দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার
চ্যাং ব্যাং
শিয়াল পণ্ডিত
|
সুখু আর দুখু
|
ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণী
|
দেড় আঙ্গুলে
নূতন
বৌ,
হাঁড়ি
ঢাক,
শেয়াল
পণ্ডিত ডাকে,-
টিকি নাড়ে বুড়ো বামুন, খেতে গেল পিটে, খ্যাংরা দিয়ে বাম্নী কোথায় মিঠে দিল পিঠে? রাগে বামুন গেল কোথায়, এলো কবে আর? কেমন করে’ হল রে বা’র রাজকন্যার হার!
কাঠুরে-বউ ব্রত নিয়ম কেমন শশা খেল? কোল-জোড়া ধন মাণিক রত্ন কেমন ছেলে পেল? ব্যাঙ্ ঘ্যাঙ্ঘ্যাঙ্ কামার বুড়ো কাঁপে থর্ থর্- রাজকন্যা চোখ-বিন্ধুলীর কেমন এল বর!
কোথায়
এত থলের ভিতর
চিঁচিঁ মিঁচিঁ
রব?- |
এক যে ছিল শিয়াল,
তা’র বাপ দিয়েছিল দেয়াল;
তা’র ছেলে সে, কম কিসে?
তা’রও হ’ল খেয়াল!
ইয়া-ইয়া গোঁফে ছাড়া দিয়া, শিয়াল পণ্ডিত শটীর বনে এক মস্ত পাঠশালা খুলিয়া ফেলিল।
চিঁচিঁ পোকা, ঝিঁঝিঁ পোকা, রামফড়িঙ্গের ছা,
কচ্ছপ, কেন্নো হাজার পা,
কেঁচো, বিছে, গুব্রে, আরসুলা, ব্যাং,
কাঁকড়া,- মাকড়া-এই এই ঠ্যাং!
শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালায় এত এত পড়ুয়া।
পড়ুয়াদের পড়ায়
পণ্ডিতের সাড়ায়,
শঁটীর বনে দিন-রাত হট্টগোল।
দেখিয়া শুনিয়া এক কুমীর ভাবিল,- “তাই তো! সকলের ছেলেই লেখাপড়া শিখিল, আমার ছেলেরা বোকা হইয়া থাকিবে?” কুমীর, শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালায় সাত ছেলে নিয়া গিয়া হাতে খড়ি দিল।
ছেলেরা আঞ্জি ক খ পড়ে। শিয়াল বলিল,- “কুমীর মশাই, দেখেন কি,- সাতদিন যাইতে-না –যাইতেই আপনার এক এক ছেলে বিদ্যাগজ্গজ্ ধনুর্ধর হইয়া উঠিবে।” মহা খুশী হইয়া কুমীর বাড়ী আসিল।
পণ্ডিত মহাশয় পড়ান, রোজ একটি করিয়া কুমীরের ছানা দিয়া জল খান। এই রকম করিয়া ছয় দিন গেল।
কুমীর ভাবিতেছে,- “কাল তো আমার ছেলেরা বিদ্যাগজ্গজ্ ধনুর্ধর হইয়া আসিবে, আজ একবার দেখিয়া আসি।” ভাবিয়া কুমীরাণীকে বলিল,- “ওগো, ইলিস-খলিসের চচ্চড়ি, রুই-কাতলার গড়গড়ি, চিতল-বোয়ালের মড়মড়ি সব তৈয়ার করিয়া রাখ, ছেলেরা আসিয়া খাইবে।” বলিয়া, কুমীর, পুরানো চটের থান, ছেঁড়া জালের চাদর, জেলে-ডিঙ্গির টোপর পরিয়া এক-গাল শেওলা চিবাইতে চিবাইতে ভূঁড়িতে হাত বুলাইতে বুলাইতে পণ্ডিত মহাশয়ের কাছে গিয়া উপস্থিত।– “পণ্ডিত মশাই, পণ্ডিত মশাই, দেখি, দেখি, ছেলেরা আমার কেমন লেখাপড়া শিখিয়াছে।”
তাড়াতাড়ি উঠিয়া পণ্ডিত মহাশয় বলিলেন,-“আসুন, আসুন, বসুন, বসুন, হ্যাঁরে, গুব্রে তামাক দে, আরে ফড়িঙ্গে, নস্যির ডিবে নিয়ে আয়। -হ্যাঁরে, কুমীর-সুন্দরেরা কোথায় গেল রে?- বসুন, বসুন, আমি ডাকিয়া নিয়া আসি।”
গর্তের ভিতরে গিয়া শিয়াল পণ্ডিত সেই শেষ-একটি ছানাকে উঁচু করিয়া সাতবার দেখাইল। বলিল,-“কুমীর মশাই, এত খাটিলাম খুঁটিলাম, আর একটুর জন্য কেন খুঁত রাখিবেন? সব ছেলেই বিদ্যাগজ্গজ্ হইয়া গিয়াছে, আর একদিন থাকিলেই একেবারে ধনুর্ধর হইয়া ঘরে যাইতে পারিবে।”
কুমির বলিল,- “আচ্ছা, আচ্ছা, বেশ, তাহাই হইবে।”
বোকা কুমীর খুশী হইয়া চলিয়া গেল।
পরদিন শিয়াল পণ্ডিত বাকী ছানাটিকে দিয়া সব-শেষ-জলযোগ সারিয়া,- পাঠশালা পুঠশালা ভাঙ্গিয়া-পলায়ন!
