দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার
রূপ-তরাসী
নীলকমল আর লালকমল
|
ডালিমকুমার
|
পাতালকন্যা মণিমালা |
সোনার কাঠি রূপার কাঠি
'হাঁ-উ মাঁ-উ কাঁ-উ' শুনি রাক্ষসেরি পুর |
১
এক রাজার দুই রাণী; তাহার এক রাণী রাক্ষসী! কিন্তু, এ কথা কেহই জানে না।
দুই রাণীর দুই ছেলে;-
লক্ষ্মী মানুষ-রাণীর ছেলে কুসুম, আর রাক্ষসী-রাণীর ছেলে অজিত।
অজিত কুসুম দুই ভাই গলাগলি।
রাক্ষসী-রাণীর মনে কাল, রাক্ষসী-রাণীর জিভে লাল। রাক্ষসী কি তাহা দেখিতে পারে?
-কবে
সতীনের ছেলের কচি কচি হাড়-মাংসে ঝোল অম্বল রাঁধিয়া খাইবে;
-তা পেটের দুষ্ট ছেলে
সতীন-পুতের সাথ ছাড়ে না। রাগে রাক্ষসীর দাঁতে-দাঁতে কড় কড় পাঁচ পরাণ সর্ সর্।-
যো না পাইয়া রাক্ষসী ছুতা-নাতা খোঁজে, চোখের দৃষ্টি দিয়া সতীনের রক্ত শোষে।
দিন দণ্ড যাইতে না যাইতে লক্ষ্মীরাণী শয্যা নিলেন।
তখন ঘোমটার আড়ে জিভ্ লক্লক্ আনাচে কানাচে উঁকি।
দুই দিনের দিন লক্ষ্মী-রাণীর কাল হইল। রাজ্য শোকে ভাসিল। কেহ কিচ্ছু বুঝিল না।
অজিতকে "সর্ সর্" কুসুমকে "মর্ মর্', -রাক্ষসী সতীন-পুতকে তিন ছত্রিশ গালি দেয়, আপন
পুতকে ঠোনা মারিয়া খেদায়!
দাদাকে নিয়া গিয়া অজিত নিরালায় চোখের জল মুছায়-"দাদা, আর থাক্ আর আমরা মার কাছে যাব
না। রাক্ষসী-মা'র কাছে আর কেহই যায় না! লোহার প্রাণ অজিত সব সয়; সোনার প্রাণ কুসুম
ভাঙ্গিয়া পড়ে। দিনে দিনে কুসুম শুকাইতে লাগিল।
২
রাণী দেখিল,
কি! আপন পেটের পুত্র,
সে-ই হইল শত্রু!-
রাণীর মনের আগুন জ্বলিয়া উঠিল।
এক রাত্রে রাজার হাতীশালে হাতী মরিল, ঘোড়াশালে ঘোড়া মরিল, গোহালে গরু মরিল;-রাজা
ফাঁপরে পড়িলেন।
পর রাত্রে ঘরে "কাঁই মাঁই!!" চমকিয়া রাজা তলোয়ার নিয়া উঠিলেন।
-সোনার খাটে
অজিত-কুসুম ঘুমায়; এক মস্ত রাক্ষস কুসুমকে ধরিয়া আনিল। রাক্ষসের হাতে কুসুম কাঠির
পুতুল! ছুটিয়া আসিয়া মাথার চুল ছিঁড়িয়া রাজার গায়ে মারিল,
-হাত নড়ে না, পা নড়ে না,
রাজা বোকা হইয়া গেলেন।
রাজার চোখের সামনে রাক্ষস কুসুমকে খাইতে লাগিল। রাজা চোখের জলে ভাসিয়া গেলেন,
মুছিতে পারিলেন না। রাজার শরীর থরথর কাঁপে, রাজা বসিতে পারিলেন না। রাণী খিল্খিল্
করিয়া হাসিয়া উঠিল।
অজিতের ঘুম ভাঙ্গিল;-
রাত যেন নিশে
মন যেন বিষে,
দাদা কাছে নাই কেন?
অজিত ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দেখে, ঘর ছম্ছম্ করিতেছে, রাণীর হাতে বালা-কাঁকন ঝম্ঝম্
করিতেছে, -দাদাকে রাক্ষসে খাইতেছে! গায়ের রোমে কাঁটা, চোখের পলক ভাঁটা, অজিত ছুটিয়া
গিয়া রাক্ষসের মাথায় এক চড় মারিল। রাক্ষস "আঁই আঁই' করিয়া ঘুরিয়া পড়িয়া এক সোনার ডেলা
উগরিয়া পলাইয়া গেল!
রাণী দেখিল, পৃথিবী উল্টিয়াছে- পেটের ছেলে শত্রু হইয়াছে! রাণী মনের আগুনে জ্ঞান-দিশা
হারাইয়া আপনার ছেলেকে মুড়মুড় করিয়া চিবাইয়া খাইল! রাণীর গলা দিয়া এক লোহার ডেলা
গড়াইয়া পড়িল।
রাণীর পা উছল, রাণীর চোখ উখর, সোনার ডেলা লোহার ডেলা নিয়া রাণী ছাদে উঠিল।
ছাদে রাক্ষসের হাট। একদিকে বলে-
হুঁম্ হুঁম্ থাম্ -আঁরো খাঁবো।
আর এক দিকে বলে,-
গুম্ গুম্ গাঁম্-দেঁশে যাঁবো।
রাণী বলিল-
"গব্ গব্ গুম্ থম্ থম্ খাঃ!
আমি হেঁথা থাকি, তোঁরা দেশে যায়ঃ!"
রাজপুরীর চূড়া ভাঙ্গিয়া পড়িল, রাজার বুক কাঁপিয়া উঠিল; -গাছ-পাথর মুচ্ড়িয়া, নদীর জল
উছ্লিয়া রাক্ষসের ঝাঁক দেশে ছুটিল।
ঘরে গিয়া রাণীর গা জ্বলে, পা জ্বলে; রাণী সোয়াস্তি পায় না। বাহিরে গিয়া রাণীর মন
ছন্ছন্, বুক কন্কন্; রাত আর পোহায় না।
না পারিয়া রাণী আরাম-কাঠি জিরাম-কাঠিটি বাহির করিয়া পোড়াইয়া ফেলিল। তাহার পর,
মায়া-মেঘে উঠিয়া, নদীর ধারে এক বাঁশ-বনের তলে সোনার ডেলা, লোহার ডেলা পুঁতিয়া
রাখিয়া, রাক্ষসী-রাণী, নিশ্চিত হইয়া ফিরিয়া আসিল।
বাঁশের আগে যে কাক ডাকিল, ঝোপের আড়ে যে শিয়াল কাঁদিল, রাণী তাহা শুনিতে পাইল না।
৩
পরদিন রাজ্যে হুলুস্থুল। ঘরে ঘরে মানুষের হাড়, পথে পথে হাড়ের জাঙ্গাল! রাক্ষসে দেশ
ছাইয়া গিয়াছে, আর রক্ষা নাই। যখন সকলে শুনিল, রাজপুত্রদেরও খাইয়াছে, তখন জীবন্ত
মানুষ দলে-দলে রাজ্য ছাড়িয়া পলাইয়া গেল।
রাজা বোকা হইয়া রহিলেন; রাজার রাজত্ব রাক্ষসে ছাইয়া গেল।
৪
নদীর ধারে বাঁশের বন হাওয়ায় খেলে, বাতাসে দোলে। এক কৃষাণ সেই বনের বাঁশ কাটিল। বাঁশ
চিবিয়া দেখে, দুই বাঁশের মধ্যে বড় বড় গোল দুই ডিম। সাপের ডিম, না কিসের ডিম। কৃষাণ
ডিম ফেলিয়া দিল।
অমনি, ডিম ভাঙ্গিয়া, লাল নীল ডিম হইতে লাল নীল রাজপুত্র বাহির হইয়া,
-মুকুট মাথে
খোলা তরোয়াল হাতে জোড়া রাজপুত্র শন্ শন্ করিয়া রাজ্য ছাড়িয়া চলিয়া গেল!
ডরে কৃষাণ মূর্ছা গেল।
যখন উঠিল, কৃষাণ দেখে, লাল ডিমের খোলস সোনার আর নীল ডিমের খোলস লোহা হইয়া পড়িয়া
আছে! তখন লোহা দিয়া কৃষাণ কাস্তে গড়াইল; সোনা দিয়া ছেলের বউর পঁইচে, বাজু বানাইয়া
দিল।
চলিয়া চলিয়া, জোড়া রাজপুত্র এক রাজার রাজ্যে আসিলেন। সে রাজ্যে বড় খোক্কসের ভয়।
রাজা রোজ মন্ত্রী রাখেন, খোক্কসেরা সে মন্ত্রী খাইয়া যায় আর এক ঘর প্রজা খায়। রাজা
নিয়ম করিয়াছেন, যে কোন জোড়া রাজপুত্র খোক্কস মারিতে পারিবে, জোড়া পরীর মত জোড়া
রাজকন্যা আর তাঁহার রাজত্ব তাহারাই পাইবে। কত জোড়া রাজপুত্র আসিয়া খোক্কসের পেটে
গেল। কেহই খোক্কস মারিতে পারে না; রাজকন্যাও পায় নাই, রাজ্যও পায় নাই।
লালকমল নীলকমল জোড়া রাজপুত্র রাজার কাছে গিয়া বলিলেন,-"আমরা খোক্কস মারিতে
আসিয়াছি!"
রাজার মনে একবার আশা নিরাশা; শেষে বলিলেন,-"আচ্ছা।"
নীলকমল লালকমল এক কুঠুরিতে গিয়া, তরোয়াল খুলিয়া বসিয়া রহিলেন।
৫
রাত্রি ক'দণ্ড হইল, কেহ আসিল না।
রাত্রি আর ক'দণ্ড গেল, কেহ আসিল না।
রাত্রি একপ্রহর হইল, তবু কেহ আসিল না।
শেষে, রাত্রি দুপুর হইল; কেহ আর আসে না। দুই ভাইয়ের বড় ঘুম পাইল। নীল লালকে
বলিলেন,-"দাদা! আমি ঘুমাই, পরে আমাকে জাগাইয়া তুমি ঘুমাইও।" বলিয়া,
বলিলেন,-"খোক্কসে যদি নাম জিজ্ঞাসা করে তো, আমার নাম আগে বলিও, তোমার নাম যেন আগে
বলিও না।" লালকমল তরোয়ালে ভর দিয়া সজাগ হইয়া বসিলেন।
খোক্কসেরা আসিয়াই, -আলোতে ভাল দেখিতে পায় না কি-না?-বলিল,-"আলোঁ নিঁবোঁ।"
লালকমল বলিলেন,-"না!"
সকলের বড় খোক্কস রাগে গঁর গঁর,-বলিল-"বঁটে! ঘরে কেঁ জাঁগেঁ?" যত খোক্কসে
কিচিমিচি,-"কেঁ জাঁগেঁ, কেঁ জাঁগেঁ?"
লালকমল উত্তর করিলেন-
"নীলকমল জাগে, লালকমল জাগে
আর জাগে তরোয়াল,
দপ্দপ্ করে ঘিয়ের দীপ জাগে-
কার এসেছে কাল?"
নীলকমলের নাম শুনিয়া খোক্কসেরা ভয়ে তিন হাত পিছাইয়া গেল! নীলকমল আর জন্মে
রাক্ষসী-রাণীর পেটে হইয়াছিল, তাই তাঁর শরীরে কি-না রাক্ষসের রক্ত! খোক্কসেরা তাহা
জানিত। সকলে বলিল,-"আচ্ছা নীলকমল কি-না পরীক্ষা কর।"
রাক্ষস-খোক্কসেরা নানা রকম ছলনা চাতুরী করে' সকলের বড় খোক্কসটা সেই সব আরম্ভ করিল।
বলিল,-তোঁদের নঁখেঁর ডাঁগাঁ দেঁখিঁ?"
লাল, নীলের মুকুটটা তরোয়ালের খোঁচা দিয়া বাহির করিয়া দিলেন। সেটা হাতে করিয়া
খোক্কসেরা বলাবলি করিতে লাগিল-বাঁপ্ রেঁ! ঐ যাঁর নঁখের ডঁগাঁ এঁমঁন, না জাঁনি সেঁ
কিঁ রেঁ!
তখন আবার বলিল,-দেঁখি তোঁদেঁর থুঁ থুঁ কেঁমঁন।"
লালকমল তরোয়াল প্রদীপের ঘি গরম করিয়া ছিটাইয়া দিলেন। খোক্কসদের লোম পুড়িয়া গন্ধে ঘর
ভরিল; খোক্কসেরা আবার আসিয়া বলিল,-"তোঁদেঁর জিঁভঁ দেঁখিবঁ।"
লাল, নীলের তরোয়ালখানা দুয়ারের ফাঁক দিয়া বাড়াইয়া দিলেন। বড় খোক্কস দুই হাতে তরোয়াল
ধরিয়া, আর সকল খোক্কসকে বলিল,-"এঁইবাঁর জিঁভ্ টানিয়া ছিঁড়িবঁ, তোঁরাঁ আঁমাঁকে
ধঁরিঁয়াঁ জোঁরেঁ টাঁন্-ন্-ন্।"
সকলে মিলিয়া খুব জোরে টানিল, আর তর্তর্ ধার নেঙ্গা তরোয়ালে বড় খোক্কসের দুই হাত
কাটিয়া কালো রক্তের বান ছুটিল! চেচাঁইয়া মেচাইয়া সকল খোক্কস ডিঙ্গাইয়া বড় খোক্কস
পলাইয়া গেল!
