ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী
রচনাবলী সূচি

মহুয়া
 


 

               বরণ
          পুরাণে বলেছে
   একদিন নিয়েছিল বেছে
স্বয়ম্বরসভাঙ্গনে দময়ন্তী সতী
         নল-নরপতি
    ছদ্মবেশী দেবতার মাঝে ।
অর্ঘ্যহারা দেবতারা চলে গেল লাজে ।
     দেবমূর্তি চিনেছে সেদিন,
তারা যে ফেলে না ছায়া, তারা অমলিন ।
     সেদিন স্বর্গের ধৈর্য গেল টুটি,
          ইন্দ্রলোক করিল ভ্রূকুটি ।

তাই শুনে কত দিন একা বসে বসে
      ভেবেছিনু বালিকাবয়সে,
আমি হব স্বয়ম্বরা বিশ্বসভাতলে,
         দেবতারই গলে
         দিব মালা তপস্বিনী,
মানবের মাঝখানে একদিন লব তারে চিনি ।
      তারি লাগি সর্ব দেহে মনে
দিনে দিনে বরমাল্য গাঁথিব যতনে ।

          কঠিন সে পণ,
ভাবি নি কেমনে তারে করিব সাধন ।
       মানুষ-যে দেশে দেশে
       কত ফেরে দেবতার ছদ্মবেশে ;
     ললাটে তিলক কারো লেখা,
দেখিতে দেখিতে ওঠে কালো হয়ে তার স্বর্ণরেখা ।
      কারো-বা কটিতে বাঁধা শরশূন্য তূণ,
কেহ করে বজ্রধ্বনি, নাহি তাহে বজ্রের আগুন ।
         বাতায়নে বসে থাকি,
কতদিন কী দেখিয়া আশ্বাসে চমকি উঠে আঁখি ;
       চেয়ে চেয়ে দ্বিধা লাগে শেষে
বৃষ্টি হতে হতে দেখি শিলা পড়ে এসে ।
 

একদিন রৌদ্রের বেলায়
       মধ্যাহ্নের জনতার মুখর মেলায়
                রাজপথ-পাশে
দাঁড়াইনু — দেখিলাম যারা যায় আসে
                তাহাদের কায়া
সম্মুখে ফেলিয়া চলে দীর্ঘতর ছায়া ।
               শুনিলাম স্পর্ধাতীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর
ছিন্ন করে দিতে চাহে দেবতার অখণ্ড অম্বর ।
                   উজ্জ্বল সজ্জায়
দীন অঙ্গ সমাচ্ছন্ন ধনের লজ্জায় ।
        ছুটে চলে অশ্বরথ,
তার চেয়ে আড়ম্বরে সঙ্গে ওড়ে ধূলির পর্বত ।

যখন সেদিন সেই ঊর্ধ্বশ্বাস লুব্ধ ঠেলাঠেলি
        নানা শব্দে উঠিছে উদ্‌বেলি
তুমি দেখি পথপ্রান্তে একা হাস্যমুখে
         নিঃশব্দ কৌতুকে
চেয়ে আছ — হৃদয় আছিল জনস্রোতে,
       মন ছিল দূরে সবা হতে ।
তুমি যেন মহাকালসমুদ্রের তটে
         নিত্যের নিশ্চল চিত্তপটে
    দেখেছিলে চঞ্চলের চলমান ছবি,
শুনেছিলে ভৈরবের ধ্যান-মাঝে উমার ভৈরবী ।
          বহে গেল জনতার ঢেউ,
      কে-যে তুমি কোথা আছ দেখে নাই কেউ ।
              একা আমি দেখেছি তোমারে —
তুমিই ফেল নি ছায়া ছায়ার মাঝারে ।
মালা হাতে গেনু ধেয়ে,
       হাসিলে আমার পানে চেয়ে ।
             মোর স্বয়ম্বরে
সেদিন মর্ত্যের মুখ ভ্রূকুটিল অবজ্ঞার ভরে ।

২৬ অগষ্ট ১৯২৮