ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


ভগ্নহৃদয়
দশম সর্গ


                      মুরলা
    যার কোন রূপ নাই,   যার কোন গুণ নাই,
তবুও যে হতভাগ্য ভালোবাসে মনে,
দুই দিন বেঁচে থাকে,   কেহ নাহি জানে তাকে,
ভালোবাসে, দুঃখ, সহে, মরে গো বিজনে।
ক্ষুদ্র তৃণফুল এক জন্মে অন্ধকারে,
দুই দণ্ড বেঁচে থাকে কীটের আগার—
শুকায়ে পড়ে সে নিজ কাঁটার মাঝারে,
নিজেরি কাঁটার মাঝে সমাধি তাহার।
কি কথা কোস্‌ রে তুই অকৃতজ্ঞ মন!
স্নেহময় দয়াময় কবি সে আমার,
এই তৃণফুলেরে কি করে নি যতন?
এরেও কি রাখে নাই হৃদয়ে তাহার?
ছেলেবেলা হতে মোরে রেখেছেন পাশে।
যখনি পূরিত মন নব গীতোচ্ছ্বাসে
আমারেই তাড়াতাড়ি শুনাতেন তিনি,
এত তাঁর ছিল সঙ্গী আছিল সঙ্গিনী!
এত যে পাইনু, তাঁরে কি পারিনু দিতে?
মুরলার যাহা কিছু ছিল— ভালোবাসা—
ক্ষুদ্র এই হৃদয়ের সুখ দুঃখ আশা!
একটু পারি নি তাঁরে সান্ত্বনা করিতে,
মুছাই নি এক বিন্দু নয়নের ধার—
যাহা কিছু সাধ্য ছিল করেছি আমার!
আমি যদি না হতেম বাল্যসখী তাঁর,
নলিনীবালারে যদি পেতেন সঙ্গিনী,
করিতে হত না তাঁরে এত হাহাকার—
কতই না সুখী আহা হতেন গো তিনি!
বিধাতা! বিধাতা! যদি তাই গো করিতে!
মুরলা জন্মিল কেন নলিনী থাকিতে!
এখনো কেন গো তার হয় না মরণ?
এ সংসারে মুরলারে কার প্রয়োজন?
ওই আসিছেন কবি!— এসো কবি!— এসো কবি!
একবার অতি কাছে এসো মুরলার!
তুমি যবে কাছে থাক কবি গো আমার—
আপনারে ভুলে যাই— ওই মুখপানে চাই
তোমা ছাড়া কিছু মনে নাহি থাকে আর!
তুমি যবে দূরে থাক, কবি গো, তখন
আপনারি ক্ষুদ্র দুঃখে থাকি অচেতন!
বড়ো যে দুর্বল দীন মুরলা তোমার!
যুঝিতে মনের সাথে পারে না সে আর!
থেকো না, থেকো না দূরে থেকো না গো প্রভু,
মুরলারে ত্যাগ করে যেও না গো কভু!
শ্রান্ত ক্লান্ত অতি দীন—   বলহীন রক্তহীন
ধুলায় লুণ্ঠিত এই অতি ক্ষুদ্র প্রাণ,
তোমার মনের ছায়ে দেহ এরে স্থান!
আমারে লুকায়ে রাখ প্রসারিয়া পাখা,
তোমারি বুকের কাছে রব আমি ঢাকা!
নহিলে দুর্বল এই দীন অসহায়
পথ হারাইয়া কোথা ভ্রমিয়া বেড়ায়?
তুমি, কবি, ছিলে নাকো— একেলা বিজনে
নিজ হাতে বসি হেথা দুঃখের কণ্টকলতা
রোপিতেছিলাম, কবি, আপনারি মনে।
তাই নিয়ে অনুক্ষণ যেন আদরের ধন
আত্মদাহী কল্পনায় খেলায়েছি কত,
যতনে ঢেলেছি তায় অশ্রুধারা শত,
এবে প্রতি মুল তার হৃদয়ের চারি ধার
দংশে শত বাহু মেলি বৃশ্চিকের মত!
তুমি, সখা, এসো কাছে— মারিতেছি জ্বলি—
ও চরণ দিয়ে, কবি, ফেল সব দলি—
প্রতি শাখা—  প্রতি পত্র—  প্রতি মূল তার!
এসো, কবি, বলো দাও— এ হৃদয়ে বলো দাও—
