ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


সানাই


 

               মরিয়া
      মেঘ কেটে গেল
             আজি এ সকাল বেলায়।
      হাসিমুখে এসো
            অলস দিনেরি খেলায়।
আশানিরাশার সঞ্চয় যত
            সুখদুঃখের ঘেরে
ভ’রে ছিল যাহা সার্থকা আর
          নিষ্ফল প্রণয়েরে,
অকূলের পানে দিব তা ভাসায়ে
       ভাঁটার গাঙের ভেলায়।

      যত বাঁধনের
            গ্রন্থন দিব খুলে,
      ক্ষণিকের তবে
            রহিব সকল ভূলে।
     যে গান হয় নি গাওয়া,
     যে দান হয় নি পাওয়া
পুবেন হাওয়ায় পরিতাপ তার
         উড়াইব অবহেলায়।
[১৯৩৯]


              
দূরবর্তিনী
সেদিন তুমি দূরের ছিলে মম,
   তাই ছিলে সেই আসন- 'পরে যা অন্তরতম ।
       অগোচরে সেদিন তোমার লীলা
           বইত অন্তঃশীলা ।
              থমকে যেতে যখন কাছে আসি
       তখন তোমার ত্রস্ত চোখে বাজত দূরের বাঁশি ।
ছায়া তোমার মনের কুঞ্জে ফিরত চুপে চুপে,
    কায়া নিত অপরূপের রূপে ।
        আশার অতীত বিরল অবকাশে
             আসতে তখন পাশে ;
                 একটি ফুলের দানে
চিরফাগুন-দিনের হাওয়া আনতে আমার প্রাণে ।
     অবশেষে যখন তোমার অভিসারের রথ
        পেল আপন সহজ সুগম পথ,
ইচ্ছা তোমার আর নাহি পায় নতুন-জানার বাধা,
      সাধনা নাই, শেষ হয়েছে সাধা ।
তোমার পালে লাগে না আর হঠাৎ দখিন-হাওয়া ;
     শিথিল হল সকল চাওয়া পাওয়া ।
মাঘের রাতে আমের বোলের গন্ধ বহে যায়,
     নিশ্বাস তার মেলে না আর তোমার বেদনায় ।
উদ্‌বেগ নাই, প্রত্যাশা নাই, ব্যথা নাইকো কিছু,
     পোষ-মানা সব দিন চলে যায় দিনের পিছু পিছু ।
             অলস ভালোবাসা
         হারিয়েছে তার ভাষাপারের ভাষা ।
    ঘরের কোণের ভরা পাত্র দুই বেলা তা পাই,
          ঝরনাতলার উছল পাত্র নাই ।
 

?১৯৩৭


               
গান
      যে ছিল আমার স্বপনচারিণী
এতদিন তারে বুঝিতে পারি নি,
           দিন চলে গেছে খুঁজিতে।
     শুভখনে কাছে ডাকিলে,
          লজ্জা আমার ঢাকিলে,
              তোমারে পেরেছি বুঝিতে।

     কে মোরে ফিরাবে অনাদরে,
           কে মোরে ডাকিবে কাছে,
     কাহার প্রেমের বেদনার মাঝে
          আমার মূল্য আছে,
     এ নিরন্তর সংশয়ে আর
         পারি না কেবলি যুঝিতে—
     তোমারেই শুধু সত্য পেরেছি বুঝিতে।

[শ্যামলী। শান্তিনিকেতন]
৮।১২।৩৮


         
বাণীহারা
ওগো মোর    নাহি যে বাণী
    আকাশে হৃদয় শুধু বিছাতে জানি।
       আমি অমাবিভাবরী আলোকহারা
             মেলিয়া তারা
      চাহি নিঃশেষ পথপানে
         নিষ্ফল আশা নিয়ে প্রাণে।
   বহুদূরে বাজে তব বাঁশি,
        সকরুণ সুর আসে ভাসি
               বিহ্বল বায়ে
           নিদ্রাসমুদ্র পারায়ে।
    তোমারি সুরের প্রতিধ্বনি
          দিই যে ফিরায়ে—
   সে কি তব স্বপ্নের তীরে
        ভাঁটার স্রোতের মতো
   লাগে ধীরে, অতি ধীরে ধীরে।
[১৩৪৬]


