ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


ভগ্নহৃদয়
তৃতীয় সর্গ


    মুরলা ও অনিল
     
  অনিল। ও হাসি কোথায় তুই শিখেছিলি বোন?
    বিষণ্ন অধর দুটি    অতি ধীরে ধীরে টুটি
অতি ধীরে ধীরে ফুটে হাসির কিরণ।
অতি ঘন মেঘমালা   ভেদি স্তরে স্তরে, বালা,
সায়াহ্ন জলদপ্রান্তে দেয় যথা দেখা
ম্লান তপনের মৃদু কিরণের রেখা।
কত ভাবনার স্তর     ভেদ করি পর পর
ওই হাসিটুকু আসি পঁহুছে অধরে!
ও হাসি কি অশ্রুজলে সিক্ত থরে থরে?
ও হাসি কি বিষাদের গোধূলির হাস?
ও হাসি কি বরষার    সুকুমারী লতিকার
ধৌতরেণু ফুলটির অতি মৃদু বাস?
মুরলা রে, কেন আহা, এমন তু, হলি!
এত ভালোবাসা কারে দিলি জলাঞ্জলি?
যে জন রেখেছে মন শূন্যের উপরে,
আপনারি ভাব নিয়া     উলটিয়া পালটিয়া
দিনরাত যেই জন শূন্যে খেলা করে,
শূন্য বাতাসের পটে শত শত ছবি
মুছিতেছে আঁকিতেছে
শতবার দেখিতেছে
সেই এক মোহময় স্বপ্নময় কবি

সদা যে বিহ্বল প্রাণে চাহিয়া আকাশ-পানে,
আঁখি যার অনিমিষ আকাশের প্রায়,
মাটিতে চরণ তবু মাটিতে না চায়

ভাবের আলোকে অন্ধ তারি পদতলে
অভাগিনী, লুটাইয়া পড়িলি কি বলে?
সে কি রে, অবোধ মেয়ে    বারেক দেখিবে চেয়ে?
জানিতেও পারিবে না, যাইবে সে চ'লে
যুথিকাহৃদয় তোর ধূলি-সাথে দ'লে।
এত ভালোবাসা তারে কেন দিলি হায়?
সাগর-উদ্দেশ-গামী তটিনীর পায়
না ভাবিয়া না চিন্তিয়া যথা অবহেলে
ক্ষুদ্র নির্ঝরিণী দেয় আপনারে ঢেলে।
নিশীথের উদাসীন পথিক সমীর
শূন্য হৃদয়ের তাপে হইয়া অধীর
কুসুমকানন দিয়া যায় যবে বয়ে
আকুল রজনীগন্ধা কথাটি না কয়ে
প্রাণের সুরভি সব দিয়া তার পায়
পরদিন বৃন্ত হতে ঝরে পড়ে যায়।
মেঘের দুঃস্বপ্নে মগ্ন দিনের মতন
কাঁদিয়া কাটিবে কি রে সারাটি যৌবন?
কেঁদে কেঁদে শ্রান্ত হয়ে দীন অতিশয়