অনেকক্ষণ পরে বড় খোক্কস আবার কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া বলিল,-"কেঁ জাঁগেঁ, কে
জাঁগেঁ?"
কতক্ষণ খোক্কস আসে নাই, লাল কমলের ঘুম পাইতেছিল; লালকমল ভুলে বলিয়া ফেলিলেন,-
"লালকমল জাগে, আর-"
মুখের কথা মুখে,-দুয়ার কবাট ভাঙ্গিয়া সকল খোক্কস লালকমলের উপর আসিয়া পড়িল। ঘিয়ের
দীপ উল্টিয়া গেল, লালের মাথার মুকুট পড়িয়া গেল;
লাল ডাকিলেন-"ভাই!"
নীলকমল জাগিয়া দেখেন,-খোক্কস! গা মোড়ামুড়ি দিয়া নীল বলিলেন,-
"আরামকাকাঠি জিরামকাঠি, কে জাগিস্ রে?
দ্যাখ তো দুয়ারে মোর ঘুম ভাঙ্গে কে!"
নীলকমলের সাড়ায় আ-খোক্কস ছা-খোক্কস সকল খোক্কস আধমরা হইয়া গেল। নীলকমল উঠিয়া ঘিয়ের
দীপ জ্বালিয়া দিয়া সব খোক্কস কাটিয়া ফেলিলেন। সকলের বড় খোক্কসটা নীলকমলের হাতে
পড়িয়া, যেন, গিরগিটির ছা!
খোক্কস মারিয়া হাত মুখ ধুইয়া দুই ভাইয়ে নিশ্চিতে ঘুমাইতে লাগিলেন।
পরদিন রাজা গিয়া দেখিলেন, দুই রাজপুত্র রক্তজবার ফুল-গলাগলি হইয়া ঘুমাইতেছেন;
চারিদিকে মরা খোক্কসরে গাদা। দেখিয়া রাজা ধন্যধন্য করিলেন। রাজার রাজত্ব ও জোড়া
রাজ-কন্যা দুই ভাইয়ের হইল।
৬
সেই যে রাক্ষসী-রাণী? রাজার পুরীতে থানা দিয়া বসিয়াছে তো? আই-রাক্ষস কাই-রাক্ষস
তাঁর দুই দূত দিয়া খোক্কসের মরণ-কথার খবর দিল। শুনিয়া রাসী-রাণী হাঁড়িমুখ ভারি
করিয়া বুকে তিন চাপড় মারিয়া বলিল,-"আই রে! কাই রে! আমি তো আর নাই রে!-
-ছাই পেটের বিষ-বড়ি
সাত জন্ম পরাণের অরি-
ঝাড়ে বংশে উচ্ছন্ন দিয়া আয়!"
অমনি আই কাই, দুই সিপাইর মূর্তি ধরিয়া নীলকমল লালকমল রাজসভায় গিয়া বলিল,-"বুকে খিল
পিটে খিল, রাক্ষসের মাথায় তেল না হইলে তো আমাদের রাজার ব্যারাম সারে না।"
লালকমল নীলকমল কহিলেন,-"আচ্ছা, তেল আনিয়া দিব।"
নূতন তরোয়ালে ধার দিয়া, দুই ভাই রাক্ষসের দেশের উদ্দেশে চলিলেন।
যাইতে যাইতে, দুই ভাই এক বনের মধ্যে গিয়া উপস্থিত হইলেন। খুব বড় এক অশ্বত্থ গাছ
হায়রাগ হইয়া দুই ভাইয়ে অশ্বত্থের তলায় বসিলেন।
সেই অশ্বত্থ গাছে বেঙ্গমা-বেঙ্গমী পীর বাসা। বেঙ্গমী বেঙ্গমাকে বলিতেছে,-
"আহ, এমন দয়াল কাঁরা, দুই ফোঁটা রক্ত দিয়া আমার বাছাদের চোখ ফুটায়!"
শুনিয়া, লাল নীল বলিলেন,-"গাছের উপরে কে কথা কয়?-রক্ত আমরা দিতে পারি।"
বেঙ্গমী "আহ্ আহা" করিল।
বেঙ্গম নিচে নামিয়া আসিল।
দুই ভাই আঙ্গুল চিবিয়া রক্ত দিলেন।
রক্ত নিয়া বেঙ্গম বাসায় গেল; একটু পরে সাঁ সোঁ করিয়া দুই বেঙ্গম বাচ্চা নামিয়া
আসিয়া বলিল,-"কে তোমরা রাজপুত্র আমাদের চোখ ফুটাইয়াছ? আমরা তোমাদের কি কাজ করিব বল।"
নীল লাল বলিলেন,-"আহা, তোমরা বেঁচে থাক : এখন আমাদের কোনই কাজ নাই।"
বেঙ্গম-বাচ্চারা বলিল,-"আচ্ছা, তা তোমরা, যাইবে কোথায় চল, আমরা পিঠে করিয়া রাখিয়া
আসি।"
দেখিতে দেখিতে ডাঙ্গা জাঙ্গাল, নদ নদী, পাহাড়-পর্বত, মেঘ, আকাশ, চন্দ্র, সূর্য সকল
ছাড়াইয়া, দুই রাজপুত্র পিঠে বাচ্চারা হু হু করিয়া শূন্যে উড়িল।
৭
শূন্যে শূন্যে সাত দিন সাত রাত্রি উড়িয়া আট দিনের দিন বাচ্চারা এক পাহাড়ের উপর
নামিল। পাহাড়ের নিচে ময়দান, ময়দান ছাড়াইলেই রাক্ষসের দেশ। নীলকমল গোটাকতর কলাই
কুড়াইয়া লালকমলের কোঁচড়ে দিয়া বলিলেন,-"লোহার কলাই চিবাইতে বলিলে এই কলাই চিবাইও!"
নীল লাল আবার চলিতে লাগিলেন।
দুই ভাই ময়দান পার হইয়া আসিয়াছেন-,আর-,
"হাঁউ মাঁউ! কাউঁ!
মনিষ্যির গঁন্ধ পাঁউ!!
ধঁরে ধঁরে খাঁউ!!!"
-করিতে করিতে পালে পালে 'অযুতে-নিযুতে রাক্ষস ছুটিয়া ছুটিয়া আসিতে লাগিল। নীলকমল
চেঁচাইয়া বলিলেন,-"আয়ী মা! আয়ী মা! আমরাই আসিয়াছি- তোমার নীলকমল, কোলে করিয়া নিয়া
যাও!"
"বঁটে বঁটে, থাঁম্ থাঁম্ !" বলিয়া রাক্ষসদিগকে থামাইয় এ-ই লম্বা লম্বা হাত পা ছুঁড়িতে
ছুঁড়িতে, ঝাঁকার জট কাঁপাইতে কাঁপাইতে, হাঁপাইয়া 'জটবিজটি' আয়ীবুড়ি আসিয়া নীলকমলকে
কোলে নিয়া-"আমার নীল! আমার নাঁতু!' বলিয়া আদর করিতে লাগিল। আয়ীর গায়ের গন্ধে নীলুর
নাড়ি উলটিয়া আসে। লালকে দেখিয়া আয়ীবুড়ি বলিল,-"ওঁ' তোঁর সঁঙ্গে কেঁ র্যাঁ?"
নীলু বলিলেন,- "ও আমার ভাই লো আয়ীমা, ভাই!"
বুড়ি বলিল,-
"তাঁ কেঁন মঁনিষ্যি মঁনিষ্যি গন্ধ পাঁই?
আঁমার নাঁতু হঁয় তো চিবিয়ে খাঁক্
নোঁহার কঁলাই।"
-বলিয়া বুড়ি 'হোঁৎ' করিয়া নাকে ভিতর হইতে পাঁচ গণ্ডা লোহার কলাই বাহির করিয়া
লাল-নাতুকে খাইতে দিল।
লাল তো আগেই জানেন; -চুপে চুপে লোহার কলাই কোঁচড়ে পুরিয়া, কোঁচড়ের সত্যিকার কলাই
কটর্ কটর্ করিয়া চিবাইলেন! বুড়ি দেখিল, সত্যি তো, লাল টুক্টুক্ নাতুই তো। বুড়ি তখন
গদ্গদ্,-দুই নাতু কোলে নিয়া বুলায়, ঢুলায়, কয়-
"আঁইয়া মাঁইয়া নাঁতুর
লাঁলু নীলু কাঁতুর্
নাঁতুর বাঁলাই দূরে যাঁ!"
-কিন্তু লালকমলের শরীরে মনুষ্যের গন্ধ! -কোটর চোখ
অস্গস্ জিভ বার বার খস্-খস্, আয়ীর
মুখের সাত কলস লাল্ গলিল!
তা নাতু? তা' কি খাওয়া যায়? বুড়ি কুয়োমুখে লাড়ুটুকু খাইতে খাইতে খাইল না। শেষে নাতু নিয়া আয়ী বাড়ি গেল!
৮
-সে কি পুরী!- রাজ্যজোড়ে। সেই 'অছ্নি অভিন্' পুরী রাক্ষসে কিল্বিল্। যত রাক্ষসে
পৃথিবী ছাঁকিয়া জীবজন্তু মারিয়া আনিয়া পুরী ভরিয়া ফেলিয়াছ। লাল নীল, রাক্ষসের কাঁধে
চড়িয়া বেড়ান আর দেখেন, -গাদায় গাদায় মরা, গাদায় গাদায় জরা! পচায়, গলায় পুরী গদ্ গদ্
থক্ থক্ -গন্ধে বালো ভূত পালায়, দেব দৈত্য ডরায়! দেখিয়া লাল বলিলেন,-"ভাই, পৃথিবী
তো উজাড় হইল।"
নীল চুপ করিয়া রহিলেন,-"নাঃ পৃথিবী আর থাকে না!' তখন, নিশি রাত্রে, যত নিশাচর
রাক্ষস, সাত সমুদ্রের ঐ পারে যত রাজ-রাজ্য উজাড় দিতে গিয়াছে; এক কাচ্চা-বাচ্চাও
পুরীতে নাই; নীলকমল উঠিয়া, লালকমলকে নিয়া পুরীর দক্ষিণ কূয়োর পাড়ে গেলেন। গিয়া, নীল
বলিলেন,-"দাদা, আমার কাপড়-চোপড় ধর।"
কাপড় দিয়া, নাল, কূয়োয় নামিয়া এক খড়গ আর এক সোনার কৌটা তুলিলেন। কৌটা খুলিতেই
জীয়নকাঠি মরণকাঠি দুই ভীমরুল ভীমরুলী বাহির হইল।
জীয়নকাঠি মরণকাঠি-ভীররুল ভীমরুলীর, গায়ে বাতাস লাগিতেই, মাথা কন্-কন্ বুক চন্-চন্,
রাক্ষসের মাথায় টনক্ পড়িল; বোকা রাজার দেশে রাক্ষসী-রাণী ঘুমের চোখে ঢুলিয়া পড়িল।
মাথার টনক্ বুকে চমক্; দীঘল দীঘল পায়ে রাক্ষসেরা নদী পবর্ত এড়ায়, ধাইয়া ধাইয়া আসে!
দেখিয়া নীলকমল জীয়নকাঠির পা ছিঁড়িয়া দিলেন। যত রাক্ষসের দুই পা খসিয়া পড়িল।
দুই হাতে ভর, তবু রাক্ষস ছুটিয়া ছুটিয়া আসে -নীলকমল জীয়নকাঠির আর চার পা ছিঁড়িয়া
ফেলিলেন। যত রাক্ষসের হাত খসিয়া পড়িল
হাত নাই পা নাই, তবু রাক্ষস,-
"হাঁউ মাঁউ কাঁউ!
সাঁত শঁত্তুর খাঁউ!!-"
-বলিয়া পড়াইয়া গড়াইয়া ছোটে। খড়গের ধারে ধরিয়া নীলকমল জীয়নকাঠির মাথা কাটিলেন। আর যত
রাক্ষসের মাথা ছুটিয়া পড়িল। আয়ীবুড়ির মাথাটা,-ছিটকাইয়া পড়িয়া নীল লালকে ধরে-ধরে
গিলে-গিলে।
তখন রাক্ষস-পুরী খাঁ খাঁ;-আর কে থাকে? নীলকমল লালকমল আয়ীবুড়ির মাথা নূতন কাপড়ে
জড়াইয়া, মরণকাঠি ভীমরুলের সোনার কৌটা নিয়া, "বেঙ্গম, বেঙ্গম!"- বলিয়া ডাক দিলেন।
৯
তিন মাস তের রাত্রির পর দুই ভাইয়ের পা দেশে পড়িল। দেশের সকলে জয় জয় করিয়া উঠিল!
নীলকমল লালকমল বলিলেন,-"সিপাইরা কৈ? ওষুধ নাও!"