পিট্টান তো পিট্টান,- কুমীর আসিয়া দেখে,-পড়ুয়ারা পড়ে না, শিয়াল পণ্ডিত ঘরে নাই,-শটীর বন খালি। কুমীর তখন সব বুঝিতে পারিল। গালে চড় মাথায় চাপড়, হাপুস নয়নে কাঁদিয়া, কুমীর বলিল,- “আচ্ছা পণ্ডিত দাঁড়া,-
আর কি কাঁকড়া খাবি না?
আর কি খালে যাবি না?
ওই খালে তো কাঁকড়া খাবি,-
দেখি কি করে,
মুই কুমীরের হাত এড়াবি।”
কুমীর চুপ করিয়া খালের জলে লুকাইয়া রহিল।
ক’দিন যায়; শিয়াল পণ্ডিত খালের ঐ ধারে ধারে ঘুরে, প্রাণন্তেও জলটিতে পা ছোঁয়ায় না। শেষে পেটের জ্বালা বড় জ্বালা;-তার উপর, ওপারের চড়ায় কাঁকড়ারা ছায়ে-পোয়ে দলে দলে দাঁড়া বাহির করিয়া ধিড়িং ধিড়িং নাচে;- আর কি সয়? সব ভুলিয়া টুলিয়া, যা’ক প্রাণ থা’ক মান-জলে দিলেন ঝাঁপ!
আর কোথা যায়, -ছত্রিশ গণ্ডা দাঁতে কুমীর, পণ্ডিতের ঠ্যাংটি ধরিয়া ফেলিল!
টানাটানি হুড়াহুড়ি,- পণ্ডিত এক নলখাগড়ার বনে গিয়া ঠেকিলেন। অমনি এক নলের আগা ভাঙ্গিয়া হাসিয়া পণ্ডিত বলিল,- “হাঃ! কুমীর মশাই এত বোকা তা’ তো জানিতাম না!- কোথায় বা আমার ঠ্যাং, কোথায় বা লাঠি! ধরুন ধরুন, লাঠিটা ছাড়িয়া ঠ্যাংটাই ধরিতেন!” কুমীর ভাবিল,-“অ্যাঁ,-লাঠি ধরিয়াছি?” –ধর্ ধর্!-ঠ্যাং ছাড়িয়া কুমীর লাঠিতে কামড় দিল। নল ছাড়িয়া দিয়া পণ্ডিত তিন লাফে পার!-“কুমীর মশাই, হোক্কা হুয়া!- আবার পাঠশালা খুলিব, ছেলে পাঠাইও।”
আবার দিন যায়; শিয়ালের আর লেজটিতেও কুমীর পা দিতে পারে না। শেষে একদিন মনে মনে অনেক যুক্তি বুদ্ধি আঁটিয়া, সটান লেজ, রোদমুখো হাঁ, ঢেঁকি-অবতার হইয়া, কুমীর খালের চড়ায় হাত পা ছড়াইয়া একেবারে মরিয়া পড়িয়া রহিল। শিয়াল পণ্ডিত সেই পথে যায়। দেখিল,-“বস্! কুমীর তো মরিয়াছে! যাই, শিয়ালীকে নিমন্ত্রণটা দিয়া আসি।”
কিন্তু, পণ্ডিতের মনে-মনে সন্দ’। -গোঁফে তিন চাড়া দিয়া মুখ চাটিয়া চুটিয়া বলিতেছে,- “আহা, বড় সাধুলোক ছিল গো!- কি হয়েছিল গো!- কি করে গেল গো!-আচ্ছা, লোকটা যে মরিল তা’র লক্ষণ কি?” হুঁ হুঁ-
কান নড়্বে পটাপট
লেজ পড়বে চটাচট
তবে তো মড়া! –এ বেটা এখনো তবে মরে নি!”
