ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


সানাই


 

              মানসী
আজি আষাঢ়ের মেঘলা আকাশে
        মনখানা উড়ো পক্ষী
বাদলা হাওয়ায় দিকে দিকে ধায়
       অজানার পানে লক্ষ্যি ।
যাহা-খুশি বলি স্বগত কাকলি,
      লিখিবারে চাহি পত্র,
গোপন মনের শিল্পসূত্রে
     বুনানো দু-চারি ছত্র ।
সঙ্গীবিহীন নিরালায় করি
    জানা-অজানার সন্ধি,
গর্‌ঠিকানিয়া বন্ধু কে আছ
    করিব বাণীর বন্দী ।
না জানি তোমার নামধাম আমি,
    না জানি তোমার তথ্য ।
কিবা আসে যায় যে হও সে হও
    মিথ্যা অথবা সত্য ।
নিভৃতে তোমারি সাথে আনাগোনা
    হে মোর অচিন মিত্র,
প্রলাপী মনেতে আঁকা পড়ে তব
    কত অদ্ভুত চিত্র ।
যে নেয় নি মেনে মর্ত শরীরে
    বাঁধন পাঞ্চভৌত্যে
তার সাথে মন করেছি বদল
    স্বপ্নমায়ার দৌত্যে ।
ঘুমের ঘোরেতে পেয়েছি তাহার
    রুক্ষ চুলের গন্ধ ।
আধেক রাত্রে শুনি যেন তার —
   দ্বার-খোলা, দ্বার-বন্ধ ।
নীপবন হতে সৌরভে আনে
   ভাষাবিহীনার ভাষ্য ।
জোনাকি আঁধারে ছড়াছড়ি করে
    মণিহার-ছেঁড়া-হাস্য ।
সঘন নিশীথে গর্জিছে দেয়া,
    রিমিঝিমি বারি বর্ষে —
মনে মনে ভাবি, কোন্‌ পালঙ্কে
    কে নিদ্রা দেয় হর্ষে ।
গিরির শিখরে ডাকিছে ময়ূর
    কবিকাব্যের রঙ্গে —
স্বপ্নপুলকে কে জাগে চমকি
    বিগলিতচীর-অঙ্গে ।
বাস্তব মোরে বঞ্চনা করে
    পালায় চকিত নৃত্যে —
তারি ছায়া যবে রূপ ধরি আসে
    বাঁধা পড়ি যায় চিত্তে ।
তারার আলোকে ভরে সেই সাকী
    মদিরোচ্ছল পাত্র,
নিবিড় রাতের মুগ্ধ মিলনে
    নাই বিচ্ছেদ মাত্র ।
ওগো মায়াময়ী, আজি বরষায়
    জাগালে আমার ছন্দ —
যাহা-খুশি সুরে বাজিছে সেতার,
    নাহি মানে কোনো বন্ধ ।
 

[কালিম্পিং]

১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭


         
 অসম্ভব ছবি
আলোকের আভা তার অলকের চুলে,
      বুকের কাছেতে হাঁটু তুলে
বসে আছে ঠেস দিয়ে পিপুলগুঁড়িতে,
      পাশেই পাহাড়ে নদী নুড়িতে নুড়িতে
              ফুলে উঠে চলে যায় বেগে ।
      দেবদারু-ছায়াতলে উঠে জেগে
                      কলস্বর,
কান পেতে শোনে তাই প্রাচীন পাথর —
           অরণ্যের কোল
     যেন মুখরিয়া তোলে শিশুর কল্লোল ।
ইংরেজ কবির লেখা একমনে পড়িছে তরুণী,
   গুন্‌গুন্‌ রব তার পিছনে দাঁড়ায়ে আমি শুনি ;
          মৃদু বেদনায় ভাবি, যে-কবির বাণী
               পড়িছে বিরাম নাহি মানি,
                   আমি কেন সে কবি না হই ।
              এতদিন নানাভাবে কাব্যে যাহা কই
     আজি এ গিরির মতো কেন সে নির্বাক ।
অদূরে মাদার-শাখে ঘুঘু দেয় ডাক ।
          আমার মর্মের ছন্দ পাখির ভাষায়
                  অফুরান নৈরাশায়
    উছলিতে থাকে একতানে
         আন-মননীর কানে কানে ।
আতপ্ত হতেছে দিন, শিশির শুকায়ে গেছে ঘাসে,
    অজানা ফুলের গুচ্ছ উচ্চ শাখে দুলিছে বাতাসে ।
         ঢালু তটে তরুচ্ছায়াতলে
              ঝিলিমিলি শিহরন ঝরনার জলে ।
    চূর্ণ কেশে নিত্য চঞ্চলতা,
দুর্বাধ্য পড়িছে চোখে, অধ্যয়নরতা
    সরায়ে দিতেছে বারংবার
বাহুক্ষেপে । ধৈর্য মোর রহিল না আর ;
     চকিতে সম্মুখ আসি শুধালাম,