সিপাইরা কি আছে? আই আর কাই তো রাক্ষস ছিল! তারা সেইদিন-ই মরিয়াছে। নীলকমল লালকমল
আপন সিপাই বুকে খিল পিঠে খিল রাজার দেশে রাসের মাথা পাঠাইয়া দিলেন।
"ও-মা!!"-মাথা দেখিয়াই রাণী-নিজ মূর্তি ধারণ করিল-
"করম্ খাম্ গরম খাম্
মুড়মুড়িয়ে হাড্ডি খাম্!
হম্ ধম্ ধম্ চিতার আগুন
তবে বুকের জ্বালা যাম্!!
বলিয়া রাক্ষসী-রাণী বিকট মূর্তি ধরিয়া ছুটিতে ছুটিতে নীলকমল লালকমলের রাজ্যে গিয়া
উপস্থিত হইল।
বাহির দুয়ারে,-"খাম্! খাম্!!"
লাল বলিলেন,-"থাম্ থাম্।" লালকমল মরণকাঠি ভীমরুল আনিয়া-কৌটা খুলিলেন।
গা ফুলিয়া ঢোল,
চোখের দৃষ্টি ঘোল,
মরণকাঠি দেখিয়া, রাক্ষসী, মরিয়া পড়িয়া গেল!
সকলে আসিয়া দেখে, -এটা আবার কি! খোক্কসের ঠাকুর'মা না কি? আমাদের রাজ্যে বুঝি
নিমন্ত্রণ খাইতে আসিয়াছেন? সকলে "হো-হো-হো!!" করিয়া উঠিল।
জল্লাদেরা আসিয়া মরা রাক্ষসিটাকে ফেলিয়া দিল।
১০
রাণী মরিল, আর বোকা রাজার রোগ সারিয়া গেল! ভাল হইয়া রাজা রাজ্যে রাজ্যে ঢোল দিলেন।
প্রজারা আসিয়া বলিল,-"হায়! আমাদের সোনার রাজপুত্র অজিত কুসুম কৈ?"
রাজা নিঃশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন,-"হায়! অজিত কুসুম কৈ?"
এমন সময় রাজপুরীর ঢাক ঢোলের শব্দ। রাজা বলিলেন,-"দেখ তো, কি।"
গলাগলি দুই রাজপুত্র আসিয়া রাজার গায়ে প্রণাম করিল। রাজা বলিলেন,-"তোরা কি আমার
অজিত কুসুম?"
প্রজারা সকলে বলিল,-"ইহারাই আমাদের অজিত কুসুম!"
তখন দুই রাজ্য এক হইল; নীলকমল লালকমল ইলাবতী লীলাবতীকে লইয়া, দুই রাজা সুখে কাল
কাটাইতে লাগিলেন।
১
এক রাজা, রাজার এক রাণী, এক রাজপুত্র। রাণীর আয়ু একজোড়া পাশার মধ্যে,- রাজপুরীর তালগাছে এক রাক্ষুসী এই কথা জানিত। কিন্তু কিছুতেই রাক্ষুসী যো পাইয়া উঠে নাই। একদিন রাজা মৃগয়ায় গিয়াছেন, রাজপুত্র সখা সাথী পাঁচজন লইয়া পাশা খেলিতেছিলেন; দেখিয়া, রাক্ষসী, এক ভিখারিণী সাজিয়া রাজপুত্রের কাছে গিয়া পাশা জোড়া চাহিল; রাজপুত্র কি জানেন? হেলায় পাশা জোড়া ভিখারিণীকে দিয়া ফেলিলেন। তিন ফুঁয়ে রাক্ষসী, রাণীর আয়ু পাশা, কোন্ রাজ্যে পাঠাইল কে জানে? রাণীর ঘরে রাণী মূর্ছা গেলেন! রাক্ষসী তাড়াতাড়ি দিয়া রাণীকে খাইয়া রাণীর মূর্তি ধরিয়া বসিয়া রহিল।
রোজ যেমন, আজও রাজা আসিলেন- রোজ যেমন, আজও রাণী সেবা যত্ন করিলেন। কেবল রাজপুত্র দেখিলেন, খাবার দিবার সময়, মায়ের জিভের একফোঁটা জল টস্ করিয়া পড়িল! গা ছম্ ছম্! রাজপুত্র আর খাইলেন না; চুপ করিয়া উঠিল গেলেন। এ কথা আর কেহই জানিল না।
ক’ বৎসর যায়, রাজার সাত ছেলে হইল। রাজা খুব ধূমধাম করিলেন। কেবল রাজপুত্র দেখিলেন, তালগাছের আগা দিন দিন শুকায়, তালগাছে কোন পক্ষী বসে না। রাজপুত্র চুপ করিয়া রহিলেন। সাত ছেলে বড় হইল। রাজা সময়মত তাহাদের অন্নপ্রাশন, ছূড়া, উপনয়ন, সব করাইলেন। তখন রাজপুত্রেরা বলিলেন,- “এখন আমরা দেশ ভ্রমণে যাইব।”
রাজা বলিলেন,- “বড়কুমার গেল না, তোরা কি করিয়া যাইবি?” রাজা বড়কুমারকে খবর দিলেন। খবর পাইয়াই এক পক্ষিরাজে চড়িয়া বড়কুমার ভাইদের কাছে গেলেন,- “কেন রে ভাই! দাদাকে তোরা ভুলিয়া গিয়াছিলি? চল্ এইবার দেশ ভ্রমণে যাইব।” আট ভাই সাজ-সজ্জা করিয়া চরকটক সঙ্গে রাজপুরী হইতে বাহির হইলেন।
ছাদের উপরে রাক্ষসী রাণী দেখে,-বড় বিপদ,-কুমার তো গেল! আছাড়ি-বিছাড়ি রাক্ষসী ঘরে গিয়া এক কৌটা খুলিল; কৌটার মধ্যে সূতাশঙ্খ-সাপ। রাক্ষসী বলিল,-
“সূতাশঙ্খ,
সূতাশঙ্খ শাঁখের আওয়াজ!
কুমারের
আয়ু কিসে বল দেখি আজ?”
সূতাশঙ্খ সূতার মত ছোট্ট-সরু; কিন্তু আওয়াজ তা’র শঙ্খের কত। সরু ফণা তুলিয়া শঙ্খের আওয়াজে সূতাশঙ্খ বলিল-
“তোর আয়ু কিসে
রাণী, মোর আয়ু কিসে?
ডালিম
কুমারের আয়ু ডালিমের বীজে।”
রাক্ষুসী বলিল,-
“যাও ওরে
সূতাশঙ্খ, বাতাসে করি ভর,-
যম-যমুনার
রাজ্য-শেযে পাশাবতীর ঘর!
এই লিখন
দিও নিয়া পাশাবতীর ঠাঁই,
সাত ছেলের তরে
আমার সাত কন্যা চাই।
রিপু অরি
যায়, সূতা, চিবিয়ে খাবে তারে,
সতীনের পুত যেন
পাশা আনতে নারে।”
লিখন নিয়া, সূতাশঙ্খ, বাতাসে ভর দিয়া গাছের উপর দিয়া-দিয়া চলিল! রাক্ষসী, এক ডালিম
হাতে, আবার মন্ত্র পড়িল-
“পক্ষিরাজ, পক্ষিরাজ, উঠে চলে যা,
পাশাবতীর রাজ্যে গিয়া ঘাস জল খা।”
মন্ত্র পড়িয়া রাক্ষসী তাড়াতাড়ি আসিয়া রাজপুরীর হাজার সিঁড়ির ধাপে উঠিয়া বলিল,-
“সিড়ি, তুমি কা’র?”
সিঁড়ি বলিল,- “যে যখন যায়, তা’র!”
রাক্ষসী বলিল,- “তবে সিঁড়ি দু’ফাঁক হও, এই ডালিমের বীজ তোমার ফাটলে থা’ক।” ডালিমের
বীজ হাজার সিঁড়ির ধাপের নীচে জন্মের মত বন্ধ হইয়া রহিল;-রাক্ষসী গিয়া নিশ্চিন্তে
দুধ-ধব্-ধব্ শয্যায় শুইয়া ঘুমাইয়া পড়িল।
অমনি,- আট রাজপুত্র কোন্ বনের মধ্যে পড়িয়া ছিলেন, সেইখানে খটাস্ করিয়া বড়কুমারের
চোখ অন্ধ হইয়া গেল,- বড়কুমার চীৎকার করিয়া উঠিলেন,- “ভাই রে! বিছার কামড়, -গেলাম
গেলাম!!”
সূর্য ডুবিয়া গেল, চারিদিকে ঝড় বৃষ্টি, অন্ধকার,-বনের মধ্যে কিছু দেখা যায় না, শোনা
যায় না, বড় রাজকুমার কোথায় পড়িয়া রহিলেন, চরকটক কোথায় গেল- সাত রাজপুত্রের ঘোড়া
ঝড়ের আগে ছুটিয়া চলিল।
২
রাক্ষসী তো স্বপ্ন দেখে,- সূতাশঙ্খ এতক্ষণে যম-যমুনা দেশের ‘সে পার’! ওদিকে সূতাশঙ্খ সারাদিন গাছে গাছে চলিয়া, হয়রাণ; একখানে রাত্রি হইল, কে আর যায়? পরিপাটী রাজার বাগান,- বাগানের এক গাছের ফলের মধ্যে ঢুকিয়া, বেশ করিয়া কুণ্ডলী মণ্ডলী পাকাইয়া, সূতা ঘুমাইয়া রহিল।
রাজকন্যা রোজ সেই গাছের ফল খান। মালী নিত্যকার মত ফল আনিয়া দিল; রাজকন্যা নিত্যকার মত ফলটি খাইলেন।– ফলের সঙ্গে সূতাশঙ্খ, রাক্ষসীর লিখন, রাজকন্যার পেটে গেল।
লিখন টিখন ওসব কথা রাজপুত্রেরা কি জানে? উড়িয়া, ছুটিয়া, পক্ষিরাজেরা যে কোথা’ দিয়া কি করিয়া গেল, কেহই জানে না। একখানে গিয়া ভোর হইল; সকলে দেখেন, -দাদা নাই! ভাবিলেন, পাছে পড়িয়া গিয়াছেন! রাশ আল্গা দিয়া সাত ভাই দাদার জন্য পক্ষিরাজ থামাইলেন। নাঃ,- দিন যায়, রাত যায়, দাদার দেখা নাই! তখন, এক ভাই বলিলেন,- “ঘোড়া যদি আগে গিয়া থাকে!”
“ঠিক্”,
ঠিক্!!” সকলে পক্ষিরাজ সামনে ছুটাইয়া দিলেন। মন্ত্র-পড়া পক্ষিরাজ একেবারে পাশাবতীর
পুরে গিয়া উপস্থিত!
পাশাবতীর পুরে পাশাবতী দুয়ারে নিশান উড়াইয়া ঘর-কুঠরী সাজাইয়া, সাজিয়া, বসিয়া আছে।
যে আসিয়া পাশা খেলিয়া হারাইতে পারিবে, আপনি, আপনার ছয় বোন নিয়া তাহাকে বরণ করিবে।
রাজপুত্রদিগকে দেখিয়া পাশাবতী বলিল,- “কে তোমরা?”
রাজপুত্রেরা বলিলেন,-“অমুক দেশের রাজপুত্র, দেশ ভ্রমণে আসিয়াছি।”
পাশাবতী বলিল,- “না! দেখিয়া বোধ হয় যক্ষ রক্ষ।– তোমরা আমার পণ জান?”
“জানি না”
“আমার পাশার পণ।– দানব যক্ষ রক্ষ হইলে পরখ্ দেখিয়া নিব; মানুষ হইলে খেলিতে হইবে।
যে দিনে
সে মালা পায়,
হারিলে মোদের পেটে যায়?”
রাজপুত্রেরা বলিলেন,- ‘পরখ্ কর!”
পাশাবতী লিখন দেখিতে চাহিল,- “দানব যক্ষ রক্ষ হইলে লিখন থাকিবে।”
রাজপুত্রেরা বলিলেন,- “লিখন কিসের? লিখন নাই।”
“তবে খেল।”
খেলিয়া রাজপুত্রেরা হারিয়া গেলেন। পাশাবতীর সাত বোনে সাত রাজপুত্র, পক্ষিরাজ সব
কুচিকুচি করিয়া কাটিয়া হালুম হালুম করিয়া খাইয়া ফেলিল। ফেলিয়া, আবার রূপসী মূর্তি
ধরিয়া বসিয়া রহিল। রাক্ষসী-রাণী স্বপ্ন দেখে কি, আর তা’র কপালে হইল কি! রাক্ষসীর
মাথায়া টনক্ পড়িয়াছে কি না, কে জানে? যা’ক্!
