ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


সানাই


 

            বিমুখতা
মন যে তাহার হঠাৎপ্লাবনী
       নদীর প্রায়
অভাবিত পথে সহসা কী টানে
          বাঁকিয়া যায় —
    সে তার সহজ গতি,
         সেই বিমুখতা ভরা ফসলের
             যতই করুক ক্ষতি ।
বাঁধা পথে তারে বাঁধিয়া রাখিবে যদি
    বর্ষা নামিলে খরপ্রবাহিণী নদী
ফিরে ফিরে তার ভাঙিয়া ফেলিবে কূল,
        ভাঙিবে তোমার ভুল ।
    নয় সে খেলার পুতুল, নয় সে
           আদরের পোষা প্রাণী,
              মনে রেখো তাহা জানি ।
         মত্তপ্রবাহবেগে
    দুর্দাম তার ফেনিল হাস্য
           কখন উঠিবে জেগে ।
   তোমার প্রাণের পণ্য আহরি
ভাসাইয়া দিলে ভঙ্গুর তরী,
       হঠাৎ কখন পাষাণে আছাড়ি
            করিবে সে পরিহাস,
      হেলায় খেলায় ঘটাবে সর্বনাশ ।
   এ খেলারে যদি খেলা বলি মান,
         হাসিতে হাস্য মিলাইতে জান,
             তা হলে রবে না খেদ ।
   ঝরনার পথে উজানের খেয়া,
             সে যে মরণের জেদ ।
   স্বাধীন বলো যে ওরে
         নিতান্ত ভুল ক'রে ।
   দিক্‌সীমানার বাঁধন টুটিয়া
ঘুমের ঘোরেতে চমকি উঠিয়া
         যে-উল্কা পড়ে খ'সে
   কোন্‌ ভাগ্যের দোষে
সেই কি স্বাধীন, তেমনি স্বাধীন এও —
     এরে ক্ষমা করে যেয়ো ।
           বন্যারে নিয়ে খেলা যদি সাধ
    লাভের হিসাব দিয়ো তবে বাদ,
গিরিনদী-সাথে বাঁধা পড়িয়ো না
           পণ্যের ব্যবহারে ।
     মূল্য যাহার আছে একটুও
সাবধান করি ঘরে তারে থুয়ো,
      খাটাতে যেয়ো না মাতাল চলার
             চলতি এ কারবারে ।
কাটিয়ো সাঁতার যদি জানা থাকে,
    তলিয়ে যেয়ো না আওড়ের পাকে,
নিজেরে ভাসায়ে রাখিতে না জান
          ভরসা ডাঙার পারে —
যতই নীরস হোক-না সে তবু
     নিরাপদ জেনো তারে ।
‘সে আমারি ' ব'লে বৃথা অহমিকা
ভালে আঁকি দেয় ব্যঙ্গের টিকা ।
আল্‌গা লীলায় নাই দেওয়া পাওয়া,
দূর থেকে শুধু আসা আর যাওয়া —
      মানবমনের রহস্য কিছু শিখা ।

[কালিম্পং

জুন ১৯৪০]


             
আত্মছলনা
দোষী করিব না তোমারে,
      ব্যথিত মনের বিকারে,
নিজেরেই আমি নিজে নিজে করি ছলনা।
     মনের বুঝাই বুঝি ভালবাস,
    আড়ালে আড়ালে তাই তুমি হাস;
    স্থির জানে, এ যে অবুঝের খেলা,
           এ শুধু মোহের রচনা।

সন্ধ্যামেঘের রাগে
     অকারণে যত ভেসে-চলে-যাওয়া
            অপরূপ ছবি জাগে।
   সেইমতো ভাসে মায়ার আভাসে
   রঙিন বাষ্প মনের আকাশে,
   উড়াইয়া দেয় ছিন্ন লিপিতে
            বিরহমিলন-ভাবনা।
[কালিম্পং]
২৯।৫।৪০


              
অসময়
বৈকালবেলা ফসল-ফুরানো
       শূন্য খেতে
বৈশাখে যবে কৃপণ ধরণী
      রয়েছে তেতে,
ছেড়ে তার বন জানি নে কখন
      কী ভুল ভুলি
শুষ্ক ধূলির ধূসর দৈন্যে
     এসেছিল বুল্‌বুলি ।

সকালবেলার স্মৃতিখানি মনে
         বহিয়া বুঝি
তরুণ দিনের ভরা আতিথ্য
       বেড়ালো খুঁজি ।
অরুণে শ্যামলে উজ্জ্বল সেই
        পূর্ণতারে
মিথ্যা ভাবিয়া ফিরে যাবে সে কি
      রাতের অন্ধকারে ।
তবুও তো গান করে গেল দান
      কিছু না পেয়ে ।
সংশয়-মাঝে কী শুনায়ে গেল
      কাহারে চেয়ে ।
যাহা গেছে সরে কোনো রূপ ধ'রে
     রয়েছে বাকি,
এই সংবাদ বুঝি মনে মনে
    জানিতে পেরেছে পাখি ।

প্রভাতবেলার যে ঐশ্বর্য
      রাখে নি কণা,
এসেছিল সে যে, হারায় না কভু
     সে সান্ত্বনা ।
সত্য যা পাই ক্ষণেকের তরে
     ক্ষণিক নহে ।
সকালের পাখি বিকালের গানে
    এ আনন্দই বহে ।

 

? ১৯৪০


                   
অপঘাত
সূর্যাস্তের পথ হতে বিকালের রৌদ্র এল নেমে ।
            বাতাস ঝিমিয়ে গেছে থেমে ।
বিচালি-বোঝাই গাড়ি চলে দূর নদিয়ার হাটে
                     জনশূন্য মাঠে ।
            পিছে পিছে
       দড়ি-বাঁধা বাছুর চলিছে ।
রাজবংশীপাড়ার কিনারে
            পুকুরের ধারে
   বনমালী পণ্ডিতের বড়ো ছেলে
        সারাক্ষণ বসে আছে ছিপ ফেলে ।
মাথার উপর দিয়ে গেল ডেকে
       শুকনো নদীর চর থেকে
   কাজ্‌লা বিলের পানে
        বুনোহাঁস গুগ্‌লি-সন্ধানে ।

কেটে-নেওয়া ইক্ষুখেত, তারি ধারে ধারে
     দুই বন্ধু চলে ধীরে শান্ত পদচারে
        বৃষ্টিধোওয়া বনের নিশ্বাসে,
            ভিজে ঘাসে ঘাসে ।
               এসেছে ছুটিতে —
হঠাৎ গাঁয়েতে এসে সাক্ষাৎ দুটিতে,
      নববিবাহিত একজনা,
শেষ হতে নাহি চায় ভরা আনন্দের আলোচনা ।
আশে-পাশে ভাঁটিফুল ফুটিয়া রয়েছে দলে দলে
       বাঁকাচোরা গলির জঙ্গলে,
           মৃদুগন্ধে দেয় আনি
               চৈত্রের ছড়ানো নেশাখানি ।
      জারুলের শাখায় অদূরে
কোকিল ভাঙিছে গলা একেঘেয়ে প্রলাপের সুরে ।

         টেলিগ্রাম এল সেই ক্ষণে
ফিন্‌ল্যান্ড্‌ চূর্ণ হল সোভিয়েট বোমার বর্ষণে ।
 

[কালিম্পিং]

১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৭