ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


নবজাতক

 


 

         আহ্বান
      কানাডার প্রতি

     বিশ্ব জুড়ে ক্ষুব্ধ ইতিহাসে
অন্ধবেগে ঝঞ্ঝাবায়ু হুংকারিয়া আসে
    ধ্বংস করে সভ্যতার চূড়া।
          ধর্ম আজি সংশয়েতে নত,
    যুগযুগের তাপসদের সাধনধন যত
           দানবপদদলনে হল গুঁড়া।
    তোমরা এসো তরুণ জাতি সবে
মুক্তিরণ-ঘোষণাবাণী জাগাও বীররবে।
         তোলো অজেয় বিশ্বাসের কেতু।
     রক্তে-রাঙা ভাঙন-ধরা পথে
দুর্গমেরে পেরোতে হবে বিঘ্নজয়ী রথে,
        পরান দিয়ে বাঁধিতে হবে সেতু।
     ত্রাসের পদাঘাতের তাড়নায়,
অসম্মান নিয়ো না শিরে, ভুলো না আপনায়।
      মিথ্যা দিয়ে, চাতুরী দিয়ে, রচিয়া গুহাবাস
          পৌরুষেরে কোরো না পরিহাস।
                  বাঁচাতে নিজ প্রাণ
      বলীর পদে দুর্বলেরে কোরো না বলিদান।

 

jজোড়াসাঁকো। কলিকাতা
   ১ এপ্রিল ১৯৩৯


            
রাতের গাড়ি
এ প্রাণ, রাতের রেলগাড়ি,
           দিল পাড়ি

      কামরায় গাড়িভরা ঘুম,
           রজনী নিঝুম।
           অসীম আঁধারে
কালি-লেপা কিছু-নয় মনে হয় যারে
     নিদ্রার পারে রয়েছে সে
          পরিচয়হারা দেশে।
     ক্ষণ-আলো ইঙ্গিতে উঠে ঝলি,
          পার হয়ে যায় চলি
     অজানার পরে অজানায়,
          অদৃশ্য ঠিকানায়।
     অতিদূর-তীর্থের যাত্রী,
          ভাষাহীন রাত্রি,
       দূরের কোথা যে শেষ
           ভাবিয়া না পাই উদ্দেশ।
      চালায় যে নাম নাহি কয়;
           কেউ বলে, যন্ত্র সে, আর কিছু নয়।
    মনোহীন বলে তারে, তবু অন্ধের হাতে
        প্রাণমন সঁপি দিয়া বিছানা সে পাতে।
    বলে, সে অনিশ্চিত, তবু জানে অতি
                 নিশ্চিত তার গতি।
    নামহীন যে অচেনা বার বার পার হয়ে যায়
           অগোচরে যারা সবে রয়েছে সেথায়,
                 তারি যেন বহে নিশ্বাস,
    সন্দেহ-আড়ালেতে মুখ-ঢাকা জাগে বিশ্বাস।
                      গাড়ি চলে,
    নিমেষ বিরাম নাই আকাশের তলে।
         ঘুমের ভিতরে থাকে অচেতনে
              কোন্‌ দূর প্রভাতের প্রত্যাশা নিদ্রিত মনে।

 

উদয়ন। শান্তিনিকেতন
  ২৮ মার্চ। ১৯৪০


          
মৌলানা জিয়াউদ্দীন
কখনো কখনো কোনো অবসরে
      নিকটে দাঁড়াতে এসে;
 'এই যে' বলেই তাকাতেম মুখে,
      'বোসো' বলিতাম হেসে।
দু-চারটে হত সামান্য কথা,
      ঘরের প্রশ্ন কিছু,
গভীর হৃদয় নীরবে রহিত
     হাসিতামাশার পিছু।
কত সে গভীর প্রেম সুনিবিড়,
      অকথিত কত বাণী,
চিরকাল-তরে গিয়েছ যখন
      আজিকে সে কথা জানি।
প্রতি দিবসের তুচ্ছ খেয়ালে
      সামান্য যাওয়া-আসা,
সেটুকু হারালে কতখানি যায়
      খুঁজে নাহি পাই ভাষা।
তব জীবনের বহু সাধনার
      যে পণ্যভারে ভরি
মধ্যদিনের বাতাসে ভাসালে
     তোমার নবীন তরী,
যেমনি তা হোক মনে জানি তার
      এতটা মূল্য নাই
যার বিনিময়ে পাবে তব স্মৃতি
       আপন নিত্য ঠাঁই
 
সেই কথা স্মরি বার বার আজ
      লাগে ধিক্‌কার প্রাণে

অজানা জনের পরম মূল্য
     নাই কি গো কোনোখানে।
এ অবহেলার বেদনা বোঝাতে
     কোথা হতে খুঁজে আনি
ছুরির আঘাত যেমন সহজ
     তেমন সহজ বাণী।
কারো কবিত্ব, কারো বীরত্ব,
     কারো অর্থের খ্যাতি