কুমীর ভাবিল, কথা বুঝি সত্যি-কান নাই তবু কুমীর মাথা ঘুরাইয়া কান নাড়ে,
চট্চট্চট্ লেজ আছাড়ে।
দূরে ছিল কতকগুলি রাখাল-
“ওরে! ওই সে কুমীর ডাঙ্গায় এল,
যে ব্যাটা সে দিন বাছুর খেল!-”
কাস্তে, লাঠি, ইট, পাট্কেল ধড়াধ্বড়্ পড়ে- হৈ হৈ রৈ রৈ করিয়া আসিয়া রাখলের দল কুমীরের পিছনে লাগিয়া গেল।
শিয়াল পণ্ডিত তিন ছুটে চম্পট-
“হোক্কা হোয়া, কুমীর মশাই!
নমস্কার!-এবার পালাই!”
২
অনেক দূরে আসিয়া শিয়াল পণ্ডিত এক বেগুনের ক্ষেতে ঢুকিলেন।
ক্ষুধায় পেট্টি আনচান, মনের সুখে বেগুন খান;
খেতে খেতে হঠাৎ কখন্ নাকে ফুটল কাঁটা,
“হ্যাঁচ্-হ্যাঁচ-হ্যাঁচ্-ফ্যাঁচ্-ফ্যাঁচ্-ফ্যাঁচ্-”
কিছুতেই কিছু না, রক্তে ভেসে গেল গা-টা
শেষে, কাবুজাবু হইয়া শিয়াল নাপিতের বাড়ী গেলেন-
“নরসুন্দর নরের সুন্দর ঘরে আছ হে?
বাইরে একটু এস রে ভাই
নরুণখানা নে।”
নাপিত বড় ভাল মানুষ ছিল; নরুণ লইয়া আসিয়া বলিল,- “কে ভাই, শিয়াল
পণ্ডিত?- তাই তো, এ কি! আহা-হা নাকটা তো গিয়াছে!” দু ফোঁটা চোখের জল ফেলিয়া ফুঁপিয়া
ফুঁপিয়া শিয়াল বলিল,-
“ওই তো দুঃখে কাঁদি রে ভাই, মন কি আমার আছে?
তুমি ছাড়া আর গতি নাই,-এলাম তোমার কাছে।”
নাপিত বড় দয়াল, মন গলিল; বলিল,- “বস, বস, কাঁটা খুলিয়া দিতেছি।”
একে হ’ল আর,
শিয়ালের নাক কেটে গেল, কাঁটা কর্তে বার!
“উঁয়া, উঁয়া! হুঁয়া, হুঁয়া!- ক্ক্যাঃ-ক্ক্যাঃ!!!-ওরে হতভাগা পাজী পাষণ্ডে’ নাপ্তে!- দ্যাখ্তো-দ্যাখ্তো কি করেছিস্!- দে ব্যাটা আগে আমার নাক জুড়িয়া দে,-নইলে তোকে দেখাচ্ছি!”
ভাল মানুষ নাপিত ভয়ে থতমত, বলিল,- “দাদা! বড় চুক হইয়া গিয়াছে; মাফ্ কর ভাই, নইলে গরীব প্রাণে মারা যাই।”
শিয়াল বলিল,-“আচ্ছা যা’; যা হইবার তা’ তো হইল;- তবে তোর নরুণখানা আমাকে দে, তোকে ছাড়িয়া দিতেছি।”
কি করে?- নাপিত শেয়ালকে নরুণখানা দিল। নরুণ পাইয়া শিয়াল বলিল,- “আচ্ছা, তবে আসি।”
শিয়াল এক কুমোরের বাড়ীর সামনে দিয়া যায়; দেখিয়া কুমোর বলিল,- “কে হে বট ভাই, কে যাচ্ছ?-মুখে ওটা কি?”