৩
অন্ধ রাজকুমারকে পিঠে করিয়া পক্ষিরাজ ঝড়-বৃষ্টি অন্ধকারে শূন্যের উপর দিয়া ছুটিতে ছুটিতে,- হাতের রাশ হারাইয়া রাজকুমার কখন্ কোথায় পড়িয়া গেলেন। পক্ষিরাজ এক পাহাড়ের উপর পড়িয়া পাথর হইয়া রহিল। রাজকুমার যেখানে পড়িলেন, সে এক নগর! সেই নগরে রাজপুরীতে সন্ধ্যার পর লক্ষ কাড়া, লক্ষ সানাই, ঢাক ঢোল সব বাজিয়া উঠে, ঘরে ঘরে চূড়ায় চূড়ায় পথে পথে মশাল জ্বলে, নিশান উড়ে, হৈ হৈ আনন্দের সাড়া পড়িয়া যায়।
ভোরে সব চুপ! তারপর কেবল কান্নাকাটি, চীৎকার, হাহাকার, বুকে চাপড়. ছুটাছুটি- চোখের জলে দেশ ভাসে, শোকে রাজ্য আচ্ছন্ন হইয়া যায়। আবার, দুপুর বহিয়া গেলে, যখন রাজার হাতী সাজিয়া গুজিয়া বাহির হয়, তখন রাজ্যের লোক নিঃশ্বাস ছাড়িয়া দিয়া খাওয়া দাওয়া করে,-তাহার পর সমস্ত নগরের লোক পথে পথে সারি দিয়া দাঁড়ায়।
পাট হাতী ছোটে, ছোটে,-একজনকে ধরিয়া, সিংহাসনে তুলিয়া নেয়-অমনি ঢাক ঢোল বাজাইয়া শাঁকে ফুঁ দিয়া সিপাই, সান্ত্রী, মন্ত্রী, অমাত্য সকলে তুলিয়া-নেওয়া মানুষকে লইয়া গিয়া রাজ্যের রাজা করে। রাজকন্যার সঙ্গে তাঁহার বিবাহ হয়।–আবার আনন্দের হাট বসে। পরদিন দেখা যায় রাজকন্যার ঘরে কেবল হাড় গোড়; রাজার চিহ্নও নাই!! এই রকমে কত রাজা হইল, কত রাজা গেল। কিন্তু রাজা না থাকিলে রাজ্য থাকে না; তাই নিত্য নূতন রাজা চাই! রাজকন্যা জানেন না, কেহই বুঝিতে পারে না, রাজাকে কিসে খায়!
পাটহাতী ছুটিয়াছে। নগরে “সার্ সার্” সোর পড়িয়া গিয়াছে; সকলে চীৎকার করিতেছে, “পথ
ছাড়, পথ ছাড়, কাতার দাও।”
রাজাকুমারের জ্ঞান হইয়াছে, শব্দ শুনিয়া রাজকুমার উঠিয়া বসিলেন,- কিসের পথ, কোথায়
আসিয়াছেন, রাজপুত্র কিছুই জানেন না, কিছুই বুঝিতে পারিলেন না; রাজপুত্র থতমত খাইয়া
রহিলেন।
হাতী কাতারের কাহাকেও ছুঁইল না;- হু হু করিয়া সকল পথ ছাড়াইয়া আসিয়া রাজপুত্রকে
তুলিয়া সিংহাসনে বসাইল। রাজ্যের লোক “রাজা! রাজা!” বলিয়া জয়-জয়কার দিয়া অন্ধ
রাজকুমারকে নিয়া রাজা করিল।
ধুমধাম, অভিষেক, জাঁকজমক, বিচার আচার, সভা দরবার-সব-শেষে রাত্রি-রাজার দেশে সব
ঘুমাইয়াছে। নগরে শহরে সাড়াটি নাই, দুয়ার দরজায় পাহারা নাই-থাকিয়া কি হইবে? কা’ল-যা
হইবে সকলেই তো তা’ জানে, পাহারারা আর পাহারা দেয় না! রাজকন্যা ঘুমে বিভোর। সেই
কাল্রাত্রে কেবল রাজকুমার জাগিয়া আছেন। ঘর বা’র নিঝুম, পৃথিবী-সংসারে টুঁ শব্দ
নাই,-পোকা-মাকড় পক্ষীটিও ডাকে না;-কাল্ নিশির কালঘুমে সব যেন ছাইয়া আছে। ঘরে
প্রদীপ দপ্ দপ্ রাজপুত্রের মন-ছব্ ছব্; কোনই সাড়া নাই-কোনই শব্দ নাই।
হঠাৎ ঘুমের মধ্যে রাজকন্যা চীৎকার করিয়া অজ্ঞান হইলেন; চিড়িক দিয়া ঘরে বিজলী জ্বালিয়া উঠিল, চড়্ চড়্ করিয়া দেওয়ালের গা ফাটিয়া গেল; চুর্ চুর্ ঝর্ ঝর্ চারিদিকে ঝালর-পাত খসিয়া পড়িতে লাগিল।–রাজপুত্রের সকল গা কাঁটা-শক্ত করিয়া তরোয়ালের মুঠি ধরিয়া হাঁটু গাড়িয়া রাজকুমার বলিলেন, “কে” রাজপুত্র কিছুই দেখিতে পান না; ঘরের আলো বিদ্যুতের চমক,- রাজকন্যার শরীর কাঠের মত শক্ত,- রাজকন্যার নাকের ভিতর হইতে সরু- মিহি- চুলের মত সাপ বাহির হইল! সেই চুল দেখিতে দেখিতে সূতা-দড়া, -কাছি, তারপর প্রকাণ্ড অজগর! শঙ্খের মত আওয়াজে সেই অজগর গর্জিয়া উঠিল। পুরী থর্ থর্ কাঁপে! হাতের তরোয়াল ঝন্ ঝন্- রাজপুত্র হাঁকিলেন – “জানি না,-যে হও তুমি রক্ষ যক্ষ দানব!- যদি রাজপুত্র হই, যদি নিষ্পাপ শরীর হয়, দৃষ্টির আড়ালে তরোয়াল ঘুরাইলাম, এই তরোয়াল তোমাকে ছুঁইবে!”
বলা আর কহা,-সূতাশঙ্খ বত্রিশ ফণা ছাড়াইয়া বিষদাঁতে আগুন ছুটাইয়া লক্লক্ করিয়া উঠিয়াছে,- রাজপুত্রের তরোয়াল ঝ-ঝন্-ঝন্ শব্দে ঘরের ঝাড় বাতি চূর্ণ করিয়া সূতাশঙ্খের বত্রিশ ফণায় গিয়া লাগিল! অমনি রাজপুত্র দেখেন,-সাপ! ঘরময় বিদ্যুতের ধাঁধাঁ, চারিদিকে ধোঁয়া!- রাজপুত্র শন্শন্ তরোয়াল ঘুরাইয়া বলিলেন,- “চক্ষু পাইলাম!!!” তরোয়ালে অজগর সাত খণ্ড হইয়া কাটিয়া গেল; সেই নিশিতে রাক্ষসী-রাণীর পুরীতে ধ-ধ্বড়্-ধ্বড়্ শব্দে হাজার সিঁড়ির ধাপ ধ্বসিয়া গেল, রাজকুমারের আয়ু সহস্রডাল সোনার ডালিম গাছ হইয়া গজাইয়া উঠিল। রাজপুরীতে ভূমিকম্প-গুড়্-গুড়্ দুড়্ শব্দ! ভয়ে রাক্ষসী ইঁদুর হইয়া “চিঁচিঁ করিতে করিতে ছুটিয়া পালাইয়া গেল। রাণীর শরীর আবার মূর্ছা গিয়া পড়িয়া রহিল। রাজ্যে রাজপুরীতে হাহাকার,-“এ সব কি!”
রাত-রাজার রাজ্যের লোক নিত্যকার মত কাঁদিতে কাঁদিতে আসিয়াছে-দেখে-ধন্য! ধন্য!-রাজা! রাজা আজ জীয়ন্ত!!! লোকের আনন্দ ধরে না! দেখে হাজারো ফণা সাত কুচি সাপ-মেজেতে পড়িয়া!! “কি সর্বনাশ!”-সকলে বুঝিল, এই সাপে এত দিন এত রাজা খাইয়াছে!- “সাপকে পোড়াও।”
পোড়াইতে গিয়া, সাপের পেটে লিখন! লিখন রাজার কাছে আসিল। পড়িয়া রাজপুত্র বলিলেন,-“রাজকন্যা! আর তো আমি থাকিতে পারি না- আমার সাত ভাই বুঝি রাক্ষসের পেটে গিয়াছে!-আমি চলিলাম!” রাজ্যের লোক মনঃক্ষুণ্ণ- “শেষে এক রাজা পাইলাম তিনিও কোথায় চলিলেন।” রাজা কবে ফিরিবেন,-সকলে পথ চাহিয়া রহিল।
ডালিমকুমার যাইতেছেন, যাইতেছেন, এক পাহাড়ে উঠিয়া দেখেন পক্ষিরাজ। ছুঁইতেই আবার প্রাণ পাইয়া পক্ষিরাজ, “চিঁহী চিঁ!” করিয়া উঠিল। রাজপুত্র বলিলেন,- “পক্ষিরাজ, এইবার চল।” যম-যমুনার দেশ-অন্ধকার গায়ে ঠেক, বাতাসে পাথর উড়ে, রাজপুত্র কিছুই মানিলেন না- ‘ঝড়ের গতি কোন্ ছার, পক্ষিরাজে আসন যা’র।’তীর-বজ্রের মত পক্ষিরাজ ছুটিয়া চলিল।
কতক দূরে গিয়া কড়ির পাহাড়। কড়ির পাহাড়ে পক্ষিরাজের পা চলে না; ছট্ফট্ রটারট্ শব্দ। রাজপুত্র বলিলেন,-“পক্ষি! থামিও না; ছুটে’ চল।” পক্ষিরাজ তীর-বজ্রের গতি- সারারাত্রি পায়ের নীচে কড়ির পাহাড় চূর হইয়া গেল।
তার পরেই হাড়ের
পাহাড়। হাড়ের পাহাড়ের নীচে কলকল শব্দে রক্ত নদীর জল তোড়ে ছুটিয়াছে; রক্তের তরঙ্গ,
রক্তের ঢেউ! দাঁত বাহির করিয়া মড়ার মুণ্ড “হী!হী!” করিয়া উঠে, হাড়ে হাড়ে কটাকট
খটাখট শব্দ,- কান পাতা যায় না। রাজপুত্র বলিলেন,- “পক্ষি! ভয় ভাই, চোখ বুজিয়া চল।”
পায়ের নীচে হাড়ের পাহাড় খট্-খট্-খটাং, ছর্-র্-র্-র্-ছট্ছট্ শব্দে তুষ হইয়া
গেল। তখন রাত্রি পোহাইল, রাজপুত্র দেখেন, দূরে পাশাবতীর পুর। পাশাবতীর পুরে ফটকে
নিশান; নিশানে লেখা আছে,-
“পাশা
খেলিয়া যে হারাইবে, সাত বোনে মালা দিব!”
রাজপুত্র হাঁকিলেন,- “পাশা খেলিব!”
খেলিতে বসিয়া রাজপুত্র চমকিয়া গেলেন,-এ পাশা তো তাঁরি! খেলিতে গিয়া রাজপুত্র হারিয়া
গেলেন,- দেখেন, এক ইঁদুর পাশা উল্টাইয়া দেয়। আনমন রাজপুত্র বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন।
পাশাবতী বলিল,-“রাজপুত্র! পণ ফেল।”
“পক্ষিরাজ নাও; কাল আবার খেলিব।” বলিয়া রাজপুত্র উঠিয়া গেলেন। পাশাবতীরা তখনি
পক্ষিরাজকে গরাসে গরাসে খাইয়া ফেলিল।
পরদিন এক গ্রামের মধ্যে গিয়া রাজপুত্র এক বিড়ালের ছানা নিয়া আসিলেন। বলিলেন, -“এস,
আজ খেলিব।” খেলিতে বসিয়াছেন- আজ ইঁদুর আসে-আসে করে, আসে না- কি যেন দেখিয়া পলায়।
রাজপুত্র দা’ন ফেলিলেন-
“এই হাতে
ছিলে পাশা, পুনু এলে হাতে,-
এত দিন ছিলে পাশা- কা’র দুধ-ভাতে?”
আর দা’ন পড়ে। পলক ফেলিতে না ফেলিতে পাশাবতী হারিয়া গেল। রাজপুত্র বলিলেন,-“আমার
পক্ষিরাজ দাও।”
রাক্ষসী পক্ষীরাজ দিন।
আবার খেলা। রাক্ষসী আবার হারিল; রাজপুত্র বলিলেন, -“আমার ঘোড়ার মত ঘোড়া, আমার মত
রাজপুত্র দাও।” পাশাবতী এক রাজপুত্র এক ঘোড়া আনিয়া দিল; রাজপুত্র দেখেন, ভাই
ভাইয়ের ঘোড়া! রাজপুত্র আবার খেলিলেন। খেলিতে খেলিতে রাজপুত্র- সাত ভাই, সাত ভাইয়ের
ঘোড়া, পাশাবতীর রাজ-রাজত্ব ঘর পুরী সব জিতিলেন। শেষে বলিলেন,-“এখন কি দিবে? এই পাশা
আর ইঁদুর দাও।” পাশাবতী কি পাশা অমনি দেয়?-তখন রাজপুত্র বিড়ালের ছানা ছাড়িয়া
দিলেন,-বিড়াল গড়্ গড়্ করিয়া ইঁদুরকে ধরিয়া ছিঁড়িয়া খাইয়া ফেলিল। ঘরের প্রদীপ
নিবিয়া গেল,-রাজ-রাজত্ব কোথায় সব? হাতের পাশা হাতে, রাজপুত্র দেখেন- সাত পাশাবতী
সাত কেঁচো হইয়া মরিয়া রহিয়াছে!
