অচলায়্তন

অচলায়তনের গানের তালিকা


রবীন্দ্রনাথের রচিত একটি নাটক। এই নাটকের মূল কাহিনি তিনি সংগ্রহ করেছিলেন রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সম্পাদিত
The Sanskrit Buddhist Literature of Nepal  (Asiuatic Society of Benagal, 1882 পৃষ্ঠা ৩১১-৩১৩) গ্রন্থের 'Story of Panchaka' নামক গল্প থেকে। গল্পটির সারমর্ম হলো -

একদিন এক ব্রাহ্মণ দুঃখভারাক্রান্ত মনে বসে ছিলেন। এক বৃদ্ধা তা দেখে, ব্রাহ্মণের কাছে দুঃখের কারণ জানতে চাইলেন। ব্রাহ্মণ বললেন যে, তাঁর স্ত্রী আসন্নপ্রসবা অবস্থায় আছেন। ইতিমধ্যে তাঁর বেশ কয়েকটি সন্তান জন্মের পরপরই মারা গেছে। এই কারণে সে ভাবছে এবারও হয়তো এই সন্তানটি জন্মের পরপরই মারা যাবে। বৃদ্ধা বললেন, এবারের সন্তান প্রসবের সময় যেন তাঁকে জানানো হয়। যথারীতি সন্তান প্রসবের সময় বৃদ্ধা এলেন এবং প্রসবে সহয়তা করলেন। এবারে ব্রাহ্মণের পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল। বৃদ্ধা নবজাতকের মুখে মাখন পুরে দিলেন এবং একটি সাদা কাপড়ে তার দেহ আবৃত করে, পুত্রটিকে একটি পরিচারিকার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, "একে নিয়ে বাজার এলাকার সড়ক সঙ্গমের কাছে দাঁড়াও এবং প্রতিটি ব্রাহ্মণ এবং শ্রমণকে দেখলেই বলবে যে, শিশুটি তাঁকে প্রণাম করছে এবং সূর্য অস্ত গেলে তাকে ফিরিয়ে আনবে।' পরিচারিকা এই নির্দেশমতো কাজ করলো এবং এর ফলে শিশুটি বেঁচে রইল। এই শিশুটির নাম রাখা হয়েছিল মহাপঞ্চক। এরপর আরও একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করলে একই ভাবে তাঁকে বাঁচানো হলো। এবং এর নাম রাখা হয়েছিল পঞ্চক। ব্রাহ্মণের মৃত্যুর পর, মহাপঞ্চক সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণ করে অর্হত্ত্ব লাভ করেন। অপর সন্তান অত্যন্ত নির্বোধ ছিলেন। এই কারণে মহাপঞ্চক তাঁকে বিহার থেকে বহিষ্কার করে দেন। এই কারণে সে শুধু পথের ধারে বসে কাঁদতে থাকে। এই অবস্থায় ভগবান বুদ্ধ তাঁকে দেখতে পেয়ে, তাঁকে এক শিষ্যের হাতে শিক্ষার জন্য অর্পণ করেন। এরপর পঞ্চক অর্হত্ব লাভ করেন।'

রবীন্দ্রনাথ এই নাটকে মহাপঞ্চক এবং পঞ্চক নামক দুটি চরিত্র নিয়েছিলে, এই বৌদ্ধ গল্প থেকে। এছাড়া কয়েকট মন্ত্র ও মন্ত্রনামও নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অচলায়তনের গল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে নিয়েছিলেন আচারসর্বস্ব ধর্মের অসারতাকে তুলে ধরার জন্য।
নাটকটি তিনি রচনা শুরু করেছিলেন ১৩১৮ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরুতেই। রবীন্দ্রনাথ ১৯১১ বঙ্গাব্দের ১৬ই মে (২ জ্যৈষ্ঠ ) চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে জানান যে,

'একটা নাটক লেখাবার চেষ্টায় আছি। দুইএক দিনের মধ্যেই সুরু করব।' [সূত্র: চিঠিপত্র ১৪, বিশ্বভারতী ২২ শ্রাবণ ১৪০৭। পত্র সংখ্যা ৩৪। পৃষ্ঠা: ৩৪]

ধারণা করা য়, এই এই নতুন নাটকটি ছিল 'অচলায়তন'। নানা কারণে াটকটি রচনায় তিনি বিশেষ মন দিতে পারেন নি। জুন মাসে িনি চারুচন্দ্রে এই বিষয়ে জানিয়ে আরও একটি চিঠি লেখেন। চিঠিতে তিনি জানান