শিয়াল বলিল,-“কুমোর ভাই না-কি? ও একটা নরুণ নিয়া যাচ্ছি।” কুমোরেরও
একটা নরুণের বড় দরকার-বলিল, “তা, ভাই, দেখি দেখি, তোমার নরুণটা কেমন?”
পরখ করিতে করিতে নরুণটা মট করিয়া ভাঙ্গিয়া গেল; কুমোর বলিল;-“আঃ-হাঃ!”
চটিয়া উঠিয়া শিয়াল বলিল,-“আজ্ঞে কুমোরের পো, সেটি হবে না! ভাল চাও তো আমার নরুণটি
যোগাইয়া দাও!”
সে গাঁয়ে কামার নাই। নিরুপায় হইয়া কুমোর বলিল,-“এখন কি করি ভাই, মাফ্ না করিলে যে
গরীব মারা যায়!”
শিয়াল বলিল, “তবে একটি হাঁড়ি দাও!”
কুমোর একটি হাঁড়ি দিয়া হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল। হাঁড়ি লইয়া শিয়াল, আবার চলিতে লাগিল।
এক বিয়ের বর যায়! বোম পটকা, আতসবাজি ছুঁড়িতে ছুঁড়িতে সকলে চলিয়াছে। অন্ধকারে, কে জানে?-একটা পটকা ছুটিয়া দিয়া শিয়ালের হাঁড়িতে পড়িল। হাঁড়িটি ফাটিয়া গেল। দুই চোখ ঘুরাইয়া আসিয়া শিয়াল বলিল,-“কে হে বাপু বড় তুমি বর যাচ্ছ-বাজি পোড়াবার আর জায়গা পাও নাই? ভাল চাও আমার হাঁড়িটি দাও!”
বর ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া গেল। সকলে বলিল,- “মাফ্ কর ভাই, মাফ্ কর ভাই,
নইলে আমরা সব মারা যাই।”
শিয়াল বলিল,- “সেটি হবে না- কনেটিকে আমাকে দাও, তারপর তোমরা যেখানে খুশী যাও।”
কি আর করে?-বর, কনেটি শিয়ালকে দিল।
কনে পাইয়া শিয়াল সেখান হইতে চলিল।
এক ঢুলীর বাড়ী গিয়া শিয়াল বলিল,- “ঢুলী ভাই, ঢুলী ভাই, তোমরা ক’জন আছ?-অঅমি বিয়ে করিব, সব ঢোল বায়না কর দেখি। কনেটি তোমার এখানে থাকিল, আমি পুরুতবাড়ী চলিলাম।”
ঢুলী ঢোল বায়না করিতে গেল, শেয়াল পুরুতবাড়ী চলিল। ঢুলীবউ কুটনা কাটিতে বসিয়াছে। কনেটি ঝিমাইতে ঝিমাইতে বঁটির উপরে পড়িয়া গিয়া কাটিয়া দুইখানা হইয়া গেল। ভয়ে ঢুলীবউ কনের দুই টুকরা নিয়া খড়ের গাদায় লুকাইয়া রাখিয়া আসিল।
পুরুত নিয়া আসিয়া শিয়াল দেখে, কনে নাই!-“ভাল চাও তো ঢুলীবউ কনেটি এনে
দাও!” ভয়ে ঢুলীবউ ঘরে উঠিয়া বলে,-“ও মা, কি হবে গো!”
শিয়াল বলিল,-“সে সব কথা থাক্, ঢুলীর ঢোলটি দাও তো ছাড়িয়া দাও তো ছাড়িয়া দিচ্ছি!”
ঢুলিবউ ভাবিল,- বাঁচিলাম!-তাড়াতাড়ি ঢোলটি আনিয়া দিয়া ঘরে গিয়া দুয়ার দিল।
ঢোল নিয়া গিয়া শিয়াল এক তালগাছের উপর উঠিয়া বাজায় আর গায়,-
“তাক্ ডুমা ডুম্ ডুম্!!!
