ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


পথের সঞ্চয়

 যাত্রার পূর্বপত্র | বোম্বাই শহর | জলস্থল | সমুদ্রপাড়ি | যাত্রা | আনন্দরূপ  | দুই ইচ্ছা | অন্তর বাহির | খেলা ও কাজ | লণ্ডনে | বন্ধু | কবি য়েট্‌স্‌ | স্টপ্‌ফোর্ড্‌ ব্রুক | ইংলণ্ডের ভাবুক সমাজ | ইংলণ্ডের পল্লীগ্রাম ও পাদ্রি | সংগীত | সমাজভেদ | সীমার সার্থকতা | সীমা ও অসীমতা | শিক্ষাবিধি | লক্ষ্য ও শিক্ষা |  আমেরিকার চিঠি |


ইংলণ্ডের ভাবুক সমাজ


    বাহিরের ভিড়ের মধ্য হইতে আমি যেন অন্তরের ভিড়ের ভিতরে গিয়া প্রবেশ করিলাম, এইরূপ আমার মনে হইল। এ দেশের যাঁহারা লেখক, যাঁহারা চিন্তাশীল, তাঁহাদের সংস্রবে যতই আসিলাম ততই অনুভব করিতে লাগিলাম ইঁহাদের চিন্তার পথে ভাবের ঠেলাঠেলি অত্যন্ত প্রবল।
    ইহাদের সমাজ সকলের শক্তিকে যে পূর্ণবেগে আকর্ষণ করিতেছে, বাহিরে লোকের ছুটাছুটি, মোটর-যানের হুড়াহুড়িতে তাহা স্পষ্টই চোখে পড়ে। কাহারও সময় নাই; তাড়াতাড়ি কাজ সারিতে হইবে; এ সমাজ কাহাকেও পিছাইয়া পড়িয়া থাকিতে দিবে না, যে একটু পিছাইয়া পড়িবে তাহাকেই হার মানিতে হইবে। এই সম্মুখে ছুটিবার ভয়ংকর ব্যগ্রতা যখন দেখি তখন মনে মনে ভাবি, সম্মুখে সে কে বসিয়া আছে। সে ডাক দেয় কিন্তু দেখা দেয় না। নীল সমুদ্রের মতো বহুদূরে তাহার ঢেউয়ের উপর ঢেউ নিশিদিন হাত তুলিতেছে, কিন্তু কোথায় কোন্‌ পর্বতশিখরের গুহাগহ্বর হইতে ঝরনাগুলি পাগলের মতো ব্যস্ত হইয়া ডাহিনে বাঁয়ে নুড়ি পাথরগুলাকে কোনোমতে ঠেলিয়া ঠুলিয়া, কাহাকেও কোনো ঠিকানা জিজ্ঞাসা না করিয়া, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া চলিয়াছে।
    বাহিরের কাজের ক্ষেত্রে এই যেমন হাঁকাহাঁকি দৌড়াদৌড়ি, চিন্তার ক্ষেত্রে ঠিক তেমনিই। কত হাজার হাজার লোক যে ঊর্ধ্বশ্বাসে, চিন্তা করিয়া চলিয়াছে তাহার ঠিকানা নাই। দৈনিক কাগজে, সাপ্তাহিকে, মাসিকে, ত্রৈমাসিকে, বক্তৃতাসভায়, শিক্ষাশালায়, পার্লামেন্টে, পুঁথিতে,চটিতে মনের ধারা অবিশ্রাম বহিয়া চলিয়াছে। মানসিক শক্তি যাহার যে রকমের এবং যে পরিমাণে আছে, তাহার সমস্তটার উপর টান পড়িয়াছে। 'চাই, আরও চাই', দেশের মর্মস্থান হইতে এই একটা ডাক সর্বদা সর্বত্র পৌঁছিতেছে। এত বড়ো একটা ডাকে কাহারও সবুর সহে না, ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিতে হইলে মন উতলা হইয়া উঠে। দেশের এই মানসভাণ্ডারে যে লোক একবার একটা কিছু জোগাইয়াছে তাহার আর নিষ্কৃতি নাই; সে লোকের উপর আরো’র তাগিদ পড়িল; খেজুরগাছের মতো বৎসরের পর বৎসরে কাটের পর কাট চলিতে থাকে; কোনো বারে রসের একটু কমতি বা বিরাম পড়িলে সে পাড়াসুদ্ধ লোকের প্রশ্নের বিষয় হইয়া উঠে।
    কাজেই এখানকার মনোরাজ্যটা যদি চোখে দেখিবার হইত তবে দেখিতাম, সদর রাস্তায় এবং গলিতে, আপিস-পাড়ায় এবং বারোয়ারি-তলায় হুড়াহুড়ি পড়িয়া গেছে; ভিড় ঠেলিয়া চলা দায়। সেখানেও কেহ বা পায়ে হাঁটিয়া চলে, কেহ বা মোটরগাড়ি হাঁকায়; কেহ বা মজুরি করে, কেহ বা মহাজনি করিয়া থাকে; কিন্তু সকলেই বিষম ব্যস্ত। ভোরবেলা হইতে রাত দুপুর পর্যন্ত চলাচলের অন্ত নাই।
    কথাটা নূতন নহে। আমাদের দেশের তন্দ্রালস নিস্তব্ধ মধ্যাহ্নেও আমরা অর্ধেক চোখ বুজিয়া আন্দাজ করিতে পারি, এ দেশের চিন্তার হাটে কী ভয়ংকর কোলাহল এবং ঠেলাঠেলি। কিন্তু, সেই ভিড়ের চাপটা নিজের মনের উপর যখন ঠেলা দেয় তখন স্পষ্ট করিয়া বুঝিতে পারি তাহার বেগ কতখানি। এ দেশে যাঁহারা মনের কারবার করেন তাঁহাদের কাছে আসিলে সেই বেগটা বুঝিতে বিলম্ব হয় না।
    ইঁহাদের সঙ্গে আমার পরিচয় খুব বেশি দিনেরও নয়, খুব অন্তরঙ্গও নয়, ক্ষণকালের দেখাসাক্ষাৎ মাত্র। কিন্তু, সেই সময়টুকুর মধ্যে একটা জিনিস লক্ষ্য করিয়া আমি বারম্বার বিস্মিত হইয়াছি, সেটা ইঁহাদের মনের ক্ষিপ্রহস্ততা। মন ইলেকট্রিক আলোর তারের মতো সর্বদা যেন প্রস্তুত হইয়াই আছে, বোতামটি টিপিবামাত্র তখনি জ্বলিয়া উঠে। আমাদের প্রদীপের আলোর ব্যবহার; সলিতা পাকাইয়া তেল ঢালিয়া চক্‌মকি ঠুকিয়া কাজ চালাইয়া থাকি বিশেষ কোনো তাগিদ নাই, সুতরাং দেরি হইলে কিছুই আসে যায় না। অতএব, আমাদের যেরূপ অভ্যাস, তাহাতে, আমার পক্ষে এই ইলেকট্রিক আলোর ক্ষিপ্রতা সম্পূর্ণ নূতন।
    এখনকার কালের সুবিখ্যাত লেখক ওয়েল্‌স্‌ সাহেবের দুই-একখানি নভেল ও আমেরিকার সভ্যতা সম্বন্ধে একখানা বই পূর্বেই পড়িয়াছিলাম। তাহাতেই জানিতাম, ইঁহার চিন্তাশক্তি ইস্পাতের তরবারির মতো যেমন ঝক্‌মক্‌ করে, তেমনি তাহা খরধার। আমার বন্ধু যেদিন ইঁহার সঙ্গে এক ডিনারে আমাকে নিমন্ত্রণ করেন, সেদিন আমার মনের মধ্যে কেমন একটু ভয় ছিল। আমার মনে ছিল, সংসারে খরতর বুদ্ধি জিনিসটাতে নিশ্চয়ই অনেক কাজ হয়, কিন্তু তাহার সংস্রব হয়তো আরামের নহে।
