ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী
রচনাবলী সূচি

মহুয়া
 


 

               বিদায়
কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও ।
      তারি রথ নিত্যই উধাও
জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন,
চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন ।

      ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল —
        তুলে নিল দ্রুতরথে
     দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে
          তোমা হতে বহুদূরে ।
          মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে
          পার হয়ে আসিলাম
আজি নবপ্রভাতের শিখরচূড়ায়,
রথের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় উড়ায়
        আমার পুরানো নাম ।
           ফিরিবার পথ নাহি ;
           দূর হতে যদি দেখ চাহি
             পারিবে না চিনিতে আমায় ।
                  হে বন্ধু, বিদায় ।

কোনোদিন কর্মহীন পূর্ণ অবকাশে,
            বসন্তবাতাসে
অতীতের তীর হতে যে রাত্রে বহিবে দীর্ঘশ্বাস,
           ঝরা বকুলের কান্না ব্যথিবে আকাশ,
সেইক্ষণে খুঁজে দেখো, কিছু মোর পিছে রহিল সে
          তোমার প্রাণের প্রান্তে ; বিস্মৃতপ্রদোষে
          হয়তো দিবে সে জ্যোতি,
হয়তো ধরিবে কভু নামহারা-স্বপ্নের মুরতি ।
          তবু সে তো স্বপ্ন নয়,
সব চেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয়,
            সে আমার প্রেম ।
            তারে আমি রাখিয়া এলেম
অপরিবর্তন অর্ঘ্য তোমার উদ্দেশে ।
        পরিবর্তনের স্রোতে আমি যাই ভেসে
               কালের যাত্রায় ।
               হে বন্ধু, বিদায় ।

       তোমার হয় নি কোনো ক্ষতি
মর্তের মৃত্তিকা মোর, তাই দিয়ে অমৃত-মুরতি
      যদি সৃষ্টি করে থাক, তাহারি আরতি
              হোক তব সন্ধ্যাবেলা ।
              পূজার সে খেলা
    ব্যাঘাত পাবে না মোর প্রত্যহের ম্লানস্পর্শ লেগে ;
           তৃষার্ত আবেগবেগে
ভ্রষ্ট নাহি হবে তার কোনো ফুল নৈবেদ্যের থালে ।
তোমার মানসভোজে সযত্নে সাজালে
যে ভাবরসের পাত্র বাণীর তৃষায়,
     তার সাথে দিব না মিশায়ে
যা মোর ধূলির ধন, যা মোর চক্ষের জলে ভিজে ।
      আজও তুমি নিজে
      হয়তো বা করিবে রচন
মোর স্মৃতিটুকু দিয়ে স্বপ্নাবিষ্ট তোমার বচন ।
     ভার তার না রহিবে, না রহিবে দায় ।
              হে বন্ধু, বিদায় ।

      মোর লাগি করিয়ো না শোক,
আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্বলোক ।
       মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই,
শূন্যেরে করিব পূর্ণ, এই ব্রত বহিব সদাই ।
উৎকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে
      সেই ধন্য করিবে আমাকে ।
      শুক্লপক্ষ হতে আনি

      রজনীগন্ধার বৃন্তখানি
              যে পারে সাজাতে
      অর্ঘ্যথালা কৃষ্ণপক্ষ-রাতে,
      যে আমারে দেখিবারে পায়
             অসীম ক্ষমায়
     ভালোমন্দ মিলায়ে সকলি,
এবার পূজায় তারি আপনারে দিতে চাই বলি ।
    তোমারে যা দিয়েছিনু, তার
    পেয়েছ নিঃশেষ অধিকার ।
    হেথা মোর তিলে তিলে দান,
করুণ মুহূর্তগুলি গণ্ডূষ ভরিয়া করে পান
       হৃদয়-অঞ্জলি হতে মম ।

       ওগো তুমি নিরুপম,
            হে ঐশ্বর্যবান,
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান;
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায় ।
         হে বন্ধু, বিদায় ।

 

ব্যালাব্রুয়ি। বাঙ্গালোর

৫ জুন ১৯২৮


           প্রণতি
     কত ধৈর্য ধরি
ছিলে কাছে দিবসশর্বরী ।
     তব পদ-অঙ্কনগুলিরে
কতবার দিয়ে গেছ মোর ভাগ্যপথের ধূলিরে ।
        আজ যবে
     দূরে যেতে হবে
        তোমারে করিয়া যাব দান
            তব জয়গান ।

কতবার ব্যর্থ আয়োজনে
     এ জীবনে
হোমাগ্নি উঠে নি জ্বলি,
        শূন্যে গেছে চলি
   হতাশ্বাস ধূমের কুণ্ডলী ।
   কতবার ক্ষণিকের শিখা
     আঁকিয়াছে ক্ষীণ টিকা
  নিশ্চেতন নিশীথের ভালে ।
লুপ্ত হয়ে গেছে তাহা চিহ্নহীন কালে ।

      এবার তোমার আগমন
           হোমহুতাশন
              জ্বেলেছে গৌরবে ।
      যজ্ঞ মোর ধন্য হবে ।
    আমার আহুতি দিনশেষে
করিলাম সমর্পণ তোমার উদ্দেশে ।

লহো এ প্রণাম —
     জীবনের পূর্ণ পরিণাম ।
            এ প্রণতি ' -পরে
স্পর্শ রাখো স্নেহভরে ।
     তোমার ঐশ্বর্য-মাঝে
সিংহাসন যেথায় বিরাজে
    করিয়ো আহ্বান,
সেথা এ প্রণতি মোর পায় যেন স্থান ।
 

বাঙ্গালোর
আষাঢ় ১৩৩৫