গীতবিতান
পূজা (১-১০০
সংখ্যক গান)
ভূমিকা
[তথ্য]
প্রথম যুগের উদয়দিগঙ্গনে
প্রথম দিনের উষা নেমে এল যবে
প্রকাশপিয়াসি ধরিত্রী বনে বনে
শুধায়ে ফিরিল সুর খুঁজে পাবে কবে ॥
এসো এসো সেই নবসৃষ্টির কবি
নবজাগরণযুগপ্রভাতের রবি-
গান এনেছিলে নব ছন্দের তালে
তরুণী উষার শিশিরস্নানের কালে
আলো-আঁধারের আনন্দবিপ্লবে॥
সে গান আজিও নানা রাগরাগিণীতে
শুনাও তাহারে আগমনীসঙ্গীতে
যে জাগায় চোখে নূতন-দেখার দেখা।
যে এসে দাঁড়ায় ব্যাকুলিত ধরণীতে
বননীলিমার পেলব সীমানাটিতে,
বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা।
অবাক্ আলোর লিপি যে বহিয়া আনে
নিভৃত প্রহরে কবির চকিত প্রাণে,
নব পরিচয়ে বিরহব্যথা যে হানে
বিহ্বল প্রাতে সঙ্গীততসৌরভে
দূর
আকাশের
অরুণিম উৎসবে
॥
কান্নাহাসির-দোল-দোলানো পৌষ-ফাগুনের পালা,
সুরের গুরু, দাও গো সুরের দীক্ষা—
তোমার সুরের ধারা ঝরে যেথায় তারি পারে
তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী,
আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান
তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে,
তোমার বীণা আমার মনোমাঝে
তোমার নয়ন আমায় বারে বারে বলেছে গান গাহিবারে॥ ফুলে ফুলে তারায় তারায় বলেছে সে কোন্ ইশারায় দিবস-রাতির মাঝ-কিনারায় ধূসর আলোয় অন্ধকারে। গাই নে কেন কী কব তা, কেন আমার আকুলতা— ব্যথার মাঝে লুকায় কথা, সুর যে হারাই অকূল পারে॥ যেতে যেতে গভীর স্রোতে ডাক দিয়েছ তরী হতে। ডাক দিয়েছ ঝড়-তুফানে বোবা মেঘের বজ্রগানে, ডাক দিয়েছ মরণপানে, শ্রাবণরাতের উতল ধারে। যাই নে কেন জান না কি— তোমার পানে মেলে আঁখি কূলের ঘাটে বসে থাকি, পথ কোথা পাই পারাবারে॥
অরূপ, তোমার বাণী অঙ্গে আমার চিত্তে আমার মুক্তি দিক্ সে আনি॥ নিত্যকালের উৎসব তব বিশ্বের দীপালিকা— আমি শুধু তারি মাটির প্রদীপ, জ্বালাও তাহার শিখা নির্বাণহীন আলোকদীপ্ত তোমার ইচ্ছাখানি ॥ যেমন তোমার বসন্তবায় গীতলেখা যায় লিখে বর্ণে বর্ণে পুষ্পে পর্ণে বনে বনে দিকে দিকে তেমনি আমার প্রাণের কেন্দ্রে নিশ্বাস দাও পুরে, শূন্য তাহার পূর্ণ করিয়া ধন্য করুক সুরে— বিঘ্ন তাহার পুণ্য করুক তব দক্ষিণপাণি ॥
গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে রুদ্ধবাণীর অন্ধকারে কাঁদন জগে ওঠে॥ বিশ্বকবির চিত্তমাঝে ভুবনবীণা যথায় বাজে জীবন তোমার সুরের ধারায় পড়ুক সেথায় লুটে॥ ছন্দ তামার ভেঙে গিয়ে দ্বন্দ্ব বাধায় প্রাণে, অন্তরে আর বাহিরে তাই তান মলে না তানে। সুরহারা প্রাণ বিষম বাধা— সেই তা আঁধি, সই তা ধাঁধা— গান-ভোলা তুই গান ফিরে নে, যাক সে আপদ ছুটে॥
আমার সুরে লাগে তোমার হাসি, যেমন ঢেউয়ে ঢেউয়ে রবির কিরণ দোলে আসি॥ দিবানিশি আমিও যে ফিরি তোমার সুরের খোঁজে, হঠাৎ এমন ভোলায় কখন তোমার বাঁশি॥ আমার সকল কাজই রইল বাকি, সকল শিক্ষা দিলেম ফাঁকি। আমার গানে তোমায় ধরব ব’লে উদাস হয়ে যাই যে চলে, তোমার গানে ধরা দিতে ভালোবাসি॥
আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে,
যারা কথা দিয়ে তোমার কথা বলে তারা কথার বেড়া গাঁথে কেবল দলের পরে দলে ॥ একের কথা আরে বুঝতে নাহি পারে, বোঝায় যত কথার বোঝা ততই বেড়ে চলে ॥ যারা কথা ছেড়ে বাজায় শুধু সুর তাদের সবার সুরে সবাই মেলে নিকট হতে দূর। বোঝে কি নাই বোঝে থাকে না তার খোঁজে, বেদন তাদের ঠেকে গিয়ে তোমার চরণতলে ॥
তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে মাটির এই কলস আমার ছাপিয়ে গেল কোন্ ক্ষণে॥ রবি ঐ অস্তে নামে শৈলতলে, বলাকা কোন্ গগনে উড়ে চলে— আমি এই করুণ ধারার কলকলে নীরবে কান পেতে রই আনমনে তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে॥ দিনে মোর যা প্রয়োজন বেড়াই তারি খোঁজ ক'রে, মেটে বা নাই মেটে তা ভাবব না আর তার তরে। সারাদিন অনেক ঘুরে দিনের শেষে এসেছি সকল চাওয়ার বাহির-দেশে, নেব আজ অসীম ধারার তীরে এসে প্রয়োজন ছাপিয়ে যা দাও সেই ধনে তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে॥
কূল থেকে মোর গানের তরী দিলেম খুলে, সাগর-মাঝে ভাসিয়ে দিলেম পালটি তুলে॥ যেখানে ঐ কোকিল ডাকে ছায়াতলে সেখানে নয়, যেখানে ঐ গ্রামের বধূ আসে জলে সেখানে নয়, যেখানে নীল মরণলীলা উঠছে দুলে সেখানে মোর গানের তরী দিলেম খুলে ॥ এবার, বীণা, তোমায় আমায় আমায় একা— অন্ধকারে নাইবা কারে গেল দেখা কুঞ্জবনের শাখা হতে যে ফুল তোলে সে ফুল এ নয়, বাতায়নের লতা হতে যে ফুল দোলে সে ফুল এ নয়— দিশাহারা আকাশ-ভরা সুরের ফুলে সেই দিকে মোর গানের তরী দিলেম খুলে॥
তোমার কাছে এ বর মাগি, মরণ হতে যেন জাগি