বেগুন ক্ষেতে ফুটল কাঁটা-তাক ডুমা ডুম্ ডুম্!
কাঁটা খুলতে কাটল নাক,
তাক ডুমা ডুম্ ডুম্!
নাকুর বদল নরুণ পেলাম,
তাক্ ডুমা ডুম্ ডুম্!
নরুণ দিয়ে হাঁড়ি পেলাম- তাক্ ডুমা ডুম
ডুম্!
হাঁড়ির বদল কনে পেলাম- তাক্ ডুমা ডুম্
ডুম্!
ডাগুম ডাগুম ডুগ্ ডুমা ডুম্ !!
ডুম্ ডুমা ডুম্ ডুম্ !!”
মনের আনন্দে শিয়াল সেই নাচিয়া উঠিয়াছে, অমনি পা হড়্কাইয়া গিয়া-
বাঃ!!!
১
এক তাঁতী, তা’র দুই স্ত্রী। দুই তাঁতীবউর দুই মেয়ে,- সুখু আর দুখু। তাঁতী, বড় স্ত্রী আর বড় মেয়ে সুখুকে বেশী বেশী আদর করে। বড় স্ত্রী বড় মেয়ে ঘর-সংসারের কূটাটুকু ছিঁড়িয়া দুইখানা করে না; কেবল বসিয়া বসিয়া খায়। দুখু আর তা’র মা সূতা কাটে, ঘর নিকোয়; দিনান্তে চারটি চারটি ভাত পায়, আর, সকলের গঞ্জনা সয়।
একদিন তাঁতী মরিয়া গেল। অমনি বড় তাঁতীবউ তাঁতীর কড়িপাতি যা’ ছিল সব লুকাইয়া ফেলিল, আপন মেয়ে নিয়া, দুখু আর দুখুর মাকে ভিন্ন করিয়া দিল।
সুখুর মা আজ হাটের বড়মাছের মুড়াটা আনে, কাল হাটের বড় লাউটা আনে, রাঁধে, বাড়ে, সতীন সতীনের মেয়েকে দেখাইয়া দেখাইয়া খায়।
দুখুর মা আর দুখুর দিনে রাত্রে সূতা কাটিয়া কোনদিন একখানা গামছা, কোন দিন একখানা ঠেঁটী, এই হয়। তাই বেচিয়া একবুড়ি পায়, দেড়বুড়ি পায়, তাই দিয়া মায়ে ঝিয়ে চারিটি অন্ন পেটে দেয়।
একদিন সূতা নাতা ইঁদুরে কাটে, তূলাটুকু নেতিয়ে যায়,-দুখুর মা, সূতা গোছা এলাইয়া দিয়া, তূলা ডালা রোদে দিয়া, ক্ষার কাপড়খানা নিয়া ঘাটে গিয়াছে। দুখু তূলা আগ্লাইয়া বসিয়া আছে। এমন সময় এক দমকা বাতাস আসিয়া দুখুর তূলাগুলা উড়াইয়া নিয়া গেল! একটু তূলাও দুখু ফিরাইতে পারিল না; শেষে দুখু কাঁদিয়া ফেলিল!
তখন বাতাস বলিল,- “দুখু কাঁদিস নে, আমার সঙ্গে আয়, তোকে তূলা দেব।” দুখু কাঁদিতে কাঁদিতে বাতাসের পিছু-পিছু গেল।
যাইতে যাইতে পথে এক গাই দুখুকে ডাকে,-“দুখু, কোথা যাচ্ছ-আমার গোয়ালটা কাড়িয়া দিয়া যাবে?” দুখু চোখের জল মুছিয়া, গাইয়ের গোয়াল কাড়িল, খড় জল দিল; দিয়া আবার বাতাসের পিছু চলিল।
খানিক দূর যাইতেই এক কলাগাছ বলিল,- “দুখু, কোথা যাচ্ছ-আমায় বড় লতাপাতায় ঘিরিয়াছে, এগুলিকে টেনে দিয়ে যাবে?” দুখু একটু থামিয়া কলাগাছের লতাপাতা ছিঁড়িয়া দিল।
আবার খানিক দূর যাইতে, এক সেওড়া গাছ ডাকিল,-“দুখু, কোথা যাচ্ছ-আমার গুঁড়িটায় বড় জঞ্জাল, ঝাড় দিয়া যাবে?” দুখু সেওড়ার গুঁড়ি ঝাড় দিল, তলার পাতাকূটা কুড়াইয়া ফেলিল। সব ফিট্ফাট্ করিয়া দিয়া, আবার দুখু বাতাসের সঙ্গে চলিল।
একটু দূরেই এক ঘোড়া বলিল- “দুখু, দুখু, কোথা যাচ্ছ,- আমাকে চার গোছা ঘাস দিয়া যাবে?” দুখু ঘোড়ার ঘাস দিল। তারপর চলিতে চলিতে দুখু বাতাসের সঙ্গে কোথায় দিয়া কোথায় দিয়া এক ধবধবে বাড়ীতে গিয়া উপস্থিত!
