াতরীর মাঝি,

অশ্রুভরা পুরব হাওয়ায় পাল তুলে দাও আজি

    উদাস হৃদয় তাকায়ে রয়, বোঝা তাহার নয় ভারী নয়,

    পুলক-লাগা এই কদম্বের একটি কেবল সাজি

ভোরবেলা যে খেলার সাথি ছিল আমার কাছে,

মনে ভাবি, তার ঠিকানা তোমার জানা আছে।

    তাই তোমারি সারিগানে  সেই আঁখি তার মনে আনে,

    আকাশ-ভরা বেদনাতে রোদন উঠে বাজি

                  ৩৯

তিমির-অবগুণ্ঠনে বদন তব ঢাকি

কে তুমি মম অঙ্গনে দাঁড়ালে একাকী

          আজি সঘন শর্বরী, মেঘমগন তারা,

           নদীর জলে ঝর্ঝরি ঝরিছে জলধারা,

                তমালবন মর্মরি পবন চলে হাঁকি

যে কথা মম অন্তরে আনিছ তুমি টানি

জানি না কোন্ মন্তরে তাহারে দিব বাণী।

          রয়েছি বাঁধা বন্ধনে, ছিঁড়িব, যাব বাটে-

          যেন এ বৃথা ক্রন্দনে এ নিশি নাহি কাটে।

                      কঠিন বাধা-লঙ্ঘনে দিব না আমি ফাঁকি

                   ৪০

আকাশতলে দলে দলে মেঘ যে ডেকে যায়

          ‘আয় আয় আয় আয়’   

জামের বনে আমের বনে রব উঠেছে তাই-

          ‘যাই যাই যাই’।

উড়ে যাওয়ার সাধ জাগে তার পুলক-ভরা ডালে

          পাতায় পাতায়

নদীর ধারে বারে বারে মেঘ যে ডেকে যায়-

          ‘আয় আয় আয়’