'সেই নাটকটা এতদিন পরে একটু মন দিয়ে লেখবার অবকাশ পাওয়া গেছে। এ পর্যন্ত এখানে অতিথির অভাব ছিল না সেইজন্য লেখায় সম্পূর্ণ মন লাগেনি, খাপছাড়াভাবে চলছিল। এখন নিভৃতে বেশ একটু হাঁকিয়ে কলম চালানো যাচ্চে। ভীড় থাক্‌লে মোটর গাড়ি পুরা দমে চালানো যায় না- কলম সম্বন্ধেও ঠিক তাই। এখন বোধ করি আর দিন পাঁচ ছয়ের মধ্যে আমার লেখাটা শেষ হয়ে যাবে।'  [সূত্র: চিঠিপত্র ১৪, বিশ্বভারতী ২২ শ্রাবণ ১৪০৭। পত্র সংখ্যা ৪১। পৃষ্ঠা: ৪৫]

১৬ই জুন রবীন্দ্রনাথ পরের আর একটা চিঠিতে চারুচন্দ্রকে এই নাটকটি রচনার বিষয়ে আবার লিখেছেন-

'নাটকখানা লিখ্‌তে সুরু করেছি। কিন্তু আকাশে ঘন মেঘের ঘটা, চারদিকে ঘন সবুজ ক্ষেত, আমার তিনতলার ঘরের জানালা দরজা সমস্ত খোলা- কলম এগতে পারচে না- একেবারে রাজকীয় আলস্যে ভরপুর হয়ে বসে আছি। তবু একটা অঙ্ক শেষ হয়েছে'
 [সূত্র: চিঠিপত্র ১৪, বিশ্বভারতী ২২ শ্রাবণ ১৪০৭। পত্র সংখ্যা ৪৩। পৃষ্ঠা: ৪৭]

২৯শে জুন রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে চারুচন্দ্রকে এই নাটকটি শেষ করেছেন জানিয়েছেন। একই সাথে নাটকটি পাঠের আসর করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

'নাটকটা শেষ করেছি। যদি ইচ্ছা কর শনিবার মধ্যাহ্ন বা অপরাহ্‌ণে ওটা শোনাবার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
[সূত্র: চিঠিপত্র ১৪, বিশ্বভারতী ২২ শ্রাবণ ১৪০৭। পত্র সংখ্যা ৪৩। পৃষ্ঠা: ৪৭]

প্রশান্তকুমার পাল তাঁর রবিজীবনী ষষ্ঠ খণ্ড (আনন্দ পাবলিশার্স, ২০০৮। পৃষ্ঠা: ২২৪) থেকে জানা যায়- ১৭ আষাঢ় [রবি ২ জুলাই] বিকেলে, রবীন্দ্রনাথ প্রশান্তকুমার মহলানবিশের কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটের বাসায় নাটকটি বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির সামনে পাঠ করেন। রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত অচলায়তনের আদি পাঠটি 125 নামে রবীন্দ্রভবনে রক্ষিত আছে। মূল পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ১৮৬ । এই পাণ্ডুলিপিতে রচনার তারিখ উল্লেখ আছে '১৫ই আষাঢ়/১৩১৮/শিলাইদহ'। খ্রিষ্টাব্দের বিচারে এই সময় ছিল '৩০ জুন ১৯১১'। [Ms. 125 বিষয় সূচি] 

 

৪ই জুলাই চারুচন্দ্রকে েখা থেকে জানা যায়, নাটকটি প্রকাশের জন্য িনি প্রবাসী পত্রিকায় পাঠিয়েছিলেন। পত্রিকায় াঠানোর আগে তিনি নাটকটি পারিমার্জন করেছিলেন, সেটাও এই চিঠি থেকে জানা যায়।

'শেষকালে নাটকটা প্রবাসীর কবলের মধ্যেই পড়ল। অনেক লোকের চক্ষে পড়বে এবং এই নিয়ে কাগজে পত্রে বিস্তর মারামারি কাটাকাটি চল্‌বে এই আমার একটা মস্ত সান্ত্বনা। তোমাদের সম্বর্দ্ধনাটা শেষ হয়ে গেলে সেটা নিঃশেষে হজম করবার যোগ্য যথেষ্ট পরিমাণে গাল খেয়ে নেবার সুযোগ হবে। সমস্ত জিনিষটা আর একবার মেজে ঘসে বাড়িয়ে কমিয়ে এবারে বেশ আমার মনের মত করে নিয়েছি।'
       [সূত্র: চিঠিপত্র ১৪, বিশ্বভারতী ২২ শ্রাবণ ১৪০৭। পত্র সংখ্যা ৪৫। পৃষ্ঠা: ৪৮]

