ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর -এর রচনাবলী
রচনাবলী সূচি

মহুয়া
 


 

              লগ্ন
প্রথম মিলনদিন, সে কি হবে নিবিড় আষাঢ়ে
         যেদিন গৈরিকবস্ত্র ছাড়ে
     আসন্নের আশ্বাসে সুন্দরা
           বসুন্ধরা ?
প্রাঙ্গণের চারি ধার ঢাকিয়া সজল আচ্ছাদনে
     যেদিন সে বসে প্রসাধনে
         ছায়ার আসন মেলি ;
    পরি লয় নূতন সবুজরঙা চেলি,
         চক্ষুপাতে লাগায় অঞ্জন,
    বক্ষে করে কদম্বের কেশর রঞ্জন ।
         দিগন্তের অভিষেকে
বাতাস অরণ্যে ফিরি নিমন্ত্রণ যায় হেঁকে হেঁকে ।
          যেদিন প্রণয়ীবক্ষতলে
মিলনের পাত্রখানি ভরে অকারণ অশ্রুজলে,
      কবির সংগীত বাজে গভীর বিরহে।–
            নহে নহে, সেদিন তো নহে ।

        সে কি তবে ফাল্গুনের দিনে,
যেদিন বাতাস ফিরে গন্ধ চিনে চিনে
          সবিস্ময়ে বনে বনে,
শুধায় সে মল্লিকারে কাঞ্চন-রঙ্গনে,
              তুমি কবে এলে ।
নাগকেশরের কুঞ্জ কেশর ধুলায় দেয় ফেলে
          ঐশ্বর্যগৌরবে ।
               কলরবে
        অজস্র মিশায় বিহঙ্গম
ফুলের বর্ণের সঙ্গে ধ্বনির সংগম ;

        অরণ্যের শাখায় শাখায়
প্রজাপতিসংঘ আনে পাখায় পাখায়
চিত্রলিপি, কুসুমেরি বিচিত্র অক্ষরে ;
       ধরণী যৌবনগর্বভরে
আকাশেরে নিমন্ত্রণ করে যবে
          উদ্দাম উৎসবে ;
কবির বীণার তন্ত্র যে বসন্তে ছিঁড়ে যেতে চাহে
             প্রমত্ত উৎসাহে ।
          আকাশে বাতাসে
          বর্ণের গন্ধের উচ্চহাসে
                 ধৈর্য নাহি রহে। —
নহে নহে, সেদিন তো নহে ।

       যেদিন আশ্বিনে শুভক্ষণে
আকাশের সমারোহ ধরণীতে পূর্ণ হয় ধনে ।
      প্রাচুর্যপ্রশান্ত তট পেয়েছে সঙ্গিনী
             তরঙ্গিণী —
তপস্বিনী সে-যে, তার গম্ভীর প্রবাহে
           সমুদ্রবন্দনাগান গাহে ।
    মুছিয়াছে নীলাম্বর বাষ্পসিক্ত চোখ
    বন্ধমুক্ত নির্মল আলোক ।
          বনলক্ষ্মী শুভব্রতা
শুভ্রের ধেয়ানে তার মেলিয়াছে অম্লান শুভ্রতা
         আকাশে আকাশে
         শেফালি মালতী কুন্দে কাশে ।
অপ্রগল্‌ভা ধরিত্রী-সে প্রণামে লুণ্ঠিত,
           পূজারিনী নিরবগুণ্ঠিত,
আলোকের আশীর্বাদে শিশিরের স্নানে
            দাহহীন শান্তি তার প্রাণে ।

          দিগন্তের পথ বাহি
                শূন্যে চাহি
       রিক্তবিত্ত শুভ্র মেঘ সন্ন্যাসী উদাসী
গৌরীশঙ্করের তীর্থে চলিয়াছে ভাসি ।
    সেই স্নিগ্ধক্ষণে, সেই স্বচ্ছ সূর্যকরে,
            পূর্ণতায় গম্ভীর অম্বরে
            মুক্তির শান্তির মাঝখানে
তাহারে দেখিব যারে চিত্ত চাহে, চক্ষু নাহি জানে ।

১৯ অগষ্ট ১৯২৮