ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


ভগ্নহৃদয়
বিংশ সর্গ


          নলিনী
      গান
    সখি লো, শোন্‌ লো তোরা শোন্‌,
আমি যে পেয়েছি এক মন!
সুখ দুঃখ হাসি অশ্রুধার,
সমস্ত আমার কাছে তার—
পেয়েছি পেয়েছি আমি, সখি,
একটি সমগ্র মন প্রাণ!
লাজ ভয় কিছু নাই তার,
নাই তার মান অভিমান!
রয়েছে তা আমারি মুঠিতে,
সাধ গেলে পারি তা টুটিতে,
যা ইচ্ছা করিতে পারি তাই—
সাধ গেলে হাসাই কাঁদাই,
সাধ গেলে ফেলে তারে দিই,
সাধ গেলে তুলে তারে রাখি,
ইচ্ছা হয় তাড়াইতে পারি,
ইচ্ছা হয় কাছে তারে ডাকি!
জানে না সে রোষ করিবারে,
ফিরে যেতে নাহি পারে আর,
শুধু জানে হাসিতে কাঁদিতে—
আর কিছু সাধ্য নাই তার!
সখি লো, এমন মন এক
পেয়েছি— পেয়েছি তোরা দেখ্‌!
আমি কভু চাই নি এ মন,
ইহাতে মোর কি প্রয়োজন?
পথিক সে, পথে যেতে যেতে
দেখা হ'ল চোখেতে চোখেতে—
মনখানা হাতে ক'রে নিয়ে
আপনি সে রেখে গেল পায়
চলে গেল দূর দূরান্তরে
মন পড়ে রহিল ধূলায়।
দু-দণ্ড চাহিয়া দেখিলাম,
ভাবিনু "মোর কি প্রয়োজন!"
আঁখি দুটি লইনু তুলিয়া,
দূরে যেতে ফিরানু বদন!
অমনি সে নূপুরের মত
চরণ ধরিল জড়াইয়া,
সাথে সাথে এল সারা পথ
রুণু ঝুনু কাঁদিয়া কাঁদিয়া।
সখি, আমি শুধাই তোদের
সত্য ক'রে মোরে বল্‌ দেখি,
পায়ে স্বর্ণভূষণের চেয়ে
হৃদয়ের নূপুর শোভে কি?
কি করিব বল্‌ দেখি তাহা—
আপনি সে গেল যদি রেখে!
আমি ত চাই নি তারে ডেকে!
আমারেই দিলে কেন আসি,
রূপসী ত ছিল রাশি রাশি!
সুহাসি কমলা ছিল না কি?
শুনেছি মধুর তার আঁখি!
বিনোদিনী ছিল ত সেথায়,
রূপ তার ধরে না ধরায়!
তবে কেন মনখানি তার
আমারে সে দিল উপহার?
দেব কি ইহারে দুরে ফেলে,
অথবা রাখিব কাছে ক'রে,
তাই ভাবিতেছি মনে মনে—
কি করিব বল্‌ তাহা মোরে।