পাশা বলিল,-“কুমার, কুমার ঘরে চল।”
আট রাজপুত্র আট পক্ষিরাজ হু হু করিয়া ছুটাইয়া দিলেন। রাজপুরীতে রাণী উঠিয়া
বসিয়াছেন,-“কতকাল ঘুমাইয়াছি!- আমার কুমার কৈ?”
“কুমার কৈ!”-চারিদিকে জয়ঢাক বাজে, পথের ধূলায় অন্ধকার- আট রাজপুত্র আট পক্ষিরাজের
সারি দিয়া রাজ্যে ফিরিয়াছেন। কুমার আসিয়া বলিলেন,-“মা কৈ, মা কৈ?”-আট রাজপুত্র
রাণীকে ঘিরিয়া প্রণাম করিলেন। শূন্য পুরীতে আবার সোনার হাট মিলিল।
“ভাইদের খোঁজে কবে গিয়াছেন, সবে-জীয়ন্ত এক রাজা আমাদের, আজও ফিরেন না।” খুঁজিয়া
খুঁজিয়া রাত-রাজার দেশের যত লোক আসিয়া দেখিল,-“আমাদের রাজা এইখানে!” তখন রাজকন্যা
রাজপাট তুলিয়া সেইখানে নিয়া আসিলেন। সকল দেখিয়া রাজা অবাক!
পরদিন ভোর বেলা সোনার ডালিম গাছে হাজার ফুল ফুটিয়া উঠিয়াছে;-আর দুপুর বেলা রাজপুরীর
তালগাছটা, কিছুর মধ্যে কিছু না, শিকড় ছিঁড়িয়া দুম্ করিয়া পড়িয়া, ফাটিয়া চৌচির হইয়া
গেল।
ক
রাজপুত্র আর এক মন্ত্রিপুত্র-দুই বন্ধুতে দেশভ্রমণে গিয়াছেন। যাইতে, যাইতে, এক
পাহাড়ের কাছে গিয়া ...সন্ধ্যা হইল!
১
এক
রাজপুত্র আর এক
মন্ত্রিপুত্র-
দুই বন্ধুতে
দেশভ্রমণে গিয়াছেন। যাইতে, যাইতে, এক পাহাড়ের কাছে গিয়া ...সন্ধ্যা হইল!
মন্ত্রিপুত্র বলিলেন,- “বন্ধু, পাহাড়-মুল্লুকে বড় বিপদ-আপদ; আইস, ঐ গাছের ডালে
উঠিয়া কোন রকমে রাতটা কাটাইয়া দিই।” রাজপুত্র বলিলেন,- “সেই ভাল।”
দুই জনে ঘোড়া বাঁধিয়া রাখিয়া, এক সরোবরের পাড়ে খুব উঁচু গাছের আগডালে উঠিয়া শুইয়া রহিলেন। অনেক রাত্রে রাজপুত্র মন্ত্রিপুত্র কি-জানি কিসের এক ভয়ঙ্কর শব্দ শুনিয়া জাগিয়া দেখেন, -বনময় আলো!- সেই আলোতে ওরে বাপরে বাপ্! রাজপুত্র মন্ত্রিপুত্রের গা-অঙ্গ ডোল হইল, গায়ে পায়ে কাঁটা দিল,- দেখেন, আকাশ পাতালে গলা ঠেকাইয়া এক কাল্-অজগর তাঁহাদের ঘোড়া দুইটাকে আস্ত আস্ত গিলিয়া খাইতেছে! অজগরের মুখে ঘোড়া ছটফট করিতেছে!
দেখিতে-দেখিতে ঘোড়া দুইটাকে গিলিয়া, যতদূর আলোকে দেখা যায়, অজগর, বনের পোকা-মাকড় খাইতে খাইতে ততদূর বেড়াইতে লাগিল। রাজপুত্র থর্ থর্ কাঁপেন! মন্ত্রিপুত্র চুপি-চুপি বলিলেন,-“বন্ধু। ডরাইও না, ওই যে আলো, ওটি সাত-রাজার ধন ফণীর মণি,-মণিটি নিতে হইবে।”
রাজপুত্র বলিলেন,- “সর্বনাশ! কেমন করিয়া নিবে?” “ভয় নাই, দেখ, আমি মণি আনিব।”
বলিয়া, মন্ত্রিপুত্র, আস্তে আস্তে নামিয়া আসিয়াই এক খাবল কাদা আনিয়া মণির উপর ফেলিয়া দিলেন। দিয়াই আপনার তরোয়ালখানি কাদার উপর উল্টাইয়া রাখিয়া, সর্সর্ করিয়া গাছে উঠিয়া গেলেন! সব অন্ধকার;-দুই জনে চুপ!
অজগর তার মণি! -সেই মণির আলো নিভিয়াছে; অজগর, হোঁস্ হোঁস্ শোঁস্ শোঁস্ শব্দে ছুটিয়া আসিল; দেখে, মণি নাই! অজগর তরোয়ালের উপর ফটাফট ছোবল মারিতে লাগিল। কাদার তলে মণি নিখোঁজ –তরোয়ালের ধারে অজগরের ফণায় রক্তের বান। চোখে আগুনের হলক, মুখে বিষের ঝলক, অজগর পাগল হইয়া গেল।
কাল্-অজগর পাগল হইয়াছে, -সারা বনের গাছ মুড়্মুড়্ করিয়া ভাঙ্গে, লেজের বাড়িতে সরোবরের জল শতখান হইয়া যায়। অবশেষে রাগে,দুঃখে, অজগর নিজের শরীর নিজে কামড়াইয়া তরোয়ালে মাথা খুঁড়িয়া মরিয়া গেল।
থর্ থর্ করিয়া দুই বন্ধুর রাত পোহাইল পরদিন রোদ উঠিলে, দুইজনে বেশ করিয়া দেখিলেন, যে, না-অজগর সত্যিই মরিয়াছে। তখন নামিয়া কাদামাখা মণি কুড়াইয়া দুই বন্ধু সরোবরে নামিলেন।
২
নামিতে নামিতে, দুই বন্ধু যতদূর যান, -জল কেবল দুই ভাগ হইয়া শুকাইয়া যায়! শেষে, মণির আলোতে দেখেন, পাতালপুরী পর্যন্ত এক পথ! দুইজনে চলিতে লাগিলেন।
খানিক দূর যাইতেই এক পরম সুন্দর অট্টালিকা। চারিদিকে ফুল-বাগান, ফুলে ফুলে ছড়াছড়ি, লতায় লতায়, পাতায় পাতায় জড়াজড়ি। দুই বন্ধু অট্টালিকার মধ্যে গেলেন। অট্টালিকার মধ্যে সোঁ সোঁ রোঁ রোঁ শব্দ। রাজপুত্র ভয়ে কাঁপিতে লাগিলেন। মন্ত্রিপুত্র বলিলেন,- “বন্ধু, ডরাইও না, মণি কাছে থাকিতে ভয় নাই।’
লক্লকে’ চক্চকে’ কোটি রঙ্গের কোটি সাপ ডিঙ্গাইয়া, সাপের উপর দিয়া হাঁটিয়া দুইজনে এক ঘরে গেলেন! সেখানে সাপের দেওয়াল, সাপের থাম, সাপের মেজে, সাপের পড়ি, সাপের মণির দেওয়ালগিরি, -লক্ষ সাপের শয্যায় মণিমালা রাজকন্যা নিশ্চিন্তে ঘুমাইতেছেন।
রাজপুত্র বলিলেন,-“বন্ধু, এ –কি!”
মন্ত্রিপুত্র বলিলেন,-“বন্ধু, দেখ, পাতালপুরীর পাতালকন্যা।”
আশ্চর্য হইয়া,- রাজপুত্র দেখিতে লাগিলেন।
ধীরে ধীরে মন্ত্রিপুত্র মণিটি নিয়া মণিমালার কপালে ছোঁয়াইতেই মণিমালা জাগিয়া উঠিয়া বসিলেন। রাজপুত্র মন্ত্রিপুত্রকে দেখিয়া এস্তে ব্যস্তে মণিমালা বলিলেন, -“আপনারা কে? এ যে কাল্-অজগরের পুরী, আপনারা কেমন করিয়া এখানে আসিলেন!”
মন্ত্রিপুত্র কহিলেন,- “রাজকন্যা, ভয় নাই; কাল্-অজগরকে আমরা মারিয়া ফেলিয়াছি। এই রাজপুত্র তোমার বর।” রাজপুত্র মণিমালা দুইজনে, মাথা নীচু করিলেন। হাসিয়া মন্ত্রিপুত্র মণিমালার গলার মালা রাজপুত্রের গলায় দিলেন, রাজপুত্রের গলার মালা মণিমালার গলায় দিলেন। চারিদিকে লক্ষ সাপের ফণা হেলিয়া দুলিয়া উঠিল।
৩
সাপের পুরীতে পরম সুখে দিন যায়। কতক দিন পর, মন্ত্রিপুত্র বলিলেন.-“বন্ধু, আমরা তো এখানে সুখেই আছি, দেশে কি হইল কে বরণ করিয়া দেশে লইয়া যাইব।” রাজপুত্র বলিলেন,-“আচ্ছা।”
আবার সরোবরের পথে মণি দেখা দিল, মন্ত্রিপুত্র দেশে গেলেন। বন্ধুকে বিদায় দিয়া, মণি লইয়া রাজপুত্র ফিরিয়া আসিলেন। দু’জনে আছেন। রাজপুত্র পৃথিবীর কত কথা মণিমালাকে বলেন, মণিমালা পাতালের যত কথা রাজপুত্রের কাছে বলেন। বলিতে বলিতে, একদিন মণিমালা বলিলেন, “জন্মে কখনো পৃথিবী দেখিলাম না, দেখিতে বড় সাধ যায়।” রাজপুত্র কিছু বলিলেন না।
দুপুরে রাজপুত্র শুইয়া আছেন। রাজপুত্রকে ঘুমে দেখিয়া মণিমালা ক্ষার খৈল গামছা নিয়া মণিটি হাতে সরোবরের পথে পৃথিবীতে উঠিলেন।–“আহা! কি সুন্দর!” পৃথিবী দেখিয়া মণিমালা অবাক। মণিমালা বলিলেন, “মণি. মণি! উজ্লে’ ওঠ্ এই সরোবরের জলে আমি নাইব।”
অমনি মণির আলো উজ্লে’ উঠিল, সরোবরের মাঝখানে রাজহাঁসের থাক, শ্বেতপাথরের ধাপ, ধবধবে’ সুন্দর ঘাটলা হইল। মণিমালা ধাপের উপর মণি রাখিয়া, ক্ষার খৈল দিয়া গা-পা কচলাইতে লাগিলেন।
সেই সময় সেই দেশের রাজপুত্র সেই বনে শিকার করিতে আসিয়াছেন। তিনি সব দেখিলেন।
দেখিয়াই রাজপুত্র ছুটিয়া আসিয়া জলে ঝাঁপ দিয়া পড়িলেন।
চমকিয়া মণিমালা দেখেন,
-মানুষ! মণি লইয়া মণিমালা ডুব দিলেন। চক্ষের পলকে সব কোথায়
গেল!- রাজপুত্র “হায় হায়” করিতে করিতে ফিরিয়া গেলেন।
কাঠকুমারী পেঁচার মা এক বুড়ী এই সব দেখিয়া। দেখিয়া বুড়ী চুপটি করিয়া রহিল।
৪
শিকারে গিয়া রাজপুত্র পাগল হইয়া আসিয়াছেন; কত ওষুধ বিষুধ, কিছুতেই রোগ সারে না; রাজা রাণী অধীর, রাজ্যের লোক অস্থির। অবশেষে রাজা ঢেঁটরা দিলেন,-“রাজপুত্রকে যে ভাল করিতে পারিবে, অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা তাকে দিব” কে ঢেঁটরা ছুঁইবে? কেহই ছুঁইল না। শেষে পেঁচোর মা বুড়ী এই কথা শুনিল। শুনিয়া বুড়ী উঠে কি পড়ে আছাড়ি বিছাড়ি সাত তাড়াতাড়ি আসিয়া ঢেঁটরা ধরিল।
রাজার কাছে গিয়া বুড়ী বলিল,-“তা রাজামশাই, আমি তো ওষুধ জানি,-তা আমি বুড়ো হাবড়া মেয়েমানুষ, তা আমার পেঁচোর সঙ্গে যদি রাজকন্যার বিয়ে দাও, তো রাজপুত্রকে ওষুধ দি।”
রাজা তাহাই
স্বীকার করিলেন।
তখন পেঁচোর মা বুড়ী একরাশ তুলা, এক চরকা নিয়া পবনের নায়ে উঠিয়া বলিল,-
ঘ্যাঁঘর্ চরকা ঘ্যাঁঘর্,
রাজপুত্র পাগল!