                            ১ এইচ.জি.ওয়েলস (
H.G.Wells)

    যাহা হউক, সেদিন সন্ধ্যাবেলায় ইঁহার সঙ্গে অনেকক্ষণের জন্য আলাপ-পরিচয় হইল। প্রথমেই আশ্বস্ত হইলাম, যখন দেখা গেল, মানুষটি সজারু জাতীয় নহে, সম্পূর্ণ মোলায়েম। দেখিতে পাইলাম, ইঁহার প্রখরতা চিন্তায়, কিন্তু প্রকৃতিতে নয়। আসল কথা, মানুষের প্রতি ইঁহার আন্তরিক দরদ আছে, অন্যায়ের প্রতি বিদ্বেষ এবং মানুষের সার্বজনীন উন্নতির প্রতি অনুরাগ আছে; সেইটে থাকিলেই মানুষের মন কেবলমাত্র চিন্তার তুব্‌ড়িবাজি করিয়া সুখ পায় না। এই দেশে সেইটে একটা মস্ত জিনিস। মানুষ এখানে সর্বদা প্রত্যক্ষগোচর হইয়া আছে; মানুষের সম্বন্ধে এখানে ঔৎসুক্যের অন্ত নাই। মানুষের প্রতি উদাসীনতার অভাবেই ইহাদের মন এমন প্রচুরশস্যশালী হইয়া উঠিয়াছে। কেননা, শুধু বীজে ও মাটিতে ফসল ভালো হয় না, জমিতে সর্বদা রস থাকা চাই; মানুষের প্রতি মানুষের টানই সেই চিরন্তন রস—যাহাতে করিয়া মনের সকলরকম ফসল একেবারে অপর্যাপ্ত হইয়া ফলিয়া উঠে। আমাদের দেশে আমি অনেক শক্তিশালী লোক দেখিয়াছি, মানুষের সঙ্গে তাঁহাদের হৃদয়ের সংস্রব সুগভীর ও সর্বদা বিদ্যমান নহে বলিয়াই তাঁহারা আপনার সাধ্যকে পূর্ণভাবে সাধিত করিয়া তুলিতে পারেন না। মানুষ তাঁহাদের কাছে তেমন করিয়া চাহিতেছে না বলিয়াই মানুষের ধন তাঁহারা পূরা পরিমাণ বাহির করিতে পারিতেছেন না। বিরল-বসতি লোকালয়ে মানুষ নিজের নিতান্ত প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কিছু ফলায় না এবং তাহারও অনেক নষ্ট হয়,ফেলা যায়। আমাদের সেইরূপ বিরলে বাস; মানুষ ছাঁকিয়া বাঁকিয়া আমাদের হৃদয়মনকে আকর্ষণ করিতেছে না। সেইজন্য আমরা অনেকে চিন্তা করিতে পারি, কিন্তু সে চিন্তা আলস্য ঘুচাইয়া আপনাকে প্রকাশ করিতে পারে না; অনেকের হৃদয় আছে, কিন্তু সে হৃদয় ছেলেপুলে ভাইপো ভাগনের বাহিরে খাটিবার ক্ষেত্রে পায় না।
    যাহাই হউক, ওয়েল্‌সের সঙ্গে কথা কহিতে গিয়া এইটে বুঝিতে পারিলাম, ইহাদের চিন্তাশীলতা ও রচনাশক্তির অবলম্বন মানুষ; এইজন্য তাহা শিকারীর শিকার-ইচ্ছার মতো কেবলমাত্র শক্তির খেলা নহে। এইজন্য ইঁহাদের চিন্তার যে তীক্ষ্মতা তাহা ছুরির তীক্ষ্মতার মতো নহে
তাহা সজীব তীক্ষ্মতা, তাহা দৃষ্টির তীক্ষ্মতা; তাহার সঙ্গে হৃদয় আছে, জীবন আছে।
    আর-একটা জিনিস দেখিয়া বারবার বিস্মিত হইলাম, সে কথা পূর্বেই বলিয়াছি। সে ইঁহাদের চিন্তার ক্ষিপ্রতা। আমার বন্ধুর সঙ্গে ওয়েল্র‌সের যতক্ষণ কথা চলিল ততক্ষণ পদে পদে কথাবার্তার প্রবাহ উজ্জ্বল চিন্তার কণায় ঝল্‌মল্‌ করিতে লাগিল। কথার সঙ্গে কথার স্পর্শে আপনি স্ফুলিঙ্গ বাহির হইতে থাকে, মুহূর্তকাল বিলম্ব হয় না। ইহাতে স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায়, ইঁহাদের মন প্রস্তুত হইয়াই আছে। ইঁহারা যে চিন্তা করিতেছেন তাহা নহে, চারি দিকের ঠেলায় ইঁহাদের নিয়ত চিন্তা করাইতেছে; তাই ইহাঁদের মন ছুটিতে ছুটিতেও ভাবিতে পারে এবং ভাবিতে ভাবিতেও কথা কহিয়া যায়। ইঁহাদের ব্যক্তিগত মনের পশ্চাতে সমস্ত দেশের মন জাগিয়া আছে; চিন্তার ঢেউ, কথার কল্লোল কেবলই নানা দিক হইতে নানা আকারে পরস্পরের চিত্তকে আঘাত করিতেছে। ইহাতে মনকে জাগ্রত ও মুখরিত না করিয়া থাকিতে পারে না।
    আমার বন্ধু চিত্রশিল্পী, কথার কারবার তাঁহার নহে। তাঁহার সঙ্গে আমার অনেকদিন অনেক আলাপ হইয়াছে; সর্বদা ইহাই লক্ষ্য করিয়াছি, যে কথাটাই ইঁহার সম্মুখে উপস্থিত হয় তৎক্ষণাৎ সেটাকে ইনি জোরের সঙ্গে ভাবিতে পারেন ও জোরের সঙ্গে বলিতে পারেন। সে জোর কিছুমাত্র গায়ের জোর নহে, তাহা চিন্তার জোর। ইঁহার অনুভূতিশক্তিও দ্রুত এবং প্রবল। যেটা ভালো লাগিবার জিনিস, সেটাকে ভালো লাগিতে ইঁহার ক্ষণমাত্র বিলম্ব হয় না, সে সম্বন্ধে ইঁহাকে আর-কাহারও মুখাপেক্ষা করিতে হয় না; যেটাকে গ্রহণ করিতে হইবে সেটাকে ইনি একেবারেই অসংশয়ে গ্রহণ করেন। মানুষকে ও মানুষের শক্তিকে গ্রহণ করিবার সহজ ক্ষমতা ইঁহার এমন প্রবল বলিয়াই ইনি ইঁহার দেশের নানা শক্তিশালী নানা শ্রেণীর লোককে এমন করিয়া বন্ধুত্বপাশে বাঁধিতে পরিয়াছেন। তাঁহারা কেহ বা কবি, কেহ সমালোচক, কেহ বৈজ্ঞানিক, কেহ দার্শনিক, কেহ গুণী, কেহ জ্ঞানী, কেহ রসিক, কেহ রসজ্ঞ; তাঁহারা সকলেই বিনা বাধায় এক ক্ষেত্রে মিলিবার মতো লোক নহেন, কিন্তু তাঁহার মধ্যে সকলেই মিলিতে পরিয়াছেন।