কেহ-বা প্রজার সুহৃদ্‌ সহায়,
     কেহ-বা রাজার জ্ঞাতি
 
তুমি আপনার বন্ধুজনেরে
     মাধুর্যে দিতে সাড়া,
ফুরাতে ফুরাতে রবে তবু তাহা
     সকল খ্যাতির বাড়া।
ভরা আষাঢ়ের যে মালতীগুলি
     আনন্দমহিমায়
আপনার দান নিঃশেষ করি
     ধুলায় মিলায়ে যায়
 
আকাশে আকাশে বাতাসে তাহারা
    আমাদের চারি পাশে
তোমার বিরহ ছড়ায়ে চলেছে
     সৌরভনিশ্বাসে।

 

শান্তিনিকেতন
৮ জুলাই ১৯৩৮


             
অস্পষ্ট
আজি ফাল্গুনে দোলপূর্ণিমারাত্রি,
     উপছায়া-চলা বনে বনে মন
          আবছা পথের যাত্রী ।

ঘুম-ভাঙানিয়া জোছনা
 
     কোথা থেকে যেন আকাশে কে বলে,
        'একটুকু কাছে বোসো না।'
ফিস্‌ফিস্‌ করে পাতায় পাতায়,
        উস্‌খুস্‌ করে হাওয়া।

ছায়ার আড়ালে গন্ধরাজের
      তন্দ্রাজড়িত চাওয়া।
চন্দনিদহে থইথই জল
    ঝিক্‌ঝিক্‌ করে আলোতে,
জামরুলগাছে ফুলকাটা কাজে
      বুনুনি সাদায় কালোতে।
প্রহরে প্রহরে রাজার ফটকে
       বহুদূরে বাজে ঘণ্টা ।
জেগে উঠে বসে ঠিকানা-হারানো
      শূন্য-উধাও মনটা ।
বুঝিতে পারি নে কত কী শব্দ
 
      মনে হয় যেন ধারণা,
রাতের বুকের ভিতরে কে করে
       অদৃশ্য পদচারণা।
গাছগুলো সব ঘুমে ডুবে আছে,
       তন্দ্রা তারায় তারায়,
কাছের পৃথিবী স্বপ্নপ্লাবনে
        দূরের প্রান্তে হারায়।
রাতের পৃথিবী ভেসে উঠিয়াছে
        বিধির নিশ্চেতনায়,
আভাস আপন ভাষার পরশ
      খোঁজে সেই আনমনায়।
রক্তের দোলে যে-সব বেদনা
      স্পষ্ট বোধের বাহিরে
ভাবনাপ্রবাহে বুদ্‌বুদ্‌ তারা
      স্থির পরিচয় নাহি রে।
প্রভাত-আলোক আকাশে আকাশে
     এ চিত্র দিবে মুছিয়া,
পরিহাসে তব অবচেতনার
     বঞ্চনা যাবে ঘুচিয়া।
চেতনার জালে এ মহাগহনে
     বস্তু যা-কিছু টিকিবে,
সৃষ্টি তারেই স্বীকার করিয়া
      স্বাক্ষর তাহে লিখিবে।
তবু কিছু মোহ, কিছু কিছু ভুল
      জাগ্রত সেই প্রাপণার
প্রাণতন্তুতে রেখায় রেখায়
      রঙ রেখে যাবে আপনার।
এ জীবনে তাই রাত্রির দান
      দিনের রচনা জড়ায়ে
চিন্তা-কাজের ফাঁকে ফাঁকে সব
      রয়েছে ছড়ায়ে ছড়ায়ে।
বুদ্ধি যাহারে মিছে বলে হাসে
     সে যে সত্যের মূলে
আপন গোপন রসসঞ্চারে
    ভরিছে ফসলে ফুলে।
অর্থ পেরিয়ে নিরর্থ এসে
    ফেলিছে রঙিন ছায়া
 
বাস্তব যত শিকল গড়িছে,
     খেলেনা গড়িছে মায়া।

 