বাড়ীতে আর কেউ নাই; ফিটফাট ঘরদোর, ঝকঝক আঙিনা, কেবল দাওয়ার উপরে এক বুড়ী বসিয়া বসিয়া সূতা কাটিতেছে, সেই সূতায় চক্ষের পলকে পলকে জোড়ায় জোড়ায় শাড়ী হইতেছে।
বুড়ী আর কেউ না, চাঁদের মা বুড়ী! বাতাস বলিল,-“দুখু, বুড়ীর কাছে গিয়া তূলা চাও, পাবে।” দুখু গিয়া বুড়ীর পায়ে ঢিপ করিয়া প্রণাম করিল, বলিল,-“দ্যাখ তো আয়ীমা, বাতাস আমার সবগুলো তূলা নিয়া আসিয়াছে-মা আমায় বক্বে আয়ীমা, আমার তূলো গুনো নিয়ে দাও।”
চুলগুলো যেন দুধের ফেনা, চাঁদের আলো; সেই চুল সরাইয়া চোখ তুলিয়া চাঁদের মা বুড়ী দেখে ছোট্ট খাট্ট মেয়েটি-চিনি হেন মিষ্টি-মধুর বুলি। বুড়ী বলিল,-“আহা সোনার চাঁদ বেঁচে থাক। ওঘরে গামছা আছে, ওঘরে কাপড় আছে, ওঘরে তেল আছে, ঐ পুকুরে গিয়া দুটো ডুব দিয়া এসো; এসে ওঘরে গিয়া আগে চাট্টি খাও, তারপরে তূলো দেবো এখন।”
ঘরে গিয়া দুখু,-কত কত ভাল ভাল গামছা, কাপড় দেখে,-তা সব ঠেলিয়া, যা’তা’ ছেঁড়া নাতা গামছা কাপড় নিয়া, যেমন-তেমন একটু তেল মাথায় ছোঁয়াইয়া, এক চিমটি ক্ষার খৈল নিয়া নাইতে গেল।
ক্ষার খৈল টুকু মাখিয়া জলে নামিয়া দুখু ডুব দিল। ডুব দিতেই এক ডুবে দুখুর সৌন্দর্য উথলে পড়ে!-সে কি রূপ!- অত রূপ দেবকন্যারও নাই!-দুখু তা’ জানিতেও পারিল না। আর একডুবে দুখুর গয়না, গায়ে ধরে না, পায়ে ধরে না। সোনাঢাকা অঙ্গ নিয়া আস্তে আস্তে উঠিয়া আসিয়া দুখু খাবার ঘরে গেল।
খাবার ঘরে কত জিনিস, দুখু কি জানে? জন্মেও অত সব দেখে নাই! এক কোণে বসিয়া দুখু চারটি পান্তা খাইয়া আসিল। চাঁদের মা বুড়ী বলিল, -“আমার সোনার বাছা এসেছিস!-ঐ ঘরে যা, পেঁটরায় তূলা আছে, নাও গে!”