কেন তোমরা আমায় ডাকো, আমার মন না মানে। পাই নে সময় গানে গানে ॥ পথ আমারে শুধায় লোকে, পথ কি আমার পড়ে চোখে, চলি যে কোন্ দিকের পানে গানে গানে ॥ দাও না ছুটি, ধর ত্রুটি, নিই নে কানে। মন ভেসে যায় গানে গানে। আজ যে কুসুম-ফোটার বেলা, আকাশে আজ রঙের মেলা, সকল দিকেই আমায় টানে গানে গানে ॥
দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার গানের ও পারে— আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে ॥ বাতাস বহে মরি মরি, আর বেঁধে রেখো না তরী— এসো এসো পার হয়ে মোর হৃদয়মাঝারে ॥ তোমার সাথে গানের খেলা দূরের খেলা যে, বেদনাতে বাঁশি বাজায় সকল বেলা যে। কবে নিয়ে আমার বাঁশি বাজাবে গো আপনি আসি আনন্দময় নীরব রাতের নিবিড় আঁধারে ॥
রাজপুরীতে বাজায় বাঁশি বেলাশেষের তান। পথে চলি, শুধায় পথিক ‘কী নিলি তোর দান’ ॥ দেখাব যে সবার কাছে এমন আমার কী-বা আছে, সঙ্গে আমার আছে শুধু এই কখানি গান॥ ঘরে আমার রাখতে যে হয় বহু লোকের মন— অনেক বাঁশি, অনেক কাঁসি, অনেক আয়োজন। বঁধুর কাছে আসার বেলায় গানটি শুধু নিলেম গলায়, তারি গলার মাল্য ক’রে করব মূল্যবান ॥
জাগ’ জাগ’ রে জাগ’ সঙ্গীত— চিত্ত অম্বর কর তরঙ্গিত নিবিড়নন্দিত প্রেমকম্পিত হৃদয়কুঞ্জবিতানে॥ মুক্তবন্ধন সপ্তসুর তব করুক বিশ্ববিহার, সূর্যশশিনক্ষত্রলোকে করুক হর্ষ প্রচার। তানে তানে প্রাণে প্রাণে গাঁথ’ নন্দনহার। পূর্ণ কর’ রে গগন-অঙ্গন তাঁর বন্দনগানে ॥
হেথা যে গান গাইতে আসা, আমার হয় নি সে গান গাওয়া— আজও কেবলই সুর সাধা, আমার কেবল গাইতে চাওয়া ॥ আমার লাগে নাই সে সুর, আমার বাঁধে নাই সে কথা, শুধু প্রাণেরই মাঝখানে আছে গানের ব্যাকুলতা। আজও ফোটে নাই সে ফুল, শুধু বয়েছে এক হাওয়া ॥ আমি দেখি নাই তার মুখ, আমি শুনি নাই তার বাণী, কেবল শুনি ক্ষণে ক্ষণে তাহার পায়ের ধ্বনিখানি— আমার দ্বারের সমুখ দিয়ে সে জন করে আসা-যাওয়া। শুধু আসন পাতা হল আমার সারাটি দিন ধ’রে— ঘরে হয় নি প্রদীপ জ্বালা, তারে ডাকব কেমন করে। আছি পাবার আশা নিয়ে, তারে হয় নি আমার পাওয়া ॥
আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান,
গানের সুরের আসন-খানি পাতি পথের ধারে। ওগো পথিক, তুমি এসে বসবে বারে বারে॥ ঐ যে তোমার ভোরের পাখি নিত্য করে ডাকাডাকি, অরুণ-আলোর খেয়ায় যখন এস ঘাটের পারে, মোর প্রভাতীর গানখানিতে দাঁড়াও আমার দ্বারে ॥ আজ সকালে মেঘের ছায়া লুটিয়ে পড়ে বনে, জল ভরেছে ঐ গগনের নীল নয়নের কোণে। আজকে এলে নতুন বেশে তালের বনে মাঠের শেষে, অমনি চলে যেয়ো নাকো গোপনসঞ্চারে। দাঁড়িয়ো আমার মেঘলা গানের বাদল-অন্ধকারে ॥
সুর ভুলে যেই ঘুরে বেড়াই কেবল কাজে
গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি তখন তারে চিনি আমি, তখন তারে জানি॥ তখন তারি আলোর ভাষায় আকাশ ভরে ভালোবাসায়, তখন তারি ধূলায় ধূলায় জাগে পরম বাণী ॥ তখন সে যে বাহির ছেড়ে অন্তরে মোর আসে, তখন আমার হৃদয় কাঁপে তারি ঘাসে ঘাসে। রূপের রেখা রসের ধারায় আপন সীমা কোথায় হারায়, তখন দেখি আমার সাথে সবার কানাকানি ॥
খেলার ছলে সাজিয়ে আমার গানের বাণী দিনে দিনে ভাসাই দিনের তরীখানি ॥ স্রোতের লীলায় ভেসে ভেসে সুদূরে কোন্ অচিন দেশে কোনো ঘাটে ঠেকবে কিনা নাহি জানি ॥ নাহয় ডুবে গেলই, নাহয় গেলই বা। নাহয় তুলে লও গো, নাহয় ফেলোই বা। হে অজানা মরি মরি, উদ্দেশে এই খেলা করি, এই খেলাতেই আপন-মনে ধন্য মানি ॥
যতখন তুমি আমায় বসিয়ে রাখ বাহির-বাটে ততখন গানের পরে গান গেয়ে মোর প্রহর কাটে ॥ যবে শুভক্ষণে ডাক পড়ে সেই ভিতর-সভার মাঝে এ গান লাগবে বুঝি কাজে তোমার সুরের রঙের রঙিন নাটে ॥ তোমার ফাগুনদিনের বকুল চাঁপা, শ্রাবণদিনের কেয়া, তাই দেখে তো শুনি তোমার কেমন যে তান দে’য়া। আমি উতল প্রাণে আকাশ-পানে হৃদয়খানি তুলি বীণায় বেঁধেছি গানগুলি তোমার সাঁঝ-সকালের সুরের ঠাটে ॥
আমার যে গান তোমার পরশ পাবে থাকে কোথায় গহন মনের ভাবে ?। সুরে সুরে খুঁজি তারে অন্ধকারে, আমার যে আঁখিজল তোমার পায়ে নাবে থাকে কোথায় গহন মনের ভাবে ?। যখন শুষ্ক প্রহর বৃথা কাটাই চাহি গানের লিপি তোমায় পাঠাই। কোথায় দুঃখসুখের তলায় সুর যে পলায়, আমার যে শেষ বাণী তোমার দ্বারে যাবে থাকে কোথায় গহন মনের ভাবে ?।
গানের ঝরনাতলায় তুমি সাঁঝের বেলায় এলে। দাও আমারে সোনার-বরন সুরের ধারা ঢেলে ॥ যে সুর গোপন গুহা হতে ছুটে আসে আকুল স্রোতে, কান্নাসাগর-পানে যে যায় বুকের পাথর ঠেলে ॥ যে সুর উষার বাণী বয়ে আকাশে যায় ভেসে, রাতের কোলে যায় গো চলে সোনার হাসি হেসে। যে সুর চাঁপার পেয়ালা ভ'রে দেয় আপনায় উজার ক’রে, যায় চলে যায় চৈত্রদিনের মধুর খেলা খেলে ॥