    আমার বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিতে গিয়া আমার ইহাই মনে হইতে থাকে, অনেক বিষয়েই ইঁহাদিগকে এখন আর গোড়া হইতেই ভাবিতে হয় না; ইঁহারা অনেক কথা অনেক দূর পর্যন্ত ভাবিয়া রাখিয়াছেন। ভাবনার প্রথম ধাক্কাতেই যত বিলম্ব, তখন তাহার পক্ষে চলা সহজ। ইঁহাদের দেশে ভাবনা জিনিসটা চলার মুখেই আছে; তাহার চাকা আপনিই সরে। মানুষের চিন্তার অধিকাংশ বিষয়েই মাঝ-রাস্তায়। এইজন্য ইঁহাদের কোনো শিক্ষিত লোকের সঙ্গে যখন আলাপ করা যায় তখন একেবারেই সুচিন্তিত কথার ধারা পাওয়া যায়,এবং সেই ধারা দ্রুতগতিশীল।
    যেখানে চিন্তার এমন একটা বেগ আছে সেখানে চিন্তার আনন্দ যে কতখানি তাহা সহজেই অনুভব করা যায়। সেই আনন্দ এখানকার শিক্ষিতসমাজের সামাজিকতার একটি প্রধান অঙ্গ। এখানকার সামাজিক মেলামেশার মধ্যে চিত্তের লীলা আপনার বিহারক্ষেত্র রচনা করিতেছে। চিন্তার সঞ্চার কেবল বক্তৃতায় এবং বইলেখায় নহে, তাহা মানুষের সঙ্গে মানুষের দেখা-সাক্ষাতে। অনেক সময় ইঁহাদের আলাপ শুনিতে শুনিতে আমার মনে হইয়াছে, এ-সব কথা লিখিয়া রাখিবার জিনিস, ছড়াইয়া ফেলিবার নহে। কিন্তু, মানুষের মন কৃপণতা করিয়া কোনো বড়ো ফল পাইতে পারে না। যেখানে ছড়াইয়া ফেলিবার যোগ্যতা নাই সেখানে ভালো করিয়া কাজে লাগাইবার যোগ্যতাও নাই। প্রত্যেক বীজের হিসাব রাখিয়া টিপিয়া টিপিয়া পুঁতিতে গেলে বড়ো রকমের চাষ হয় না। দরাজ হাতে ছড়াইয়া ছড়াইয়া চলিতে হয়, তাহাতে অনেকটা নিষ্ফল হইয়াও মোটের উপর লাভ দাঁড়ায়। এইজন্য চিন্তায় চর্চায় সেই আনন্দ থাকা চাই যাহাতে সে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি হইয়া জন্মিতে পারে। আমাদের দেশে চিত্তের সেই আনন্দলীলার অভাবটাই সকল দৈন্যের চেয়ে বেশি বলিয়া ঠেকে।
    কেম্‌ব্রিজের কলেজ-ভবনে একজন অধ্যাপকের বাড়িতে নিমন্ত্রিত হইয়া আমি দিন-দুয়েক বাস করিয়াছিলাম। ইঁহার নাম লোয়েস্‌ ডিকিন্সন্‌। ইনিই 'জন্‌ চীনাম্যানের পত্র' বইখানির লেখক। সে বইখানি যখন প্রথম বাহির হয় তখন আমাদের দেশে প্রাচ্য দেশাভিমানের একটা প্রবল হাওয়া দিয়াছিল। সমস্ত য়ুরোপের চিত্ত যেমন একই সভ্যতাসূত্রের চারি দিকে দানা বাঁধিয়াছে তেমনি করিয়া একদিন সমস্ত এসিয়া এক সভ্যতার বৃন্তের উপর একটি শতদলপদ্ম হইয়া বিশ্ববিধাতার চরণতলে নৈবেদ্যরূপে জাগিয়া উঠিবে, এই কল্পনা ও কামনা আমাদিগকে মাতাইয়া তুলিতেছিল। সেই সময়ে এই 'চীনাম্যানের পত্র' বইখানি অবলম্বন করিয়া আমি এক মস্ত প্রবন্ধ লিখিয়া সভায় পাঠ করিয়াছিলাম। তখন জানিতাম, সে বইখানি সত্যই চীনাম্যানের লেখা। যিনি লেখক তাঁহাকে দেখিলাম; তিনি চীনাম্যান নহেন তাহাতে সন্দেহ নাই; কিন্তু, তিনি ভাবুক, অতএব তিনি সকল দেশের মানুষ। যে দুইদিন ইঁহার বাসায় ছিলাম ইঁহার সঙ্গে প্রায় নিয়ত আমার কথাবার্তা হইয়াছে। স্রোতের সঙ্গে স্রোত যেমন অনায়াসে মেশে তেমনি অশ্রান্ত আনন্দে তাঁহার চিত্তবেগের টানে আমার চিত্ত ধাবিত হইয়া চলিতেছিল। ইহা বিশেষ কোনো উপার্জন বা লাভের ব্যাপার নহে; ইহা কোনো বিশেষ বিষয়ের বই পড়া বা কলেজের বক্তৃতাশোনার কাজ করে না; ইহা মনের চলার আনন্দ। যেমন বসন্তে সমস্তই কেবল ফল ও ফুল নহে, তাহার সঙ্গে দক্ষিণের হাওয়া আছে, সেই হাওয়ার উত্তাপে ও আন্দোলনে ফুলের আনন্দ বিকাশ সম্পূর্ণ হইতে থাকে, তেমনি এখানকার মনোবিকাশের চারি দিকে যে একটা আলাপের বসন্তহাওয়া বহিতেছে, যাহাতে গন্ধ ব্যাপ্ত হইতেছে ও বীজ
ছড়াইয়া পড়িতেছে, যাহাতে প্রাণের ক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাণের উৎসব দিগ্‌দিগন্তরকে মাতাইয়া তুলিতেছে, এই সহৃদয় চিন্তাশীল অধ্যাপকের গ্রন্থমণ্ডিত বাসাটুকুর মধ্যে আমি তাহারই একটা প্রবল স্পর্শ পাইলাম। ইঁহার সঙ্গে এক সময়ে যখন এখানকার একজন বিখ্যাত গণিত-অধ্যাপক রাসেল সাহেব আসিয়া মিলিত হইলেন তখন তাঁহাদের আলাপের আন্দোলন আমার মনকে পদে পদে অভিহত করিয়া আনন্দিত করিয়া তুলিল। গণিতের তেজে কাহারও মন দগ্ধ হইয়া শুকাইয়া যায়, কাহারও মন আলোকিত হইয়া উঠে। রাসেল সাহেবের মন যেন প্রখর আলোকে দীপ্যমান। সেই চিন্তার আলোকের সঙ্গে সঙ্গে অপর্যাপ্ত হাস্যরশ্মি মিলিত হইয়া আছে, সেইটে আমার কাছে সবচেয়ে সরস লাগিল। রাত্রে আহারের পর আমরা কলেজের বাগানে গিয়া বসিতাম সেখানে একদিন রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত প্রাচীন তরুসভার গভীর নীরবতার মধ্যে এই দুই অধ্যাপক বন্ধুর আলাপ আমি শুনিতেছিলাম। আলাপের বিষয় বহুদূরব্যাপী। তাহার মধ্যে সাহিত্য, সমাজতত্ত্ব, দর্শন, সকল রকম জিনিসই ছিল। আমার কাছে সেই রাত্রির স্মৃতিটি বড়ো রমণীয়। এক দিকে বিরাট বিশ্বপ্রকৃতির আকাশ-জোড়া নিস্তব্ধতা, আর-এক দিকে তাহারই মাঝখান দিয়া মানুষের চঞ্চল মন আপনার তরঙ্গমালা বিস্তার করিয়া সমস্ত বিশ্বকে বাহুবন্ধনে বাঁধিবার জন্য অভিসারে চলিয়াছে। যেন পর্বতমালা স্থির