উদয়ন। শান্তিনিকেতন
 ২৭ মার্চ ১৯৪০


        
এপারে-ওপারে
রাস্তার ওপারে
    বাড়িগুলি ঘেঁষাঘেঁষি সারে সারে।
            ওখানে সবাই আছে
ক্ষীণ যত আড়ালের আড়ে-আড়ে কাছে-কাছে।
       যা-খুশী প্রসঙ্গ নিয়ে
           ইনিয়ে-বিনিয়ে
     নানা কণ্ঠে বকে যায় কলস্বরে।
           অকারণে হাত ধরে;
       যে যাহারে চেনে
পিঠেতে চাপড় দিয়ে নিয়ে যায় টেনে
            লক্ষ্যহীন অলিতে গলিতে,
     কথা-কাটাকাটি চলে গলাগলি চলিতে চলিতে।
বৃথাই কুশলবার্তা জানিবার ছলে
     প্রশ্ন করে বিনা কৌতূহলে।
          পরস্পরে দেখা হয়,
                বাঁধা ঠা ট্টা করে বিনিময়।
কোথা হতে অকস্মাৎ ঘরে ঢুকে
          হেসে ওঠে অহেতু কৌতুকে ।
    'আনন্দবাজার ' হতে সংবাদ-উচ্ছিষ্ট ঘেঁটে ঘেঁটে
          ছুটির মধ্যাহ্নবেলা বিষম বিতর্কে যায় কেটে।
সিনেমা-নটীর ছবি নিয়ে দুই দলে
           রূপের তুলনা-দ্বন্দ্ব চলে,
     উত্তাপ প্রবল হয় শেষে
          বন্ধুবিচ্ছেদের কাছে এসে।
      পথপ্রান্তে দ্বারের সম্মুখে বসি
ফেরিওয়ালাদের সাথে হুঁকো-হাতে দর-কষাকষি।
             একই সুরে দম দিয়ে বার বার
      গ্রামোফোনে চেষ্টা চলে থিয়েটরি গান শিখিবার।
কোথাও কুকুরছানা ঘেউ-ঘেউ আদরের ডাকে
               চমক লাগায় বাড়িটাকে।
        শিশু কাঁদে মেঝে মাথা হানি,
    সাথে চলে গৃহিণীর অসহিষ্ণু তীব্র ধমকানি।
         তাস-পিটোনির শব্দ, নিয়ে জিত হার
                থেকে থেকে বিষম চিৎকার।
যেদিন ট্যাক্সিতে চ'ড়ে জামাই উদয় হয় আসি
           মেয়েতে মেয়েতে হাসাহাসি,
                 টেপাটেপি, কানাকানি,
অঙ্গরাগে লাজুকেরে সাজিয়ে দেবার টানাটানি।
         দেউরিতে ছাতে বারান্দায়
নানাবিধ আনাগোনা ক্ষণে ক্ষণে ছায়া ফেলে যায়।

        হেথা দ্বার বন্ধ হয় হোথা দ্বার খোলে,
দড়িতে গামছা ধুতি ফর্‌ফর্‌ শব্দ করি ঝোলে।
           অনির্দিষ্ট ধ্বনি চারি পাশে
                  দিনে রাত্রে কাজের আভাসে।
          উঠোনে অনবধানে-খুলে-রাখা কলে
                   জল বহে যায় কলকলে;
          সিঁড়িতে আসিতে যেতে
                   রাত্রিদিন পথ স্যাঁৎসেঁতে।
          বেলা হলে ওঠে ঝন্‌ঝনি
                   বাসন-মাজার ধ্বনি।
          বেড়ি হাতা খুন্তি রান্নাঘরে
      ঘরকরনার সুরে ঝংকার জাগায় পরস্পরে।
            কড়ায় সর্ষের তেল চিড়্‌বিড়্‌ ফোটে,
      তারি মধ্যে কইমাছ অকস্মাৎ ছ্যাঁক্‌ করে ওঠে।
বন্দেমাতরম্‌-পেড়ে শাড়ি নিয়ে তাঁতিবউ ডাকে
                   বউমাকে।
            খেলার ট্রাইসিকেলে
ছড়্‌ ছড়্‌ খড়্‌ খড়্‌ আঙিনায় ঘোরে কার ছেলে।
    যাদের উদয় অস্ত আপিসের দিক্‌চক্রবালে
            তাদের গৃহিণীদের সকালে বিকালে
       দিন পরে দিন যায়
            দুইবার জোয়ার-ভাঁটায়
                   ছুটি আর কাজে।

    হোথা পড়া-মুখস্থের একঘেয়ে অশ্রান্ত আওয়াজে
              ধৈর্য হারাইছে পাড়া,
                   এগ্‌জামিনেশনে দেয় তাড়া।

প্রাণের প্রবাহে ভেসে
      বিবিধ ভঙ্গীতে ওরা মেশে।
                চেনা ও অচেনা
            লঘু আলাপের ফেনা
                   আবর্তিয়া তোলে
            দেখাশোনা আনাগোনা গতির হিল্লোলে।

রাস্তার এপারে আমি নিঃশব্দ দুপুরে
      জীবনের তথ্য যত ফেলে রেখে দূরে
           জীবনের তত্ত্ব যত খুঁজি
                নিঃসঙ্গ মনের সঙ্গে যুঝি,
      সারাদিন চলেছে সন্ধান
               দুরূহের ব্যর্থ সমাধান।
           মনের ধূসর কূলে
প্রাণের জোয়ার মোরে একদিন দিয়ে গেছে তুলে।
      চারি দিকে তীক্ষ্ম আলো ঝক্‌ঝক্‌ করে
            রিক্তরস উদ্দীপ্ত প্রহরে।
                  ভাবি এই কথা

