বিষয়:
রবীন্দ্রসঙ্গীত।
শিরোনাম:
আমি মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের
বায়ে
পাঠ ও পাঠভেদ:
- গীতবিতান (বিশ্বভারতী, কার্তিক
১৪১২)-এর পাঠ: পূজা (দুঃখ-৮)
পর্যায়ের ১৯৯ সংখ্যক গান।
আমি
মারের সাগর পাড়ি দেব বিষম ঝড়ের
বায়ে
আমার
ভয়ভাঙা এই নায়ে
॥
মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে
ছেঁড়া
পালে বুক ফুলিয়ে
তোমার
ওই পারেতেই যাবে তরী ছায়াবটের ছায়ে ॥
পথ আমারে সেই দেখাবে যে
আমারে চায়-
আমি অভয়
মনে ছাড়ব তরী, এই শুধু মোর দায়।
দিন ফুরালে, জানি জানি,
পৌছে ঘাটে দেব আনি
আমার দুঃখদিনের
রক্তকমল তোমার করুণ পায়ে ॥
-
পাণ্ডুলিপির পাঠ:
-
পাঠভেদ:
-
ভাবসন্ধান:
১৪২২ বঙ্গাব্দের শিক্ষক সভার জন্য লিখিত পাঠ।
মার
শব্দের
অর্থ:
বৌদ্ধ ধর্মমতে
মৃত্যর রাজা হলেন মার। নির্বাণলাভের পথকে ধ্বংস করে এই দেবতা মানুষকে
মৃত্যুর রাজ্যে নিয়ে
যায়। ফলে মানুষ তার কৃতকর্মের জন্য বার বার জন্মগ্রহণ করতে বাধ্য হয়। বৌদ্ধ
ধর্মগ্রন্থ ধম্মপদ (ত্রিপিটকের সুত্ত পিটক অংশের খুদ্দক পাঠের দ্বিতীয় গ্রন্থ)-এর
মতে 'যে
ব্যক্তি কেবল বাহ্য-শোভা খুঁজে বেড়ায়,
ইন্দ্রিয়কে সংযত
করে না,যে
ব্যক্তি অমিতাহারী,অলস
এবং উদ্যমহীন,মার
তাকে পরাহত করে। [ধম্মপদ ৭ম সূত্র]
মারের সাথে
যুদ্ধ করার প্রধান অস্ত্র প্রজ্ঞা। আসক্তবিহীন চিত্তে প্রজ্ঞার দ্বারা আত্মশুদ্ধি
করে,মারের
কবল থেকে মুক্তি লাভ করলেই নির্বাণ লাভ করা সম্ভব। ভোগের রাজ্যে প্রবেশ করলে,চিত্তের
ভিতর মার প্রবেশ করে। মার নানা ধরনের প্রলোভনের মাধ্যমে মানুষকে নিজের রাজ্যে টেনে
নেয়। যে লোভের বশবর্তী হয়ে ভোগের রাজ্যে প্রবেশ করে,
তার স্থান হবে মারের
রাজ্যে (মৃত্যর জগৎ)। মানুষ যখন ভোগ করে,
তখনই মানুষের চিত্তে মার
প্রবেশ করে। মানুষ যা নিজে ভোগ করছে বলে মনে করে,
মূলত তা মার-ই ভোগ করে।
কালিকা পুরাণ
মতে-ব্রহ্মা কামদেবকে মহাদেবের ধ্যান ভঙ্গ করার অনুমতি দিলেন। কিন্তু কামদেব এই
কাজে সফল হবেন কিনা, সে বিষয়ে ব্রহ্মার সংশয় ছিল। তাই তিনি গভীরভাবে বিষয়টি ভাবতে
বসলেন। এই সময় তাঁর দ্রুত শ্বাস-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করলো ভীষণাকৃতির জীব।
এরা নানা ধরনের অস্ত্র ধারণ করে মার্কাট্ শব্দের দ্বারা কোলাহল সৃষ্টি করলো।
ব্রহ্মা পরে এদের নামকরণ করেন মার। এরপর কামদেব এদের কাজ কি, তা ব্রহ্মাকে জিজ্ঞাসা
করলে, ব্রহ্মা তাঁকে বলেন যে, এরা জ্ঞানীদিকের জ্ঞানপথে সর্বদা বিঘ্ন সৃষ্টি করবে।
এরা মহাবেগশালী এবং কামরূপী হবে। পরে ব্রহ্মা কামদেবকে এদের অধিনায়ক করে দেন।
[কালিকা পুরাণ, ষষ্ঠ অধ্যায়]
রবীন্দ্রনাথ এই গানে 'মার' শব্দটি গ্রহণ করেছেন, কল্যাণকর কোনো
লক্ষ্যের পথে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিকুল অবস্থাকে রূপকার্থে ব্যবহার করেছেন।