কাশের বনে ক্ষণে ক্ষণে রব উঠেছে তাই-

          ‘যাই যাই যাই’।

মেঘের গানে তরীগুলি তান মিলিয়ে চলে

          পাল-তোলা পাখায়

                ৪১

কদম্বেরই কানন ঘেরি আষাঢ়মেঘের ছায়া খেলে,

পিয়ালগুলি নাটের ঠাটে হাওয়ায় হেলে

          বরষনের পরশনে  শিহর লাগে বনে বনে,

          বিরহী এই মন যে আমার সুদূর-পানে পাখা মেলে

আকাশপথে বলাকা ধায় কোন্ সে অকারণের বেগে,

পুব হাওয়াতে ঢেউ খেলে যায় ডানার গানের তুফান লেগে।

          ঝিল্লিমুখর বাদল-সাঁঝে  কে দেখা দেয় হৃদয়-মাঝে,

          স্বপনরূপে চুপে চুপে ব্যথায় আমার চরণ ফেলে

                  ৪২

আষাঢ়, কোথা হতে আজ পেলি ছাড়া।

মাঠের শেষে শ্যামল বেশে ক্ষণেক দাঁড়া

          জয়ধ্বজা ওই-যে তোমার গগন জুড়ে।

          পুব হতে কোন্‌ পশ্চিমেতে যায় যে উড়ে,

                      গুরু গুরু ভেরী কারে দেয় যে সাড়া

নাচের নেশা লাগল তালের পাতায় পাতায়,

হাওয়ার দোলায় দোলায় শালের বনকে মাতায়।

          আকাশ হতে আকাশে কার ছুটোছুটি,

          বনে বনে মেঘের ছায়ায় লুটোপুটি-

                      ভরা নদীর ঢেউয়ে ঢেউয়ে কে দেয় নাড়া

                   ৪৩

ছায়া ঘনাইছে বনে বনে,      গগনে গগনে ডাকে দেয়া।

কবে নবঘন-বরিষনে          গোপনে গোপনে এলি কেয়া

          পুরবে নীরব ইশারাতে          একদা নিদ্রাহীন রাতে

                      হাওয়াতে কী পথে দিলি খেয়া-

                                  আষাঢ়ের খেয়ালের কোন্ খেয়া

যে মধু হৃদয়ে ছিল মাখা      কাঁটাতে কী ভয়ে দিলি ঢাকা।

   বুঝি এলি যার অভিসারে   মনে মনে দেখা হল তারে,

                      আড়ালে আড়ালে দেয়া-নেয়া-

                                  আপনায় লুকায়ে দেয়া-নেয়া

                     ৪৪

   এই শ্রাবণ-বেলা বাদল-ঝরা           যূথীবনের গন্ধে ভরা

   কোন্  ভোলা দিনের বিরহিণী,   যেন তারে চিনি চিনি-

ঘন বনের কোণে কোণে ফেরে ছায়ার-ঘোমটা-পরা

কেন বিজন বাটের পানে  তাকিয়ে আছি কে তা জানে।

          হঠাৎ কখন অজানা সে   আসবে আমার দ্বারের পাশে,

বাদল-সাঁঝের আঁধার-মাঝে গান গাবে প্রাণ-পাগল-করা

                  ৪৫

শ্রাবণবরিষন পার হয়ে   কী বাণী আসে ওই রয়ে রয়ে

          গোপন কেতকীর পরিমলে,   সিক্ত বকুলের বনতলে,

          দূরের আঁখিজল বয়ে বয়ে কী বাণী আসে ওই রয়ে রয়ে

কবির হিয়াতলে ঘুরে ঘুরে  আঁচল ভরে লয় সুরে সুরে।

          বিজনে বিরহীর কানে কানে  সজল মল্লার-গানে-গানে

                      কাহার নামখানি কয়ে কয়ে

                                  কী বাণী আসে ওই রয়ে রয়ে

                   ৪৬

আজ কিছুতেই যায় না মনের ভার,

দিনের আকাশ মেঘে অন্ধকার- হায় রে

          মনে ছিল আসবে বুঝি,   আমায় সে কি পায় নি খুঁজি-

          না-বলা তার কথাখানি জাগায় হাহাকার

সজল হাওয়ায় বারে বারে

সারা আকাশ ডাকে তারে।

          বাদল-দিনের দীর্ঘশ্বাসে   জানায় আমায় ফিরবে না সে-

          বুক ভরে সে নিয়ে গেল বিফল অভিসার

                 ৪৭

গহন রাতে শ্রাবণধারা পড়িছে ঝরে,

          কেন গো মিছে জাগাবে ওরে

এখনো দুটি আঁখির  কোণে যায় যে দেখা

          জলের রেখা,

          না-বলা বাণী রয়েছে যেন অধর ভরে

নাহয় যেয়ো গুঞ্জরিয়া বীণার তারে

          মনের কথা শয়নদ্বারে।

নাহয় রেখো মালতীকলি শিথিল কেশে

          নীরবে এসে,