    ওইখানে ঘনীভূত জনতার বিচিত্র তুচ্ছতা
         এলোমেলো আঘাতে সংঘাতে
নানা শব্দ নানা রূপ জাগিয়ে তুলিছে দিনরাতে।
     কিছু তার টেঁকে নাকো দীর্ঘকাল,
           মাটিগড়া মৃদঙ্গের তাল
                ছন্দটারে তার
          বদল করিছে বারংবার।
     তারি ধাক্কা পেয়ে মন
              ক্ষণে-ক্ষণ
         ব্যগ্র হয়ে ওঠে জাগি
    সর্বব্যাপী সামান্যের সচল স্পর্শের লাগি।
         আপনার উচ্চতট হতে
নামিতে পারে না সে যে সমস্তের ঘোলা গঙ্গাস্রোতে।
  পুরী
২০ বৈশাখ ১৩৪৬


            
মংপু পাহাড়ে
       কুজ্‌ঝটিজাল যেই
                সরে গেল মংপু-র
      নীল শৈলের গায়ে
               দেখা দিল রঙপুর ।
বহুকেলে জাদুকর, খেলা বহুদিন তার,
আর কোনো দায় নেই, লেশ নেই চিন্তার।
দূর বৎসর-পানে ধ্যানে চাই যদ্‌দূর
দেখি লুকোচুরি খেলে মেঘ আর রোদ্‌দুর।
কত রাজা এল গেল, ম ' ল এরই মধ্যে,
লড়েছিল বীর, কবি লিখেছিল পদ্যে।
কত মাথা-কাটাকাটি সভ্যে অসভ্যে,
কত মাথা-ফাটাফাটি সনাতনে নব্যে।
ওই গাছ চিরদিন যেন শিশু মস্ত,
সূর্য-উদয় দেখে, দেখে তার অস্ত।
ওই ঢালু গিরিমালা, রুক্ষ ও বন্ধ্যা,
দিন গেলে ওরই ‘ পরে জপ করে সন্ধ্যা।
নিচে রেখা দেখা যায় ঐ নদী তিস্তার,
কঠোরের স্বপ্নে ও মধুরের বিস্তার।

হেনকালে একদিন বৈশাখী গ্রীষ্মে
টানাপাখা-চলা সেই সেকালের বিশ্বে
রবিঠাকুরের দেখা সেইদিন মাত্তর,
আজি তো বয়স তার কেবল আটাত্তর
 
সাতের পিঠের কাছে একফোঁটা শূন্য
 
শত শত বরষের ওদের তারুণ্য ।
ছোটো আয়ু মানুষের, তবু একি কাণ্ড,
এটুকু সীমায় গড়া মনোব্রহ্মাণ্ড

কত সুখে দুখে গাঁথা, ইষ্টে অনিষ্টে,
সুন্দর কুৎসিতে, তিক্তে ও মিষ্টে,
কত গৃহ-উৎসবে, কত সভাসজ্জায়,
কত রসে মজ্জিত অস্থি ও মজ্জায়,
ভাষার-নাগাল-ছাড়া কত উপলব্ধি,
ধেয়ানের মন্দিরে আছে তার স্তব্ধি।
অবশেষে একদিন বন্ধন খণ্ডি
অজানা অদৃষ্টের অদৃশ্য গণ্ডি
অন্তিম নিমেষেই হবে উত্তীর্ণ।
তখনি অকস্মাৎ হবে কি বিদীর্ণ
এত রেখা এত রঙে গড়া এই সৃষ্টি,
এত মধু-অঞ্জনে রঞ্জিত দৃষ্টি।
বিধাতা আপন ক্ষতি করে যদি ধার্য
নিজেরই তবিল-ভাঙা হয় তার কার্য,
নিমেষেই নিঃশেষ করি ভরা পাত্র
বেদনা না যদি তার লাগে কিছুমাত্র,
আমারই কী লোকসান যদি হই শূন্য

শেষ ক্ষয় হলে কারে কে করিবে ক্ষুণ্ন।
এ জীবনে পাওয়াটারই সীমাহীন মূল্য,
মরণে হারানোটা তো নহে তার তুল্য।
রবিঠাকুরের পালা শেষ হবে সদ্য,
তখনো তো হেথা এক অখণ্ড অদ্য
জাগ্রত রবে চির-দিবসের জন্যে
এই গিরিতটে, এই নীলিম অরণ্যে।
তখনো চলিবে খেলা নাই যার যুক্তি

বার বার ঢাকা দেওয়া, বার বার মুক্তি ।
তখনো এ বিধাতার সুন্দর ভ্রান্তি

উদাসীন এ আকাশে এ মোহন কান্তি।

 

    মংপু

১০ জুন ১৯৩৮


        
ইস্টেশন
সকাল বিকাল ইস্টেশনে আসি,
চেয়ে চেয়ে দেখতে ভালবাসি।
       ব্যস্ত হয়ে ওরা টিকিট কেনে,
ভাঁটির ট্রেনে কেউ-বা চড়ে
      কেউ-বা উজান ট্রেনে।
সকাল থেকে কেউ-বা থাকে বসে,
কেউ-বা গাড়ি ফেল্‌ করে তার
      শেষ-মিনিটের দোষে।