কণ্ঠে নিলেম গান, আমার শেষ পারানির কড়ি— একলা ঘাটে রইব না গো পড়ি ॥ আমার সুরের রসিক নেয়ে তারে ভোলাব গান গেয়ে, পারের খেয়ায় সেই ভরসায় চড়ি ॥ পার হব কি নাই হব তার খবর কে রাখে— দূরের হাওয়ায় ডাক দিল এই সুরের পাগলাকে। ওগো তোমরা মিছে ভাব’, আমি যাবই যাবই যাব— ভাঙল দুয়ার, কাটল দড়াদড়ি ॥
আমার ঢালা গানের ধারা সেই তো তুমি পিছিয়েছিলে, আমার গাঁথা স্বপন-মালা কখন চেয়ে নিয়েছিলে ॥ মন যবে মোর দূরে দূরে ফিরেছিল আকাশ ঘুরে তখন আমার ব্যথার সুরে আভাস দিয়ে গিয়েছিলে ॥ যবে বিদায় নিয়ে যাব চলে মিলন-পালা সাক্ হলে শরৎ-আলোয় বাদল-মেঘে এই কথাটি রইবে লেগে- এই শ্যামলে এই নীলিমায়
আমায়
দেখা দিয়েছিলে
॥ কবে আমি বাহির হলেম তোমারি গান গেয়ে— সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়। ভুলে গেছি কবে থেকে আসছি তোমায় চেয়ে— সে তো আজকে নয় সে আজকে নয় ॥ ঝরনা যেমন বাহিরে যায়, জানে না সে কাহারে চায়, তেমনি করে ধেয়ে এলেম জীবনধারা বেয়ে— সে তো আজকে নয় সে আজকে নয় ॥ কতই নামে ডেকেছি যে, কতই ছবি এঁকেছি যে, কোন্ আনন্দে চলেছি তার ঠিকানা না পেয়ে— সে তো আজকে নয় সে আজকে নয়। পুষ্প যেমন আলোর লাগি না জেনে রাত কাটায় জাগি তেমনি তোমার আশায় আমার হৃদয় আছে ছেয়ে— সে তো আজকে নয় সে আজকে নয় ॥
তোমায় আমায় মিলন হবে ব'লে আলোয় আকাশ ভরা। তোমায় আমায় মিলন হবে ব'লে ফুল্ল শ্যামল ধরা ॥ তোমায় আমায় মিলন হবে ব’লে রাত্রি জাগে জগৎ লয়ে কোলে, উষা এসে পূর্বদুয়ার খোলে কলকণ্ঠস্বরা ॥ চলছে ভেসে মিলন-আশা-তরী অনাদিস্রোত বেয়ে। কত কালের কুসুম উঠে ভরি বরণডালি ছেয়ে। তোমায় আমায় মিলন হবে ব’লে যুগে যুগে বিশ্বভুবনতলে পরান আমার বধূর বেশে চলে চিরস্বয়ম্বরা॥
প্রভু, তোমার বীণা যেমনি বাজে আঁধার-মাঝে অমনি ফোটে তারা। যেন সেই বীণাটি গভীর তানে আমার প্রাণে বাজে তেমনিধারা ॥ তখন নূতন সৃষ্টি প্রকাশ হবে কী গৌরবে হৃদয়-অন্ধকারে। তখন স্তরে স্তরে আলোকরাশি উঠবে ভাসি চিত্তগগনপারে ॥ তখন তোমারি সৌন্দর্যছবি, ওগো কবি, আমায় পড়বে আঁকা— তখন বিস্ময়ের রবে না সীমা, ওই মহিমা আর যাবে না ঢাকা। তখন তোমারি প্রসন্ন হাসি পড়বে আসি নবজীবন-’পরে। তখন আনন্দ-অমৃতে তব ধন্য হব চিরদিনের তরে ॥
তুমি একলা ঘরে ব’সে ব’সে কী সুর বাজালে প্রভু, আমার জীবনে ! তোমার পরশরতন গেঁথে গেঁথে আমায় সাজালে প্রভু গভীর গোপনে ॥ দিনের আলোর আড়াল টানি কোথায় ছিলে নাহি জানি, অস্তরবির তোরণ হতে চরণ বাড়ালে আমার রাতের স্বপনে ॥ আমার হিয়ায় হিয়ায় বাজে আকুল আঁধার যামিনী, সে যে তোমার বাঁশরি। আমি শুনি তোমার আকাশপারের তারার রাগিণী, আমার সকল পাশরি। কানে আসে আশার বাণী— খেলা পাব দুয়ারখানি রাতের শেষে শিশির-ধোওয়া প্রথম সকালে তোমার করুণ কিরণে ॥
শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু, হে প্রিয়,
তোমার সুর শুনায়ে যে ঘুম ভাঙাও সে ঘুম আমার রমণীয়— জাগরণের সঙ্গিনী সে, তারে তোমার পরশ দিয়ো ॥ অন্তরে তার গভীর ক্ষুধা, গোপনে চায় আলোকসুধা, আমার রাতের বুকে সে যে তোমার প্রাতের আপন প্রিয় ॥ তারি লাগি আকাশ রাঙা আঁধার-ভাঙা অরুণরাগে, তারি লাগি পাখির গানে নবীন আশার আলাপ জাগে। নীরব তোমার চরণধ্বনি শুনায় তারে আগমনী, সন্ধ্যাবেলার কুঁড়ি তারে সকালবেলায় তুলে নিয়ো ॥
মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে
মোর প্রভাতের এই প্রথম খনের কুসুমখানি তুমি জাগাও তারে ওই নয়নের আলোক হানি ॥ সে যে দিনের বেলায় করবে খেলা হাওয়ায় দুলে, রাতের অন্ধকারে নেবে তারে বক্ষে তুলে— ওগো তখনি তো গন্ধে তাহার ফুটবে বাণী ॥ আমার বীণাখানি পড়ছে আজি সবার চোখে, হেরো তারগুলি তার দেখছে গুণে সকল লোকে। ওগো কখন সে যে সভা ত্যেজে আড়াল হবে, শুধু সুরটুকু তার উঠবে বেজে করুণ রবে— যখন তুমি তারে বুকের ’পরে লবে টানি ॥
মালা হতে খসে-পড়া ফুলের একটি দল মাথায় আমার ধরতে দাও, ওগো, ধরতে দাও। ওই মাধুরীসরোবরের নাই যে কোথাও তল, হোথায় আমায় ডুবতে দাও, ওগো, মরতে দাও ॥ দাও গো মুছে আমার ভালে অপমানের লিখা ; নিভৃতে আজ বন্ধু, তোমার আপন হাতের টিকা ললাটে মোর পরতে দাও, ওগো, পরতে দাও ॥ বহুক তোমার ঝড়ের হাওয়া আমার ফুলবনে, শুকনো পাতা মলিন কুসুম ঝরতে দাও। পথ জুড়ে যা পড়ে আছে আমার এ জীবনে দাও গো তাদের সরতে দাও, ওগো সরতে দাও। তোমার মহাভাণ্ডারেতে আছে অনেক ধন— কুড়িয়ে বেড়াই ভ’রে, ভরে না তায় মন, অন্তরেতে জীবন আমায় ভরতে দাও ॥
এত আলো জ্বালিয়েছ এই গগনে কী উৎসবের লগনে ॥ সব আলোটি কেমন ক’রে ফেল আমার মুখের প’রে, তুমি আপনি থাকো আলোর পিছনে ॥ প্রেমটি যেদিন জ্বালি হৃদয়-গগনে কী উত্সবের লগনে সব আলো তার কেমন ক’রে পড়ে তোমার মুখের ’পরে, আমি আপনি পড়ি আলোর পিছনে ॥