দুখু গিয়া দেখিল,-পেঁটরার উপর পেঁটরা- ছোট, বড়, ক-ত রকমের! দুখু এক পাশের ছোট্ট এতটুকু এক খেলনা-পেঁটরা নিয়া বুড়ীর কাছে দিল। বুড়ী বলিল,-“আমার মানিক ধন! আমার কাছে কেন, এখন মা’র কাছে যাও, এই পেঁটরায় তূলা দিয়াছি।” বুড়ীর পায়ের ধূলা নিয়া পেঁটরা কাঁখে, রূপে, গয়নায়, পথ ঘাট আলো করিয়া দুখু বাড়ী চলিল। পথে ঘোড়া বলিল,-“দুখু দুখু, এস এস, আর কি দিব, এই নাও।” ঘোড়া খুব তেজী এক পক্ষীরাজ বাচ্ছা দিল।
সেওড়া গাছ বলিল,-“দুখু, দুখু, এস এস, আর কি দিব, এই নাও।” সেওড়া গাছ এক ঘড়া মোহর দিল।
কলাগাছ বলিল,-“দুখু, দুখু, এস এস, আর কি দিব, এই নাও।” কলাগাছ মস্ত এক ছড়া সোনার কলা দিল।
গাই বলিল,- “দুখু, দুখু, এস এস, আর কি দিব, এই নাও।” গাই এক কপিলা-লক্ষণ বক্না দিল। ঘোড়ার বাচ্চার পিঠে ঘড়া, ছড়া, তুলিয়া, বক্না নিয়া দুখু বাড়ী আসিল।
“দুখু, দুখু, ও পোড়ারমুখী- তূলা নিয়া কোথায় গেলি?-” ডাকিয়া, ডুকিয়া, আনাচে কানাচে, খানা জঙ্গল খুঁজিয়া, মেয়ে না পাইয়া দুখুর মা অস্থির-দুখুর মা ছুটিয়া আসিল, “ও মা, মা আমার, এতক্ষণ তুই কোথায় ছিলি?”-আসিয়া দেখে,-“ও মা! এ কি অন্ধের নড়ি দুঃখিনীর মেয়ে এ সব তুই কোথায় পেলি!”-মা গিয়া দুখুকে বুকে নিল।
মাকে দুখু সব কথা বলিল; শুনিয়া দুখুর মা মনের আনন্দে দুখুকে নিয়া সুখুর মা’র কাছে গেল,-“দিদি, দিদি,- ও সুখু, সুখু, আমাদের দুঃখ ঘুচেছে, চাঁদের মা বুড়ী দুখুকে এই সব দিয়াছে। সুখু কতক নাও, দুখুর কতক থাক।”
চোখ টানিয়া মুখ বাঁকাইয়া-তিন ঝক্না ভিরকুট্টি, সুখুর মা বলিল, -“বালাই! পরের কড়ির ভাগ-বাঁটরি-তার কপালে খ্যাংরা মারি! ধুইয়া খা।” মনে মনে সুখুর মা বিড়্ বিড়্-“শত্তুরের কপালে আগুন,-কেন, আমার সুখু কি জলে ভাসা মেয়ে? দরদ দেখে মরে যাই! কপালে থাকে তো, সুখু আমার কালই আপনি ইন্দ্রের ঐশ্বর্য লুটে আনবে।” মুখ খাইয়া দুখু দুখুর মা ফিরিয়া আসিল।
রাত্রে পেঁটরা খুলিতেই দুখুর রাজপুত্র-বর বাহির হইল। রাজপুত্র-বর ঘোড়ায় চড়িয়া বেড়ায়, কপিলার দুধে আঁচায়,-দুখু, দুখুর মা,র ঘর-কুঁড়ে আলো হইয়া গেল।
২
রা নাই, শব্দ নাই, সুখুর মা সামনের দুয়ারে খিল দিয়াছে। পরদিন সুখুর মা পিছন দুয়ারে তূলা রোদে দিয়া ‘পিস্পিস্’ ‘ফিস্ফিস্’ সুখুকে বসাইয়া ক্ষার কাপড়ে পুঁটলি বাঁধিয়া ঘাটে গেল।
কতক্ষণ পর বাতাস আসিয়া সুখুর তূলা উড়াইয়া নেয়,-কুটিকুটি সুখু,-বাতাসের পিছু পিছু ছুটিল!
সেই গাই ডাকিল,- “সুখু, কোথা যাচ্ছ শুনে যাও।” সুখু ফিরিয়াও দেখিল না। কলাগাছ, সেওড়া গাছ, ঘোড়া সকলেই ডাকিল, দুখু কাহারও কথা কানে তুলিল না। সুখু আরো রাগিয়া গিয়া গালি পাড়ে,-“উঁ! আমি যাবো চাঁদের মা বুড়ীর বাড়ী, তোমাদের কথা শুনতে বসি!”