           দিনরাত গড়্‌গড়্‌ ঘড়্‌ঘড়্‌,
           গাড়িভরা মানুষের ছোটে ঝড়।
           ঘন ঘন গতি তার ঘুরবে
           কভু পশ্চিমে, কভু পূর্বে।

চলচ্ছবির এই-যে মূর্তিখানি
      মনেতে দেয় আনি
নিত্য-মেলার নিত্য-ভোলার ভাষা

      কেবল যাওয়া-আসা ।
মঞ্চতলে দণ্ডে পলে
     ভিড় জমা হয় কত

পতাকাটা দেয় দুলিয়ে,
    কে কোথা হয় গত।
এর পিছনে সুখদুঃখ-
    ক্ষতিলাভের তাড়া
         দেয় সবলে নাড়া।

       সময়ের ঘড়িধরা অঙ্কেতে
       ভোঁ ভোঁ ক'রে বাঁশি বাজে সংকেতে।
       দেরি নাহি সয় কারো কিছুতেই

       কেহ যায়, কেহ থাকে পিছুতেই।

ওদের চলা ওদের পড়ে-থাকায়
আর কিছু নেই, ছবির পরে
      কেবল ছবি আঁকায়।
খানিকক্ষণ যা চোখে পড়ে
     তার পরে যায় মুছে,
আত্ম-অবহেলার খেলা
    নিত্যই যায় ঘুচে।
ছেঁড়া পটের টুকরো জমে
   পথের প্রান্ত জুড়ে,
তপ্ত দিনের ক্লান্ত হাওয়ায়
    কোন্‌খানে যায় উড়ে।
'গেল গেল 'ব'লে যারা
       ফুকরে কেঁদে ওঠে
ক্ষণেক-পরে কান্না-সমেত
      তারাই পিছে ছোটে ।

         ঢং ঢং বেজে ওঠে ঘণ্টা,
         এসে পড়ে বিদায়ের ক্ষণটা।
         মুখ রাখে জানলায় বাড়িয়ে,
         নিমেষেই নিয়ে যায় ছাড়িয়ে।

চিত্রকরের বিশ্বভুবনখানি

     এই কথাটাইনিলেম মনে মানি।
কর্মকারের নয় এ গড়া-পেটা

আঁকড়ে ধরার জিনিস এ নয়,
     দেখার জিনিস এটা।
কালের পরে যায় চলে কাল,
     হয় না কভু হারা
ছবির বাহন চলাফেরার ধারা।
দুবেলা সেই এ সংসারের
    চলতি ছবি দেখা,
এই নিয়ে রই যাওয়া-আসার
     ইস্টেশনে একা।

           এক তুলি ছবিখানা এঁকে দেয়,
           আর তুলি কালি তাহে মেখে দেয়।
           আসে কারা এক দিক হতে ওই,
           ভাসে কারা বিপরীত স্রোতে ওই।

 

শান্তিনিকেতন
৭ জুলাই ১৯৩৮


            জবাবদিহি
কবি হয়ে দোল-উৎসবে
      কোন্‌ লাজে কালো সাজে আসি,
এ নিয়ে রসিকা তোরা সবে
      করেছিলি খুব হাসাহাসি।
চৈত্রের দোল-প্রাঙ্গণে
      আমার জবাবদিহি চাই
এ দাবি তোদের ছিল মনে,
      কাজ ফেলে আসিয়াছি তাই।
দোলের দিনে, সে কী মনের ভুলে,
     পরেছিলাম যখন কালো কাপড়,
দখিন হাওয়া দুয়ারখানা খুলে
     হঠাৎ পিঠে দিল হাসির চাপড়।
সকল বেলা বেড়াই খুঁজি খুঁজি
     কোথা সে মোর গেল রঙের ডালা,
কালো এসে আজ লাগালো বুঝি
     শেষ প্রহরে রঙহরণের পালা।

ওরে কবি, ভয় কিছু নেই তোর

     কালো রঙ যে সকল রঙের চোর।
জানি যে ওর বক্ষে রাখে তুলি
    হারিয়ে-যাওয়া পূর্ণিমা ফাল্গুনী

অস্তরবির রঙের কালো ঝুলি,
    রসের শাস্ত্রে এই কথা কয় শুনি।
অন্ধকারে অজানা-সন্ধানে
    অচিন লোকে সীমাবিহীন রাতে
রঙের তৃষা বহন করি প্রাণে
    চলব যখন তারার ইশারাতে,
হয়তো তখন শেষ-বয়সের কালো
    করবে বাহির আপন গ্রন্থি খুলি
যৌবনদীপ
 জাগাবে তার আলো
    ঘুমভাঙা সব রাঙা প্রহরগুলি।
কালো তখন রঙের দীপালিতে
     সুর লাগাবে বিস্মৃত সংগীতে।