আপনার পানে তবে      চাহিয়া দেখিবি যবে
দেখিবি জীবনদিন সন্ধ্যা হয় হয়!
যে মেঘ-মাঝারে থাকি উদিলি প্রভাতে
সেই মেঘমাঝে থাকি অস্ত গেলি রাতে।
  মুরলা।        কি জানি কেমন
    মুরলার সুখের কি দুঃখের জীবন!
সুখ দুঃখ দিনরাত মিলিয়া উভয়ে
রেখেছে সায়াহ্ন করি এ শান্ত হৃদয়ে।
হেন আলিঙ্গনে তারা রয়েছে সদাই
যেন তারা দুটি সখা, যেন দুটি ভাই।
জোছনা ও যামিনীতে প্রণয় যেমন
তেমনি মিলিয়া তারা রয়েছে দুজন।
সুখের মুখেতে থাকে দুখের কালিমা,
দুখের হৃদয়ে জাগে সুখের প্রতিমা।
একা যবে বসে থাকি স্তব্ধ জোছনায়,
বহে বাতায়ন-পানে নিশীথের বায়,
বড়ো সাধ যায় মনে যারে ভালোবাসি
একবার মুহূর্ত সে বসে কাছে আসি,
দুটি শুধু কথা কহে
একটু আদর
সেই স্তব্ধ জোছনায়    কাঁদিয়া কাঁদিয়া হায়
মরিয়া যাই গো তারি বুকের উপর।
যখনি কবিরে দেখি সব যাই ভুলে,
কিছুই চাহি না আর
কিছুই ভাবি না আর
শুধু সেই মুখে চাই দুটি আঁখি তুলে।
দেখি দেখি
কি যে দেখি, কি বলিব কি সে!
হৃদয় গলিয়া যায় জোছনায় মিশে।
জোছনার মত সেই বিগলিত হিয়া
প্রাণের ভিতরে ধরি     একেবারে মগ্ন করি
কবিরে চৌদিকে যেন থাকে আবরিয়া।
মনে মনে মন যেন কাঁদিয়া দু-করে
কবির চরণ দুটি জড়াইয়া ধরে,
আঁখি মুদি "কবি! কবি!" বলে শতবার

শতবার কেঁদে বলে "আমার! আমার!"
"আমার আমার" যেন বলিতে বলিতে
চাহে মন একেবারে জীবন ত্যজিতে!
সুখেতে কি দুখে যেন ফেটে যায় বুক

সুখ বলে দুখ আমি, দুখ বলে সুখ।
কোথা কবি, কোথা আমি! সে যে গো দেবতা

তারে কি কহিতে পারি প্রণয়ের কথা?
কবি যদি ভুলে কভু মোরে ভালোবাসে
তা হলে যে ম'রে যাব সঙ্কোচে উল্লাসে।
চাই না চাই না আমি প্রণয় তাঁহার,
যাহা পাই তাই ভালো স্নেহসুধাধার।
শুকতারা স্নেহমাখা করুণ নয়ানে
চেয়ে থাকে অস্তমান যামিনীর পানে,
তেমনি চাহেন যদি কবি স্নেহভরে
মুরলার ক্ষুদ্র এই হৃদয়ের 'পরে
তাহা হলে নয়নের সামনে তাঁহার
হাসিয়ে ফুরায়ে যাবে জীবন আমার।
  অনিল। স্বার্থপর, আপনারি ভাবভরে ভোর,
    আজিও সে দেখিল না হৃদয়টি তোর?
সর্বস্ব তাহারি পদে দিয়া বিসর্জন
কাঁদিয়া মরিছে এক দীনহীন মন,
ইহাও কি পড়িল না নয়নে তাহার?
আপনারে ছাড়া কেহ নাহি দেখিবার?
নিশ্চয় দেখেছে, তবু দেখেও দেখে নি।
দেখেছে সে
নিরুপায় নিতান্তই অসহায়
ভালোবাসিয়াছে এক অভাগা রমণী।
দেখেছে
হৃদয় এক ফাটিয়া নীরবে
একান্ত মরিবে, তবু কথা নাহি কবে!
দেখেও দেখে নি তবু, পশু সে নির্দয়!
ভাঙিয়া দেখিতে চাহে রমণীহৃদয়।
শতধা করিতে চায় মন রমণীর,
দেখিবারে হৃদয়ের শির উপশির।
এমন সুন্দর মন মুরলা তোমার

