ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


সানাই


 

             জ্যোতির্বাষ্প
হে বন্ধু, সবার চেয়ে চিনি তোমাকেই
         এ কথায় পূর্ণ সত্য নেই ।
চিনি আমি সংসারের শত-সহস্রেরে
        কাজের বা অকাজের ঘেরে
নির্দিষ্ট সীমায় যারা স্পষ্ট হয়ে জাগে,
       প্রত্যহের ব্যবহারে লাগে,
            প্রাপ্য যাহা হাতে দেয় তাই,
                  দান যাহা তাহা নাহি পাই ।

অনন্তের সমুদ্রমন্থনে
     গভীর রহস্য হতে তুমি এলে আমার জীবনে ।
            উঠিয়াছ অতলের অস্পষ্টতাখানি
                  আপনার চারি দিকে টানি ।
নীহারিকা রহে যথা কেন্দ্রে তার নক্ষত্রেরে ঘেরি,
জ্যোতির্ময় বাষ্প-মাঝে দূরবিন্দু তারাটিরে হেরি ।
তোমা-মাঝে শিল্পী তার রেখে গেছে তর্জনীর মানা,
            সব নহে জানা ।
সৌন্দর্যের যে-পাহারা জাগিয়া রয়েছে অন্তঃপুরে
        সে আমারে নিত্য রাখে দূরে ।

[শান্তিনিকেতন]
২৮ মার্চ ১৯৪০


           
জানালায়
বেলা হয়ে গেল, তোমার জানালা- ' পরে
        রৌদ্র পড়েছে বেঁকে ।
এলোমেলো হাওয়া আমলকি-ডালে-ডালে
         দোলা দেয় থেকে থেকে ।
      মন্থর পায়ে চলেছে মহিষগুলি,
রাঙা পথ হতে রহি রহি ওড়ে ধূলি,
        নানা পাখিদের মিশ্রিত কাকলিতে,
    আকাশ আবিল ম্লান সোনালির শীতে ।
পসারী হোথায় হাঁক দিয়ে যায়
             গলি বেয়ে কোন্‌ দূরে,
ভুলে গেছি যাহা তারি ধ্বনি বাজে
              বক্ষে করুণ সুরে ।
          চোখে পড়ে খনে খনে
       তব জানালায় কম্পিত ছায়া
              খেলিছে রৌদ্র-সনে ।

      কেন মনে হয়, যেন দূর ইতিহাসে
                 কোনো বিদেশের কবি
      বিদেশী ভাষার ছন্দে দিয়েছে এঁকে
                এ বাতায়নের ছবি ।
ঘরের ভিতরে যে-প্রাণের ধারা চলে
       সে যেন অতীত কাহিনীর কথা বলে ।
            ছায়া দিয়ে ঢাকা সুখদুঃখের মাঝে
                  গুঞ্জনসুরে সুরশৃঙ্গার বাজে ।
যারা আসে যায় তাদের ছায়ায়
      প্রবাসের ব্যথা কাঁপে,
আমার চক্ষু তন্দ্রা-অলস
       মধ্যদিনের তাপে ।
ঘাসের উপরে একা বসে থাকি,
       দেখি চেয়ে দূর থেকে,
শীতের বেলায় রৌদ্র তোমার
       জানালায় পড়ে বেঁকে ।

[উদীচী। শান্তিনিকেতন]
  ১৫ জানুয়ারি ১৯৪০


               
ক্ষণিক
এ চিকন তব লাবণ্য যবে দেখি
         মনে মনে ভাবি, এ কি
ক্ষণিকের 'পরে অসীমের বরদান,
       আড়ালে আবার ফিরে নেয় তারে
              দিন হলে অবসান ।
    একদা শিশিররাতে
           শতদল তার দল ঝরাইবে
                হেমন্তে হিমপাতে,
    সেই যাত্রায় তোমারো মাধুরী
               প্রলয়ে লভিবে গতি ।
    এতই সহজে মহাশিল্পীর
             আপনার এত ক্ষতি
          কেমন করিয়া সয়,
প্রকাশে বিনাশে বাঁধিয়া সূত্র
            ক্ষয়ে নাহি মানে ক্ষয় ।
যে দান তাহার সবার অধিক দান
           মাটির পাত্রে সে পায় আপন স্থান ।
                  ক্ষণভঙ্গুর দিনে
নিমেষ-কিনারে বিশ্ব তাহারে
              বিস্ময়ে লয় চিনে ।
        অসীম যাহার মূল্য সে-ছবি
              সামান্য পটে আঁকি
     মুছে ফেলে দেয় লোলুপেরে দিয়ে ফাঁকি ।
দীর্ঘকালের ক্লান্ত আঁখির উপেক্ষা হতে তারে
           সরায় অন্ধকারে ।
দেখিতে দেখিতে দেখে না যখন প্রাণ
       বিস্মৃতি আসি অবগুণ্ঠনে
                রাখে তার সম্মান ।
        হরণ করিয়া লয় তারে সচকিতে,
                লুব্ধ হাতের অঙ্গুলি তারে
                       পারে না চিহ্ন দিতে ।
 