উদয়ন। শান্তিনিকেতন
   ২৮ মার্চ ১৯৪০


         সাড়ে নটা
সাড়ে নটা বেজেছে ঘড়িতে;
        সকালের মৃদু শীতে
তন্দ্রাবেশে হাওয়া যেন রোদ পোহাইতেছে
       পাহাড়ের উপত্যকা-নিচে
                    বনের মাথায়
       সবুজের আমন্ত্রণ-বিছানো পাতায়।
বৈঠকখানার ঘরের রেড়িয়োতে
             সমুদ্রপারের দেশ হতে
       আকাশে প্লাবন আনে সুরের প্রবাহে,
বিদেশিনী বিদেশের কণ্ঠে গান গাহে
                 বহু যোজনের অন্তরালে।
সব তার লুপ্ত হয়ে মিলেছে কেবল সুরে তালে।
          দেহহীন পরিবেশহীন
                    গীতস্পর্শ হতেছে বিলীন
                          সমস্ত চেতনা ছেয়ে।
         যে বেলাটি বেয়ে
                    এল তার সাড়া
    সে আমার দেশের সময়-সূত্র-ছাড়া।
একাকিনী, বহি রাগিণীর দীপশিখা
        আসিছে অভিসারিকা
               সর্বভারহীনা;
অরূপা সে, অলক্ষিত আলোকে আসীনা।
     গিরিনদীসমুদ্রের মানে নি নিষেধ,
             করিয়াছে ভেদ
    পথে পথে বিচিত্র ভাষার কলরব,
পদে পদে জন্ম-মৃত্যু বিলাপ-উৎসব।
       রণক্ষেত্রে নিদারুণ হানাহানি,
লক্ষ লক্ষ গৃহকোণে সংসারের তুচ্ছ কানাকানি,
              সমস্ত সংসর্গ তার
       একান্ত করেছে পরিহার।
                বিশ্বহারা
একখানি নিরাসক্ত সংগীতের ধারা।
      যক্ষের বিরহগাথা মেঘদূত
           সেও জানি এমনিই অদ্ভুত।
     বাণীমূর্তি সেও একা।
শুধু নামটুকু নিয়ে কবির কোথাও নেই দেখা।
            তার পাশে চুপ
     সেকালের সংসারের সংখ্যাহীন রূপ।
সেদিনের যে প্রভাতে উজ্জয়িনী ছিল সমুজ্জ্বল
           জীবনে উচ্ছল
    ওর মাঝে তার কোনো আলো পড়ে নাই।
রাজার প্রতাপ সেও ওর ছন্দে সম্পূর্ণ বৃথাই।
         যুগ যুগ হয়ে এল পার
কালের বিপ্লব বেয়ে, কোনো চিহ্ন আনে নাই তার।
        বিপুল বিশ্বের মুখরতা
উহার শ্লোকের প থে স্তব্ধ করে দিল সব কথা।


                প্রবাসী
              হে প্রবাসী,
আমি কবি যে বাণীর প্রসাদ-প্রত্যাশী
            অন্তরতমের ভাষা
     সে করে বহন। ভালোবাসা
তারি পক্ষে ভর করি নাহি জানে দূর।
         রক্তের নিঃশব্দ সুর
     সদা চলে নাড়ীতন্তু বেয়ে,
  সেই সুর যে ভাষার শব্দে আছে ছেয়ে
       বাণীর অতীতগামী তাহারি বাণীতে
ভালোবাসা আপনার গূঢ় রূপ পারে যে জানিতে।
      হে বিষয়ী, হে সংসারী, তোমরা যাহারা
                 আত্মহারা,
        যারা ভালোবাসিবার বিশ্বপথ
    হারায়েছ, হারায়েছ আপন জগৎ,
        রয়েছে আত্মবিরহী গৃহকোণে,
            বিরহের ব্যথা নেই মনে।
    আমি কবি পাঠালেম তোমাদের উদ্ভ্রান্ত পরানে
সে ভাষার দৌত্য যাহা হারানো নিজেরে কাছে আনে,

         ভেদ করি মরুকারা
শুষ্ক চিত্তে নিয়ে আসে বেদনার ধারা।
       বিস্মৃতি দিয়েছে তাহে ঘের
আজন্মকালের যাহা নিত্যদান চিরসুন্দরের

       তারে আজ লও ফিরে।
              লক্ষ্মীর মন্দিরে
     আমি আনিয়াছি নিমন্ত্রণ;
জানায়েছি, সেথাকার তোমার আসন
            অন্যমনে তুমি আছ ভুলি।
      জড় অভ্যাসের ধূলি
           আজি নববর্ষে পুণ্যক্ষণে
     যাক উড়ে তোমার নয়নে
দেখা দিক্‌
  এ ভুবনে সর্বত্রই কাছে আসিবার
       তোমার আপন অধিকার।
 

              সুদূরের মিতা,
মোর কাছে চেয়েছিলে নূতন কবিতা।
           এই লও বুঝে,
নূতনের স্পর্শমন্ত্র এর ছন্দে পাও যদি খুঁজে।