নাহয় রাখী পরায়ে যেয়ো ফুলের ডোরে।

          কেন  গো মিছে জাগাবে ওরে

                    ৪৮

          যেতে দাও  যেতে দাও গেল যারা।

                      তুমি যেয়ো না, তুমি যেয়ো না,

          আমার  বাদলের গান হয় নি সারা

কুটিরে কুটিরে বন্ধ দ্বার, নিভৃত রজনী অন্ধকার,

          বনের অঞ্চল কাঁপে চঞ্চল- অধীর সমীর তন্দ্রাহারা

দীপ নিবেছে নিবুক নাকো,   আঁধারে তব পরশ রাখো।

বাজুক কাঁকন তোমার হাতে   আমার গানের তালের সাথে,

          যেমন    নদীর ছলোছলো জলে ঝরে ঝরোঝরো শ্রাবণধারা

                  ৪৯

          ভেবেছিলেম আসবে ফিরে,

তাই     ফাল্গুনশেষে দিলেম বিদায়।

তুমি     গেলে ভাসি নয়ননীরে

এখন    শ্রাবণদিনে মরি দ্বিধায়

এখন    বাদল-সাঁঝের অন্ধকারে  আপনি কাঁদাই আপনারে,

একা     ঝরো ঝরো বারিধারে  ভাবি কী ডাকে ফিরাব তোমায়

          যখন থাক আঁখির কাছে

          তখন দেখি ভিতর বাহির সব ভরে আছে।

সেই     ভরা দিনের ভরসাতে  চাই বিরহের ভয় ঘোচাতে,

তবু      তোমা-হারা বিজন রাতে

কেবল   হারাই-হারাই বাজে হিয়ায়

                ৫০

আজি ওই     আকাশ-’পরে সুধায় ভরে আষাঢ়-মেঘের ফাঁক।

              হৃদয়-মাঝে মধুর বাজে কী উৎসবের শাঁখ

একি       হাসির বাঁশির তান, একি চোখের জলের গান-

             পাই নে দিশে কে জানি সে দিল আমায় ডাক

আমার     নিরুদ্দেশের পানে  কেমন করে টানে  এমন করুণ গানে।

          ওই পথের পারের আলো  আমার  লাগল চোখে ভালো,

                      গগনপারে দেখি তারে সুদূর নির্বাক্

                  ৫১

ও        আষাঢ়ের পূর্ণিমা আমার,        আজি রইলে আড়ালে-

                      স্বপনের আবরণে লুকিয়ে দাঁড়ালে

আপনারই মনে জানি না একেলা হৃদয়-আঙিনায় করিছ কী খেলা-

তুমি আপনায় খুঁজিয়া ফেরো কি তুমি আপনায় হারালে

          একি  মনে রাখা  একি  ভুলে যাওয়া।

          একি   স্রোতে ভাসা,  একি  কূলে যাওয়া

কভুবা নয়নে কভুবা পরানে  কর লুকোচুরি কেন যে কে জানে।

কভুবা ছায়ায় কভুবা আলোয়  কোন্  দোলায় যে নাড়ালে

                ৫২

          শ্যামল ছায়া, নাইবা গেলে

          শেষ বরষার ধারা ঢেলে

সময় যদি ফুরিয়ে থাকে-  হেসে বিদায় করো তাকে,

এবার নাহয় কাটুক বেলা অসময়ের খেলা খেলে

          মলিন, তোমার মিলাবে লাজ-

          শরৎ এসে            পরাবে সাজ।

নবীন রবি উঠবে হাসি,  বাজাবে মেঘ সোনার বাঁশি-

কালোয় আলোয় যুগলরূপে শূন্যে দেবে মিলন মেলে

                ৫৩

          আহ্বান আসিল মহোৎসবে

          অম্বরে গম্ভীর ভেরিরবে

পূর্ববায়ু চলে ডেকে  শ্যামলের অভিষেকে-

          অরণ্যে অরণ্যে নৃত্য হবে

          নির্ঝরকল্লোল-কলকলে

          ধরণীর আনন্দ উচ্ছলে।

শ্রাবণের বীণাপাণি মিলালো বর্ষণবাণী

          কদম্বের পল্লবে পল্লবে

               ৫৪

          কোন্ পুরাতন প্রাণের টানে

          ছুটেছে মন মাটির পানে

চোখ ডুবে যায় নবীন ঘাসে,  ভাবনা ভাসে পুব-বাতাসে-

মল্লারগান প্লাবন জাগায় মনের মধ্যে শ্রাবণ-গানে

          লাগল যে দোল বনের মাঝে

          অঙ্গে সে মোর দেয় দোলা যে।

যে বাণী ওই ধানের ক্ষেতে  আকুল হল অঙ্কুরেতে

          আজ এই মেঘের শ্যামল মায়ায়

                      সেই বাণী মোর সুরে আনে

                  ৫৫

নীল-    অঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায় সম্বৃত অম্বর  হে গম্ভীর!