কার হাতে এই মালা তোমার পাঠালে আজ ফাগুন-দিনের সকালে ॥ তার বর্ণে তোমার নামের রেখা গন্ধে তোমার ছন্দ লেখা, সেই মালাটি বেঁধেছি মোর কপালে আজ ফাগুন-দিনের সকালে ॥ গানটি তোমার চলে এল আকাশে আজ ফাগুন-দিনের বাতাসে। ওগো, আমার নামটি তোমার সুরে কেমন করে দিলে জুড়ে লুকিয়ে তুমি ওই গানেরই আড়ালে আজ ফাগুন-দিনের সকালে ॥
বল তো এইবারের মতো প্রভু, তোমার আঙিনাতে তুলি আমার ফসল যত ॥ কিছু-বা ফল গেছে ঝরে, কিছু-বা ফল আছে ধরে, বছর হয়ে এল গত— রোদের দিনে ছায়ায় বসে বাজায় বাঁশি রাখাল যত ॥ হুকুম তুমি কর যদি চৈত্র-হাওয়ায় পাল তুলে দিই— ওই-যে মেতে ওঠে নদী। পার ক’রে নিই ভরা তরী, মাঠের যা কাজ সারা করি, ঘরের কাজে হই গো রত— এবার আমার মাথার বোঝা পায়ে তোমার করি নত ॥
তোমায় নতুন করে পাব ব'লে হারাই ক্ষণে-ক্ষণ
ও মোর ভালোবাসার ধন। ও মোর ভালোবাসার ধন ॥ ওগো, তুমি আমার নও আড়ালের, তুমি আমার চিরকালের— ক্ষণকালের লীলার স্রোতে হও যে নিমগন ও মোর ভালোবাসার ধন ॥ আমি তোমায় যখন খুঁজে ফিরি ভয়ে কাঁপে মন— প্রেমে আমার ঢেউ লাগে তখন। তোমার শেষ নাহি, তাই শূন্য সেজে শেষ করে দাও আপনাকে যে— ওই হাসিরে দেয় ধুয়ে মোর বিরহের রোদন ও মোর ভালোবাসার ধন ॥
ধীরে বন্ধু, ধীরে ধীরে চলো তোমার বিজনমন্দিরে ॥ জানি নে পথ, নাই যে আলো, ভিতর বাহির কালোয় কালো, তোমার চরণশব্দ বরণ করেছি আজ এই অরণ্যগভীরে ॥
ধীরে বন্ধু, ধীরে ধীরে চলো অন্ধকারের তীরে তীরে। চলব আমি নিশীথরাতে তোমার হাওয়ার ইশারাতে, তোমার বসনগন্ধ বরণ করেছি আজ এই বসন্তসমীরে ॥
এবার আমায় ডাকলে দূরে
দুঃখের বরষায় চক্ষের জ্বল যেই নামল বক্ষের দরজায় বন্ধুর রথ সেই থামল ॥ মিলনের পাত্রটি পূর্ণ যে বিচ্ছেদ -বেদনায় ; অর্পিনু হাতে তার, খেদ নাই আর মোর খেদ নাই ॥ বহুদিনবঞ্চিত অন্তরে সঞ্চিত কী আশা, চক্ষের নিমেষেই মিটল যে পরশের তিয়াষা। এত দিনে জানলেম যে কাঁদনে কাঁদলেম সে কাহার জন্য। ধন্য এ জাগরণ, ধন্য এ ক্রন্দন, ধন্য রে ধন্য ॥
সে দিনে আপদ আমার যাবে কেটে পুলকে হৃদয় যেদিন পড়বে ফেটে॥ তখন তোমার গন্ধ তোমার মধু আপনি বাহির হবে বঁধু হে, তারে আমার ব’লে ছলে বলে কে বলো আর রাখিবে এঁটে ॥ আমারে নিখিল ভুবন দেখছে চেয়ে রাত্রিদিবা। আমি কি জানি নে তার অর্থ কিবা! তারা যে জানে আমার চিত্তকোষে অমৃতরূপ আছে বসে গো— তারেই প্রকাশ করি, আপনি মরি, তবে আমার দুঃখ মেটে॥
আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাই নি। তোমায় দেখতে আমি পাই নি। বাহির-পানে চোখ মেলেছি, আমার হৃদয়-পানে চাই নি ॥ আমার সকল ভালোবাসায় সকল আঘাত সকল আশায় তুমি ছিলে আমার কাছে, তোমার কাছে যাই নি ॥ তুমি মোর আনন্দ হয়ে ছিলে আমার খেলায়— আনন্দে তাই ভুলেছিলেম, কেটেছে দিন হেলায়। গোপন রহি গভীর প্রাণে আমার দুঃখসুখের গানে সুর দিয়েছ তুমি, আমি তোমার গান তো গাই নি ॥
কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না শুকনো ধুলো যতো ! কে জানিত আসবে তুমি গো অনাহূতের মতো ॥ পার হয়ে এসেছ মরু, নাই যে সেথায় ছায়াত তরু— পথের দুঃখ দিলেম তোমায় গো এমন ভাগ্যহত ॥ আলসেতে বসে ছিলেম আমি আপন ঘরের ছায়ে, জানি নাই যে তোমার কত ব্যথা বাজবে পায়ে পায়ে। ওই বেদনা আমার বুকে বেজেছিল গোপন দুখে— দাগ দিয়েছে মর্মে আমার গো গভীর হৃদয়ক্ষত ॥
আমায় বাঁধবে যদি কাজের ডোরে কেন পাগল কর এমন ক'রে ?। বাতাস আনে কেন জানি কোন্ গগনের গোপন বাণী, পরানখানি দেয় যে ভ’রে ॥
সোনার আলো কেমনে হে, রক্তে নাচে সকল দেহে। কারে পাঠাও ক্ষণে ক্ষণে আমার খোলা বাতায়নে,
সকল হৃদয় লয় যে হ’রে
॥ ওদের সাথে মেলাও যারা চরায় তোমার ধেনু, তোমার নামে বাজায় যারা বেণু ॥ পাষাণ দিয়ে বাঁধা ঘাটে এই-যে কোলাহলের হাটে কেন আমি কিসের লোভে এনু ॥
কী ডাক ডাকে বনের পাতাগুলি, কার ইশারা-তৃণের অঙ্গুলি ! প্রাণেশ আমার লীলাভরে খেলেন প্রাণের খেলাঘরে, পাখির মুখে এই-যে খবর পেনু ॥
আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব— ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ, জীবন নব নব ॥ কত-যে গিরি কত-যে নদী-তীরে বেড়ালে বহি ছোটো এ বাঁশিটিরে, কত-যে তান বাজালে ফিরে ফিরে কাহারে তাহা কব ॥ তোমারি ওই অমৃতপরশে আমার হিয়াখানি হারালো সীমা বিপুল হরষে, উথলি উঠে বাণী। আমার শুধু একটি মুঠি ভরি দিতেছ দান দিবস-বিভাবরী— হল না সারা কত-না যুগ ধরি কেবলই আমি লব ॥
প্রভু, বলো বলো কবে তোমার পথের ধুলার রঙে রঙে আঁচল রঙিন হবে। তোমার বনের রাঙা ধূলি ফুটায় পূজার কুসুমগুলি, সেই ধূলি হায় কখন আমায় আপন করি লবে ? প্রণাম দিতে চরণতলে ধুলার কাঙাল যাত্রীদলে চলে যারা, আপন ব’লে চিনবে আমায় সবে ॥
