ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী
রচনাবলী সূচি

মহুয়া
 


 

       ছায়ালোক
যেথায় তুমি গুণী জ্ঞানী, যেথায় তুমি মানী,
          যেথায় তুমি তত্ত্ববিদের সেরা,
আমি সেথায় লুকিয়ে যেতে পথ পাব না জানি,
          সেথায় তুমি লোকের ভিড়ে ঘেরা ।
    সেথায় তোমার বুদ্ধি সদাই জাগে,
    চক্ষে তোমার আবেশ নাহি লাগে,
    আমার ভীরু হৃদয় ছায়া মাগে,
         তোমার সেথায় আলোক খরতর,
    যখন সেথা চাহ আমার বাগে
        সংকোচে প্রাণ কাঁপে থর থর ।

মোহভাঙা দৃষ্টি তোমার যখন আঘাত হানে,
       যায় নিখিলের রহস্যদ্বার টুটে,
এক নিমেষে অপরূপের রূপের মধ্যখানে
      অন্ত্র যন্ত্র প্রকাশ পেয়ে উঠে ।
   বসুন্ধরার শ্যামল প্রাণের ঢাকা
   রূঢ় পাথর গোপন ক ' রে রাখা,
   ভিতরে তার কতই আঁকাবাঁকা
       কতকালের দাহন-ইতিহাসে,
   ফাটলধরা কত-যে দাগ আঁকা
       তোমার চোখে বাহির হয়ে আসে ।

তেমনি করে যখন কভু আমার পানে চাবে
        মর্মভেদী কৌতূহলের আঁখি,
বিধাতা যা লুকান লাজে দেখতে-যে তাই পাবে
       মোর রচনায় যা আছে তাঁর বাকি ।
    আমার মাঝে তোমার অগোচরে
    আদিম যুগের গোপন গভীর স্তরে
    অপূর্ণতা রয়েছে অন্তরে,
       সৃষ্টি আমার অসমাপ্ত আছে,
সামনে এলে মরি-যে সেই ডরে
   ভাঙাচোরা চক্ষে পড়ে পাছে ।

তোমার প্রাণে কোনোখানে নাই কি মায়ার ঠাঁই
      মত্ততাহীন তত্ত্বপরপারে,
যেথায় তীক্ষ্ম চোখের কোনো প্রশ্ন জেগে নাই
       অসতর্ক মুক্ত হৃদয়দ্বারে ?
   যেথায় তুমি দৃষ্টিকর্তা নহ,
   সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টি লয়ে রহ,
   যেথা নানা বর্ণের সংগ্রহ,
       যেথা নানা মূর্তিতে মন মাতে,
   যেথা তোমার অতৃপ্ত আগ্রহ
       আপন-ভোলা রসের রচনাতে ।

সেথায় আমি যাব যখন চৈত্ররজনীতে
      বনের বাণী হাওয়ায় নিরুদ্দেশা,
চাঁদের আলোয় ঘুম-হারানো পাখির কলগীতে
      পথ-হারানো ফুলের রেণু মেশা ।
   দেখবে আমায় স্বপন-দেখা চোখে,
   চমকে উঠে বলবে তুমি, ‘ ও কে,
কোন্‌ দেবতার ছিল মানসলোকে,
      এল আমার গানের ডাকে ডাকা । '
সে রূপ আমার দেখবে ছায়ালোকে
      যে রূপ তোমার পরান দিয়ে আঁকা ।

৯ আশ্বিন ১৩৩৫