নিশ্চল গাম্ভীর্যের সহিত আকাশ ভেদ করিয়া দাঁড়াইয়া আছে, আর তাহারই পায়ের কাছটা ঘিরিয়া ঘিরিয়া নির্ঝরিণী ছুটিয়া চলিয়াছে, তাহাকে কেহই থামাইয়া রাখিতে পারিতেছে না; তাহার কলোচ্ছ্বাস কেবলই প্রশ্ন করিতেছে, এবং গভীর গিরিকন্দরগুলা তাহারই ধ্বনিপ্রতিধ্বনিতে মুখরিত হইয়া উঠিতেছে। প্রকৃতি এবং চিত্ত এই দুইয়ের যোগ আমি সেই প্রাচীন বিদ্যালয়ের পুরাতন বাগানে বসিয়া অনুভব করিতেছিলাম। বৃহৎ বিশ্বের নীরবতা মানুষের মধ্যেই বাণী-আকারে আপনাকে অবিশ্রাম প্রকাশ করিতেছে; এই বাণীস্রোতেই বিশ্বের আত্মোপলব্ধি, তাহার নিরন্তর আনন্দ, ইহাই আমি সেদিন নিবিড়রূপে উপলব্ধি করিলাম। আমার মনে হইতে লাগিল, জগতে অন্ধকারের মহাসত্তা অতিবিপুল। অনন্ত আকাশে সেই মহান্ধকার আপনাকে আলোকের লীলায় ব্যক্ত করিতেছে; সেই আলোকের আবর্ত চঞ্চল, তাহা সর্বদা কম্পমান; তাহা কোথাও বা শিখায়, কোথাও বা স্ফুলিঙ্গে, কোথাও বা ক্ষণকালের জন্য, কোথাও বা দীর্ঘকালের জন্য উজ্জ্বল হইয়া উঠিতেছে; কিন্তু এই চঞ্চল আলোকমালাই অবিচলিত মহৎ অন্ধকারের বাণী। মানুষের চিত্তের চঞ্চল ধারাটিও তেমনি বিশাল বিশ্বের এক প্রান্ত দিয়া নানা পথে আঁকিয়া-বাঁকিয়া নানা শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হইয়া কেবলই বিশ্বকে প্রকাশ করিতে করিতে চলিয়াছে। যেখানে সেই প্রকাশ পরিপূর্ণ ও প্রশস্ত সেইখানেই বিশ্বের চরিতার্থতা আনন্দে ও ঐশ্বর্যের সমারোহে উৎসবময় হইয়া উঠিতেছে। নিস্তব্ধ রাত্রে দুই বন্ধুর মৃদু কণ্ঠের কথাবার্তায় আমি মানুষের মনের মধ্যে সমস্ত বিশ্বের সেই আনন্দ, সেই ঐশ্বর্য অনুভব করিতেছিলাম।

‌১. চীনেম্যানের চিঠি : বঙ্গদর্শন, আষাঢ় ১৩০৯, পৃ ১৫১-৬২। প্রবন্ধটি "মজুমদার লাইব্রেরির সংসৃষ্ট 'আলোচনা সমিতি'র বিশেষ অধিবেশনে" রবীন্দ্রনাথ পাঠ করিয়াছিলেন।
২. বার্ট্রান্ড্‍‌ রাসেল (
Bertrand Russel)


ইংলণ্ডের পল্লীগ্রাম ও পাদ্রি

    সকল সময়েই মানুষ যে নিজের যোগ্যতা বিচার করিয়া বৃত্তি অবলম্বন করিবার সুযোগ পায় তাহা নহে সেইজন্য পৃথিবীতে কর্মরথের চাকা এমন কঠোর স্বরে আর্তনাদ করিতে করিতে চলে। যে মানুষের মুদির দোকান খোলা উচিত ছিল সে ইস্কুল-মাস্টারি করে, পুলিসের দারোগা হওয়ার জন্য যে লোক সৃষ্ট হইয়াছে তাহাকে পাদ্রির কাজ চালাইতে হয়। অন্য ব্যবসায়ে এইরূপ উল্‌টাপাল্‌টাতে খুব বেশি ক্ষতি করে না, কিন্তু ধর্মব্যবসায়ে ইহাতে বড়োই অঘটন ঘটাইয়া থাকে। কারণ, ধর্মের ক্ষেত্রে মানুষ যথাসম্ভব সত্য হইতে না পারিলে তাহাতে কেবল যে ব্যর্থতা আনে তাহা নহে, তাহাতে অমঙ্গলের সৃষ্টি করে।
    খৃস্টানধর্মের আদর্শের সঙ্গে এ দেশের মানবপ্রকৃতির এক জায়গায় খুব একটা অসামঞ্জস্য আছে, খৃস্টানশাস্ত্রোপদিষ্ট একান্ত নম্রতা ও দাক্ষিণ্য এ দেশের স্বভাব-সংগত নহে, প্রকৃতির সঙ্গে এবং মানুষের সঙ্গে লড়াই করিয়া নিজেকে জয়ী করিবার উত্তেজনা ইহাদের রক্তে প্রাচীনকাল হইতে বংশানুক্রমে সঞ্চারিত হইয়া আসিয়াছে; সেইজন্য সৈন্যদলে যাহাদের ভর্তি হওয়া উচিত ছিল তাহারা যখন পাদ্রির কাজে নিযুক্ত হয় তখন ধর্মের রঙ শুভ্রতা ত্যাগ করিয়া লাল টক্‌টকে হইয়া উঠে। সেইজন্য যুরোপে আমরা সকল সময়ে পাদ্রিদিগকে শান্তির পক্ষে, সার্বজাতিক ন্যায়পরতার পক্ষে দেখিতে পাই না। যুদ্ধবিগ্রহের সময় ইহারা বিশেষভাবে ঈশ্বরকে নিজেদের দলপতি করিয়া দাঁড় করায় এবং ঈশ্বরোপাসনাকে রক্তপাতের ভূমিকারূপে ব্যবহার করে।
    অনেক সময়েই দেখা যায়, ইহারা যাহাদিগকে হীদেন বলে তাহাদের প্রতি সত্যবিচার করিতে ইহারা অক্ষম। যেন তাহারা খৃস্টানের ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী আর কোনো দেবতার সৃষ্টি, সুতরাং তাহাদিগকে নিন্দিত করিতে পারিলে যেন নিজের ঈশ্বরের গৌরব বৃদ্ধি করা হয়, এই রকমের একটা ভাব তাহাদের মনে আছে। এই বিরুদ্ধতা, এই উগ্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা দ্বারা পাদ্রি অন্য ধর্মের লোককে সর্বদা পীড়া দিয়াছে। তাহারা অস্ত্রধারী সৈন্যদলের মতো অন্যকে আঘাত করিয়া জয় করিতে চাহিয়াছে।