রবীন্দ্রনাথ যে পাণ্ডুলিপি থেকে এই নাটকটি পাঠ করেছিলেন, তাতে নানারকম পরিবর্তন করেই প্রবাসী পত্রিকায় পাঠিয়েছিলেন। এই পরিমার্জিত পাণ্ডুলিপিটির একটি নকল তৈরি করেছিলেন নেপালচন্দ্র রায়। এই কপিটি পাঠানো হয়েছিল প্রবাসী পত্রিকায়। পরে নেপালচন্দ্র রায়ের পুত্র কালীপদ রায় রবীন্দ্রভবনে উপহার দিয়েছিলেন।  রবীন্দ্রভবনে এটি  244 সংখ্যক পাণ্ডুলিপি নামে রক্ষিত আছে।   Ms. 244 [বিষয় সূচি]                             

 

নাটকটি প্রবাসী পত্রিকার 'আশ্বিন ১৩১৮' সংখ্যায় [পৃষ্ঠা: ৫৪৫-৫৯২] প্রকাশিত হয়েছিল। চারুচন্দ্রে লিখিত চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ আশংকা করেছিলেন 'কাগজে পত্রে বিস্তর মারামারি কাটাকাটি চল্‌বে'। রবীন্দ্রনাথের এই অনুমান অমূলক ছিল না। নাটকটি প্রকাশের পরপরই 'আর্যাবর্ত্ত' পত্রিকার 'কার্তিক ১৩১৮' সংখ্যায় অধ্যাপক ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তীব্র সমালোচনা করেন। এই সমালোচনার উত্তর দিয়েছিলেন। এই সমালোচনাটি প্রকাশিত হয়েছিল 'আর্যাবর্ত্ত' পত্রিকার 'অগ্রহায়ণ ১৩১৮' সংখ্যায়।
    [সূত্র: রবীন্দ্ররচনাবলী একাদশ খণ্ড, বিশ্বভারতী আশ্বিন ১৩৩৯। পৃষ্ঠা: ৫০৪]
   
অচলায়তনের বিষয়
যে কোনো বন্ধনই মুক্তির পথকে রুদ্ধ করে দেয়। আর রুদ্ধতাই সৃষ্টি করে অচলায়তন। এই অচলায়তনে ভেঙে নতুন চলার পথ তৈরির আদর্শকে উপস্থাপন করার জন্য রবীন্দ্রনাথ এই নাটকটি রচনা করেছিলেন। এর কাহিনী একটি বৌদ্ধাখ্যান। এটি নাটকের অবলম্বন মাত্র। এই অবলম্বনের উপর ভর করে, তিনি তাঁর ভাবনাকে রূপকাশ্রয়ে উপস্থাপন করেছেন এই নাটকের মধ্যে।

এই নাটকের অচল হলেন মহাপঞ্চক। তিনি তাঁর শাস্ত্রাচারে, মন্ত্রে এবং ভাবনায় অটল।  তিনি জ্ঞানমার্গে বসে সব কিছু বিচার সেখানে আচারে বিঘ্ন হলে তিনি ক্ষুদ্ধ হন। তাঁর অহঙ্কার যে, তিনি পরমনিষ্ঠা, শাস্ত্রজ্ঞান এবং শাস্ত্রাচারের জোরে মহাপঞ্চকের আসনে উঠে আসতে পেরেছেন। সেই মহাপঞ্চকের অচলায়তনের পরিবর্তেনর সুবাতাস বয়ে আনেন 'গুরু'।  তিনি শোনপাংশু এবং দর্ভকদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে অচলায়তন ভাঙার মন্ত্র নিয়ে মহানায়কের মতো এসে দাঁড়ান। তিনি জাতপাত, ছোঁয়াছুঁয়ি মানেন না। তিনি শুধু শাস্ত্রাচার, মন্ত্রের শক্তিকে অগ্রাহ্যই করেন না, রীতিমতো এসবের বিরুদ্ধে যোদ্ধৃবেশে দাঁড়ান। তাঁর সংস্পর্শে সবকিছু পাল্টে যেতে থাকে, শুধু অচল অটল হয়ে বসে থাকেন মহাপঞ্চক। তিনি কখনো দাদাঠাকুরেরর বেশে দর্ভকের কাছে অচলায়তনের প্রাচীর ভাঙার নেতা হয়ে উঠেন। আবার একই সাথে জ্ঞানহীন শোনপাংশুদের কাছে জ্ঞানের আলো পৌঁছানোর জন্য মহাপঞ্চককে চান। এই বিচারে গুরু রহস্যময়।

রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব ভাবনা এই নাটকের ভিতরে অনেকটাই স্পষ্ট। তিনি অচলায়তন অচলতা ভাঙতে চান। কিন্তু ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করেই। তাই মহাপঞ্চককের পুরোপুরি বিরদ্ধে নয়। আবার সংস্কার চান, সেকারণে গুরু'র বিরুদ্ধেও নন। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে মর্যাদার স্থানে রেখেই পরিবর্তন চান কল্যাণের জন্য। এ চাওয়া মাড়িয়ে যাওয়া নয়, এগিয়ে যাওয়া।