আর কভু বর্ষিব না অশ্রুবারিধার!
              [কবির প্রবেশ]
  কবি। সকাল হইতে, মুরলা সখি লো,
           খুঁজিয়া বেড়াই তোরে,
বড়োই অধীর-হরষে আমার
       হৃদয় গিয়েছে ভরে।
পারি নে রাখিতে প্রাণের উচ্ছ্বাস,
আকুল ব্যাকুল করিতে প্রকাশ,
অধীর হইয়া সকাল হইতে
      খুঁজিয়া বেড়াই তোরে।
তোরে না কহিলে হৃদয়ের কথা
      মন শান্তি নাহি মানে;
কেন, সখি, তুই ব’সে রয়েছিস্‌
      একা একা এই খানে?
দেখ, সখি, আজ গিয়েছিনু আমি
      প্রমোদকাননে তার,
গাছের ছায়াতে আপনার মনে
      বসেছিনু একধার।—
মুরলা, হেথায় অন্ধকার ঘোর,
দেখিতে পাই নে মুখখানি তোর,
এত অন্ধকার ভালো নাহি লাগে,
     ওই খানে যাই উঠে।
ওখানে পড়েছে রবির কিরণ,
সমুখে সরসী হাসিছে কেমন,
গাছের উপরে শাখা শাখা ভরে
      বকুল রয়েছে ফুটে।
এই খানে আয়, এই খানে বোস্‌!
      শোন্‌ সখি তার পরে—
গাছের তলায় ছিলাম বসিয়া
      মগন ভাবনা-ভরে।
গীতস্বর শুনি চমকি উঠিনু,
      শুনিনু মধুর বাঁশরী বাজে।
গীতের প্লাবনে আকাশ পাতাল
      ডুবিয়া গেল গো নিমেষমাঝে।
আকাশব্যাপিনী জোছনার, সখি,
      মরমে মরমে পশিল গান!
পৃথিবী-ডুবান’ জোছনারে, সখি,
     ডুবায়ে দিল সে মধুর তান!
একটি একটি করি কথা তার
     পশিতে লাগিল শ্রবণে যত,
শোণিত লাগিল উঠিতে পড়িতে,
     হৃদয় হইল পাগল-মত।
একটি একটি একটি করিয়া
     গাঁথিতে লাগিনু কথা,
গান গাওয়া তার ফুরাল’ যখন
     ফুরাল' আমার গাঁথা।
মুরলা, সখি লো, বল্‌ দেখি মোরে
কি গান গাহিতেছিল মধুস্বরে
     বিশ্ব করি বিমোহিত!
আমারি রচিত— আমারি রচিত—
     আমারি রচিত গীত!
মুরলা, সখি লো, বল্‌ দেখি মোরে
কে গান গাহিতেছিল মধুস্বরে
     উনমাদ করি মন!
আমারি নলিনী— আমারি নলিনী—
     আমারি হৃদয়ধন।
সখি, মোর সেই মনের কথা,
সখি, মোর সেই গানের কথা,
দিয়াছে মাজিয়া তার স্বর দিয়া—
প্রতি কথা তার উঠে উজলিয়া
     মেঘে রবিকর যথা।
শুনিবি কি গান গাহিতেছিল সে
     অমৃতমধুর রবে?
     শোন্‌ মন দিয়ে তবে।

             গান
কে তুমি গো খুলিয়াছ স্বর্গের দুয়ার?
ঢালিতেছ এত সুখ,    ভেঙে গেল— গেল বুক—
যেন এত সুখ হৃদে ধরে না গো আর!
তোমার সৌন্দর্য্যভারে     দুর্বল হৃদয় হা রে
অভিভূত হয়ে যেন পড়েছে আমার!
এস তবে হৃদয়েতে,     রেখেছি আসন পেতে—
ঘুচাও এ হৃদয়ের সকল আঁধার!
তোমার চরণে দিনু প্রেম-উপহার—
না যদি চাও গো দিতে প্রতিদান তার,
নাই বা দিলে তা বালা,    থাক' হৃদি করি আলা,
হৃদয়ে থাকুক্‌ জেগে সৌন্দর্য্য তোমার!