আমার না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে তোমার ভাবনা তারার মতন রাজে ॥ নিভৃত মনের বনের ছায়াটি ঘিরে না-দেখা ফুলের গোপন গন্ধ ফিরে, আমার লুকায় বেদনা অঝরা অশ্রুনীরে— অশ্রুত বাঁশি হৃদয়গহনে বাজে ॥ ক্ষণে ক্ষণে আমি না জেনে করেছি দান তোমায় আমার গান। পরানের সাজি সাজাই খেলার ফুলে, জানি না কখন নিজে বেছে লও তুলে— তুমি অলখ আলোকে নীরবে দুয়ার খুলে প্রাণের পরশ দিয়ে যাও মোর কাজে ॥
আমার হৃদয় তোমার আপন হাতের দোলে দোলাও, কে আমারে কী-যে বলে ভোলাও ভোলাও ॥ ওরা কেবল কথার পাকে নিত্য আমায় বেঁধে রাখে, বাঁশির ডাকে সকল বাঁধন খোলও ॥ মনে পড়ে, কত-না দিন রাতি আমি ছিলেম তোমার খেলার সাথি। আজকে তুমি তেমনি ক’রে সামনে তোমার রাখো ধরে, আমার প্রাণে খেলার সে ঢেউ তোলাও ॥
ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে ও বন্ধু আমার ! না পেয়ে তোমার দেখা, একা একা দিন যে আমার কাটে না রে ॥ বুঝি গো রাত পোহালো, বুঝি ওই রবির আলো আভাসে দেখা দিল গগন-পারে— সমুখে ওই হেরি পথ, তোমার কি রথ পৌঁছবে না মোর দুয়ারে ॥ আকাশের যত তারা চেয়ে রয় নিমেষহারা, বসে রয় রাত-প্রভাতের পথের ধারে। তোমারি দেখা পেলে সকল ফেলে ডুববে আলোক-পারাবারে। প্রভাতের পথিক সবে এল কি কলরবে— গেল কি গান গেয়ে ওই সারে সারে ! বুঝি-বা ফুল ফুটেছে, সুর উঠেছে অরুণবীণার তারে তারে ॥
তোমায় কিছু দেব ব’লে চায় যে আমার মন, নাই-বা তোমার থাকল প্রয়োজন॥ যখন তোমার পেলেম দেখা, অন্ধকারে একা একা ফিরতেছিলে বিজন গভীর বন। ইচ্ছা ছিল একটি বাতি জ্বালাই তোমার পথে, নাই-বা তোমার থাকল প্রয়োজন ॥ দেখেছিলেম হাটের লোকে তোমারে দেয় গালি, গায়ে তোমার ছড়ায় ধুলাবালি। অপমানের পথের মাঝে তোমার বীণা নিত্য বাজে আপন-সুরে-আপনি-নিমগন। ইচ্ছা ছিল বরণমালা পরাই তোমার গলে, নাই-বা তোমার থাকল প্রয়োজন ॥ দলে দলে আসে লোকে, রচে তোমার স্তব— নানা ভাষায় নানান কলরব। ভিক্ষা লাগি তোমার দ্বারে আঘাত করে বারে বারে কত-যে শাপ, কত-যে ক্রন্দন। ইচ্ছা ছিল বিনা পণে আপনাকে দিই পায়ে, নাই-বা তোমার থাকল প্রয়োজন ॥
আমার অভিমানের বদলে আজ নেব তোমার মালা আজ নিশিশেষে শেষ করে দিই চোখের জলের পালা ॥ আমার কঠিন হৃদয়টারে ফেলে দিলেম পথের ধারে, তোমার চরণ দেবে তারে মধুর পরশ পাষাণ-গালা ॥ ছিল আমার আঁধারখানি, তারে তুমিই নিলে টানি, তোমার প্রেম এল যে আগুন হয়ে— করল তারে আলা। সেই-যে আমার কাছে আমি ছিল সবার চেয়ে দামি, তারে উজার করে সাজিয়ে দিলেম তোমার বরণডালা॥
তুমি খুশি থাকো আমার পানে চেয়ে চেয়ে তোমার আঙিনাতে বেড়াই যখন বেড়াই গেয়ে গেয়ে ॥ তোমার পরশ আমার মাঝে সুরে সুরে বুকে বাজে, সেই আনন্দ নাচায় ছন্দ বিশ্বভুবন ছেয়ে ছেয়ে ॥ ফিরে ফিরে চিত্তবীণায় দাও যে নাড়া, গুঞ্জরিয়া গুঞ্জরিয়া দেয় সে সাড়া। তোমার আঁধার তোমার আলো দুই আমারে লাগল ভালো— আমার হাসি বেড়ায় ভাসি তোমার হাসি বেয়ে বেয়ে ॥
আমার সকল রসের ধারা তোমাতে আজ হোক না হারা ॥ জীবন জুড়ে লাগুক পরশ, ভুবন ব্যেপে জাগুক হরষ, তোমার রূপে মরুক ডুবে আমার দুটি আঁখিতারা ॥
হারিয়ে যাওয়া মনটি আমার ফিরিয়ে তুমি আনলে আবার । ছড়িয়ে-পড়া আশাগুলি কুড়িয়ে তুমি লও গো তুলি, গলার হারে দোলাও তারে গাঁথা তোমার ক’রে সারা ॥
রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে তোমায় আমায় দেখা হল সেই মোহানার ধারে॥ সেইখানেতে সাদায় কালোয় মিলে গেছে আঁধার আলোয়— সেইখানেতে ঢেউ ছুটেছে এ পারে ওই পারে॥ নিতলনীল নীরব মাঝে বাজল গভীর বাণী, নিকষেতে উঠল ফুটে সোনার রেখাখানি। মুখের পানে তাকাতে যাই, দেখি-দেখি দেখতে না পাই— স্বপন-সাথে জড়িয়ে জাগা, কাঁদি আকুল ধারে॥
আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে তখন কে তুমি তা কে জানত। তখন ছিল না ভয়, ছিল না লাজ মনে, জীবন বহে যেত অশান্ত ॥ তুমি ভোরের বেলা ডাক দিয়েছ কত যেন আমার আপন সখার মতো, হেসে তোমার সাথে ফিরেছিলেম ছুটে সে দিন কত-না বন-বনান্ত ॥ ওগো, সেদিন তুমি গাইতে যে-সব গান কোনো অর্থ তাহার কে জানত। শুধু সঙ্গে তারি গাইত আমার প্রাণ, সদা নাচত হৃদয় অশান্ত। হঠাৎ খেলার শেষে আজ কী দেখি ছবি— স্তব্ধ আকাশ, নীরব শশী রবি, তোমার চরণ-পানে নয়ন করি নত ভুবন দাঁড়িয়ে আছে একান্ত ॥
সীমার মাঝে, অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর — আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর॥ কত বর্ণে কত গন্ধে কত গানে কত ছন্দে অরূপ, তোমার রূপের লীলায় জাগে হৃদয়পুর। আমার মধ্যে তোমার শোভা এমন সুমধুর॥ তোমায় আমায় মিলন হলে সকলই যায় খুলে, বিশ্বসাগর ঢেউ খেলায়ে উঠে তখন দুলে। তোমার আলোয় নাই তো ছায়া, আমার মাঝে পায় সে কায়া, হয় সে আমার অশ্রুজলে সুন্দরবিধুর। আমার মধ্যে তোমার শোভা এমন সুমধুর॥
আজি যত তারা তব আকাশে