    তাই ভারতবর্ষে পাদ্রিদের সম্বন্ধে আমাদের যে ধারণা তাহা এই বিরুদ্ধতার ধারণা। তাহারা যে আমাদের সঙ্গে অত্যন্ত পৃথক, এইটেই আমরা অনুভব করিয়াছি। তাহারা আমাদিগকে খৃস্টান করিতে প্রস্তুত, কিন্তু নিজেদের সঙ্গে আমাদিগকে মিলাইয়া লইতে প্রস্তুত নহে। তাহারা আমাদিগকে জয় করিবে,কিন্তু এক করিবে না। এক জাতির সঙ্গে আর-এক জাতিকে মিলাইবার ভার ইহাদেরই লওয়া উচিত ছিল। যাহাতে পরস্পর পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা রক্ষা করিয়া সুবিচার করিতে পারে, সেই সেতু বাঁধিয়া দেওয়া তো ইহাদেরই কাজ। কিন্তু, তাহার বিপরীত ঘটিয়াছে। খৃস্টান পাদ্রিরা অখৃস্টান জাতির ধর্ম সমাজ ও আচার-ব্যবহারকে যতদূর সম্ভব কালিমালিপ্ত করিয়া দেশের লোকের কাছে চিত্রিত করিয়াছে। এমন কোনো জাতি নাই যাহার হীনতা বা শ্রেষ্ঠতাকে স্বতন্ত্র করিয়া দেখানো যায় না। অথচ ইহাই নিশ্চিত সত্য যে, সকল জাতিকেই তাহার শ্রেষ্ঠতার দ্বারা বিচার করিলেই তাহাকে সত্যরূপে জানা যায়। হৃদয়ে প্রেমের অভাব এবং আত্মগরিমাই এই বিচারের বাধা। যাঁহারা ভগবানের প্রেমে জীবনকে উৎসর্গ করেন তাঁহারা এই বাধাকে অতিক্রম করিবেন, ইহাই আশা করা যায়। কিন্তু, অন্য জাতিকে হীন করিয়া দেখাইয়া পাদ্রিরা খৃস্টান অখৃস্টানের মধ্যে যতবড়ো প্রবল ভেদ ঘটাইয়াছে এমন বোধহয় আর-কেহই করে নাই। অন্যকে দেখিবার বেলায় তাহারা ধর্মব্যবসায়ে সাম্প্রদায়িক কালো চশমা পরিয়াছে। বিজেতা ও বিজিত জাতির মাঝখানে একটা প্রচণ্ড অভিমান স্বভাবতই আছে, তাহা শক্তির অভিমান
সুতরাং পরস্পরের মধ্যে মানুষোচিত মিলনের সেই একটা মস্ত অন্তরায় পাদ্রিরা সেই অভিমানকে ধর্ম ও সমাজনীতির দিক হইতেও বড়ো করিয়া তুলিয়াছে। কাজেই খৃস্টানধর্মও নানা প্রকারে আমাদের মিলনের একটা বাধা হইয়া উঠিয়াছে, তাহা আমাদের পরস্পরের শ্রেষ্ঠ পরিচয় আবৃত করিয়া রাখিয়াছে।
    কিন্তু, এমন সাধারণভাবে কোনো সম্প্রদায় সম্বন্ধে কোনো কথা বলা চলে না, তাহার প্রমাণ পাইয়াছি। এখানে আসিয়া একজন খৃস্টান পাদ্রির সহিত আমার আলাপ হইয়াছে যিনি পাদ্রির চেয়ে খৃস্টান বেশি
ধর্ম যাঁহার মধ্যে ব্যবসায়িক মূর্তি ধরিয়া উগ্ররূপে দেখা দেয় নাই, সমস্ত জীবনের সহিত সুসম্মিলিত হইয়া প্রকাশ পাইতেছে। এমন মানুষকে কেহ মনে করিতে পারে না যে 'ইনি আমাদের পক্ষের লোক নহেন, ইনি অন্য দলের'। ইহাই অত্যন্ত অনুভব করি, ইনি মানুষ ইনি সত্যকে মঙ্গলকে সকল মানুষের মধ্যে দেখিতে আনন্দ বোধ করেন তাহা খৃষ্টানেরই বিশেষ সম্পত্তি মনে করিয়া ঈর্ষা করেন না। আরও আশ্চর্যের বিষয়, ইঁহার কর্মক্ষেত্র ভারতবর্ষে। সেখানে খৃষ্টানের পক্ষে যথার্থ খৃস্টান হইবার সমস্ত একটা বাধা আছে কারণ, সেখানে তিনি রাজা। সেখানে রাষ্ট্রনীতি ধর্মনীতির সপত্নী। অনেক সময়ে তিনিই সুয়োরানী। এইজন্য ভারতবর্ষের পাদ্রি ভারতবাসীর সমগ্র জীবনের সঙ্গে সমবেদনার যোগ রাখিতে পারেন না। একটা মস্ত জায়গায় আমাদের সঙ্গে তাঁহাদের জাতীয় স্বার্থের সংঘাত আছে এবং একজায়গায় তাঁহারা তাঁহাদের গুরুর উপদেশ শিরোধার্য করিয়া শির নত করিতে পারেন না। তিনি নম্রতা দ্বারা পৃথিবী জয় করিতে বলিয়াছেন, কিন্তু সেটা স্বর্গরাজ্যের নীতি। ইঁহারা মর্ত্যরাজ্যের অধীশ্বর।
    আমি যাঁহার কথা বলিতেছি ইনি রেভারেণ্ড্‌ এণ্ড্রুস। ভারতবর্ষের লোকের কাছে ইঁহার পরিচয় আছে। তিনি আপনার মধ্যে যে ইংরেজ রাজা আছে তাহাকে একেবারে হার মানাইয়াছেন এবং আমাদের আপন হইবার পবিত্র অধিকার লাভ করিয়াছেন। খৃস্টানধর্ম যেখানে সমগ্র জীবনের সমাগ্রী হইয়া উঠিয়াছে সেখানে যে কী মাধুর্য এবং উদারতা তাহা ইঁহার মধ্যে প্রত্যক্ষ দেখিতে পাওয়াকে আমি বিশেষ সৌভাগ্য বলিয়া গণ্য করি।
    ইনিই একদিন আমাকে বলিলেন, 'দেশে ফিরিবার পূর্বে এখানকার গৃহস্থবাড়ি তোমাকে দেখিয়া যাইতে হইবে। শহরে তাহার অনেক রূপান্তর ঘটিয়াছে
  পল্লীগ্রামে না গেলে তাহার ঠিক পরিচয় পাওয়া যায় না।' ইঁহার একজন বন্ধু স্টাফোর্ড্শ‌শিয়রে এক পল্লীতে পাদ্রির কাজ করিয়া থাকেন; তাঁহারই বাড়িতে এণ্ড্রুস সাহেব কিছুদিন আমাদের বাসের ব্যবস্থা করিয়া দিলেন।
    অগস্ট্‌ মাস এ-দেশে গ্রীষ্ম-ঋতুর অধিকারের মধ্যে গণ্য। সে সময়ে শহরের লোক পাড়াগাঁয়ে হাওয়া খাইয়া আসিবার জন্য চঞ্চল হইয়া উঠে। আমাদের দেশে এমন অবারিতভাবে আমরা প্রকৃতির সঙ্গে পাই, সেখানে আকাশ এবং আলোক এমন প্রচুররূপে আমাদের পক্ষে সুলভ যে, তাহার সঙ্গে যোগসাধনের জন্য বিশেষ ভাবে আমাদিগকে কোনো আয়োজন করিতে হয় না। কিন্তু এখানে প্রকৃতিকে তাহার ঘোমটা খুলিয়া দেখিবার জন্য লোকের মনের ঔৎসুক্য কিছুতেই ঘুচিতে চায় না। ছুটির দিনে ইহারা যেখানে একটু খোলা মাঠ আছে সেইখানেই দলে দলে ছুটিয়া যায়—বড়ো ছুটি পাইলেই শহর হইতে বাহির হইয়া পড়ে। এমনি করিয়া প্রকৃতি ইহাদিগকে চলাচলের মুখে রাখিয়াছে, ইহাদিগকে এক জায়গায় স্থির হইয়া বসিয়া থাকিতে দেয় না। ছুটির ট্রেনগুলি একেবারে লোকে পরিপূর্ণ। বসিবার জায়গা পাওয়া যায় না। সেই শহরের উড়ুক্ষু মানুষের ঝাঁকের সঙ্গে মিশিয়া আমরা বাহির হইয়া পড়িলাম।
    গম্যস্থানের স্টেশনে আমাদের নিমন্ত্রণকর্তা তাঁহার খোলা গাড়িটি লইয়া আমাদের জন্য অপেক্ষা করিতেছিলেন। গাড়িতে যখন চড়িলাম, তখন আকাশে মেঘ। ছায়াচ্ছন্ন প্রভাতের আবরণে পল্লীপ্রকৃতি ম্লানমুখে দেখা দিল। অল্পকিছু দূর যাইতেই বৃষ্টি আরম্ভ হইল।