          বনলক্ষ্মীর কম্পিত কায়, চঞ্চল অন্তর-

          ঝঙ্কৃত তার ঝিল্লির মঞ্জীর  হে গম্ভীর

          বর্ষণগীত হল মুখরিত মেঘমন্দ্রিত ছন্দে,

          কদম্ববন গভীর মগন আনন্দঘন গন্ধে-

          নন্দিত তব উৎসবমন্দির হে গম্ভীর

          দহনশয়নে তপ্ত ধরণী পড়েছিল পিপাসার্তা,

          পাঠালে তাহারে ইন্দ্রলোকের অমৃতবারির বার্তা।

          মাটির কঠিন বাধা হল ক্ষীণ, দিকে দিকে হল দীর্ণ-

          নব-অঙ্কুর-জয়পতাকায় ধরাতল সমাকীর্ণ-

          ছিন্ন হয়েছে বন্ধন বন্দীর  হে গম্ভীর

                   ৫৬

          আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে

          দুয়ার কাঁপে ক্ষণে ক্ষণে,

          ঘরের বাঁধন যায় বুঝি আজ টুটে

ধরিত্রী তাঁর অঙ্গনেতে    নাচের তালে ওঠেন মেতে,

          চঞ্চল তাঁর অঞ্চল যায় লুটে

          প্রথম যুগের বচন শুনি মনে

          নবশ্যামল প্রাণের নিকেতনে।

পুব-হাওয়া ধায় আকাশতলে,  তার সাথে মোর ভাবনা চলে

          কালহারা কোন্ কালের পানে ছুটে

                           ৫৭

          পথিক মেঘের দল জোটে ওই  শ্রাবণগগন-অঙ্গনে।

শোন্     শোন্ রে, মন রে আমার,        উধাও হয়ে নিরুদ্দেশের সঙ্গ নে

          দিক্-হারানো দুঃসাহসে         সকল বাঁধন পড়ুক খসে,

          কিসের বাধা ঘরের কোণের শাসনসীমা-লঙ্ঘনে

                      বেদনা তোর বিজুলশিখা জ্বলুক অন্তরে।

                      সর্বনাশের করিস সাধন বজ্রমন্তরে।

          অজানাতে করবি গাহন, ঝড় সে পথের হবে বাহন-

          শেষ করে দিস আপনারে তুই প্রলয় রাতের ক্রন্দনে

                    ৫৮

বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা, আষাঢ় তোমার মালা।

তোমার শ্যামল শোভার বুকে বিদ্যুতেরই জ্বালা

তোমার মন্ত্রবলে পাষাণ গলে, ফসল ফলে-

মরু বহে আনে তোমার পায়ে ফুলের ডালা

মরোমরো পাতায় পাতায় ঝরোঝরো বারির রবে

গুরুগুরু মেঘের মাদল বাজে তোমার কী উৎসবে।

সবুজ সুধার ধারায় প্রাণ এনে দাও তপ্ত ধরায়,

বামে রাখ ভয়ঙ্করী বন্যা মরণ-ঢালা

                ৫৯

ওরে     ঝড় নেমে আয়, আয় রে আমার শুকনো পাতার ডালে

          এই বরষায় নবশ্যামের আগমনের কালে

          যা উদাসীন, যা প্রাণহীন, যা আনন্দহারা,

          চরম রাতের অশ্রুধারায় আজ হয়ে যাক সারা-

          যাবার যাহা যাক সে চলে রুদ্র নাচের তালে

          আসন আমায় পাততে হবে রিক্ত প্রাণের ঘরে,

          নবীন বসন পরতে হবে সিক্ত বুকের ’পরে

          নদীর জলে বান ডেকেছে, কূল গেল তার ভেসে,

          যূথীবনের গন্ধবাণী ছুটল নিরুদ্দেশে-

          পরান আমার জাগল বুঝি মরণ-অন্তরালে

                  ৬০

এই শ্রবণের বুকের ভিতর আগুন আছে।

সেই আগুনের কালোরূপ যে আমার চোখের ’পরে নাচে

ও তার শিখার জটা ছড়িয়ে পড়ে দিক হতে ওই দিগন্তরে,

তার কালো আভার কাঁপন দেখো তালবনের ওই গাছে গাছে

বাদল-হাওয়া পাগল হল সেই আগুনের হুহুঙ্কারে।

দুন্দুভি তার বাজিয়ে বেড়ায় মাঠ হতে কোন্ মাঠের পারে।

ওরে, সেই আগুনের পুলক ফুটে  কদম্ববন রঙিয়ে উঠে,

সেই আগুনের বেগ লাগে আজ আমার গানের পাখার পাছে

                    ৬১

   মেঘের           কোলে কোলে যায় রে চলে বকের পাঁতি।

ওরা      ঘর-ছাড়া মোর মনের কথা যায় বুঝি ওই গাঁথি গাঁথি

          সুদূরের   বীণার স্বরে কে ওদের হৃদয় হরে

          দুরাশার   দুঃসাহসে উদাস করে-

সে কোন্  উধাও হাওয়ার পাগলামিতে পাখা ওদের ওঠে মাতি

ওদের  ঘুম ছুটেছে, ভয় টুটেছে একেবারে,       

অলক্ষ্যেতে লক্ষ ওদের-পিছন-পানে তাকায় না রে।

          যে বাসা  ছিল জানা  সে ওদের  দিল  হানা,

          না-জানার   পথে ওদের নাই রে মানা-

ওরা      দিনের শেষে দেখেছে কোন্ মনোহরণ আঁধার রাতি

                   ৬২

উতল-ধারা বাদল ঝরে।      সকল বেলা একা ঘরে

          সজল হাওয়া বহে বেগে,       পাগল নদী ওঠে জেগে,

          আকাশ ঘেরে কাজল মেঘে,    তমালবনে আঁধার করে

ওগো বঁধু দিনেরশেষে         এলে তুমি কেমন বেশে-

আঁচল দিয়ে শুকাব জল,       মু্ছাব পা আকুল কেশে।

          নিবিড় হবে তিমির-রাতি,       জ্বেলে দেব প্রেমের বাতি,

          পরানখানি দেব পাতি-          চরণ রেখো তাহার ’পরে

ভুলে গিয়ে জীবন মরণ       লব তোমায় ক’রে বরণ-

করিব জয় শরম-ত্রাসে,       দাঁড়াব আজ তোমার পাশে-

          বাঁধন বাধা যাবে জ্ব’লে,         সুখ দুঃখ দেব দ’লে,