               
অনসূয়া
কাঁঠালের ভূতি-পচা, আমানি, মাছের যত আঁশ,
              রান্নাঘরের পাঁশ,
     মরা বিড়ালের দেহ, পেঁকো নর্দমায়
বীভৎস মাছির দল ঐকতান-বাদন জমায় ।
         শেষরাত্রে মাতাল বাসায়
স্ত্রীকে মারে, গালি দেয় গদ্‌গদ ভাষায়,
       ঘুমভাঙা পাশের বাড়িতে
পাড়াপ্রতিবেশী থাকে হুংকার ছাড়িতে ।
       ভদ্রতার বোধ যায় চলে,
    মনে হয় নরহত্যা পাপ নয় ব'লে ।
            কুকুরটা, সর্ব অঙ্গে ক্ষত,
     বিছানায় শোয় এসে, আমি নিদ্রাগত ।
নিজেরে জানান দেয় তীব্রকণ্ঠে আত্মশ্লাঘী সতী
        রণচণ্ডা চণ্ডী মূর্তিমতী ।
    মোটা সিঁদুরের রেখা আঁকা,
              হাতে মোটা শাঁখা,
    শাড়ি লাল-পেড়ে,
         খাটো খোঁপা-পিণ্ডটুকু ছেড়ে
    ঘোমটার প্রান্ত ওঠে টাকের সীমায় —
অস্থির সমস্ত পাড়া এ মেয়ের সতী-মহিমায় ।

এ গলিতে বাস মোর, তবু আমি জন্ম-রোমান্টিক —
          আমি সেই পথের পথিক
    যে-পথ দেখায়ে চলে দক্ষিণে বাতাসে,
পাখির ইশারা যায় যে-পথের অলক্ষ্য আকাশে ।
      মৌমাছি যে-পথ জানে
           মাধবীর অদৃশ্য আহ্বানে ।
     এটা সত্য কিংবা সত্য ওটা
           মোর কাছে মিথ্যা সে তর্কটা ।
     আকাশকুসুম-কুঞ্জবনে,
              দিগঙ্গনে
     ভিত্তিহীন যে-বাসা আমার
সেখানেই পলাতকা আসা-যাওয়া করে বার-বার ।
     আজি এই চৈত্রের খেয়ালে
         মনেরে জড়ালো ইন্দ্রজালে ।
                দেশকাল
     ভুলে গেল তার বাঁধা তাল ।
নায়িকা আসিল নেমে আকাশপ্রদীপে আলো পেয়ে ।
            সেই মেয়ে
      নহে বিংশ-শতকিয়া
ছন্দোহারা কবিদের ব্যঙ্গহাসি-বিহসিত প্রিয়া ।
     সে নয় ইকনমিক্‌স্‌-পরীক্ষাবাহিনী
আতপ্ত বসন্তে আজি নিশ্বসিত যাহার কাহিনী ।
        অনসূয়া নাম তার, প্রাকৃতভাষায়
কারে সে বিস্মৃত যুগে কাঁদায় হাসায়,
      অশ্রুত হাসির ধ্বনি মিলায় সে কলকোলাহলে
              শিপ্রাতটতলে ।
   পিনদ্ধ বল্কলবন্ধে যৌবনের বন্দী দূত দোঁহে
        জাগে অঙ্গে উদ্ধত বিদ্রোহে ।
     অযতনে এলায়িত রুক্ষ কেশপাশ
বনপথে মেলে চলে মৃদুমন্দ গন্ধের আভাস ।
      প্রিয়কে সে বলে, ‘ পিয় ',
             বাণী লোভনীয় —
     এনে দেয় রোমা ঞ্চ -হরষ
            কোমল সে ধ্বনির পরশ ।
     সোহাগের নাম দেয় মাধবীরে
            আলিঙ্গনে ঘিরে,
     এ মাধুরী যে দেখে গোপনে
           ঈর্ষার বেদনা পায় মনে ।
 

যখন নৃপতি ছিল উচ্ছৃঙ্খল উন্মত্তের মতো
      দয়াহীন ছলনায় রত
         আমি কবি অনাবিল সরল মাধুরী
             করিতেছিলাম চুরি
     এলা-বনচ্ছায়ে এক কোণে,
   মধুকর যেমন গোপনে
        ফুলমধু লয় হরি
   নিভৃত ভাণ্ডার ভরি ভরি
        মালতীর স্মিত সম্মতিতে ।
   ছিল সে গাঁথিতে
       নতশিরে পুষ্পহার
   সদ্য-তোলা কুঁড়ি মল্লিকার ।
বলেছিনু, আমি দেব ছন্দের গাঁথুনি
     কথা চুনি চুনি ।

        অয়ি মালবিকা
অভিসার-যাত্রাপথে কখনো বহ নি দীপশিখা ।
    অর্ধাবগুণ্ঠিত ছিলে কাব্যে শুধু ইঙ্গিত-আড়ালে,
           নিঃশবদে চরণ বাড়ালে
      হৃদয়প্রাঙ্গণে আজি স্পষ্ট আলোকে —
  বিস্মিত চাহনিখানি বিস্ফারিত কালো দুটি চোখে,
     বহু মৌনী শতাব্দীর মাঝে দেখিলাম —
                 প্রিয় নাম
    প্রথম শুনিলে বুঝি কবিকণ্ঠস্বরে
              দূর যুগান্তরে ।
    বোধ হল, তুলে ধ'রে ডালা
  মোর হাতে দিলে তব আধফোটা মল্লিকার মালা ।
সুকুমার অঙ্গুলির ভঙ্গীটুকু মনে ধ্যান ক ' রে
        ছবি আঁকিলাম বসে চৈত্রের প্রহরে ।
   স্বপ্নের বাঁশিটি আজ ফেলে তব কোলে
       আর-বার যেতে হবে চ'লে
   সেথা, যেথা বাস্তবের মিথ্যা বঞ্চনায়
             দিন চলে যায় ।