আমি কেমন করিয়া জানাব আমার জুড়ালো হৃদয় জুড়ালো- আমার জুড়ালো হৃদয় প্রভাতে। আমি কেমন করিয়া জানাব আমার পরান কী নিধি কুড়ালো- ডুবিয়া নিবিড় গভীর শোভাতে ॥
আজ গিয়েছি সবার মাঝারে, সেথায় দেখেছি আলোক-আসনে- দেখেছি আমার হৃদয়রাজারে। আমি দুয়েকটি কথা কয়েছি তা সনে সে নীরব সভা-মাঝারে- দেখেছি চিরজনমের রাজারে ॥ এই বাতাস আমারে হৃদয়ে লয়েছে, আলোক আমার তনুতে- কেমনে মিলে গেছে মোর তনুতে- তাই এ গগন-ভরা প্রভাত পশিল আমার অণুতে অণুতে। আজ ত্রিভুবন-জোড়া কাহার বক্ষে দেহ মন মোর ফুরালো- কেন রে নিঃশেষে আজি ফুরালো। আজ যেখানে যা হেরি সকলেরই মাঝে জুড়ালো জীবন জুড়ালো- আমার আদি ও অন্ত জুড়ালো ॥
প্রভু আমার, প্রিয় আমার পরম ধন হে। চিরপথের সঙ্গী আমার চিরজীবন হে ॥ তৃপ্তি আমার, অতৃপ্তি মোর, মুক্তি আমার, বন্ধনডোর, দুঃখসুখের চরম আমার জীবন মরণ হে ॥ আমার সকল গতির মাঝে পরমগতি হে, নিত্য প্রেমের ধামে আমার পরম পতি হে। ওগো সবার, ওগো আমার, বিশ্ব হতে চিত্তে বিহার— অস্তবিহীন লীলা তোমার নূতন নূতন হে ॥
তুমি বন্ধু, তুমি নাথ, নিশিদিন তুমি আমার। তুমি সুখ, তুমি শান্তি, তুমি হে অমৃতপাথার ॥ তুমিই তো আনন্দলোক, জুড়াও প্রাণ, নাশো শোক,
তাপহরণ
তোমার চরণ অসীমশরণ দীনজনাব
॥ ও অকূলের কূল, ও অগতির গতি, ও অনাথের নাথ, ও পতিতের পতি। ও নয়নের আলো, ও রসনার মধু, ও রতনের হার, ও পরানের বঁধু। ও অপরূপ রূপ, ও মনোহর কথা, ও চরমের সুখ, ও মরমের ব্যথা। ও ভিখারির ধন, ও অবোলায় বোল— ও জনমের দোলা, ও মরণের কোল ॥
আমার মাঝে তোমারি মায়া জাগালে তুমি কবি। আপন-মনে আমারি পটে আঁকো মানস ছবি ॥ তাপস তুমি ধেয়ানে তব কী দেখ মোরে কেমনে কব, আপন-মনে মেঘস্বপন আপনি রচ রবি। তোমার জটে আমি তোমারি ভাবের জাহ্নবী ॥ তোমারি সোনা বোঝাই হল, আমি তো তার ভেলা- নিজেরে তুমি ভোলাবে ব'লে আমারে নিয়ে খেলা। কণ্ঠে মম কী কথা শোন অর্থ আমি বুঝি না কোনো, বীণাতে মোর কাঁদিয়া ওঠে তোমারি ভৈরবী। মুকুল মম সুবাস তব গোপনে সৌরভী ॥
ভুলে যাই থেকে থেকে তোমার আসন-’পরে বসাতে চাই নাম আমাদের হেঁকে হেঁকে ॥ দ্বারী মোদের চেনে না যে, বাধা দেয় পথের মাঝে ॥ বাহিরে দাঁড়িয়ে আছি, লও ভিতরে ডেকে ডেকে ॥ মোদের প্রাণ দিয়েছে আপন হাতে, মান দিয়েছ তারি সাথে। থেকেও সে মান থাকে না যে লোভে আর ভয়ে লাজে— ম্লান হয় দিনে দিনে যায় ধুলাতে ঢেকে ঢেকে ॥
তোমার এই মাধুরী ছাপিয়ে আকাশ ঝরবে, আমার প্রাণে নইলে সে কি কোথাও ধরবে ?। এই-যে আলো সূর্যে গ্রহে তারায় ঝ’রে পড়ে শতলক্ষ ধারায়, পূর্ণ হবে এ প্রাণ যখন ভরবে ॥ তোমার ফুলে যে রঙ ঘুমের মতো লাগল আমার মনে লেগে তবে সে যে জাগল গো। যে প্রেম কাঁপায় বিশ্ববীণায় পুলকে সঙ্গীতে সে উঠবে ভেসে পলকে যে দিন আমার সকল হৃদয় হরবে ॥
এরে ভিখারি সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে, হাসিতে আকাশ ভরিলে ॥ পথে পথে ফেরে, দ্বারে দ্বারে যায়, ঝুলি ভরি রাখে যাহা-কিছু পায়— কতবার তুমি পথে এসে, হায়, ভিক্ষার ধন হরিলে ॥ ভেবেছিল চির-কাঙাল সে এই ভুবনে, কাঙাল মরণে জীবনে। ওগো মহারাজা, বড়ো ভয়ে ভয়ে দিনশেষে এল তোমারি আলয়ে— আধেক আসনে তারে ডেকে লয়ে নিজ মালা দিয়ে বরিলে ॥
আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না। এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা ॥ কত জনম-মরণেতে তোমারি ওই চরণেতে আপনাকে যে দেব, তবু বাড়বে দেনা ॥ আমারে যে নামতে হবে ঘাটে ঘাটে, বারে বারে এই ভুবনের প্রাণের হাটে। ব্যবসা মোর তোমার সাথে চলবে বেড়ে দিনে রাতে, আপনা নিয়ে করব যতই বেচা কেনা ॥
তুমি যে এসেছ মোর ভবনে রব উঠেছে ভুবনে ॥ নহিলে ফুলে কিসের রঙ লেগেছে, গগনে কোন্ গান গানে জেগেছে, কোন্ পরিমল পবনে ॥ দিয়ে দুঃখসুখের বেদনা আমায় তোমার সাধনা। আমার ব্যথায় ব্যথায় পা ফেলিয়া এলে তোমার সুর মেলিয়া, এলে আমার জীবনে ॥
তুমি যে চেয়ে আছ আকাশ ভ’রে, নিশিদিন অনিমেষে দেখেছ মোরে ॥ আমি চোখ এই আলোকে মেলব যবে তোমার ওই চেয়ে-দেখা সফল হবে, এ আকাশ দিন গুনিছে তারি তরে ॥ ফাগুনের কুসুম-ফোটা হবে ফাঁকি আমার এই একটি কুঁড়ি রইলে বাকি। সে দিনে ধন্য হবে তারার মালা তোমার এই লোকে লোকে প্রদীপ জ্বালা আমার এই আঁধারটুকু ঘুচলে পরে ॥
আমার বাণী আমার প্রাণে লাগে— যত তোমায় ডাকি, আমার আপন হৃদয় জাগে ॥ শুধু তোমায় চাওয়া সেও আমার পাওয়া, তাই তো পরান পরানপণে হাত বাড়িয়ে মাগে ॥ হায় অশক্ত, ভয়ে থাকিস পিছে। লাগলে সেবায় অশক্তি তোর আপনি হবে মিছে। পথ দেখাবার তরে যাব কাহার ঘরে— যেমনি আমি চলি, তোমার প্রদীপ চলে আগে ॥
