ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী
রচনাবলী সূচি

মহুয়া
 


 

                আশীর্বাদ
জ্বলিল অরুণরশ্মি আজি ওই তরুণ প্রভাতে
     হে নবীনা, নবরাগরক্তিম শোভাতে ।
           সীমন্তে সিন্দূরবিন্দু তব
           জ্যোতি আজি পেল অভিনব,
চেলাঞ্চলে উদ্ভাসিল অন্তরের দীপ্যমান প্রভা,
শরমের বৃন্তে তুমি আনন্দের বিকশিত জবা ।

সাহানা রাগিণীরসে জড়িত আজি এ পুণ্যতিথি,
     তোমার ভুবনে আসে পরম অতিথি ।
           আনো আনো মাঙ্গল্যের ভার,
           দাও বধূ, খুলে দাও দ্বার,
তোমার অঙ্গনে হেরো সগৌরবে ওই রথ আসে,
সেই বার্তা আজি বুঝি উদ্‌ঘোষিল আকাশে বাতাসে ।

নবীন জীবনে তব নববিশ্ব রচনার ভাষা
     আজি বুঝি পূর্ণ হল লয়ে নব আশা ।
         সৃষ্টির সে আনন্দ-উৎসবে
         তব শ্রেষ্ঠধন দিতে হবে,
সেই সৃষ্টিসাধনায় আপনি করিবে আবিষ্কার
তোমার আপনা-মাঝে লুকানো যে ঐশ্বর্যভাণ্ডার ।

পথ কে দেখাল এই পথিকেরে তাহা আমি জানি,
     ওই চক্ষুতারা তারে দ্বারে দিল আনি ।
             যে সুর নিভৃতে ছিল প্রাণে
            কেমনে তা শুনেছিল কানে,
তোমার হৃদয়কুঞ্জে যে ফুল ছায়ায় ছিল ফুটে
তাহার অমৃতগন্ধ গিয়েছিল বন্ধ তার টুটে ।

যদি পারিতাম আজি অলকার দ্বারীরে ভুলায়ে
      হরিয়া অমূল্য মণি অলকেতে দিতাম দুলায়ে ।
            তবু মোর মন মোরে কহে
            সে-দান তোমার যোগ্য নহে,
তোমায় কমলবনে দিব আনি রবির প্রসাদ,
তোমার মিলনক্ষণে সঁপিব কবির আশীর্বাদ ।

 

আশ্বিন ? ১৩৩৫


            নববধূ
চলেছে উজান ঠেলি তরণী তোমার,
            দিক্‌প্রান্তে নামে অন্ধকার ।
কোন্‌ গ্রামে যাবে তুমি, কোন্‌ ঘাটে হে বধূবেশিনী,
             ওগো বিদেশিনী!
উৎসবের বাঁশিখানি কেন-যে কে জানে
ভরেছে দিনান্তবেলা ম্লান মূলতানে,
তোমারে পরালো সাজ মিলি সখীদল
            গোপনে মুছিয়া চক্ষুজল ।

মৃদুস্রোত নদীখানি ক্ষীণ কলকলে
         স্তিমিত বাতাসে যেন বলে —
‘ কত বধূ গিয়েছিল কতকাল এই স্রোত বাহি
          তীরপানে চাহি ।
ভাগ্যের বিধাতা কোনো কহেন নি কথা,
নিস্তব্ধ ছিলেন চেয়ে লজ্জাভয়ে নতা
তরুণী কন্যার পানে, তরী-'পরে ছিলেন গোপনে
         তরুণীর কাণ্ডারীর সনে । '

কোন্‌ টানে জানা হতে অজানায় চলে
        আধো হাসি আধো অশ্রুজলে ।
ঘর ছেড়ে দিয়ে তবে ঘরখানি পেতে হয় তারে
             অচেনার ধারে ।
ওপারের গ্রাম দেখো আছে ওই চেয়ে,
বেলা ফুরাবার আগে চলো তরী বেয়ে,
ওই ঘাটে কত বধূ কত শত বর্ষ বর্ষ ধরি
        ভিড়ায়েছে ভাগ্যভীরু তরী ।

জনে জনে রচি গেল কালের কাহিনী,
         অনিত্যের নিত্যপ্রবাহিনী ।
জীবনের ইতিবৃত্তে নামহীন কর্ম-উপহার
         রেখে গেল তার ।
আপনার প্রাণসূত্রে যুগ যুগান্তর
গেঁথে গেঁথে চলে গেল না রাখি স্বাক্ষর,
ব্যথা যদি পেয়ে থাকে না রহিল কোনো তার ক্ষত,
         লভিল মৃত্যুর সদাব্রত ।

তাই আজি গোধূলির নিস্তব্ধ আকাশ
         পথে তব বিছালো আশ্বাস ।
কহিল সে কানে কানে, প্রাণ দিয়ে ভরা যার বুক
            সেই তার সুখ ।
রয়েছে কঠোর দুঃখ রয়েছে বিচ্ছেদ,
তবু দিন পূর্ণ হবে, রহিবে না খেদ
যদি বলে যাও বধূ, ‘ আলো দিয়ে জ্বেলেছিনু আলো,
         সব দিয়ে বেসেছিনু ভালো । '

 

১৯ আশ্বিন  ১৩৩৫