এই গানের 'বিষম ঝড়' হলো অশুভ বিধ্বংসী শক্তি। হয়তো রবীন্দ্রনাথ মারের সাথে যুদ্ধ করার প্রধান অস্ত্র
হিসেবে প্রজ্ঞাকেই
নির্দেশ করেছেন ।
আসক্তবিহীন চিত্তে প্রজ্ঞার দ্বারা আত্মশুদ্ধি করে,মারের
কবল থেকে মুক্তি লাভ করলেই নির্বাণ লাভ করা সম্ভব।
উল্লেখ্য এই নির্বাণ পুনর্জন্ম রোধের জন্য নয়।
এই গানের স্থায়ীতে-নির্ভীকচিত্তে জগতের কল্যাণের পথে, জ্ঞানের
পথের সকল বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা স্পষ্ট হয়ে
উঠেছে। হতে পারে তার যাত্রাপথের সকল আয়োজন মারের সাগর পারি দেওয়ার উপযুক্ত নয়
(ছেঁড়া পাল), কিন্তু মাভৈঃ (ভয় নাই) বাণীকে সম্বল করে, অপরাজেয় ইচ্ছাশক্তির জোরে
লক্ষে পৌঁছে যাওয়ার প্রতিজ্ঞাটাই এই গানে ব্যক্ত হয়েছে। হয়তো লক্ষ্যে পৌঁছার যথার্থ পথ জানা নেই, কবির সেসবের ভাবনা নেই।
চলতে চলতে পথের সন্ধান মিলবে, আর যারা জ্ঞানের ভিতর দিয়ে কল্যাণের পথ খুঁজে পেতে
চায়, তাঁরা তাঁর পাশে এসে দাঁড়াবেন এবং পথের সন্ধান তাঁরাই দেবেন। কবির কর্তব্য
শুধু যাত্রা শুরু করা। কবি নিশ্চিত যাত্রা পথের শেষে, শান্তি ও কল্যাণের ঘাটে তিনি
ঠিকই পৌঁছাবেন। মন ক্ষতবিক্ষত হবে, দুঃখ-বেদনার ভিতর দিয়ে ঘটবে আত্মশুদ্ধি, জয় হবে
প্রজ্ঞার পরাজিত হবে মার। আর জয়ের রক্তকমল নিবেদিত হবে কল্যাণ, জ্ঞানের চিরন্তন
সত্তার কাছে।[উল্লেখ্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মরণে শুধু নয়, বর্তমানে
আমরা যে মারের সাগরে বিষম ঝড়ের আবর্তিত হচ্ছি, তার কাছে আত্মসমর্পণ না করে মাভৈঃ
বাণীর ভরসা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময়। এযুদ্ধ অস্ত্রের নয় জ্ঞানের।
তথ্যানুসন্ধান
- ক. রচনাকাল ও স্থান:
১৩২৮ বঙ্গাব্দে ১৩ই পৌষ (বুধবার ২৮ ডিসেম্বর ১৯২১
খ্রিষ্টাব্দ) রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন থেকে শিলাইদহের পথে যাত্রা
করেন।
এই সময় তিনি একটি নাটক রচনা করেন।
রাণু'র কাছে লেখা চিঠি থেকে জানা যায়, এই নাটকটির নাম ছিল পথ
এবং
তিনি পৌষ মাসের ২২ তারিখে শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেন। এই সময়ের ভিতরে তিনি নাটকটির
প্রাথমিক খসড়া প্রস্তুত করেছিলেন। এরপর নানা রকম পরিবর্তন করে তিনি
ফাল্গুন মাসে এই নাটক চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছিল।
তখন এর
নামকরণ করা হয়েছিল মুক্তধারা।
এই নাটকের ১৪টি গানের ভিতরে ৭টি নতুন
ছিল। ধারণা করা যায়, এই গানগুলো পৌষ থেকে ফাল্গুন মাসের ভিতরে রচিত।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর গীতবিতান কালানুক্রমিক সূচী গ্রন্থে এই গানগুলোর
তারিখ উল্লেখ করেছেন ৩০ পৌষ সংক্রান্তি। অবশ্য এই বিষয়ে প্রভাতকুমার কোনো সূত্র
উল্লেখ করেন নি। এই সময় রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল ৬০ বৎসর
৯ মাস।
[৬০ বৎসর
অতিক্রান্ত বয়সে রবীন্দ্রসঙ্গীতের তালিকা]
- খ.