          ঝড়ের রাতে তোমার সাথে     বাহির হব অভয়ভরে

উতল-ধারা বাদল ঝরে,      দুয়ার খুলে এলে ঘরে।

          চোখে আমার ঝলক লাগে,     সকল মনে পুলক জাগে,

          চাহিতে চাই মুখের বাগে-      নয়ন মেলে কাঁপি ডরে

                             ৬৩

                      ওই-যে ঝড়ের মেঘের কোলে

          বৃষ্টি আসে মুক্তকেশে আঁচলখানি দোলে

ওরই গানের তালে তালে     আমে জামে শিরীষ শালে

          নাচন লাগে পাতায় পাতায় আকুল কল্লোলে

                      আমার     দুই আঁখি ওই সুরে

          যায় হারিয়ে সজল ধারায়  ওই ছায়াময় দূরে।

ভিজে হাওয়ায় থেকে থেকে  কোন্ সাথি মোর যায় যে ডেকে,

          একলা দিনের বুকের ভিতর ব্যথার তুফান তোলে

                      ৬৪

          কখন      বাদল-ছোঁওয়া লেগে

          মাঠে মাঠে ঢাকে মাটি সবুজ মেঘে মেঘে

          ওই        ঘাসের ঘনঘোরে

ধরণীতল হল শীতল চিকন আভায় ভ’রে-

ওরা      হঠাৎ-গাওয়া গানের মতো এল প্রাণের বেগে

ওরা যে এই প্রাণের রণে মরুজয়ের সেনা,

ওদের সাথে আমার প্রাণের প্রথম যুগের চেনা-

          তাই       এমন গভীর স্বরে

          আমার আঁখি নিল ডাকি ওদের খেলাঘরে-

ওদের   দোল দেখে আজ প্রাণে আমার দোলা ওঠে জেগে

                   ৬৫

আজ     নবীন মেঘের সুর লেগেছে আমার মনে।

আমার   ভাবনা যত উতল হল অকারণে

কেমন ক’রে যায় যে ডেকে,  বাহির করে ঘরের থেকে,

          ছায়াতে চোখ ফেলে ছেয়ে ক্ষণে ক্ষণে

          বাঁধনহারা জলধারার কলরোলে

          আমারে কোন্ পথের বাণী যায় যে ব’লে।

সে পথ গেছে নিরুদ্দেশে      মানসলোকে গানের শেষে

          চিরদিনের বিরামহীন কুঞ্জবনে

                      ৬৬

          আজ আকাশের মনের কথা ঝরো ঝরো বাজে

            সারা প্রহর আমার বুকের মাঝে

দিঘির কালো জলের ’পরে   মেঘের ছায়া ঘনিয়ে ধরে,

          বাতাস বহে যুগান্তরের প্রাচীন বেদনা যে

            সারা প্রহর আমার বুকের মাঝে

                      আঁধার বাতায়নে

একলা আমার কানাকানি ওই আকাশের সনে।

ম্লানস্মৃতির বাণী যত   পল্লবমর্মরের মতো

          সজল সুরে ওঠে জেগে ঝিল্লিমুখর সাঁঝে

             সারা প্রহর আমার বুকের মাঝে

                     ৬৭

          এই        সকাল বেলার বাদল-আঁধারে

          আজি      বনের বীণায় কী সুর বাঁধা রে

ঝরো ঝরো বৃষ্টিকলরোলে    তালের পাতা মুখর ক’রে তোলে রে,

          উতল হাওয়া বেণুশাখায় লাগায় ধাঁদা রে

          ছায়ার   তলে তলে জলের ধারা ওই

          হেরো  দলে দলে নাচে তাথৈ থৈ- তাথৈ থৈ

মন যে আমার পথ-হারানো সুরে সকল আকাশ বেড়ায় ঘুরে ঘুরে রে,

          শোনে যেন কোন্ ব্যাকুলের করুণ কাঁদা রে

                      ৬৮

পুব-সাগরের পার হতে কোন্ এল পরবাসী-

শূন্যে বাজায় ঘন ঘন হাওয়ায় হাওয়ায় সন সন

          সাপ খেলাবার বাঁশি

সহসা তাই কোথা হতে কুলু কুলু কলস্রোতে

দিকে দিকে জলের ধারা ছুটেছে উল্লাসী

আজ দিগন্তে ঘন ঘন গভীর গুরু গুরু   ডমরুরব হয়েছে ওই শুরু।

          তাই শুনে আজ গগনতলে  পলে পলে দলে দলে

                      অগ্নিবরন নাগ নাগিনী ছুটেছে উদাসী

                    ৬৯

          আজি  বর্ষারাতের শেষে

সজল মেঘের কোমল কালোয় অরুণ আলো মেশে

বেণুবনের মাথায় মাথায়   রঙ লেগেছে পাতায় পাতায়,

রঙের ধারায় হৃদয় হারায়,   কোথা যে যায় ভেসে

          এই  ঘাসের ঝিলিমিলি,

তার সাথে মোর প্রাণের কাঁপন এক তালে যায় মিলি।

মাটির প্রেমে আলোর রাগে  রক্তে আমার পুলক লাগে-

বনের সাথে মন যে মাতে,  ওঠে আকুল হেসে

               ৭০

          শ্রাবমেঘের আধেক দুয়ার ওই খোলা,

          আড়াল থেকে দেয় দেখা কোন্ পথ-ভোলা

ওই-যে পুরব-গগন জুড়ে     উত্তরী তার যায় রে উড়ে,

          সজল হাওয়ার হিন্দোলাতে দেয় দোলা

          লুকাবে কি প্রকাশ পাবে কেই জানে-

          আকাশে কি ধরায় বাসা কোন্‌খানে।

নানা বেশে ক্ষণে ক্ষণে         ওই তো আমার লাগায় মনে

          পরশখানি নানা-সুরের-ঢেউ-তোলা

                  ৭১

বহু যুগের  পার হতে আষা এল আমার মনে,
কোন্
 সে কবির ছন্দ বাজে ঝরো ঝরো বরিষনে॥
যে
 মিলনের মালাগুলি ধুলায় মিশে হল ধূলি
গন্ধ
 তারি ভেসে আসে আজি সজল সমীরণে॥
সে
 দিন এমনি মেঘের ঘটা রেবানদ তীরে,
এমনি
 বারি ঝরেছিল শ্যামলশৈলশিরে।
মালবিকা
 অনিমিখে চেয়ে ছিল পথের দিকে,
সেই
 চাহনি এল ভেসে কালো মেঘের ছায়ার সনে॥ 