হটর্ হটর্
পবনের না’,
মণিমালার দেশে
যা।”
পবনের না’ মণিমালার দেশে গেল। বুড়ী সরোবরের কিনারে বসিয়া ঘ্যাঁঘর্ ঘ্যাঁঘর্ করিয়া
চরকায় সূতা কাটিতে লাগিল।
আবার দুপুরে রাজপুত্র শুইয়াছেন; মণিমালা মণি নিয়া উঠিয়া আসিলেন,- “ও বুড়ী, বুড়ী,
তুই কোথা’ থেকে’ এলি? আমাকে একখানা শাড়ী বুনিয়া দে।”
বুড়ী শাড়ী বুনিয়া দিয়া কড়ি চাহিল! মণিমালা বলিলেন,-“বুড়ী, কড়ি তো নাই, এই এক মণি
আছে!”
বুড়ী বলিল-“তা, তা-তাই দাও।”
মণিমালা মণি দিতে গেলেন, বুড়ী খপ্ করিয়া মণিমালাকে পবনের নৌকায় উঠাইয়া বলিল,-
“ঘ্যাঁঘর্ চরকা
ঘ্যাঁঘর্,
রাজপুত্র পাগল!
হটর্ হটর্
পবনের না’,
রাজপুত্রের কাছে যা।”
আর কী? বুড়ী মণিমালাকে রাজপুরীতে দিয়া, মণিটি লুকাইয়া নিয়া বাড়ীতে গেল।
রাজপুত্র ভাল হইলেন! মণিমালার সঙ্গে তাঁহার বিয়ে! পেঁচোর সঙ্গে রাজকন্যার বিবাহ
হইবে কি না? সাত বচ্ছর নিখোঁজ পেঁচোর জন্য বুড়ী দেশে দেশে লোক পাঠাইল।
মণিমালা বলিলেন,- “আমার এক বৎসর ব্রত, এক বৎসর পরে যা’ হয় হইবে।”
সকলে বলিলেন,- “আচ্ছা।”
সকলে বলিলেন,- “আচ্ছা।”
মণি গেল, মণিমালা গেল, সাপের নিশাস গরল, সাপের পরশ হিম, আজ রাজপুত্র ঘুমে ঢুলু
ঢুলু। ঢুলিয়া রাজপুত্র সাপের শয্যায় ঘুরিয়া পড়িলেন। শিয়রের সাপ ফণা তুলিয়া গর্জিয়া
উঠিল, আশের সাপ পাশের সাপ, গা-মোড়া দিয়া উঠিয়া রাজপুত্রকে আষ্টে-পিষ্ঠে জড়াইয়া
ধরিল। নাগপাশের বাঁধনে রাজপুত্র সাপের শয্যায় বিষের ঘোরে অচেতন হইয়া রহিলেন।
৫
দোলা চৌদোলা পঞ্চকটক নিয়া সরোবরের পাড়ে আসিয়া মন্ত্রিপুত্র ডাকেন,- “বন্ধু! বন্ধু!
পথ দেখাও।”
না, সাড়া শব্দ কিছুই নাই! দিনের পর দিন গেল, রাত্রির পর রাত্রি গেল, বন্ধু আর সাড়া
দিল না। তখন মন্ত্রিপুত্র ভাবিত হইয়া পঞ্চকটক বনে রাখিয়া, বাহির হইলেন।
খানিক দূর গেলে, পথের লোকেরা বলিল,-“কে-গো তুমি কা’র বাছা, পেঁচোকে দেখিয়াছ? পেঁচো
রাজার জামাই হইবে, পেঁচোর মা বুড়ী পেঁচোর খোঁজে পথে পথে ঘুরে।”
মন্ত্রিপুত্র বলিলেন,-“হাঁ, হাঁ, আমি পেঁচোকে দেখিয়াছি; তা সে রাজত্ব রাজকন্যা পাইল
কেন?”
লোকেরা সকল কথা বলিল।
মন্ত্রিপুত্র বলিল,- “বেশ্ বেশ্! তা, পেঁচোর রূপটি,-রূপটি যেন কেমন?” লোকেরা
পেঁচোর রূপের কথা বলিল।
শুনিয়া মন্ত্রিপুত্র চলিয়া আসিলেন।
পরদিন মন্ত্রিপুত্র করিলেন কি, পোশাক-টোশাক ছাড়িয়া, গালে মুখে কালি, গায়ে পায়ে
ছেঁড়া কানি, বুড়ীর বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত। খক্ খক্ কাশি, খিল্ খিল্ হাসি, দুই
হাতে দুই গাছের ডাল- পেঁচোর নাচে উঠান কাঁপে।
আথিবিথি বুড়ী ছুটিয়া আসিল,- “এই তো আমার বাছা!-আহা আহা বুকের মাণিক, কোথায় ছিলি ঘরে
এলি?- আয় আয়, তোর জন্যে –
রাজ-রাজিত্বি
দুধের বাটী,
রাজকন্যা
পরিপাটি
সোনার
দানা মোহর থান-
সাতরাজার ধন মণি খান-
-তোরি জন্যে রেখেছি!”
আহ্লাদে আটখানা বুড়ী গুড়ুসুড়ু মাণিটি বাহির করিয়া চুপি চুপি পেঁচোর হাতে দিল।
মণি
পাইয়া পেঁচো তো তিন লাফে, ঘর!- “মা, মা, আমি তো ভাল হইয়াছি!- এই দেখ কেমন আমার নূপ,
-নূপের গাঙ্গে নূপ ভেস্যে যায়।” বুড়ী বলিল,- “আহা আহা বাছা আমার! এত রূপ নিয়ে কোথায়
ছিলি,- রাজকন্যা তোর জন্য কাঁদিয়া পাগল!
পরদিন বুড়ী আউল চুলের ঝুঁটি বাঁধিয়া, নড়ি ঠক্ঠক্, রাজার কাছে গেল,- “তা, তা, রাজা
মশাই, রাজা মশাই, রাজকন্যা বাহির কর- পেঁচো আমার আসিয়াছেন। আহা আহা, পেঁচোর আমার যে
রূপ,-রূপ নয় তো নূপ,-নূপের গাঙ্গে নূপ ভেস্যে যায়।” রাজা কি করেন, পেঁচোর সঙ্গে
রাজকন্যার বিবাহ দিলেন।
৬
বাসর ঘরে মন্ত্রিপুত্র পেঁচো রাজকন্যাকে সব কথা বলিলেন। শুনিয়া রাজকন্যা নিঃশ্বাস
ছাড়িয়া বাঁচিলেন; বলিলেন,- “আমার ভাই মণিমালাকে আটক করিয়া রাখিয়াছেন।”
তখন মন্ত্রিপুত্র চুপি চুপি বলিলেন,- “আমি যা’ যা’ বলি মণিমালাকে চুপি চুপি এই সব
কথা বলিও, আর এই জিনিসটি মণিমালার হাতে দিও।” বলিয়া মন্ত্রিপুত্র ফণীর মণিটি
রাজকন্যার কাছে দিলেন। এক দিন, দুই দিন, তিন দিন গেল। চা’র দিনের দিনে, রাত
পোহাইলে, মণিমালা বলিলেন,- “রাজপুত্র, আমার ব্রত শেষ হইয়াছে, আমি আজ বরণ-সাজে
সাজিয়া নদীর জলে স্নান করিব। আমার সঙ্গে বাদ্য-ভাণ্ডু দিও না, জন-জৌলুষ দিও না;
কেবল এক পেঁচো আর রাজকন্যা যাইবেন।”
অমনি রাজপুরী হইতে নদীর ঘাটে চাঁদোয়া পড়িল। মণিমালা, পেঁচোকে আর রাজকন্যাকে নিয়া
বরণ-সাজে স্নান করিতে গেলেন। স্নান না স্নান!- জলে নামিয়াই মণিমালা বলিলেন,-
“মণি আমার, আমায়
ভূলে’ কোথায় ছিলি?”
“বুড়ীর থলে।”
কোথায় এসে আবার মণি আমায় পেলি?”
“পেঁচোর গলে।”
মণিমালা বলিলেন,-
“আজ তবে চল্
মণি, অগাধ জলে!”
দেখিতে-না-দেখিতে নদীর জল দু’ফাঁক হইল, পেঁচো আর রাজকন্যাকে নিয়া মণিমালা তাহার
মধ্যে অদেখা হইয়া গেলেন।
রাজপুত্র করেন-“হায়!হায়!”
রাজা রাণী করেন-
“হায়! হায়!”
মাথা খুঁড়িয়া
বুড়ী মরিল,
রাজ্য
ভরিয়া কান্না উঠিল।
শিয়রের সাপ গুড়িসুড়ি, গায়ের সাপ ছাড়াছাড়ি,- রাজপুত্র চক্ষু মুছিয়া উঠিয়া বসিলেন।–
তখন, মণির আলো মণির বাতি, ঢাক ঢোলে হাজার কাটি, রাজপুত্র মন্ত্রিপুত্র, মণিমালা আর
রাজকন্যাকে লইয়া আপন দেশে চলিয়া গেলেন!
পাতালপুরীর সাপের রাজ্যের সকল সাপ বাতাস হইয়া উড়িয়া গেল।
সোনার কাটি
রূপার কাটি
১
এক
রাজপুত্র, এক মন্ত্রিপুত্র, এক সওদাগরের পুত্র আর এক কোটালের পুত্র-চার জনে খুব
ভাব।
কেহই কিছু করেন না, কেবল ঘোড়ায় চড়িয়া বেড়ান। দেখিয়া, শুনিয়া রাজা, মন্ত্রী,
সওদাগর, কোটাল, বিরক্ত হইয়া উঠিলেন; বলিয়া দিলেন,-“ছেলেরা খাইতে আসিলে ভাতের বদলে
ছাই দিও।”
মন্ত্রীর স্ত্রী, সওদাগরের স্ত্রী, কোটালের স্ত্রী কি করেন? চোখের জল চোখে রাখিয়া,
ছাই বাড়িয়া দিলেন। ছেলেরা অবাক হইয়া উঠিয়া গেল। হাজার হ’ক পেটের ছেলে; তা’র সামনে
কেমন করিয়া ছাই দিবেন? রাণী তাহা পারিলেন না। রাণী পরমান্ন সাজাইয়া, থালার এক কোণে
একটু ছাইয়ের গুঁড়া রাখিয়া ছেলেকে খাইতে দিলেন।
রাজপুত্র বলিলেন,-“মা, থালে ছাইয়ের গুঁড়া কেন?”
রাণী বলিলেন,-“ও কিছু নয় বাবা, অমনি পড়িয়াছে।”
রাজপুত্রের মন মানিল না; বলিলেন-“না, মা, না বলিলে আমি খাইব না।” রাণী কি করেন? সকল
কথা ছেলেকে খুলিয়া বলিলেন। শুনিয়া, রাজপুত্র মায়ের পায়ে প্রণাম করিয়া, উঠিলেন।
চার বন্ধুতে রোজ যেখানে আসিয়া মিলেন, সেইখানে আসিয়া সকলকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আজ কে
কেমন খাইয়াছ?
সকলেই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেন। তখন রাজপুত্র বলিলেন,-“ভাই, আর দেশে থাকিব না, চল দেশ
ছাড়িয়া যাই।”
“সেই ভাল!” চারিজনে চারি ঘোড়া ছুটাইয়া দিলেন।
২
ঘোড়া ছুটাইতে ছুটাইতে ছুটাইতে, চার বন্ধু এক তেপান্তরের মাঠের সীমায় আসিয়া পৌঁছিলেন। মাঠের উপর দিয়া চার দিকে চার পথ।
কে কোন দিকে যাইবেন? ঠিক হইল, -কোটালের দক্ষিণ, সওদাগরের উত্তর, মন্ত্রীর পশ্চিম আর রাজপুত্রের পূব। তখন সকলে মাথার পাগড়ীর কাপড় ছিঁড়িয়া চার পথের মাঝখানে চার নিশান উড়াইয়া দিলেন,- “যে-ই যখন ফিরুক অন্য বন্ধুদের জন্য এইখানে আসিয়া বসিয়া থাকিবে।” চার ঘোড়া চার পথে ছুটিল।
সারা দিনমান চার জনে ঘোড়া ছুটাইলেন, কেহই কোথাও গ্রাম, নগর, বন্দর, বাড়ী কিছুই দেখিলেন না; সন্ধ্যার পর আবার সকলেই কোন্ এক এক-ই জায়গায় আসিয়া উপস্থিত!
সে মস্ত বন! রাজপুত্র বলিলেন,- “দেখ, আমরা নিশ্চয় রাক্ষসের মায়ায় পড়িয়াছি; সাবধানে রাত জাগিতে হইবে! কিন্তু ক্ষুধায় শরীর অবশ, দেখ কিছু খাবার পাওয়া যায় কি-না” সকলে ঘোড়া বাঁধিয়া খাবার সন্ধানে গেলেন।
বনে একটিও ফল দেখা যায় না, কোনও জীবজন্তু দেখা যায় না, কেবল পাথর কাঁকর আর বড় বড় বট পাকুড় তাল শিমুলের গাছ!