 

     [পুরী]
৯ বৈশাখ ১৩৪৬

                জন্মদিন

               তোমরা রচিলে যারে
                     নানা অলংকারে
              তারে তো চিনি নে আমি,
                    চেনেন না মোর অন্তর্যামী
তোমাদের স্বাক্ষরিত সেই মোর নামের প্রতিমা।
         বিধাতার সৃষ্টিসীমা
               তোমাদের দৃষ্টির বাহিরে।

       কালসমুদ্রের তীরে
             বিরলে রচেন মূর্তিখানি
      বিচিত্রিত রহস্যের যবনিকা টানি
             রূপকার আপন নিভৃতে।
                    বাহির হইতে
       মিলায়ে আলোক অন্ধকার
কেহ এক দেখে তারে, কেহ দেখে আর।
      খণ্ড খণ্ড রূপ আর ছায়া,
            আর কল্পনার মায়া,
আর মাঝে মাঝে শূন্য, এই নিয়ে পরিচয় গাঁথে
                   অপরিচয়ের ভূমিকাতে।
         সংসারখেলার কক্ষে তাঁর
    যে-খেলেনা রচিলেন মূর্তিকার
মোরে লয়ে মাটিতে আলোতে,
             সাদায় কালোতে,
    কে না জানে সে ক্ষণভঙ্গুর
কালের চাকার নিচে নিঃশেষে ভাঙিয়া হবে চুর।
      সে বহিয়া এনেছে যে-দান
সে করে ক্ষণেকতরে অমরের ভান
 
      সহসা মুহূর্তে দেয় ফাঁকি,
          মুঠি-কয় ধূলি রয় বাকি,
আর থাকে কালরাত্রি সব-চিহ্ন-ধুয়ে-মুছে-ফেলা।
      তোমাদের জনতার খেলা
             রচিল যে পুতুলিরে
সে কি লুব্ধ বিরাট ধূলিরে
        এড়ায়ে আলোতে নিত্য রবে।
এ কথা কল্পনা কর যবে
         তখন আমার
    আপন গোপন রূপকার
হাসেন কি আঁখিকোণে,
      সে কথাই ভাবি আজ মনে।
 

     পুরী

৫ বৈশাখ ১৩৪৬


                 প্রশ্ন
চতুর্দিকে বহ্নিবাষ্প শূন্যাকাশে ধায় বহু দূরে,
    কেন্দ্রে তার তারাপুঞ্জ মহাকাল-চক্ররথে ঘুরে।
       কত বেগ, কত তাপ, কত ভার, কত আয়তন,
             সূক্ষ্ম অঙ্কে করেছে গণন
      পণ্ডিতেরা লক্ষ কোটি ক্রোশ দূর হতে
               দুর্লক্ষ্য আলোতে।

              আপনার পানে চাই,
          লেশমাত্র পরিচয় নাই।
      এ কি কোনো দৃশ্যাতীত জ্যোতি।
কোন্‌ অজানারে ঘিরি এই অজানার নিত্য গতি।
     বহু যুগে বহু দূরে স্মৃতি আর বিস্মৃতি-বিস্তার,
         যেন বাষ্পপরিবেশ তার
    ইতিহাসে পিণ্ড বাঁধে রূপে রূপান্তরে।
‘ আমি ' উঠে ঘনাইয়া কেন্দ্র-মাঝে অসংখ্য বৎসরে।
    সুখদুঃখ ভালোমন্দ রাগদ্বেষ ভক্তি সখ্য স্নেহ
        এই নিয়ে গড়া তার সত্তাদেহ ;
     এরা সব উপাদান ধাক্কা পায়, হয় আবর্তিত,
                       পুঞ্জিত, নর্তিত।
                এরা সত্য কী যে
                      বুঝি নাই নিজে।
                বলি তারে মায়া
 
যাই বলি শব্দ সেটা, অব্যক্ত অর্থের উপচ্ছায়া।
                তার পরে ভাবি,
এ অজ্ঞেয় সৃষ্টি ‘আমি' অজ্ঞেয় অদৃশ্যে যাবে নাবি।
     অসীম রহস্য নিয়ে মুহূর্তের নিরর্থকতায়
          লুপ্ত হবে নানারঙা জলবিম্বপ্রায়,
    অসমাপ্ত রেখে যাবে তার শেষকথা
               আত্মার বারতা।
    তখনো সুদূরে ঐ নক্ষত্রের দূত
ছুটাবে অসংখ্য তার দীপ্ত পরমাণুর বিদ্যুৎ
            অপার আকাশ-মাঝে,
               কিছুই জানি না কোন্‌ কাজে।
বাজিতে থাকিবে শূন্যে প্রশ্নের সুতীব্র আর্তস্বর,
       ধ্বনিবে না কোনোই উত্তর।

 