                     ৭২

          বাদল-বাউল বাজায় রে একতারা-

সারা     বেলা ধ’রে ঝরোঝরো ঝরো ধারা

জামের বনে ধানের ক্ষেতে    আপন তানে আপনি মেতে

                      নেচে নেচে হল সারা

          ঘন জটার ঘটা ঘনায় আঁধার আকাশ-মাঝে।

          পাতায় পাতায় টুপুর নূপুর মধুর বাজে।

ঘর-ছাড়ানো আকুল সুরে      উদাস হয়ে বেড়ায় ঘুরে

                      পুবে হাওয়া গৃহহারা

                 ৭৩

এ কী    গভীর বাণী এল  ঘন মেঘের আড়াল ধ’রে

                      সকল আকাশ আকুল ক’রে

সেই     বাণীর পরশ লাগে, নবীন প্রাণের বাণী জাগে,

হঠাৎ দিকে দিগন্তের  ধরার হৃদয় ওঠে ভরে

          কে সে বাঁশি বাজিয়েছিল কবে প্রথম সুরে তালে,

          প্রাণেরে ডাক দিয়েছিল সুদূর আঁধার আদিকালে।

তার      বাঁশির ধ্বনিখানি আজ আষাঢ় দিল আনি,

সেই     অগোচরের তরে  আমার হৃদয় নিল হ’রে

                ৭৪

          আজি      হৃদয় আমার যায় যে ভেসে

          যার        পায় নি দেখা তার উদ্দেশে

বাঁধন ভোলে, হাওয়ায় দোলে,  যায় সে বাদল-মেঘের কোলে  রে

                কোন্-সে অসম্ভবের দেশে

          সেথায় বিজন সাগরকূলে

          শ্রাবণ ঘনায় শৈলমূলে।

রাজার পুরে তমালগাছে  নূপুর শুনে ময়ূর নাচে রে

          সুদূর তেপান্তরের শেষে

                     ৭৫

          ভোর হল যেই শ্রাবণশর্বরী

তোমার বেড়ায় উঠল ফুটে হেনার মঞ্জরী

গন্ধ তারি রহি রহি  বাদল-বাতাস আনে বহি,

আমার মনের কোণে কোণে বেড়ায় সঞ্চরি

বেড়া দিলে কবে তুমি তোমার ফুলবাগানে-

আড়াল ক’রে রেখেছিলে আমার বনের পানে।

কখন গোপন অন্ধকারে  বর্ষারাতের অশ্রুধারে

তোমার আড়াল মধুর হয়ে ডাকে মর্মরি

                         ৭৬

বৃষ্টিশেষের হাওয়া কিসের খোঁজে বইছে ধীরে ধীরে।

           গুঞ্জরিয়া কেন বেড়ায় ও যে বুকের শিরে শিরে

অলখ তারে বাঁধা অচিন বীণা ধরার বক্ষে রহে নিত্য লীনা- এই হাওয়া

           কত যুগের কত মনের কথা    বাজায় ফিরে ফিরে

           ঋতুর পরে ঋতু ফিরে আসে   বসুন্ধরার কূলে।

           চিহ্ন পড়ে বনের ঘাসে ঘাসে   ফুলের পরে ফুলে।

গানের পরে গানে তারি সাথে    কত সুরের কত যে হার গাঁথে- এই হাওয়া

           ধরার কণ্ঠ বাণীর বরণমালায় সাজায় ঘিরে ঘিরে

                     ৭৭

বাদল-ধারা হল সারা, বাজে বিদায়-সুর।

গানের পালা শেষ ক’রে দে রে, যাবি অনেক দূর

ছাড়ল খেয়া ও পার হতে ভাদ্রদিনের ভরা স্রোতে  রে,

           দুলছে তরী নদীর পথে তরঙ্গবন্ধুর

কদমকেশর ঢেকেছে আজ বনতলের ধূলি,

মৌমাছিরা কেয়াবনের পথ গিয়েছে ভুলি।

অরণ্যে আজ স্তব্ধ হাওয়া, আকাশ আজি শিশির-ছাওয়া  রে,

           আলোতে আজ স্মৃতির আভাস বৃষ্টির বিন্দুর

                      ৭৮

ঝরে ঝরো ঝরো ভাদরবাদর,                        বিরহকাতর শর্বরী।

ফিরিছে এ কোন্ অসীম রোদন           কানন কানন মর্মরি

আমার প্রাণের রাগিণী আজি এ           গগনে গগনে উঠিছে বাজিয়ে

মোর হৃদয় একি রে ব্যাপিল তিমিরে    সমীরে সমীরে সঞ্চরি

                     ৭৯

এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে,            এসো করো স্নান নবধারাজলে

দাও আকুলিয়া ঘন কালো কেশ,         পরো দেহ ঘেরি মেঘনীল বেশ-

কাজলনয়নে, যূথিমালা গলে,                        এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে

আজি ক্ষণে ক্ষণে হাসিখানি, সখী,        অধরে নয়নে উঠুক চমকি

মল্লারগানে তব মধুস্বরে       দিক্ বাণী আনি বনমর্মরে।

ঘনবরিষনে জলকলকলে      এসো নীপবনে ছায়াবীথিতলে

                     ৮০

কোথা যে উধাও হল মোর প্রাণ উদাসী

           আজি ভরা বাদরে

    ঘন ঘন গুরু গুরু গরজিছে,

ঝরো ঝরো নামে দিকে দিগন্তে জলধারা-

মন ছুটে শূন্যে শূন্যে অনন্তে অশান্ত বাতাসে

                      ৮১

আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে       কী এনেছিস বল্-

হাসির কানায় কানায় ভরা     নয়নের জল

বাদল-হাওয়ার দীর্ঘশ্বাসে যূথীবনের বেদন আসে-

ফুল-ফোটানোর খেলায় কেন ফুল-ঝরানোর  ছল।

           ও তুই কী এনেছিস বল্

ওগো,   কী আবেশ হেরি চাঁদের চোখে,

              ফেরে সে কোন্ স্বপন-লোকে।

মন বসে রয় পথের ধারে,    জানে না সে পাবে কারে-

আসা-যাওয়ারা আভাস ভাসে বাতাসে চঞ্চল।

                       ও তুই     কী এনেছিস বল্

                     ৮২

পুব-হাওয়াতে দেয় দোলা আজ মরি মরি।

হৃদয়নদীর কূলে কূলে জাগে লহরী

পথ চেয়ে তাই একলা ঘাটে বিনা কাজে সময় কাটে,

পাল তুলে ওই আসে তোমার সুরেরই তরী

ব্যথা আমার কূল মানে না,    বাধা মানে না।

পরান আমার ঘুম জানে না,   জাগা জানে না।

মিলবে যে আজ অকূল-পানে তোমার গানে আমার গানে,

ভেসে যাবে রসের বানে       আজ বিভাবরী

                 ৮৩

অশ্রুভরা বেদনা দিকে দিকে জাগে।

আজি    শ্যামল মেঘের মাঝে   বাজে কার কামনা

           চলিছে ছুটিয়া অশান্ত বায়,

          ক্রন্দন কার তার গানে ধ্বনিছে-

          করে কে সে বিরহী বিফল সাধনা

               ৮৪

ধরণীর গগনের মিলনের ছন্দে

বাদলবাতাস মাতে মালতীর গন্ধে

উৎসবসভা-মাঝে   শ্রাবণের বীণা বাজে,

শিহরে শ্যামল মাটি প্রাণের আনন্দে

দুই কূল আকুলিয়া অধীর বিভঙ্গে

নাচন উঠিল জেগে নদীর তরঙ্গে।

কাঁপিছে বনের হিয়া  বরষনে মুখরিয়া,

বিজলি ঝলিয়া ওঠে নবঘনমন্দ্রে

               ৮৫

বন্ধু, রহো রহো সাথে

আজি এ সঘন শ্রাবণপ্রাতে।

ছিলে কি মোর স্বপনে    সাথিহারা রাতে

বন্ধু, বেলা বৃথা যায় রে

আজি এ বাদলে  আকুল হাওয়ায় রে-

কথা কও মোর হৃদয়ে,   হাত রাখো হাতে

               ৮৬

একলা বসে বাদল-শেষে শুনি কত কী-

‘এবার আমার গেল বেলা’ বলে কেতকী

বৃষ্টি-সারা মেঘ যে তারে   ডেকে গেল আকাশপারে,

তাই তো সে যে উদাস হল- নইলে যেত কি

ছিল সে যে একটি ধারে বনের কিনারায়,

উঠত কেঁপে তড়িৎ-আলোর চকিত ইশারায়।

শ্রাবণঘন-অন্ধকারে   গন্ধ যেত অভিসারে-

সন্ধ্যাতারা আড়াল থেকে খবর পেত কি

         ৮৭
শ্যামল শোভন শ্রাবণ, তুমি নাই বা গেলে

সজল বিলোল আঁচল মেলে

পুব হাওয়া কয়, ‘ওর যে সময় গেল চলে।’

শরৎ বলে, ‘ভয় কী সময় গেল ব’লে,

            বিনা কাজে আকাশ-মাঝে            কাটবে বেলা অসময়ের খেলা-খেলে।’

    কালো মেঘের আর কি আছে দিন।

                ও যে হল  সাথিহীন।

    পুব-হাওয়া কয়, ‘কালোর এবার যাওয়াই ভালো।’

    শরৎ বলে, ‘মিলবে যুগল কালোয় আলো,

         সাজবে বাদল সোনার সাজে            আকাশ-মাঝে         কালিমা ওর ঘুচিয়ে ফেলে।’

                  ৮৮

    নমো, নমো, নমো করুণাঘন, নমো হে।

                নয়ন স্নিগ্ধ অমৃতাঞ্জনপরশে,

                জীবন পূর্ণ সুধারসবরষে,

তব দর্শনধনসার্থক মন হে,         অকৃপণবর্ষণ করুণাঘন হে

                   ৮৯

    তাপের তাপের বাঁধন কাটুক রসের বর্ষণে।

    হৃদয় আমার, শ্যামল-বঁধুর করুণ স্পর্শ নে

অঝোর-ঝরন শ্রাবণজলে           তিমিরমেদুর বনাঞ্চলে

    ফুটুক সোনার কদম্বফুল নিবিড় হর্ষণে

    ভরুক গগন, ভরুক কানন, ভরুক নিখিল ধরা,

    দেখুক ভুবন মিলনস্বপন মধুর-বেদনা-ভরা।

পরান-ভরানো ঘনছায়াজাল বাহির-আকাশ করুক আড়াল-

    নয়ন ভুলুক, বিজলি ঝলুক পরম দর্শনে

                 ৯০

ওই কি এলে আকাশপারে দিক-ললনার প্রিয়-

চিত্তে আমার লাগল তোমার ছায়ার উত্তরীয়

মেঘের মাঝে মৃদঙ তোমার বাজিয়ে দিলে কি ও,

ওই তালেতে মাতিয়ে আমায় নাচিয়ে দিয়ো দিয়ো

                 ৯১

    গগনে গগনে আপনার মনে কী খেলা তব।

    তুমি কত বেশে নিমেষে নিমেষে নিতুই নব

জটার-গভীরে লুকালে রবিরে,     ছায়াপটে আঁকো এ কোন্ ছবি রে।

    মেঘমল্লারে কী বল আমারে কেমনে কব

    বৈশাখী ঝড়ে সে দিনের সেই অট্টহাসি

    গুরুগুরু সুরে কোন্ দূরে দূরে যায় যে ভাসি।

সে সোনার আলো শ্যামলে মিশালো-শ্বেত উত্তরী আজ কেন কালো।

    লুকালে ছায়ায় মেঘের মায়ায় কী বৈভব

                       ৯২

শ্রাবণ, তুমি বাতাসে কার আভাস পেলে-

পথে তারি সকল বারি দিলে ঢেলে।

কেয়া কাঁদে, ‘যায় যায় যায়।’

কদম ঝরে, ‘হায় হায় হায়।’

পুব-হাওয়া কয়, ‘ওর তো সময় নাই বাকি আর।’

শরৎ বলে, ‘যাক-না সময়, ভয় কিবা তার-

কাটবে বেলা আকাশ-মাঝে বিনা কাজে অসময়ের খেলা খেলে।’

কালো মেঘের আর কি আছে দিন,       ও যে হল সাথিহীন।

পুব-হাওয়া কয়, ‘কালোর এবার যাওয়াই ভালো।’

শরৎ বলে, মিলিয়ে  দেব কালোয় আলো-

সাজবে বাদল আকাশ-মাঝে সোনার সাজে কালিমা ওর মুছে ফেলে।’