এমন কোমল, শান্ত, গভীর, উদার

ও মহান্‌ হৃদয়েতে প্রেমজলধির
নাই রে দিগন্ত বুঝি, নাই তার তীর।
করিস নে, করিস নে ও হৃদি বিনাশ!
যৌবনেই প্রণয়েতে হোস নে উদাস!
কহিগে প্রণয় তোর কবির সকাশে,
শুধাইগে ভালো তোরে বাসে কি না বাসে।
ভালো যদি নাই বাসে কেন সেই জন
মিছা স্নেহ দেখাইয়া বেঁধে রাখে মন?
না যদি করিতে পারে তোরে আপনার,
আপনার মতো কেন করে ব্যবহার?
কথা নাহি কহে যেন, না করে আদর,
পরের মতন থাকে
দেখে তোরে পর!
নিরদয়-দয়া তোরে নাই বা করিল!
শত্রুতার ভালোবাসা নাই বা বাসিল!
মুহূর্তসুখের তোরে দিয়া প্রলোভন
অসুখী করিবে কেন সারাটি জীবন?
দু-দণ্ডের আদরেতে কভু ভুলিস না!
আধেক সুখেতে কভু পূরে না বাসনা।
এখনি চলিনু তবে তার কাছে যাই,
ভালো বাসে কি না বাসে শুধাইতে চাই।
  মুরলা। মনে করেছিনু, ভাই, এ প্রাণের কথা
    কাহারেও বলিব না যত পাই ব্যথা।
সেদিন সায়াহ্নকালে উচ্ছ্বসি উঠিয়া
বড়ো নাকি কেঁদে মোর উঠেছিল হিয়া,
তাই আমি পাগলের মত একেবারে
ছুটিয়া তোমারি কাছে গেনু কাঁদিবারে।
উচ্ছ্বসি বলিনু যত কাহিনী আমার!
কেন রে বলিলি হা রে, দুর্বল, অসার?
ভালোবাসিতেই যদি করিলি সাহস,
লুকাতে নারিস তাহা হা হৃদি অবশ?
পরের চোখের কাছে না ফেলিলে জল
আশ কি মেটে না তোর রে আঁখি দুর্বল?
মুরলা রে, অভাগী রে,    কেন ভালো বাসিলি রে?
যদি বা বাসিলি ভালো কেন তোর মন
হ’ল হেন নীচ হীন, দুর্বল এমন?
একটি মিনতি আজি রাখ গো আমার!
সহস্র যাতনা পাই আর কখন তো, ভাই,
ফেলিব না তব কাছে অশ্রুবারিধার

যেও না কবির কাছে ধরি তব পায়,
ভুলে যাও যত কথা কহেছি তোমায়!
দয়া করে আরেকটি কথা মোর রাখ,
যদি গো কবির ’পরে রোষ করে থাক
মোর কাছে কভু আর কোরো নাক নাম তাঁর

সে নাম ঘৃণার স্বরে কভু সহিব না!
জানালেম এই মোর প্রাণের প্রার্থনা!
  অনিল। তবে কি এমনি শুধু মিছে ভালোবেসে
    শূন্য এ জীবন তোর ফুরাইবে শেষে!
  মুরলা। যায় যদি যাক্‌ ভাই, ফুরায় ফুরাক,
    প্রভাতে তারার মতো মিশায় মিশাক
মুরলার মতো ছায়া     কত আসে কত যায়,
             কি হয়েছে তায়!
অবোধ বালিকা আমি, মিছে কষ্ট পাই

এ জীবনে মুরলার কোন কষ্ট নাই!
স্নেহের সমুদ্র সেই কবি গো আমার

অনন্ত স্নেহের ছায়ে     আমারে রেখেছে পায়ে,
তাই যেন চিরকাল থাকে মুরলার!
সে স্নেহের কোলে শুয়ে কাটায় জীবন!
সে স্নেহের কোলে প্রাণ করে বিসর্জন!
কুসুমিত সে অনন্ত স্নেহরাজ্য-’পরে
তিল স্থান থাকে যেন মুরলার তরে!
যত দিন থাকে প্রাণ
   ব্যাপি সেইটুকু স্থান
মাটিতে মিশায়ে রবে হৃদয় আমার।
কোনো
কোনো কোনো সুখ নাহি চাহি আর।