শ্যামলী। শান্তিনিকেতন

৭ ডিসেম্বর ১৯৩৮


                 রোম্যাণ্টিক
আমারে বলে যে ওরা রোম্যাণ্টিক।
     সে কথা মানিয়া লই
          রসতীর্থ-পথের পথিক।
       মোর উত্তরীয়ে
    রঙ লাগায়েছি, প্রিয়ে
দুয়ার-বাহিরে তব আসি যবে
    সুর করে ডাকি আমি ভোরের ভৈরবে।
বসন্তবনের গন্ধ আনি তুলে
         রজনীগন্ধার ফুলে
    নিভৃত হাওয়ায় তব ঘরে।
কবিতা শুনাই মৃদুস্বরে,
       ছন্দ তাহে থাকে,
           তার ফাঁকে ফাঁকে
শিল্প রচে বাক্যের গাঁথুনি
 
              তাই শুনি
     নেশা লাগে তোমার হাসিতে।
              আমার বাঁশিতে
    যখন আলাপ করি মুলতান
মনের রহস্য নিজ রাগিণীর পায় যে সন্ধান।
    যে-কল্পলোকের কেন্দ্রে তোমারে বসাই
           ধূলি-আবরণ তার সযত্নে খসাই
 
    আমি নিজে সৃষ্টি করি তারে।
         ফাঁকি দিয়ে বিধাতারে
কারুশালা হতে তাঁর চুরি করে আনি রঙ-রস,
            আনি তাঁরি জাদুর পরশ।
    জানি, তার অনেকটা মায়া,
              অনেকটা ছায়া।
আমারে শুধাও যবে 'এরে কভু বলে বাস্তবিক ?'
    আমি বলি, 'কখনো না, আমি রোম্যাণ্টিক।'
            যেথা ওই বাস্তব জগৎ
       সেখানে আনাগোনার পথ
              আছে মোর চেনা।
                  সেথাকার দেনা
শোধ করি
   সে নহে কথায় তাহা জানি  
           তাহার আহ্বান আমি মানি ।
দৈন্য সেথা, ব্যাধি সেথা, সেথায় কুশ্রীতা,
               সেথায় রমণী দস্যুভীতা
   
সেথায় উত্তরী ফেলি পরি বর্ম;
            সেথায় নির্মম কর্ম;
সেথা ত্যাগ, সেথা দুঃখ, সেথা ভেরি বাজুক 'মাভৈঃ';
     শৌখিন বাস্তব যেন সেথা নাহি হই।
        সেথায় সুন্দর যেন ভৈরবের সাথে
               চলে হাতে-হাতে।


                 
ক্যান্ডীয় নাচ
সিংহলে সেই দেখেছিলেম ক্যান্ডিদলের নাচ;
শিকড়গুলোর শিকড় ছিঁড়ে যেন শালের গাছ
       পেরিয়ে এল মুক্তিমাতাল খ্যাপা,
    হুংকার তার ছুটল আকাশ-ব্যাপা।
ডালপালা সব দুড়্‌দাড়িয়ে ঘূর্ণি হাওয়ায় কহে
   
                 নহে, নহে, নহে
   
নহে বাধা, নহে বাঁধন, নহে পিছন-ফেরা,
         নহে আবেগ স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা,
    নহে মৃদু লতার দোলা, নহে পাতার কাঁপন
 
আগুন হয়ে জ্বলে ওঠা এ যে তপের তাপন।
    ওদের ডেকে বলেছিল সমুদ্দরের ঢেউ,
‘আমার ছন্দ রক্তে আছে এমন আছে কেউ ?'
    ঝঞ্ঝা ওদের বলেছিল, মঞ্জীর তোর আছে
ঝংকারে যার লাগাবে লয় আমার প্রলয়নাচে ?'
   ওই যে পাগল দেহখানা, শূন্যে ওঠে বাহু,
             যেন কোথায় হাঁ করেছে রাহু,
    লুব্ধ তাহার ক্ষুধার থেকে চাঁদকে করবে ত্রাণ,
             পূর্ণিমাকে ফিরিয়ে দেবে প্রাণ।
    মহাদেবের তপোভঙ্গে যেন বিষম বেগে
                  নন্দী উঠল জেগে;
            শিবের ক্রোধের সঙ্গে
উঠল জ্বলে দুর্দাম তার প্রতি অঙ্গে অঙ্গে
             নাচের বহ্নিশিখা
                      নির্দয়া নির্ভীকা।
খুঁজতে ছোটে মোহমদের বাহন কোথায় আছে
     দাহন করবে এই নিদারুণ আনন্দময় নাচে।
নটরাজ যে পুরুষ তিনি, তাণ্ডবে তাঁর সাধন,
     আপন শক্তি মুক্ত ক'রে ছেঁড়েন আপন বাঁধন;
দুঃখবেগে জাগিয়ে তোলেন সকল ভয়ের ভয়;
     জয়ের নৃত্যে আপনাকে তাঁর জয়।

 

 আলমোড়া

জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৪