অসীম ধন তো আছে তোমার, তাহে সাধ না মেটে। নিতে চাও তা আমার হাতে কণায় কণায় বেঁটে ॥ দিয়ে রতন মণি, দিয়ে তোমার রতন মণি আমায় করলে ধনী— এখন দ্বারে এসে ডাকো, রয়েছি দ্বার এঁটে ॥ আমায় তুমি করবে দাতা, আপনি ভিক্ষু হবে— বিশ্বভুবন মাতল যে তাই হাসির কলরবে। তুমি রইবে না ওই রথে, তুমি রইবে না ওই রথে নামবে ধুলাপথে যুগ-যুগান্ত আমার সাথে চলবে হেঁটে হেঁটে ॥
যদি আমায় তুমি বাঁচাও, তবে তোমার নিখিল ভুবন ধন্য হবে ॥ যদি আমার মনের মলিন কালী ঘুচাও পুণ্যসলিল ঢালি তোমার চন্দ্র সূর্য নূতন আলোয় জাগিবে জ্যোতির মহোত্সবে ॥ আজও ফোটে নি মোর শোভার কুঁড়ি, তারি বিষাদ আছে জগত্ জুড়ি। যদি নিশার তিমির গিয়ে টুটে আমার হৃদয় জেগে ওঠে, তবে মুখর হবে সকল আকাশ আনন্দময় গানের রবে ॥
যিনি সকল কাজের কাজী মোরা তাঁরি কাজের সঙ্গী। যাঁর নানা রঙের রঙ্গ মোরা তাঁরি রসের রঙ্গী ॥ তাঁর বিপুল ছন্দে ছন্দে মোরা যাই চলে আনন্দে, তিনি যেমনি বাজান ভেরী মোদের তেমনি নাচের ভঙ্গী ॥ এই জন্ম-মরণ-খেলায় মোরা মিলি তাঁরি মেলায়, এই দুঃখসুখের জীবন মোদের তাঁরি খেলার অঙ্গী। ওরে ডাকেন তিনি যবে তাঁর জলদ-মন্দ্র রবে ছুটি পথের কাঁটা পায়ে দ’লে সাগর গিরি লঙ্ঘি ॥
আমরা তারেই জানি তারেই জানি সাথের সাথি, তারেই করি টানা টানি ॥ সঙ্গে তারি চরাই ধেনু, বাজাই বেণু, তারি লাগি বটের ছায়ায় আসন পাতি ॥ তারে হালের মাঝি করি চালাই তরী, ঝড়ের বেলায় ঢেউয়ের খেলায় মাতামাতি। সারা দিনের কাজ ফুরালে সন্ধ্যাকালে তাহারি পথ চেয়ে ঘরে জ্বালাই বাতি ॥
যা হবার তা হবে। যে আমারে কাঁদায় সে কি অমনি ছেড়ে রবে ?। পথ হতে যে ভুলিয়ে আনে পথ যে কোথায় সেই তা জানে, ঘর যে ছাড়ায় হাত যে বাড়ায়— সেই তো ঘরে লবে ॥
অন্ধকারের মাঝে আমায় ধরেছ দুই হাতে। কখন্ তুমি এলে, হে নাথ, মৃদু চরণপাতে ?। ভেবেছিলেম, জীবনস্বামী, তোমায় বুঝি হারাই আমি- আমায় তুমি হারাবে না বুঝেছি আজ রাতে ॥ যে নিশীথে আপন হাতে নিবিয়ে দিলেম আলো তারি মাঝে তুমি তোমার ধ্রুবতারা জ্বালো। তোমার পথে চলা যখন ঘুচে গেল, দেখি তখন আপনি তুমি আমার পথে লুকিয়ে চল সাথে ॥
হে মোর দেবতা, ভরিয়া এ 'দেহ প্রাণ কী অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান। আমার নয়নে তোমার বিশ্বছবি দেখিয়া লইতে সাধ যায় তব কবি, আমার মুগ্ধ শ্রবণে নীরব রহি শুনিয়া লইতে চাহ আপনার গান॥ আমার চিত্তে তোমার সৃষ্টিখানি রচিয়া তুলিছে বিচিত্র তব বাণী। তারি সাথে, প্রভু, মিলিয়া তোমার প্রীতি জাগায়ে তুলিছে আমার সকল গীতি— আপনারে তুমি দেখিছ মধুর রসে আমার মাঝারে নিজেরে করিয়া দান॥
শুধু কি তার বেঁধেই তোর কাজ ফুরাবে গুণী মোর, ও গুণী! বাঁধা বীণা রইবে পড়ে এমনি ভাবে গুণী মোর, ও গুণী! তা হলে হার হল যে হার হল, শুধু বাঁধাবাঁধিই সার হল গুণী মোর, ও গুণী! বাঁধনে যদি তোমার হাত লাগে তা হলেই সুর জাগে, গুণী মোর, ও গুণী! না হলে, ধুলায় প'ড়ে লাজ কুড়াবে॥
আমারে তুমি কিসের ছলে পাঠাবে দূরে, আবার আমি চরণতলে আসিব ঘুরে ॥ সোহাগ করে করিছ হেলা টানিবে ব’লে দিতেছ ঠেলা- হে রাজা, তব কেমন খেলা রাজ্য জুড়ে ॥
সভায় তোমার থাকি সবার শাসনে, আমার কণ্ঠে সেথায় সুর কেঁপে যায় ত্রাসনে॥ তাকায় সকল লোকে, তখন দেখতে না পাই চোখে কোথায় অভয় হাসি হাসো আপন আসনে॥ কবে আমার এ লজ্জাভয় খসাবে, তোমার একলা ঘরের নিরালাতে বসাবে। যা শোনাবার আছে গাব ওই চরণের কাছে, দ্বারের আড়াল হতে শোনে বা কেউ না-শোনে॥
তোমার প্রেমে ধন্য কর যারে সত্য ক’রে পায় সে আপনারে ॥ দুঃখে শোকে নিন্দা-পরিবাদে চিত্ত তার ডোবে না অবসাদে, টুটে না বল সংসারের ভারে ॥ পথে যে তার গৃহের বাণী বাজে, বিরাম জাগে কঠিন তার কাজে। নিজেরে সে যে তোমারি মাঝে দেখে, জীবন তার বাধায় নাহি ঠেকে, দৃষ্টি তার আঁধার-পরপারে ॥
লুকিয়ে আস আঁধার রাতে, তুমি আমার বন্ধু! লও যে টেনে কঠিন হাতে, তুমি আমার আনন্দ॥ দুঃখরথের তুমিই রথী, তুমিই আমার বন্ধু। তুমি সঙ্কট তুমিই ক্ষতি, তুমি আমার আনন্দ ॥ শত্রু আমারে করো গো জয়, তুমিই আমার বন্ধু। রুদ্র তুমি হে ভয়ের ভয়, তুমি আমার আনন্দ॥ বজ্র এসো হে বক্ষ চিরে, তুমিই আমার বন্ধু। মৃত্যু লও হে বাঁধন ছিড়ে, তুমি আমার আনন্দ॥
তুমি কি এসেছ মোর দ্বারে খুঁজিতে আমার আপনারে। তোমারি যে ডাকে কুসুম গোপন হতে বাহিরায় নগ্ন শাখে শাখে, সেই ডাকে ডাকো আজি তারে ॥ তোমারি সে ডাকে বাধা ভোলে, শ্যামল গোপন প্রাণ ধূলি-অবগুণ্ঠন খোলে সে ডাকে তোমারি সহসা নবীন উষা আসে হাতে আলোকের ঝারি, দেয় সাড়া ঘন অন্ধকারে ॥
আজ আলোকের এই ঝর্নাধারায় ধুইয়ে দাও। আপনাকে এই লুকিয়ে-রাখা ধুলার ঢাকা ধুইয়ে দাও॥ যে জন আমার মাঝে জড়িয়ে আছে ঘুমের জালে আজ এই সকালে ধীরে ধীরে তার কপালে এই অরুণ আলোর সোনার-কাঠি ছুঁইয়ে দাও। বিশ্বহৃদয়-হতে-ধাওয়া আলোয়-পাগল প্রভাত-হাওয়া, সেই হাওয়াতে হৃদয় আমার নুইয়ে দাও॥ আজ নিখিলের আনন্দধারায় ধুইয়ে দাও, মনের কোণের সব দীনতা মলিনতা ধুইয়ে দাও। আমার পরান-বীণায় ঘুমিয়ে আছে অমৃতগান— তার নাইকো বাণী, নাইকো ছন্দ, নাইকো তান। তারে আনন্দের এই জাগরণী ছুঁইয়ে দাও। বিশ্বহৃদয়-হতে-ধাওয়া প্রাণে-পাগল গানের হাওয়া, সেই হাওয়াতে হৃদয় আমার নুইয়ে দাও॥