                     ৯৩

           কেন্       পান্থ, এ চঞ্চলতা।

           কোন্      শূন্য হতে এল কার বারতা

নয়ন কিসের প্রতীক্ষা-রত     বিদায়বিষাদে উদাসমত-

ঘনকুন্তলভার ললাটে নত,    ক্লান্ত তড়িতবধূ তন্দ্রাগতা

কেশরকীর্ণ কদম্ববনে           মর্মরমুখরিত মৃদুপবনে

বর্ষণহর্ষ-ভরা ধরণীর           বিরহবিশঙ্কিত করুণ কথা।

ধৈর্য মানো ওগো, ধৈর্য মানো!            বরমাল্য গলে তব হয় নি ম্লান’

                       আজও হয় নি ম্লান’-

ফুলগন্ধনিবেদনবেদনসুন্দর   মালতী তব চরণে প্রণতা

                    ৯৪

আজি    শ্রাবণঘনগহন মোহে    গোপন তব চরণ ফেলে

           নিশার মতো, নীরব ওহে,       সবার দিঠি এড়ায়ে এলে

           প্রভাত আজি মুদেছে আঁখি,    বাতাস বৃথা যেতেছে ডাকি,

           নিলাজ নীল আকাশ ঢাকি       নিবিড় মেঘ কে দিল মেলে

           কূজনহীন কাননভূমি,            দুয়ার দেওয়া সকল ঘরে-

           একেলা কোন্ পথিক তুমি      পথিকহীন পথের ’পরে।

           হে একা সখা, হে প্রিয়তম,     রয়েছে খোলা এ ঘর মম-

           সমুখ দিয়ে স্বপনসম                        যেয়ো না মোরে হেলায় ঠেলে

                         ৯৫

আজি    ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার

           পরানসখা বন্ধু হে আমার

           আকাশ কাঁদে হতাশসম,        নাই যে ঘুম নয়নে মম-

           দুয়ার খুলি হে প্রিয়তম, চাই যে বারে বার

                       বাহিরে কিছু দেখিতে নাই পাই,

                       তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই।

           সুদূর কোন্ নদীর পারে         গহন কোন্ বনের ধারে

           গভীর কোন্ অন্ধকারে হতেছ তুমি পার

                       ৯৬

চলে     ছলোছলো নদীধারা   নিবিড় ছায়ায়   কিনারায়।

           ওকে   মেঘের ডাকে ডাকল সুদূরে,  ‘আয় আয় আয়।’

           কূলে    প্রফুল্ল বকুলবন  ওরে   করিছে আবাহন-

           কোথা দূরে বেণুবন গায়,  ‘আয় আয় আয়

        তীরে তীরে, সখী,    ওই-যে উঠে নবীন ধান্য পুলকি।

           কাশের বনে বনে  দুলিছে ক্ষণে ক্ষণে-

           গাহিছে সজল বায়,  ‘আয়, আয় আয়।’

                        ৯৭

           আমারে যদি জাগালে আজি নাথ,

           ফিরো না তবে ফিরো না, করো করুণ আঁখিপাত

নিবিড় বনশাখার ’পরে         আষামেঘে বৃষ্টি ঝরে,

বাদল-ভরা আলস-ভরে       ঘুমায়ে আছে রাত

           বিরামহীন বিজুলিঘাতে নিদ্রাহারা প্রাণ

           বরষাজলধারার সাথে গাহিতে চাহে গান।

হৃদয় মোর চোখের জলে     বাহির হল তিমিরতলে,

   আকাশ খোঁজে ব্যাকুল বলে   বাড়ায়ে দুই হাত

                     ৯৮

           আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে,

           আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে

এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি  পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি

           নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে

   রহিয়া রহিয়া বিপুল মাঠের ’পরে নব তৃণদলে বাদলের ছায়া পড়ে।

‘এসেছে এসেছে’, এই কথা বলে প্রাণ, ‘এসেছে এসেছে’ উঠিতেছে এই গান-

                       নয়নে এসেছে, হৃদয়ে এসেছে ধেয়ে

                    ৯৯

এসো হে এসো সজল ঘন বাদলবরিষনে-

বিপুল তব শ্যামল স্নেহে এসো হে এ জীবনে

এসো হে গিরিশিখর চুমি   ছায়ায় ঘিরি কাননভূমি,

গগন ছেয়ে এসো হে তুমি গভীর গরজনে

ব্যথিয়া উঠে নীপের বন পুলক-ভরা ফুলে,

উছলি উঠে কলরোদন নদীর কূলে কূলে।

এসো হে এসো হৃদয়-ভরা,   এসো হে এসো পিপাসাহরা,

           এসো হে আঁখি শীতল-করা,    ঘনায়ে এসো মনে

                   ১০০

চিত্ত আমার হারালো আজ মেঘের মাঝখানে-

কোথায় ছুটে চলেছে সে কোথায় কে জানে

   বিজুলি তার বীণার তারে   আঘাত করে বারে বারে,

   বুকের মাঝে বজ্র বাজে কী মহাতানে

পুঞ্জ পুঞ্জ ভারে ভারে নিবিড় নীল অন্ধকারে

জড়ালো রে অঙ্গ আমার, ছড়ালো প্রাণে।

  পাগল হাওয়া নৃত্যে মাতি   হল আমার সাথের সাথি-

   অট্ট হাসে ধায় কোথা সে, বারণ না মানে