উদয়ন। শান্তিনিকেতন

২০ মার্চ ১৯৪০


                   
শেষ অভিসার
আকাশে ঈশানকোণে মসীপুঞ্জ মেঘ ।
       আসন্ন ঝড়ের বেগ
স্তব্ধ রহে অরণ্যের ডালে ডালে
       যেন সে বাদুড় পালে পালে ।
নিষ্কম্প পল্লবঘন মৌনরাশি
      শিকার-প্রত্যাশী
বাঘের মতন আছে থাবা পেতে,
     রন্ধ্রহীন আঁধারেতে ।
ঝাঁকে ঝাঁক
    উড়িয়া চলেছে কাক
আতঙ্ক বহন করি উদ্‌বিগ্ন ডানার ' পরে ।
    যেন কোন্‌ ভেঙে-পড়া লোকান্তরে
ছিন্ন ছিন্ন রাত্রিখন্ড চলিয়াছে উড়ে
     উচ্ছৃঙ্খল ব্যর্থতার শূন্যতল জুড়ে ।

দুর্যোগের ভূমিকায় তুমি আজ কোথা হতে এলে
          এলোচুলে অতীতের বনগন্ধ মেলে ।
    জন্মের আরম্ভপ্রান্তে আর-একদিন
          এসেছিলে অম্লান নবীন
              বসন্তের প্রথম দূতিকা,
    এনেছিলে আষাঢ়ের প্রথম যূথিকা
                 অনির্বচনীয় তুমি ।
   মর্মতলে উঠিলে কুসুমি
অসীম বিস্ময়-মাঝে, নাহি জানি এলে কোথা হতে
    অদৃশ্য আলোক হতে দৃষ্টির আলোতে ।
        তেমনি রহস্যপথে, হে অভিসারিকা,
আজ আসিয়াছ তুমি ; ক্ষণদীপ্ত বিদ্যুতের শিখা
          কী ইঙ্গিত মেলিতেছে মুখে তব,
                  কী তাহার ভাষা অভিনব ।
 

আসিছ যে-পথ বেয়ে সেদিনের চেনা পথ এ কি ।
                    এ যে দেখি
         কোথাও বা ক্ষীণ তার রেখা,
    কোথাও চিহ্নের সূত্র লেশমাত্র নাহি যায় দেখা ।
             ডালিতে এনেছ ফুল স্মৃত বিস্মৃত,
                   কিছু-বা অপরিচিত ।
    হে দূতী, এনেছ আজ গন্ধে তব যে-ঋতুর বাণী
               নাম তার নাহি জানি ।
                   মৃত্যু-অন্ধকারময়
পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে আসন্ন তাহার পরিচয় ।
    তারি বরমাল্যখানি পরাইয়া দাও মোর গলে
           স্তিমিতনক্ষত্র এই নীরবের সভাঙ্গনতলে ।
                 এই তব শেষ অভিসারে
                     ধরণীর পারে
            মিলন ঘটায়ে যাও অজানার সাথে
                 অন্তহীন রাতে ।

মংপু

২৩।৪।৪০


                 
নামকরণ
বাদলবেলায় গৃহকোণে
রেশমে পশমে জামা বোনে,
নীরবে আমার লেখা শোনে,
     তাই সে আমার শোনামণি ।
প্রচলিত ডাক নয় এ যে
দরদীর মুখে ওঠে বেজে,
পণ্ডিতে দেয় নাই মেজে —
    প্রাণের ভাষাই এর খনি ।
সেও জানে আর জানি আমি
এ মোর নেহাত পাগলামি —
ডাক শুনে কাজ যায় থামি,
    কঙ্কণ ওঠে কনকনি ।

সে হাসে, আমিও তাই হাসি —
     জবাবে ঘটে না কোনো বাধা ।
অভিধান-বর্জিত ব'লে
     মানে আমাদের কাছে সাদা ।
     কেহ নাহি জানে কোন্‌ খনে
              পশমের শিল্পের সাথে
সুকুমার হাতের নাচনে
    নূতন নামের ধ্বনি গাঁথে
       শোনামণি, ওগো সুনয়নী ।
 

গৌরীপুর ভবন। কালিম্পং

   ২৪ মে ১৯৪০