ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী
রচনাবলী সূচি

মহুয়া
 


 

                    বিরহ
শঙ্কিত আলোক নিয়ে দিগন্তে উদিল শীর্ণ শশী,
অরণ্যে শিরীষশাখে অকস্মাৎ উঠিল উচ্ছ্বসি
             বসন্তের হাওয়ার খেয়াল,
ব্যথায় নিবিড় হল শেষ বাক্য বলিবার কাল ।

গোধূলির গীতিশূন্য স্তম্ভিত প্রহরখানি বেয়ে
শান্ত হল শেষ দেখা — নির্নিমেষ রহিলাম চেয়ে ।
      ধীরে ধীরে বনান্তে মিলালো
প্রান্তরের প্রান্ততটে অস্তশেষ ক্ষীণ পাংশু আলো ।

যে দ্বার খুলিয়া গেলে রুদ্ধ সে হবে না কোনোমতে ।
কান পাতি রবে তব ফিরিবার প্রত্যাশার পথে —
          তোমার অমূর্ত আসা-যাওয়া
যে পথে চঞ্চল করে দিগ্‌বালার অঞ্চলের হাওয়া ।

বসন্তে মাঘের অন্তে আম্রবনে মুকুলমত্ততা
মধুপগুঞ্জনে মিশি আনে কোন্‌ কানে-কানে কথা ।
            মোর নাম তব-কণ্ঠে-ডাকা
শান্ত আজি তাপক্লান্ত দিনান্তের মৌন দিয়ে ঢাকা ।

সঙ্গহীন স্তব্ধতার সুগম্ভীর নিবিড় নিভৃতে
বাক্যহারা চিত্তে মোর এতদিনে পাইনু শুনিতে
       তুমি কবে মর্মমাঝে পশি
আপন মহিমা হতে রেখে গেলে বাণী মহীয়সী ।

 

[শান্তিনিকেতন]
২৬ আষাঢ় ১৩৩৫


           বিদায়সম্বল
যাবার দিকের পথিকের 'পরে
      ক্ষণিকার স্নেহখানি
শেষ উপহার করুণ অধরে
      দিল কানে কানে আনি ।
‘ ভুলিব না কভু, রবে মনে মনে '
এই মিছে আশা দেয় খনে খনে,
ছলছল ছায়া নবীন নয়নে
      বাধোবাধো মৃদু বাণী ।

যাবার দিকের পথিক সে কথা
      ভরি লয় তার প্রাণে ।
পিছনের এই শেষ আকুলতা
      পাথেয় বলি সে জানে ।
যখন আঁধারে ভরিবে সরণী,
ভুলে-ভরা ঘুমে নীরব ধরণী,
‘ ভুলিব না কভু, ' এই ক্ষীণধ্বনি
       তখনো বাজিবে কানে ।

যাবার দিকের পথিক সে বোঝে —
       যে যায় সে যায় চ'লে,
যারা থাকে তারা এ উহারে খোঁজে,
      যে যায় তাহারে ভোলে ।
তবুও নিজেরে ছলিতে ছলিতে
বাঁশি বাজে মনে চলিতে চলিতে
‘ ভুলিব না কভু ' বিভাসে ললিতে
         এই কথা বুকে দোলে ।

 

সিঙাপুর
১৯ অগস্ট ১৯২৭