  "তুমি কি শোন নি মোর নাম।"

মুখে তার সে কি অসন্তোষ,

   সে কি লজ্জা, সে কি রোষ,

     সে কি সমুদ্ধত অহংকার।

          উত্তর শোনার

    অপেক্ষা না করি আমি দ্রুত গেনু চলি।

          ঘুঘুর কাকলি

   ঘন পল্লবের মাঝে আশ্বিন রৌদ্র ও ছায়ারে

           ব্যথিত করিছে চির নিরুত্তর ব্যর্থতার ভারে।

 

মিথ্যা, মিথ্যা এ স্বপন, ঘরে ফিরে বসিয়া নির্জনে

       শৈল-অরণ্যের সেই ছবিখানি আনি মনে-মনে

                অসম্ভব রচনায়

      পূরণ করিনু তারে ঘটে নি যা সেই কল্পনায়।

 

      যদি সত্য হ'ত যদি বলিতাম কিছু,

          শুনিত সে মাথা করি নিচু,

               কিংবা যদি সুতীব্র চাহনি

                    বিদ্যুৎবাহনী

              কটাক্ষে হানিত মুখে

      রক্ত মোর আলোড়িয়া বুকে,

   কিংবা যদি চলে যেত অঞ্চল সংবরি

শুষ্কপত্রপরিকীর্ণ বনপথ সচকিত করি,

    আমি রহিতাম চেয়ে

        হেসে উঠিতাম গেয়ে-

   "চলে গেলে হে রূপসী, মুখখানি ঢেকে,

বঞ্চিত কর নি মোরে, পিছনে গিয়েছে কিছু রেখে।"

 

          হায় রে, হয় নি কিছু বলা

    হয় নি ছায়ার পথে ছায়াসম চলা,

         হয়তো সে শিলাতল-'পরে

   এখনো পড়িছে কাব্য গুন্‌গুন্ স্বরে।

শান্তিনিকেতন

১৬ জুলাই ১৯৪০


                     
অসম্ভব
পূর্ণ হয়েছে বিচ্ছেদ, যবে ভাবিনু মনে,
একা একা কোথা চলিতেছিলাম নিষ্কারণে ।
শ্রাবণের মেঘ কালো হয়ে নামে বনের শিরে,
খর বিদ্যুৎ রাতের বক্ষ দিতেছে চিরে,
দূর হতে শুনি বারুণী নদীর তরল রব —
মন শুধু বলে, অসম্ভব এ অসম্ভব ।

এমনি রাত্রে কতবার, মোর বাহুতে মাথা,
শুনেছিল সে যে কবির ছন্দে কাজরি-গাথা ।
রিমিঝিমি ঘন বর্ষণে বন রোমাঞ্চিত,
দেহে আর মনে এক হয়ে গেছে যে-বাঞ্ছিত
এল সেই রাতি বহি শ্রাবণের সে-বৈভব —
মন শুধু বলে, অসম্ভব এ অসম্ভব ।

দূরে চলে যাই নিবিড় রাতের অন্ধকারে,
আকাশের সুর বাজিছে শিরায় বৃষ্টিধারে ।
যূথীবন হতে বাতাসেতে আসে সুধার স্বাদ,
বেণীবাঁধনের মালায় পেতেম যে-সংবাদ
এই তো জেগেছে নবমালতীর সে সৌরভ —
মন শুধু বলে, অসম্ভব এ অসম্ভব ।

ভাবনার ভুলে কোথা চলে যাই অন্যমনে
পথসংকেত কত জানায়েছে যে-বাতায়নে ।
শুনিতে পেলেম সেতারে বাজিছে সুরের দান
অশ্রুজলের আভাসে জড়িত আমারি গান ।
কবিরে ত্যজিয়া রেখেছ কবির এ গৌরব —
মন শুধু বলে, অসম্ভব এ অসম্ভব ।
 