প্রকাশ ও গ্রন্থভুক্তি:
- গ্রন্থ:
-
পত্রিকা:
-
প্রবাসী [বৈশাখ ১৩২৯ বঙ্গাব্দ।
মুক্তধারা। ধনঞ্জয়ের গান।
পৃষ্ঠা: ১৬]
[নমুনা]
-
রেকর্ডসূত্র: রেকর্ডসূত্র পাওয়া যায় নি।
- প্রকাশের
কালানুক্রম: ১৩২৯ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত 'মুক্তধারা' নাটকের সাথে মুদ্রিত হয়েছিল। এরপ ১৩৩৮ বঙ্গাব্দে গানটি গীতবিতান -এর দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথম সংস্করণ অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে গীতবিতান -এর প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় সংস্করণ। এই সংস্করণে গানটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল (উপবিভাগ: দুঃখ: ৮)। ১৩৭১ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে প্রকাশিত অখণ্ড গীতবিতানের পূজা পর্যায়ের ১৯৯ সংখ্যক গান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। গানটি একইভাবে অখণ্ড গীতাবিতানের তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল পৌষ ১৩৮০ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে।
- গ.
সঙ্গীত বিষয়ক তথ্যাবলী:
- স্বরলিপি:
অনাদিকুমার দস্তিদার। পাণ্ডুলিপি থেকে স্বরবিতান-৫২তে মুদ্রিত হয়েছে।
-
তাল:
- স্বরবিতান-৫২এ গৃহীত
স্বরলিপিতে রাগ-তালের উল্লেখ নেই। স্বরবিতান-৫২এ গৃহীত উক্ত গানটির
স্বরলিপিটি ৪।৪ ছন্দে নিবদ্ধ। অর্থাৎ তালটি কাহারবা’ হিসাবে বিবেচনা
করা যেতে পারে।
-
অঙ্গ: বাউল। তাল: কাহারবা।
[রবীন্দ্রসংগীত: রাগ-সুর নির্দেশিকা। সুধীর চন্দ। প্যাপিরাস, ডিসেম্বর ২০০৬। পৃষ্ঠা: ৩৩]
-
অঙ্গ: সারি।
তাল: কাহারবা ।
[রাগরাগিণীর এলাকায় রবীন্দ্রসংগীত, প্রফুল্লকুমার চক্রবর্তী, জুলাই
২০০১। পৃষ্ঠা:
৬২]
উল্লেখ্য, কখনো কখনো এই
গানটি দ্রুত দাদরা'তে পরিবেশিত হতে দেখা যায়। কিন্তু দ্রুত দাদরা’য় নিবদ্ধ কোনো
স্বরলিপি পাওয়া যায় না।
- বিষায়ঙ্গ: পূজা
- সুরাঙ্গ: বাউলাঙ্গ
- গ্রহস্বর: সা। লয়: অতি দ্রুত।