হঠাৎ দেখেন, একটু দূরে এক হরিণের মাথা পড়িয়া রহিয়াছে। সকলের আনন্দের সীমা রহিল না; কোটালের পুত্র পাঠ কুড়াইতে গেলেন, সওদাগরের পুত্র জল আনিতে গেলেন, মন্ত্রিপুত্র আগুনের চেষ্টায় গেলেন, রাজপুত্র একটা গাছের শিকড়ে মাথা রাখিয়া গা ছাড়াইয়া শুইয়া পড়িলেন।
রাজপুত্র ঘুমে। কাঠ নিয়া আসিয়া কোটাল দেখেন, আর বন্ধুরা আসে নাই। কাঠ রাখিয়া কোটাল হরিণের মাথাটি কাটিতে গেলেন।
তরোয়াল ছোঁয়াইয়াছেন-আর অমনি হরিণের মাথার ভিতর হইতে এক বিকটমূর্তি রাক্ষসী বাহির হইয়া কোটাল আর কোটালের ঘোড়াটিকে খাইয়া, আবার যেমন হরিণের মাথা তেমনি হরিণের মাথা হইয়া পড়িয়া রহিল।
জল আনিয়া সওদাগর দেখেন, কাঠ রাখিয়া কোটাল-বন্ধু কোথায় গিয়াছে। সওদাগর হরিণের মাথা
কাটিতে গেলেন। সওদাগর, সওদাগরের ঘোড়া রাক্ষসীর পেটে গেল।
মন্ত্রি আসিয়া দেখেন, জল আসিয়াছে, কাঠ আসিয়াছে, বন্ধুরা কোথায়? “আচ্ছা, মাংসটা
বানাইয়া রাখি।”
“বাঁচাও বাঁচাও!- বন্ধু, কোথায় তোমরা
-জন্মের মত গেলাম!”
মন্ত্রিপুত্রের চীৎকারে রাজপুত্র ধড়্মড়্ করিয়া উঠিয়া বসিলেন। দেখেন, -কি
সর্বনাশ,-রাক্ষসী !!! রাক্ষসী মন্ত্রিপুত্র আর মন্ত্রিপুত্রের ঘোড়া খাইয়া
রাজপুত্রের ঘোড়াকে ধরিল। তরোয়াল খুলিয়া রাজপুত্র দাঁড়াইলেন; রাজপুত্রের পক্ষিরাজ
চেঁচাইয়া বলিল,- “রাজপুত্র, পলাও, পলাও, আর রক্ষা নাই!!” রাজপুত্র বলিলেন,- “পলাইব
না- বন্ধুদের খাইয়াছে, রাক্ষসী মারিব!” রাজপুত্র তরোয়াল উঠাইলেন,- চোখ আঁধার, হাত
অবশ। রাক্ষসী আসিয়া,- “রাজপুত্র, পলাও, পলাও!” তখন রাজপুত্র, দিশা হারাইয়া, যে দিকে
চক্ষু যায়, দৌড়াইতে লাগিলেন।
রাজপুত্র এক রাজার রাজ্য ছাড়িয়া আর এক রাজার রাজ্যে,-তবু রাক্ষসী পিছন ছাড়ে না। তখন নিরুপায় হইয়া রাজপুত্র সামনে এক আমগাছ দেখিয়া বলিলেন,-“হে আমগাছ! যদি তুমি সত্যকালের বৃক্ষ হও, রাক্ষসীর হাত হইতে আমাকে রক্ষা কর।” আমগাছ দু’ফাঁক হইয়া গেল, রাজপুত্র তাহার মধ্যে গিয়া হাঁফ ছাড়িলেন।
রাক্ষসী গাছকে কত অনুনয় বিনয় করিল, কত ভয় দেখাইল, গাছ কিছুই শুনিল না। তখন রাক্ষসী
এক রূপসী মূর্তি ধরিয়া সেই গাছের তলায় বসিয়া কাঁদিতে লাগিল। সেই দেশের রাজা, বনে
শিকার করিতে আসিয়াছেন। কান্না শুনিয়া রাজা বলিলেন,- “দেখ তো, বনের মধ্যে কে কাঁদে?”
লোকজন আসিয়া দেখে, আমগাছের নীচে এক পরমা সুন্দরী মেয়ে।*
মেয়েটিকে রাজা রাজপুরীতে নিয়া গেলেন।
৩
রাজা সেই বনের মেয়েকে বিবাহ করিলেন। রাণী হইয়া রাক্ষসী ভাবিল,-“সেই রাজপুত্রকে কেমন করিয়া খাই!” ভাবিয়া রাক্ষসী, সাত বাসি পান্তা, চৌদ্দ বাসি তেঁতুলের অম্বল খাইয়া অসুখ বানাইয়া বসিল। তাহার পর রাক্ষসী বিছানার নীচে শোলাকাটি পাতিল। পাতিয়া সেই বিছানায় শুইয়া রঙ্গীমুখ ভঙ্গী করিয়া চোখের তারা কপালে তুলিয়া, একবার ফিরে এ-পাশ, একবার ফিরে ও-পাশ।
রাজা আসিয়া দেখেন, রাণী খান না, দান না, শুক্ন ঘরে জল ঢালিয়া চাঁচর চুলে আঁচড় কাটিয়া, রাণী শুইয়া আছেন। দেখিয়া রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন,- “এ কি রাণী! কি হইয়াছে?”
কথা কি ফোটে? ‘কোঁকাইয়া কোঁকইয়া’ কত কষ্টে রাণী বলিল,- “আমার হাড়মুড়্মুড়ীর ব্যারাম হইয়াছে।” রাণীর গড়াগড়িতে বিছানার নীচের শোলাকাটিগুলা মুড়্ মুড়্ করিয়া ভাঙ্গিতেছিল কি-না? রাজা ভাবিলেন,- “তাই তো? রাণীর গায়ের হাড়গুলা মুড়্ মুড়্ করিতেছে!-হায় কি হইবে!”
কত ওষুধ, কত চিকিৎসা; রাণীর কি যে-সে অসুখ? অসুখ সারিল না! শেষে রাণী বলিল,- “ওষুধে তো কিছু হইবে না, বনের সেই আমগাছ কাটিয়া তাহার তক্তার ধোঁয়া ঘরে দিলে তবে আমার ব্যারাম সারিবে।”
রাজাজ্ঞা, অমনি হাজার হাজার ছুতোর গিয়া আমগাছকে কুড়ুল মারিল! গাছের ভিতরে রাজপুত্র বলিলেন,- “হে বৃক্ষ, যদি সত্যকালের বৃক্ষ হও, তো আমাকে একটি আমের মধ্যে করিয়া ঐ পুকুরের জলে ফেলিয়া দাও।” অমনি গাছ হইতে একটি আম টুব্ করিয়া পুকুরের জলে পড়িল; তখনি এক রাঘব বোয়াল সেটিকে খাবার মনে করিয়া এক হাঁয়ে গিলিয়া ফেলিল।
ছুতোরেরা আমগাছটি কাটিয়া লইয়া গিয়া তাহার তক্তা করিয়া রাণীর ঘরের চারিদিকে খুব করিয়া ধোঁয়া দিতেছে! কিন্তু রাণী সব জানিতে পারিল; বলিল,- “নাঃ, এতেও কিছু হইল না। সে পুকুরে যে রাঘব বোয়াল আছে, তাহার পেটে একটি আম, সেই আমটি খাইলে আমার অসুখ সারিবে।”
সিঙ্গী জাল, ধিঙ্গী জাল, সব জাল নিয়া জেলেরা পুকুরে ফেলিল; রাঘব বোয়াল ধরা পড়িল। পেটের ভিতর আম, আমের ভিতর রাজপুত্র বলিলেন,-“হে বোয়াল, যদি তুমি সত্যিকারের বোয়াল হও, তো আমাকে একটি শামুক করিয়া ফেলিয়া দাও।” বোয়াল রাজপুত্রকে শামুক করিয়া ফেলিয়া দিল। জেলেরা বোয়াল আনিয়া পেট চিরিয়া কিছুই পাইল না। রাজা ভাবিলেন,- “আর রাণীর অসুখ সারিল না!”
৪
এক গৃহস্থের বৌ নাইতে গিয়াছে, রাজপুত্র শামুক তাহার পায়ে ঠেকিল। গৃহস্থের বৌ
শামুকটি তুলিয়া আছাড় দিয়া ভাঙ্গিতেই ভিতর হইতে রাজপুত্র বাহির হইল। গৃহস্থের বৌ ভয়ে
জড়সড়। রাজপুত্র বলিলেন,- “বৌ, ভয় করিও না, আমি মানুষ,- রাক্ষসের ভয়ে শামুকের মধ্যে
রহিয়াছি। তুমি আমার প্রাণ দিয়াছ, আজ হইতে তুমি আমার হাসন সখী।”
রাজপুত্র হাসন সখীর বাড়ীতে আছেন।
রাণী সব জানিল; রাজাকে বলিল,- “আমার অসুখ তো আর কিছুতেই সারিবে না, আমার বাপের দেশে
হাসন চাঁপা নাটন কাটি, চিরণ দাঁতের চিকন পাটি, আর বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি
আছে, সেইগুলি আনাইলে আমার অসুখ সারিবে।”
“কে আনিবে, কে আনিবে?”
“অমুক গৃহস্থের বাড়ী এক রাজপুত্র আছে, সে-ই আনিবে।”
অমনি হাজার হাজার পাইক ছুটিল।
চারিদিকে রাজার পাইক; হাসন সখী ভয়ে অস্থির। রাজপুত্র বলিলেন,- “হাসন সখী আমারি জন্যে তোমাদের বিপদ, আমি দেশ ছাড়িয়া যাই।”
বাহির হইতেই, পাইকেরা- রাজপুত্রকে ধরিয়া লইয়া গেল! রাজার কাছে যাইতে রাজপুত্র বলিলেন,-“মহারাজ! রাণী আপনার রাক্ষসী;-রাক্ষসীর হাত হইতে আমাকে বাঁচান।”
শুনিয়া রাজা বলিলেন,-“মিথ্যা কথা।–তাহা হইবে না, রাণীর বাপের দেশে হাসন চাঁপা নাটন কাটি, চিরণ দাঁতের চিকণ পাটি, আর বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি আছে, সেই সব তোমাকে আনিতে হইবে।” রাজা এক পত্র দিয়া রাজপুত্রকে পাঠাইয়া দিলেন।
৫
কি করিবেন, রাজপুত্র চলিতে লাগিলেন। কোথায় সে হাসন চাঁপা নাটন কাটি, কোথায় বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচি- কোথায় সে রাণীর বাপের দেশ?-রাজপুত্র ভাবিলেন-“হায়! রাক্ষসীর হাত হইতে কিসে এড়াই!” রাজপুত্র, যেদিকে চক্ষু যায় চলিতে লাগিলেন।
কত দিন কত রাত চলিতে চলিতে, এক জায়গায় আসিয়া রাজপুত্র দেখেন, এক মস্ত পুরী। রাজপুত্র বলিলেন,-“আহা! এতদিনে আশ্রয় পাইলাম।”
পুরীর মধ্যে দিয়া মানুষ জন কিছু দেখিতে পান না,-খুঁজিতে খুঁজিতে এক ঘরে দেখেন, সোনার খাটে গা রূপার খাটে পা এক রাজকন্যা শুইয়া আছেন। রাজপুত্র ডাকাডাকি করিলেন,- রাজকন্যা উঠিলেন না! তখন রাজপুত্র দেখেন, বিছানার দুইদিকে দুইটি কাটি- শিয়রের কাটিটি রূপার, পায়ের দিকের কাটিটি সোনার। রাজপুত্র শিয়রের কাটি পায়ের দিকে নিলেন, পায়ের দিকের কাটি শিয়রে নিলেন! রাজকন্যা উঠিয়া বসিলেন।–“কে আপনি!- দেব না দৈত্য, দানব না মানব,-এখানে কেমন করিয়া আসিলেন?- পলাইয়া যান,-পলাইয়া যান,-এ রাক্ষসের পুরী।”
রাজপুত্রের প্রাণ শুকাইয়া গেল।–“এক রাক্ষসের হাত হইতে আসিলাম, এখানেও রাক্ষস!-
রাজকন্যা, আমি কোথায় যাই?”
রাজকন্যা বলিলেন,-“আচ্ছা, আপনি কে আগে বলুন।”
রাজপুত্র সকল কথা বলিলেন, তারপর বলিলেন-“আমি তো সেই রাক্ষসী রাণীর হাত আজও এড়াইতে
পারিলাম না, তা এ রাক্ষসের পুরীতে এমন এক রাজকন্যা কেন?”