শান্তিনিকেতন

১৬ জুলাই ১৯৪০


               
গানের মন্ত্র
মাঝে মাঝে আসি যে তোমারে
        গান শিখাবারে —
মনে তব কৌতুক লাগে,
       অধরের আগে
দেখা দেয় একটুকু হাসির কাঁপন ।
       যে-কথাটি আমার আপন
            এই ছলে হয় সে তোমারি ।
তারে তারে সুর বাঁধা হয়ে যায় তারি
     অন্তরে অন্তরে
         কখন তোমার অগোচরে ।
     চাবি করা চুরি,
প্রাণের গোপন দ্বারে প্রবেশের সহজ চাতুরী,
          সুর দিয়ে পথ বাঁধা
যে-দুর্গমে কথা পেত পদে পদে পাষাণের বাধা —
      গানের মন্ত্রেতে দীক্ষা যার
           এই তো তাহার অধিকার ।
     সেই জানে দেবতার অলক্ষিত পথ
শূন্যে শূন্যে যেথা চলে মহেন্দ্রের শব্দভেদী রথ ।
    ঘনবর্ষণের পিছে যেমন সে বিদ্যুতের খেলা
                বিমুখ নিশীথবেলা,
   অমোঘ বিজয়মন্ত্র হানে
       দূর দিগন্তের পানে,
   আঁধারের সংকোচ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে
            মেঘমল্লারের ঝড়ে ।

শান্তিনিকেতন
১৮ জুলাই ১৯৪০


           
স্বল্প
জানি আমি, ছোটো আমার ঠাঁই —
    তাহার বেশি কিছুই চাহি নাই ।
        দিয়ো আমায় সবার চেয়ে অল্প তোমার দান,
            নিজের হাতে দাও তুলে তো
                রইবে অফুরান ।

আমি তো নই কাঙাল পরদেশী,
    পথে পথে খোঁজ করে যে
        যা পায় তারো বেশি ।
            সকলটুকুই চায় সে পেতে হাতে,
                পুরিয়ে নিতে পারে না সে
                    আপন দানের সাথে ।

তুমি শুনে বললে আমায় হেসে,
    বললে ভালোবেসে,
       ‘ আশ মিটিবে এইটুকুতেই তবে ?”
            আমি বলি, “ তার বেশি কী হবে ।
                 যে-দানে ভার থাকে
                      বস্তু দিয়ে পথ সে কেবল
                            আটক করে রাখে ।

যে-দান কেবল বাহুর পরশ তব
    তারে আমি বীণার মতো বক্ষে তুলে লব ।
        সুরে সুরে উঠবে বেজে,
             যেটুকু সে তাহার চেয়ে
                  অনেক বেশি সে যে ।
লোভীর মতো তোমার দ্বারে
     যাহার আসা-যাওয়া
        তাহার চাওয়া-পাওয়া
     তোমায় নিত্য খর্ব করে আনে
             আপন ক্ষুধার পানে ।
     ভালোবাসার বর্বরতা,
   মলিন করে তোমারি সম্মান
       পৃথুল তার বিপুল পরিমাণ ।
তাই তো বলি, প্রিয়ে,
    হাসিমুখে বিদায় কোরো স্বল্প কিছু দিয়ে ;
        সন্ধ্যা যেমন সন্ধ্যাতারাটিরে
            আনিয়া দেয় ধীরে
                 সূর্য-ডোবার শেষ সোপানের ভিতে
                      সলজ্জ তার গোপন থালিটিতে । ”
 

শান্তিনিকেতন

১৭ জুলাই ১৯৪০


               
অবসান
জানি দিন অবসান হবে,
    জানি তবু কিছু বাকি রবে।
       রজনীতে ঘুমহারা পাখি
          এক সুরে গাহিবে একাকী—
              যে শুনিবে, সে রহিবে জাগি
    সে জানিবে, তারি নীড়হারা
         স্বপন খুঁজিছে সেই তারা
              যেথা প্রাণ হয়েছে বিবাগী।
কিছু পরে করে যাবে চুপ
    ছায়াঘন স্বপনের রূপ।
        ঝরে যাবে আকাশকুসুম,
            তখন কূজনহীন ঘুম
                এক হবে রাত্রির সাথে।
     যে-গান স্বপনে নিল বাসা
          তার ক্ষীণ গুঞ্জন-ভাষা
               শেষ হবে সব-শেষ রাতে।
 

[শান্তিনিকেতন

১৯ জুলাই ১৯৪০