    বাড়িতে গিয়া যখন পৌঁছিলাম গৃহস্বামিনী তাঁহার আগুন-জ্বালা বসিবার ঘরে লইয়া গেলেন। বাড়িটি পুরাতন পাদ্রিনিবাস নহে। ইহা নূতন তৈরি। গৃহসংলগ্ন ভূমিখণ্ডে বৃদ্ধ তরুশ্রেণী বহুদিনের ধারাবাহিক মানবজীবনের বিলুপ্ত স্মৃতিকে পল্লবপুঞ্জের অস্ফুট ভাষায় মর্মরিত করিতেছে না। বাগানটি নূতন, বোধহয় ইঁহারাই প্রস্তুত করিয়াছেন। ঘন সবুজ তৃণক্ষেত্রের ধারে ধারে বিচিত্র রঙের ফুল ফুটিয়া কাঙাল চক্ষুর কাছে অজস্র সৌন্দর্যের অবারিত অন্নসত্র খুলিয়া দিয়াছে। গ্রীষ্ম-ঋতুতে ইংলণ্ডে ফুলপল্লবের যেমন সরসতা ও প্রাচুর্য, এমন তো আমি কোথাও দেখি নাই। এখানে মাটির উপরে ঘাসের আস্তরণ যে কী ঘন ও তাহা কী নিবিড় সবুজ, তাহা না দেখিলে বিশ্বাস করা যায় না।
    বাড়িটির ঘরগুলি পরিপাটি পরিচ্ছন্ন; লাইব্রেরি সুপাঠ্য গ্রন্থে পরিপূর্ণ; ভিতরে বাহিরে কোথাও লেশমাত্র অযত্নের চিহ্ন নাই। এখানকার ভদ্র গৃহস্থ-ঘরে এই জিনিসটাই বিশেষ করিয়া আমার মনে লাগিয়াছে। ইঁহাদের ব্যবহারের আরামের ও গৃহসজ্জার উপকরণ আমাদের চেয়ে অনেক বেশি, অথচ ঘরের প্রত্যেক সামান্য জিনিসটির প্রতি গৃহস্থের চিত্ত সতর্কভাবে জাগ্রত আছে। নিজের চারি দিকের প্রতি শৈথিল্য যে নিজেরই অবমাননা তাহা ইহারা খুব বুঝে। এই জাগ্রত আত্মাদরের ভাবটি ছোটোবড়ো সকল বিষয়েই কাজ করিতেছে। ইহারা নিজের মনুষ্যগৌরবকে খাটো করিয়া দেখে না বলিয়াই নিজের ঘরবাড়িকে যেমন সর্বপ্রযত্নে তাহার উপযোগী করিয়া তুলিয়াছে, তেমনি নিজের প্রতিবেশকে সমাজকে দেশকে সকল বিষয়ে সকল দিক হইতে সম্মার্জন করিয়া তুলিবার জন্য ইহাদের প্রয়াস অহরহ উদ্যত হইয়া রহিয়াছে। ত্রুটি জিনিসটাকে ইহারা কোনো কারণেই কোনো জায়গাতেই মাপ করিতে চায় না।
    বিকালের দিকে আমাকে লইয়া গৃহস্বামী ঊট্রম সাহেব বেড়াইতে বাহির হইলেন। তখন বৃষ্টি থামিয়াছে, কিন্তু আকাশে মেঘের অবকাশ নাই। এখানকার পুরুষেরা যেমন কালো টুপি মাথায় দিয়া মলিন বর্ণের কোর্তা পরিয়া বেড়ায়, এখানকার দেবতাও সেইরকম অত্যন্ত গম্ভীর ভদ্রবেশে আচ্ছন্ন হইয়া দেখা দিলেন। কিন্তু, এই ঘনগাম্ভীর্যের ছায়াতলেও এখানকার পল্লীশ্রী সৌন্দর্য-ঢাকা পড়িল না। গুল্মশ্রেণীর বেড়ার দ্বারা বিভক্ত ঢেউখেলানো প্রান্তরের প্রগাঢ় শ্যামলিমা দুই চক্ষুকে স্নিগ্ধতায় অভিষিক্ত করিয়া দিল। জায়গাটা পাহাড়ে বটে, কিন্তু পাহাড়ের উগ্র বন্ধুরতা কোথাও নাই—আমাদের দেশের রাগিণীতে যেমন সুরের গায়ে সুর মীড়ের টানে ঢলিয়া পড়ে, এখানকার মাটির উচ্ছ্বাসগুলি তেমনি ঢালু হইয়া পরস্পর গায়ে গায়ে মিলিয়া রহিয়াছে; ধরিত্রীর সুরবাহারে যেন কোন্‌ দেবতা নিঃশব্দ রাগিণীতে মেঘমল্লারের গৎ বাজাইতেছেন। আমাদের দেশের যে-সকল প্রদেশ পার্বত্য, সেখানকার যেমন একটা উদ্‌ধত মহিমা আছে এখানে তাহা দেখা যায় না। চারি দিকে চাহিয়া দেখিলে মনে হয়, বন্য প্রকৃতি এখানে সম্পূর্ণ পোষ মানিয়াছে। যেন মহাদেবের বাহন বৃষ—শরীরটি নধর চিক্কণ, নন্দীর তর্জনী-সংকেত মানিয়া তাহার পায়ের কাছে শিঙ নামাইয়া শান্ত হইয়া পড়িয়া আছে, প্রভুর তপোবিঘ্নের ভয়ে হাম্বাধ্বনিও করিতেছে না।
    পথে চলিতে চলিতে ঊট্রম সাহেব একজন পথিকের সঙ্গে কিছু কাজের কথা আলাপ করিয়া লইলেন। ব্যাপারটা এই
স্থানীয় চাষী গৃহস্থদিগকে নিজেদের ভিটার চারি দিকে খানিকটা করিয়া বাগান করিতে উৎসাহ দিবার জন্য, ইঁহারা একটি কমিটি করিয়া উৎকর্ষ সাধন-অনুসারে পুরস্কারের ব্যবস্থা করিয়াছেন। অল্পদিন হইল পরীক্ষা হইয়া গিয়াছে, তাহাতে এই পথিকটি পুরস্কারের অধিকারী হইয়াছে। ঊট্রম সাহেব আমাকে কয়েকটি চাষী গৃহস্থের বাড়ি দেখাইতে লইয়া গেলেন। তাহারা প্রত্যেকেই নিজের কুটীরের চারি দিকে বহু যত্নে খানিকটা করিয়া ফুলের ও তরকারির বাগান করিয়াছে। ইহারা সমস্ত দিন মাঠের কাজে খাটিয়া সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরিয়া এই বাগানের কাজ করে। এমনি করিয়া গাছ পালার প্রতি ইহাদের এমন একটা আনন্দের টান হয় যে, এই অতিরিক্ত পরিশ্রম ইহাদের গায়ে লাগে না। ইহার আর-একটি সুফল এই যে, এই উৎসাহে মদের নেশাকে খেদাইয়া রাখে। বাহিরকে রমণীয় করিয়া তুলিবার এই চেষ্টায় নিজের অন্তরকেও ক্রমশ সৌন্দর্যের সুরে বাঁধিয়া তোলা হয়। এখানকার পল্লীবাসীর সঙ্গে ঊট্রম সাহেবের হিতানুষ্ঠানের সম্বন্ধ আরও নানা দিক হইতে দেখিয়াছি। এইপ্রকার মঙ্গলব্রতে-নিয়ত-উৎসর্গ-করা জীবন যে কী সুন্দর তাহা ইঁহাকে দেখিয়া অনুভব করিয়াছি। ভগবানের সেবার অমৃতরসে ইঁহার জীবন পরিপক্ক মধুর ফলের মতো নম্র হইয়া পড়িয়াছে। ইঁহার ঘরের মধ্যে ইনি একটি পুণ্যের প্রদীপ জ্বালিয়া রাখিয়াছেন; অধ্যয়ন ও উপাসনার দ্বারা ইঁহার গার্হস্থ্য প্রতিদিন ধৌত হইতেছে; ইঁহার আতিথ্য যে কিরূপ সহজ ও সুন্দর তাহা আমি ভুলিতে পারিব না।