রাজকন্যা বলিলেন,-“এই পুরী আমার বাপের; রাক্ষসেরা আমার বাপ-মা রাজ-রাজত্ব খাইয়াছে,
কেবল আমাকে রাখিয়াছে। যদি আমি পলাইয়া যাই সেই জন্য বাহিরে যাইবার সময় রাক্ষসেরা
সোনার কাটি রূপার কাটি দিয়া আমাকে মারিয়া রাখিয়া যায়।” শুনিয়া রাজপুত্র ভাবিতে
লাগিলেন, কি করিয়া দুইজনে রাক্ষসের হাত হইতে এড়াইবেন।
“আঁই লোঁ মাঁই লোঁ, মাঁনুষের গঁন্ধ পাঁই লোঁ।
ধঁরে ধঁরে খাঁই লো!-”
সেই সময় চারিদিক হইতে রাক্ষসেরা শব্দ করিয়া আসিতে লাগিল। রাজকন্যা
বলিলেন,-“রাজপুত্র, রাজপুত্র-শীগ্গির আমাকে মারিয়া ঐ যে শিব-মন্দির আছে, ওরি মাঝে
ফুল-বেলপাতার নীচে গিয়া লুকাইয়া থাকুন।”
“আঁই লোঁ মাঁই লোঁ’ করিয়া রাক্ষসেরা আসিল। বুড়ী রাক্ষসী রাজকন্যাকে বাঁচাইয়া,
বলিল;-
“নাঁত্নি লোঁ নাঁত্নি! মাঁনুষ মাঁনুষ গঁন্ধ কঁয়-
মাঁনুষ আঁবার কোঁথায় রঁয়?”
রাজকন্যা বলিলেন,-“মানুষ আবার-থাকিবে কোথায়; আমিই আছি, আমাকে খাইয়া ফেল।”
বুড়ী বলিল,- “উঁ হু হুঁ নাঁত্নি লোঁ, তাঁ’ কিঁ পাঁরি!-এঁই নে নাঁত্নি তোঁর জঁন্যে
কঁত খাঁবার এঁনেচি।” নাত্নিকে খাওয়াইয়া দাওয়াইয়া, বুড়ী আর সকল রাক্ষস, নাকে কানে
হাঁড়ি হাঁড়ি সরষের তৈল ঢালিয়া নাক ডাকাইয়া ঘুমাইয়া পড়িল। রাজকন্যা, আয়ীর মাথার পাকা
চুল তোলেন আর ডেলা ডেলা এক এক উকুন দুই পাথরের চাপ দিয়া কটাস্ কটাস্ করিয়া মারেন।
রাজকন্যার রাত এই ভাবে যায়।
পরদিন আবার রাজকন্যাকে মারিয়া রাখিয়া রাক্ষসেরা চলিয়া গেল। রাজপুত্র বাহির হইয়া
আসিয়া রাজকন্যাকে জীয়াইলেন, দুইজনে স্নান খাওয়া দাওয়া করিলেন। রাজপুত্র
বলিলেন,-“রাজকন্যা, এ ভাবে কতদিন থাকিব? আজ যখন বুড়ী আসিবে, তখন দুই কথা ছল ভাণ
করিয়া, ওদের মরণ কিসে আছে, তাই জিজ্ঞাসা করিও।”
আবার রাক্ষসেরা আসিলে, রাজপুত্র শিবমন্দিরে গিয়া লুকাইলেন। রাজকন্যাকে
খাওয়াইয়া-দাওয়াইয়া বুড়ী খাটের উপর বসিল।–রাজকন্যা বলিলেন,-“আয়ি, লো আয়ি, কত রাজ্য
ঘুরিয়া হাঁপাইয়া হুঁপাইয়া আইলি, আয় একটু বাতাস করি, পাকা চুল দু’গাছ তুলিয়া দি!”
“ওঁ মাঁ লোঁ মাঁ লঁক্ষ্মি!” বুড়ী হাসিয়া চোখ দুইটা কপালে তুলিয়া বলিল,- “হ্যাঁ লোঁ
হ্যাঁ নাঁত্নি, পাঁ-টা তোঁ কঁট্ কঁট্হ কঁচ্ছে। এঁকটু টিঁপিয়া দিঁবি?”
“তা আর দিব না আয়ীমা?” হাঁড়ি ভরা সরষের তৈল আয়ীর পায়ের ফাটলে দিয়া, রাজকন্যা আয়ীর
পা টিপিতে বসিলেন।
পা টিপিতে বসিয়া রাজকন্যা চোখে তেল দিয়া কাঁদেন,- এক ফোঁটা চোখের জল বুড়ীর পায়ে
পড়িল। চমকিয়া উঠিয়া জলফোঁটা আঙ্গুলের আগায় করিয়া নিয়া জিভে দিয়া লোণা লাগিল, বুড়ী
বলিল,- “নাঁত্নি তুঁই কাঁদছিঁস্-কেঁন লোঁ, কেঁন লোঁ? তোঁর আঁবার দুঁঃখু কিঁসের?”
রাজকন্যা বলিলেন,- “কাঁদি আয়ীমা, কবে বা তুই মরিয়া যাইবি, আর সকল রাক্ষসে আমাকে
খাইয়া ফেলিবে।”
কুলার মত কান নাড়িয়া মূলার মত দাঁত বাহির করিয়া হাসিয়া আয়ী বলিল,- “ওঁরে আঁমার
সোঁনার নাঁত্নী, মোঁদের কিঁ মঁরণ আঁছে যেঁ মঁরিব? এ পিঁত্থিমির মোঁদের কিঁচ্ছুতে
মঁরণ নাঁই!- কেঁবল ঐ পুঁকুরে যেঁ ফঁটিকস্তঁম্ভ আঁছে, তাঁর মঁধ্যে এঁক সাঁতফণা সাঁপ
আঁছে; এঁক নিঁঃশ্বাসে উঁঠিয়া ঐ সোঁনার তাঁলগাঁছের তাঁলপত্র খাঁড়া পাঁড়িয়া যঁদি কোঁন
রাঁজপুত্র ফঁটিকস্তঁম্ভ ভাঁঙ্গিয়া সাঁপ বাঁহির কঁরিয়া বুঁকের উঁপর রাঁখিয়া কাঁটিতে
পাঁরে, তঁবেই, তঁবেই মোঁদের মঁরণ।– তাঁ মাঁটিতে যঁদি এঁক ফোঁটা রঁক্ত পঁড়ে, তোঁ এঁক
এঁক ফোঁটায় সাঁত সাঁত হাঁজার কঁরিয়া রাঁক্ষস জঁন্ম নিঁবে!”
শুনিয়া রাজকন্যা বলিলেন,-“তবে আর কী আয়ীমা! তা, কেউ পারিবে না, তোরাও মরিবি না;-
আমারও আর ভাবনা নাই। আচ্ছা আয়ীমা! অমুক দেশের রাজার রাণী যে রাক্ষসী তা’র আয়ু কিসে
আয়ীমা? আর হাসন চাঁপা নাটন কাটি চিরণ দাঁতের চিরণ পাটি, বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত
বিচি কোথায় পাওয়া যায় আয়ীমা?”
আয়ী বলিল, “আছে লোঁ নাঁত্নি আঁছে! যেঁ ঘঁরে তোঁর বাঁপ থাঁকত সেঁই ঘঁরে আঁছে, আঁর
সেঁ ঘঁরে যেঁ এঁক শুঁক, তাঁরি মঁধ্যে আঁমার মেঁয়ে সেঁই রাঁণীর প্রাঁণ! কাঁউকে যেঁন
কঁস্ নেঁ নাঁত্নি, সঁব তোঁ আঁমি তোঁকেই দোঁবো।”
পরদিন বুড়ী সকল রাক্ষস নিয়া বাহির হইল; বলিয়া গেল,- “নাঁত্নি লোঁ, আঁজ আঁমরা এঁই
কাঁছেই থাঁকিব।” যে দিন, রাক্ষসেরা দূরের কথা বলে, সে দিন কাছে কাছে থাকে, যে দিন
কাছের কথা বলে, সে দিন খুব দূরে দূরে যায়। রাক্ষসেরা চলিয়া গেলে রাজপুত্র আসিয়া
রাজকন্যাকে বাঁচাইয়া সকল কথা শুনিলেন। তখনি, স্নান-টান করিয়া, কাপড়চোপড় ছাড়িয়া
শিবমন্দিরে ফুল –বেলপাতা অঞ্জলি দিয়া, রাজপুত্র নিশ্বাস বন্ধ করিয়া তালগাছে উঠিয়া
তালপত্র খাঁড়া পড়িলেন। তারপর পুকুরে নামিয়া স্ফটিকস্তম্ভ ভাঙ্গিয়া দেখেন, সাতফণা
সাপ। রাজপুত্র সাপ নিয়া উপরে আসিলেন। পৃথিবীর সকল রাক্ষসের মাথা টন্টন্ করিয়া
উঠিল;- যে যেখানে ছিল রাক্ষসেরা ছুটিয়া আসিতে লাগিল।– আলুথালু চুল, এ-ই লম্বা লম্বা
পা ছুঁড়িতে ছুঁড়িতে বুড়ী সকলের আগে ছুটিয়া আসে-
“আঁই লোঁ মাঁই লোঁ, নাঁত্নি লোঁ নাঁত্নি লোঁ,-
তোঁর মঁনে এঁই ছিঁল লোঁ।
তোঁর মুঁণ্ডুটা চিঁবিয়া খাঁই লোঁ!”
আর মুণ্ডু খাওয়া! রাজকন্যা বলিলেন,- “রাজপুত্র, শীগ্গির সাপ কাটিয়া ফেল!” বুকের
উপর রাখিয়া তালপত্র খাঁড়া দিয়া রাজপুত্র সাপের গলা কাটিয়া ফেলিলেন। এক ফোঁটা রক্তও
পড়িতে দিলেন না। সব ফুরাইল, যত রাক্ষস পুকুর পাড়ে আসিতে আসিতেই মুণ্ডু খসিয়া পড়িয়া
গেল।
রাজপুত্র রাজকন্যা হাঁপ ছাড়িয়া ঘরে গেলেন। এক কুঠরীতে হাসন চাঁপা নাটন কাটি, চিরণ
দাঁতের চিকন পাটি, সব রহিয়াছে, আর এক শুক পাখী ছট্ফট্ করিয়া চেঁচাইতেছে। সব লইয়া
রাজপুত্র বলিলেন,- “রাজকন্যা, আমার দেশে চল।”
রাজকন্যাকে একখানে রাখিয়া, রাজপুত্র, রাণীর ওষুধ আর শুকটি নিয়া রাজার কাছে গেলেন,-
“মহারাজ, আর একবার সভা করিবেন, আমি রাণীর অসুখ সারাইব।”
ভারী খুশী হইয়া রাজা সভা করিয়া বসিলেন। রাজপুত্র কাটি, পাটি, চাঁপা, কাঁকুড় সভায়
রাখিলেন। সকলে দেখে, কি আশ্চর্য! রাজপুত্র বলিলেন, -“মহারাজ, রাণীকে নিজে আসিয়া
এইগুলি নিতে হইবে।”
রাণীর তো ওদিকে হাড়মুড়্মুড়ি গিয়া কল্জে-ধড়্ফড়ি ব্যারাম হইয়াছে-“ছেলেটা তো তবে সব
নাশ করিয়া আসিয়াছে! আজ ওকে খা’ব! রাজ্য খা’ব!!”-
রাজ্য খা!-সভার দুয়ারে রাণী পা দিয়াছে, আর রাজপুত্র বলিলেন,- “ও রাক্ষসী, আমাকে
খা’বি?- এই দ্যাখ্!”- রাজপুত্র খাঁচা হইতে শুকটিকে বাহির করিয়া এক টানে শুকের গলা
ছিঁড়েন আর কি!-রাক্ষসী বলিল- “খাঁব না, খাঁব না, রাঁখ্ রাখ্!! তোঁর পাঁয়ে
পঁড়ি!”-রাণীর মূর্তি কোথায়, দাঁত-বিকটী রাক্ষসী!!-
রাজা, সভার সকলে থরথর কাঁপেন।
রাজপুত্র বলিলেন,-“দে, আমার কোটালবন্ধু দে, কোটাল-বন্ধুর ঘোড়া দে! দে, আমার
সওদাগরবন্ধু দে, সওদাগরবন্ধুর ঘোড়া দে! মন্ত্রিবন্ধু, মন্ত্রিবন্ধুর ঘোড়া দে, আমার
ঘোড়া দে!”
রাক্ষসী হোয়াক্ হায়াক্ করিয়া একে একে সব উগ্রিয়া দিল! তখন রাজপুত্র
বলিলেন,-“মহারাজ, দেখিলেন, রাণী রাক্ষসী কিনা?”-
-“এইবার রাক্ষসী-নিপাত যাও!!”
শুকের গলা ছিঁড়িল-রাক্ষসী গ্যাঁ গ্যাঁ করিয়া পড়িয়া মরিয়া গেল! রাক্ষসীর
মরণ,-মরিতে-মরিতেও মরণকাম্ড়ি- রাজার সিংহাসন ধরিয়া টান মারে আর কি!-সার্ সার্
করিয়া রাজা বাঁচিয়া গেলেন।
ঘাম দিয়া সকলের জ্বর ছাড়িল। রাজা বলিলেন,-“ধন্য তুমি কোথাকার রাজপুত্র! যত ধন চাও,
ভাণ্ডার খুলিয়া দিয়া যাও।”
রাজপুত্র বলিলেন,- “আমি কিছুই চাই না,-এতদিনে রাক্ষসীর হাত হইতে সকলে বাঁচিলাম,-এখন
আমরা দেশে যাইব।” রাজা শুনিলেন না, ভাণ্ডার খুলিয়া সকল ধন রত্ন বাহির করিয়া দিলেন।