এ অন্ধকার ডুবাও তোমার অতল অন্ধকারে ওহে অন্ধকারের স্বামী। এসো নিবিড়, এসো গভীর, এসো জীবন-পারে আমার চিত্তে এসো নামি। এ দেহ মন মিলিয়ে যাক, হইয়া যাক হারা ওহে অন্ধকারের স্বামী। বাসনা মোর, বিকৃতি মোর, আমার ইচ্ছাধারা ওই চরণে যাক থামি। নির্বাসনে বাঁধা আছি দুর্বাসনার ডোরে ওহে অন্ধকারের স্বামী । সব বাঁধনে তোমার সাথে বন্দী করো মোরে— ওহে, আমি বাঁধন-কামী। আমার প্রিয়, আমার শ্রেয়, আমার হে পরম, ওহে অন্ধকারের স্বামী, সকল ঝ’রে সকল ভ’রে আসুক সে চরম— ওগো, মরুক-না এই আমি
ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা প্রভু, তোমার পানে, তোমার পানে, তোমার পানে। যায় যেন মোর সকল গভীর আশা প্রভু, তোমার কানে, তোমার কানে, তোমার কানে ॥ চিত্ত মম যখন যেথা থাকে সাড়া যেন দেয় সে তব ডাকে, যত বাঁধন সব টুটে গো যেন প্রভু, তোমার টানে, তোমার টানে, তোমার টানে ॥ বাহিরের এই ভিক্ষা-ভরা থালি এবার যেন নিঃশেষে হয় খালি, অন্তর মোর গোপনে যায় ভরে প্রভু, তোমার দানে, তোমার দানে, তোমার দানে। হে বন্ধু মোর, হে অন্তরতর, এ জীবনে যা-কিছু সুন্দর সকলই আজ বেজে উঠুক সুরে প্রভু, তোমার গানে, তোমার গানে, তোমার গানে ॥
জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো ॥ কর্ম যখন প্রবল-আকার গরজি উঠিয়া ঢাকে চারি ধার হৃদয়প্রান্তে, হে জীবননাথ, শান্ত চরণে এসো ॥ আপনারে যবে করিয়া কৃপণ কোণে পড়ে থাকে দীনহীন মন দুয়ার খুলিয়া, হে উদার নাথ, রাজসমারোহে এসো। বাসনা যখন বিপুল ধুলায় অন্ধ করিয়া অবোধে ভুলায়, ওহে পবিত্র, ওহে অনিদ্র, রুদ্র আলোকে এসো ॥
পাত্রখানা যায় যদি যাক ভেঙেচুরে— আছে অঞ্জলি মোর, প্রসাদ দিয়ে দাও-না পূরে ॥ সহজ সুখের সুধা তাহার মূল্য তো নাই, ছড়াছড়ি যায় সে-যে ওই যেখানে চাই— বড়ো-আপন কাছের জিনিস রইল দূরে। হৃদয় আমার সহজ সুধায় দাও-না পূরে ॥ বারে বারে চাইব না আর মিথ্যা টানে ভাঙন-ধরা আঁধার-করা পিছন-পানে। বাসা বাঁধার বাধঁনখানা যাক-না টুটে, অবাধ পথের শূন্যে আমি চলব ছুটে। শূন্য ভরা তোমার বাঁশি সুরে সুরে হৃদয় আমার সহজ সুধায় দাও-না পূরে ॥
গাব তোমার সুরে দাও সে বীণাযন্ত্র, শুনব তোমার বাণী দাও সে অমর মন্ত্র। করব তোমার সেবা দাও সে পরম শক্তি, চাইব তোমার মুখে দাও সে অচল ভক্তি॥ সইব তোমার আঘাত দাও সে বিপুল ধৈর্য, বইব তোমার ধ্বজা দাও সে অটল স্থৈর্য॥ নেব সকল বিশ্ব দাও সে প্রবল প্রাণ, করব আমায় নিঃস্ব দাও সে প্রেমের দান॥ যাব তোমার সাথে দাও সে দখিন হস্ত, লড়ব তোমার রণে দাও সে তোমার অস্ত্র॥ জাগব তোমার সত্যে দাও সেই আহবান। ছাড়ব সুখের দাস্য, দাও দাও কল্যাণ॥
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে তোমারি সুরটি আমার মুখের ’পরে বুকের ’পরে॥ পুরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে দুই নয়ানে— নিশীথের অন্ধকারে গভীর ধারে পড়ুক প্রাণে। নিশিদিন এই জীবনের সুখের ’পরে দুখের ’পরে শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে। যে শাখায় ফুল ফোটে না, ফল ধরে না একেবারে, তোমার ওই বাদল-বায়ে দিক জাগায়ে সেই শাখারে। যা-কিছু জীর্ণ আমার, দীর্ণ আমার, জীবনহারা, তাহারি স্তরে স্তরে পড়ুক ঝরে সুরের ধারা। নিশিদিন এই জীবনের তৃষার ’পরে, ভুখের ’পরে শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে॥
বাজাও আমারে বাজাও বাজালে যে সুরে প্রভাত-আলোরে সেই সুরে মোরে বাজাও ॥ যে সুর ভরিলে ভাষাভোলা গীতে শিশুর নবীন জীবনবাঁশিতে জননীর-মুখ-তাকানো হাসিতে- সেই সুরে মোরে বাজাও ॥ সাজাও আমারে সাজাও। যে সাজে সাজালে ধরার ধূলিরে সেই সাজে মোরে সাজাও। সন্ধ্যামালতী সাজে যে ছন্দে শুধু আপনারই গোপন গন্ধে, যে সাজ নিজেরে ভোলে আনন্দে- সেই সাজে মোরে সাজাও ॥
তুমি যত ভার দিয়েছ সে ভার করিয়া দিয়েছ সোজা। আমি যত ভার জমিয়ে তুলেছি সকলই হয়েছে বোঝা। এ বোঝা আমার নামাও বন্ধু, নামাও— ভারের বেগেতে চলেছি কোথায়, এ যাত্রা তুমি থামাও ॥ আপনি যে দুখ ডেকে আনি সে-যে জ্বালায় বজ্রানলে— অঙ্গার ক’রে রেখে যায়, সেথা কোনো ফল নাহি ফলে। তুমি যাহা দাও সে-যে দুঃখের দান শ্রাবণধারায় বেদনার রসে সার্থক করে প্রাণ ॥ যেখানে যা-কিছু পেয়েছি কেবলই সকলই করেছি জমা— যে দেখে সে আজ মাগে-যে হিসাব, কেহ নাহি করে ক্ষমা এ বোঝা আমার নামাও বন্ধু, নামাও— ভারের বেগেতে ঠেলিয়া চলেছি, এ যাত্রা মোর থামাও ॥ |