    এই-যে এক-একটি করিয়া পাদ্রি কয়েকটি গ্রামের কেন্দ্রে বসিয়া আছেন, ইহার সার্থকতা এবার আমি স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম। এই সর্বদেশব্যাপী ব্যূহবদ্ধ চেষ্টার দ্বারা নিতান্ত গণ্ডগ্রামগুলি মধ্যে একটা উন্নতির প্রয়াস জাগ্রত হইয়া আছে। এইরূপে ধর্ম এ দেশে শুভকর্ম-আকারে চারি দিকে বিস্তীর্ণ হইয়া রহিয়াছে। একটি বৃহৎ ব্যবস্থার সূত্রে এ দেশের সমস্ত লোকালয় মালার-মতো গাঁথা হইয়াছে। আমাদের মতো যাহারা এইপ্রকার সর্বজনীন ব্যবস্থার অভাবে পীড়িত হইতেছে তাহারাই জানে ইহা কতবড়ো একটি কল্যাণ।
    মানুষ এমন কোনো নিখুঁত ব্যবস্থা চিরকালের মতো পাকা করিয়া গড়িয়া রাখিতে পারে না যাহার মধ্যে কোনো ভণ্ডামি, কোনো অনর্থ কোনো কালে প্রবেশ করিবার পথ না পায়। এ দেশের ধর্মমত ও ধর্মতন্ত্রের সঙ্গে এখনকার উন্নতিশীল কালের কিছু কিছু অসামঞ্জস্য ঘটিতেছে, এ কথা সকলেই জানে। আমি এখানকার অনেক ভালো লোকের মুখে শুনিয়াছি, ভজনালয়ে যাওয়া তাঁহাদের পক্ষে অসাধ্য হইয়াছে। যে-সকল কথা বিশ্বাস করা অসম্ভব তাহাকে অন্ধভাবে স্বীকার করিবার পাপে তাঁহারা লিপ্ত হইতে চান না। এইরূপে দেশপ্রচলিত ধর্মমত নানা স্থানে জীর্ণ হইয়া পড়াতে ধর্মের আশ্রয়কে তাঁহারা সর্বাংশেই পরিত্যাগ করিয়াছেন। এইরূপ সময়েই নানা কপটাচার বৃদ্ধ ধর্মমতকে আশ্রয় করিয়া তাহাকে আরও রোগাতুর করিয়া তোলে। আজকালকার দিনে নিঃসন্দেহই চার্চের মধ্যে এমন অনেক পাদ্রি আসন গ্রহণ করিয়াছেন যাঁহারা যাহা বিশ্বাস করেন না তাহা প্রচার করেন, এবং যাহা প্রচার করেন তাহাকে কায়ক্লেশে বিশ্বাস করিবার জন্য নিজেকে ভোলাইবার আয়োজন করিতে থাকেন। এই মিথ্যা যে সমাজকে নানা প্রকারে আঘাত করিতেছে তাহাতে সন্দেহ নাই। চিরদিনই গোঁড়ামি ধর্মের সিংহদ্বারকে এমন সংকীর্ণ করিয়া ধরে যাহাতে করিয়া ক্ষুদ্রতাই প্রবেশ করিবার পথ পায়, মহত্ত্ব বাহিরে পড়িয়া থাকে। এইরূপে য়ুরোপে যাঁহারা জ্ঞানে প্রাণে হৃদয়ে মহৎ তাঁহারা অনেকেই য়ুরোপের ধর্মতন্ত্রের বাহিরে পড়িয়া গিয়াছেন। এ অবস্থা কখনোই কল্যাণকর হইতে পারে না।
    কিন্তু, য়ুরোপকে তাহার প্রাণশক্তি রক্ষা করিতেছে। তাহা কোনো একটা জায়গায় আটকা পড়িয়া বসিয়া থাকে না। চলা তাহার ধর্ম
গতির বেগে সে আপনার বাধাকে কেবলই আঘাত করিয়া ক্ষয় করিতেছে। খৃস্টান-ধর্মমত যে পরিমাণে সংকুচিত হইয়া এই স্রোতের বেগকে বাধা দিতেছে সেই পরিমাণে ঘা খাইয়া তাহাকে প্রশস্ত হইতে হইবে। সেই প্রক্রিয়া প্রত্যহই চলিতছে; অবশেষে এখনকার মনীষীরা যাহাকে খৃষ্টানধর্ম বলিয়া পরিচয় দিতেছেন তাহা নিজের স্থূল আবরণ সম্পূর্ণ পরিহার করিয়াছে। তাহা ত্রিত্ববাদ মানে না, যিশুকে অবতার বলিয়া স্বীকার করে না, খৃস্টানপুরাণ-বর্ণিত অতিপ্রাকৃত ঘটনায় তাহার আস্থা নাই, তাহা মধ্যস্থবাদীও নহে। য়ুরোপের ধর্মপ্রকৃতির মধ্যে একটা খুব আলোড়ন উপস্থিত হইয়াছে। অতএব ইহা নিশ্চিত, য়ুরোপ কখনোই আপনার সনাতন ধর্মমতকে আপনার সর্বাঙ্গীণ উন্নতির চেয়ে নীচে ঝুলিয়া পড়িতে দিয়া নিজেকে এত বড়ো একটা বোঝায় চিরকাল ভারাক্রান্ত করিয়া রাখিবে না।
    যাহাই হউক, পাদ্রিরা এই-যে ধর্মমতের জাল দিয়া সমস্ত দেশকে বেষ্টন করিয়া বসিয়া আছে, ইহাতে সময়ে সময়ে দশের উন্নতিকে কিছু কিছু বাধা দেওয়া সত্ত্বেও মোটের উপর ইহাতে যে দেশের ভিতরকার উচ্চ সুরকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই। আমাদের দেশে ব্রাহ্মণদের এই কাজ ছিল। কিন্তু ব্রাহ্মণের কর্তব্য বর্ণগত হওয়াতে তাহা স্বভাবতই আপন কর্তব্যের দায়িত্ব হারাইয়া ফেলিয়াছে। ব্রাহ্মণের কর্তব্যের আদর্শ যতই উচ্চ হইবে ততই তাহা বিশেষ যোগ্য ব্যক্তির বিশেষ শিক্ষা ও ক্ষমতার উপর নির্ভর করিবে
যখনি সমাজের কোনো বিশেষ শ্রেণীর মধ্যে এই দায়িত্বকে বংশগত করিয়া দেওয়া হইয়াছে তখনি আদর্শকে যতদূর সম্ভব খর্ব করিয়া দেওয়া হইয়াছে। ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মগ্রহণের দ্বারাই মানুষ ব্রাহ্মণ হইতে পারে, এই নিতান্ত স্বভাববিরুদ্ধ মিথ্যার বোঝা আমাদের সমাজ চোখ বুজিয়া বহন করিয়া আসাতেই তাহার ধর্ম প্রাণহীন ও প্রথাগত অন্ধ সংস্কারে পরিণত হইতেছে। যে ব্রাহ্মণকে সমাজ ভক্তি করিতে বাধ্য হইয়াছে সে ব্রাহ্মণ চরিত্রে ও ব্যবহারে ভক্তিভাজন হইবার জন্য নিজেকে বাধ্য মনে করে না; সে কেবলমাত্র পৈতার লাগামের দ্বারা সমাজকে চালনা করিয়া তাহাকে নানা দিকে কিরূপ হীনতার মধ্যে উত্তীর্ণ করিয়া দিতেছে, তাহা অভ্যাসের অন্ধতা-বশতই আমরা বুঝিতে পারি না। এখানে প্রত্যেক পাদ্রিই যে অকৃত্রিম নিষ্ঠার সহিত খৃস্টানধর্মের আদর্শ নিজের জীবনে গ্রহণ করিয়াছে এ কথা আমি বিশ্বাস করি না; কিন্তু ইহারা বংশগত পাদ্রি নহে, সমাজের কাছে ইহাদের জবাবদিহি আছে, নিজের চরিত্রকে আচরণকে ইহারা কলুষিত করিতে পারে না সুতরাং আর-কিছুই না হোক, সেই নির্মল চরিত্রের, সেই ধর্মনৈতিক সাধনার সুরটিকে যথাসাধ্য দেশের কাছে ইহারা ধরিয়া রাখিয়াছে। শাস্ত্রে যাহাই বলুক, ব্যবহারতঃ অধার্মিক ব্রাহ্মণকে দিয়া ধর্মকর্ম করাইতে আমাদের সমাজের কিছুমাত্র লজ্জা সংকোচ নাই। ইহাতে ধর্মের সঙ্গে পুণ্যের আন্তরিক বিচ্ছেদ না ঘটিয়া থাকিতে পারে না ইহাতে আমাদের মনুষ্যত্বকে আমরা প্রত্যহ অবমানিত করিতেছি। এখানে অধার্মিক পাদ্রিকে সমাজ কখনোই ক্ষমা করিবে না; সে পাদ্রি হয়তো ভক্তিমান না হইতে পারে, কিন্তু তাহাকে চরিত্রবান হইতেই হইবে এই উপায়েই সমাজ নিজের মনুষ্যত্বের প্রতি সম্মান রক্ষা করিতেছে এবং নিঃসন্দেহই চরিত্রসম্পদে তাহার পুরষ্কার লাভ করিতেছে।
    তাই বলিতেছিলাম, এখানকার পাদ্রির দল সমস্ত দেশের জন্য একটা ধর্মনৈতিক মোটা-ভাত মোটা-কাপড়ের ব্যবস্থা করিয়াছে। কিন্তু সেইটুকুতেই তো সন্তুষ্ট হওয়ার কথা নহে। সমস্ত দেশের সামনে ক্ষণে ক্ষণে যে বড়ো বড়ো ধর্মসমস্যা উপস্থিত হয়, খৃস্টের বাণীর সঙ্গে সুর মিলাইয়া পাদ্রিরা তো তাহার মীমাংসা করেন না। দেশের চিত্তের মধ্যে খৃস্টকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া রাখিবার যে ভার তাঁহারা লইয়াছেন, এইখানে পদে পদে তাহার ব্যত্যয় দেখিতে পাই। যখন বোয়ার-যুদ্ধ উপস্থিত হইয়াছিল তখন সমস্ত দেশের পাদ্রিরা তাহার কিরূপ বিচার করিয়াছিলেন। এই-যে পারস্যকে দুই টুক্‌রা করিয়া কুটিয়া ফেলিবার জন্য য়ুরোপের দুই মোটা মোটা গৃহিণী বঁটি পাতিয়া বসিয়াছেন
পাদ্রিরা চুপ করিয়া আছেন কেন! ভারতবর্ষে কুলিসংগ্রহ ব্যাপারে, কুলি খাটাইবার ব্যবস্থায়, সেখানকার শাসনতন্ত্রে, সেখানে দেশীয়দের প্রতি ইংরেজের ব্যবহারে এমন-কি, কোনো অবিচার ঘটে না যাহাতে খৃস্টের নাম লইয়া তাঁহারা সকলে মিলিয়া দুর্বল অপমানিতের পাশে আসিয়া দাঁড়াইতে পারেন। তেমন স্বর্গীয় দৃশ্য কি আমরা দেখিয়াছি। ইংরেজিতে 'পয়সার বেলায় পাকা টাকার বেলায় বোকা' বলিয়া একটা চলতি কথা আছে, বড়ো বড়ো খৃস্টানদেশের ধর্মনৈতিক আচরণে আমরা তাহার পরিচয় প্রতিদিন পাইতেছি; তাঁহারা ব্যক্তিগত নৈতিক আদর্শকে আঁট করিয়া রাখিতে চান অথচ সমস্ত জাতি ব্যূহবদ্ধ হইয়া এমন-সকল প্রকাণ্ড পাপাচরণে নির্লজ্জভাবে প্রবৃত্ত হইতেছেন যাহাতে সুদূরব্যাপী দেশ ও কালকে আশ্রয় করিয়া দুর্বিষহ দুঃখদুর্গতির সৃষ্টি করিতেছে; এমন দুর্দিনে অনেক মহাত্মাকে স্বজাতির এই সর্বজনীন শয়তানির বিরুদ্ধে নির্ভয়ে লড়িতে দেখিয়াছি, কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে পাদ্রি কয়জন। এমন-কি, গণনা করিলে দেখা যাইবে, তাঁহাদের মধ্যে অধিকাংশই প্রচলিত খৃস্টানধর্মে আস্থাবান নহেন। অথচ চার্চের চির-প্রথাসম্মত কোনো বাহ্য পূজাবিধিতে সামান্য একটু নড়চড় ঘটাইলে সমস্ত পাদ্রিসমাজে বিষম হুলস্থূল পড়িয়া যায়। এইজন্যই কি যিশু তাঁহার রক্ত দিয়াছিলেন। জগতের সম্মুখে ইহা কোন্‌ সুসমাচার প্রচার করিতেছে, খৃস্টানদেশের পাদ্রির দল স্বজাতির ধর্ম-তহবিলের শিকপয়সা আধপয়সা আগ্‌লাইয়া বসিয়া আছেন, কিন্তু বড়ো বড়ো ‘কোম্পানির কাগজ’ ফুঁকিয়া দিবার বেলায় তাঁহাদের হুঁস নাই। তাঁহারা তাঁহাদের দেবতাকে কড়ির মূল্যে সম্মান করেনও মোহরের মূল্যে অপমানিত করিয়া থাকেন, ইহাই প্রতিদিন দেখিতেছি। পাদ্রিদের মধ্যে এমন মহদাশয় আছেন যাঁহারা অকৃত্রিম বিশ্ববন্ধু, কিন্তু সে তাঁহাদের ব্যক্তিগত মাহাত্ম্য। কিন্তু, দলের দিকে তাকাইলে এই কথা মনে আসে যে, ধর্মকে দলের হাতে সমর্পণ করিলে তাহাকে খানিকটা পরিমাণে দলিত করা হয়ই। ইহাতেও একপ্রকার জাত তৈরি করা হয়, তাহা বংশগত জাতের চেয়ে অনেক বিষয়ে ভালো হইলেও তাহাতে জাতের বিষ খানিকটা থাকিয়া যায় ও তাহা জমিয়া উঠিতে থাকে। ধর্ম মানুষকে মুক্তি দেয়, এইজন্য ধর্মকে সকলের চেয়ে মুক্ত রাখা চাই; কিন্তু, ধর্ম যেখানে দলের বেড়ায় আটকা পড়ে সেখানেই ক্রমশ তাহার ছোটো দিকটাই বড়ো দিকের চেয়ে বড়ো হইয়া উঠে, বাহিরের জিনিস অন্তরের জিনিসকে আচ্ছন্ন করে ও যাহা সাময়িক তাহা নিত্যকে পীড়া দিতে থাকে। এইজন্যই সমস্ত দেশ জুড়িয়া পাদ্রির দল বসিয়া থাকা সত্ত্বেও নিদারুণ দস্যুবৃত্তি ও কসাইবৃত্তি করিতে রাষ্ট্রনৈতিক অধিনায়কদের লেশমাত্র সংকোচ বোধ হয় না; তাঁহাদের সেই পুণ্যজ্যোতি নাই যাহার সম্মুখে এই-সকল বিরাট পাপের কলঙ্ককালিমা সর্বসমক্ষে বীভৎসরূপে উদ্‌ঘাটিত হয়।