[উদীচী। শান্তিনিকেতন]
  ১৫ জানুয়ারি ১৯৪০


               
অনাবৃষ্টি
প্রাণের সাধন কবে নিবেদন
                   করেছি চরণতলে,
অভিষেক তার হল না তোমার
                   করুণ নয়নজলে।
রসের বাদল নামিল না কেন
                   তাপের দিনে।
ঝরে গেল ফুল, মালা পরাই নি
                  তোমার গলে।

    মনে হয়েছিল, দেখেছি করুণা
               আঁখির পাতে—
উড়ে গেল কোথা শুকনো যূথীর সাথে।
    যদি এ মাটিতে চলিতে চলিতে
             পড়িত তোমার দান
                   এ মাটি লভিত প্রাণ,
     একদা গোপনে ফিরে পেতে তারে
                 অমৃত ফলে।


[শান্তিনিকেতন]
১৩ জানুয়ারি ১৯৪০


           
নতুন রঙ
এ ধূসর জীবনের গোধূলী,
         ক্ষীণ তার উদাসীন স্মৃতি,
মুছে-আসা সেই ম্লান ছবিতে
           রঙ দেয় গুঞ্জনগীতি।

ফাগুনের চম্পকপরাগে
           সেই রঙ জাগে,
ঘুমভাঙা কোকিলের কূজনে
           সেই রঙ লাগে,
সেই রঙ পিয়ালের ছায়াতে
            ঢেলে দেয় পুর্ণিমাতিথি।

এই ছবি ভৈরবী-আলাপে
         দোলে মোর কম্পিত বক্ষে,
সেই ছবি সেতারের প্রলাপে
        মরীচিকা এনে দেয় চক্ষে,
বুকের লালিম-রঙে রাঙানো
        সেই ছবি স্বপ্নের অতিথি।

[শান্তিনিকেতন]
১৩ জানুয়ারি ১৯৪০


          
গানের খেয়া
যে গান আমি গাই
       জানি নে সে
           কার উদ্দেশ্যে।
যবে জাগে মনে
     অকারণে
         চপল হাওয়া
     সুর যায় ভেসে
          কার উদ্দেশ্যে।
ঐ মুখে চেয়ে দেখি,
       জানি নে তুমিই সে কি
অতীত কালের মুরতি এসেছ
            নতুন কালের বেশে।
       কভু জাগে মনে,
যে আসে নি এ জীবনে
               ঘাট খুঁজি খুঁজি
গানের খেয়া সে মাগিতেছে বুঝি
       আমার তীরেতে এসে।


১৩।১।৪০

 

            অধরা
অধরা মাধুরী ধরা পড়িয়াছে
            এ মোর ছন্দবন্ধনে।
বলাকাপাঁতির পিছিয়ে-পড়া ও পাখি,
               বাসা সুদূরের বনের প্রাঙ্গণে।
        গত ফসলের পলাশের রাঙিমারে
              ধরে রাখে ওর পাখা,
        ঝরা শিরীষের পেলব আভাস
               ওর কাকলিতে মাখা।
শুনে যাও বিদেশিনী,
           তোমার ভাষায় ওরে
                 ডাকো দেখি নাম ধ’রে।

        ও জানে তোমারি দেশের আকাশ
               তোমারি রাতের তারা,
                   তব যৌবন-উৎসবে ও যে
                           গানে গানে দেয় সাড়া,
ওর দুটি পাখা চঞ্চলি উঠে তব হৃৎকম্পনে।
               ওর বাসাখানি তব কুঞ্জের
                       নিভৃত প্রাঙ্গণে।

[শান্তিনিকেতন]
১৩ জানুয়ারি ১৯৪০