বাতাসের সাথে সাথে সুখু চাঁদের মা বুড়ীর বাড়ী গেল। গিয়াই,-“ও বুড়ি, বুড়ি, বসে’ বসে’ কি কচ্ছিস? আমায় আগে সব জিনিস দিয়ে নে, তার পর সূতো কাটিস। হুঁ! উনুনমুখী দুখু, তা’কেই আবার এত সব দিয়েছেন!” বলিয়া, সুখু, বুড়ীর চরকা মরকা টানিয়া ভাঙ্গে আর কি!
চাঁদের মা বুড়ী অবাক।–“রাখ্ রাখ্”-ওমা! এতটুকু মেয়ে তার কাঠ কাঠ কথা, উড়ুনচণ্ডে’ কাণ্ড! বুড়ী চুপ করিয়া রহিল; তারপর বলিল, -“আচ্ছা, নেয়ে খেয়ে নে, তারপর সব পাবি।”
বলতে সয় না, সুখু দুড়্দাড়্ করিয়া এ ঘর থেকে’ সব্বার ভাল গামছা খানা, ওঘরে থেকে, সব্বার ভাল শাড়ী খানা, সুবাস তেলের হাঁড়ি চন্দনের বাটি যত কিছু নিয়া ঘাটে গেল।
সাতবার করিয়া তেল মাখে, সাতবার করিয়া মাথা ঘষে, ফিরিয়া ফিরিয়া চায়,-সাতবার করিয়া আর্শি ধরিয়া মুখ দেখে,- তবু সুখুর মনের মত হয় না। তিন প্রহর ধরিয়া এই রকম করিয়া শেষে সুখু জলে নামিল।
এক ডুবে সৌন্দর্য! এক ডুবে গহনা!!-আঃ!!!- আর সুখুকে পায় কে? সুখু এদিকে চায়, সুখু ওদিকে চায়, “যত যত ডুব দিব, না জানি আরো কি পাব!”
“আঁই-আঁই-আঁই!!!”- তিন ডুব দিয়া উঠিয়া সুখু দেখে,-গা-ভরা আঁচিল, ঘা পাঁচড়া-এ-ই নখ, শোণের গোছা চুল-কত কদর্য সুখুর কপালে!- “ওঁ মাঁ, মাঁ গোঁ!-কিঁ হঁল গোঁ”-কাঁদিতে কাঁদিতে সুখু বুড়ীর কাছে গেল।
দেখিয়া বুড়ী বলিল,-“আহা আহা ছাইকপালি,- তিন ডুব দিয়াছিলি বুঝি?-যা, কাঁদিসনে যা;- বেলা ব’য়ে গেছে, খেয়ে দেয়ে নে!” বুড়ীকে গালি পাড়িতে পাড়িতে সুখু, খাবার ঘরে গিয়া পায়েস পিঠা ভাল ভাল সব খাবার খাবলে খাবলে খাইয়া ছড়াইয়া হাত মুখ ধুইয়া আসিল-“আচ্ছা বুড়ি, মাঁর কাঁছে আঁগে যাঁই!-দেঁ তুঁই পেঁটরা দিঁবি কিঁ না দেঁ।”বুড়ী পেঁটবার ঘর দেখাইয়া দিল। য-ত বড় পারিল, এ-ই মস্ত এক পেঁটরা মাথায় করিয়া সুখু বিড়্ বিড়্ করিয়া বুড়ীর চৌদ্দ বুড়ীর মুণ্ডু খাইতে খাইতে রূপে দিক্ চম্কাইয়া বাড়ী চলিল!
সুখুর রূপ দেখিয়া শিয়াল পালায়, পথের মানুষ মূর্ছা যায়। পথে ঘোড়া এক লাথি মারিল; সুখু করে-“আঁই আঁই!” সেওড়া গাছের এক ডাল মটাস করিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িল, সুখু করে-“মঁলাম! মঁলাম!” কলাগাছের এক কাঁদি কলা ছিঁড়িয়া পিঠে পড়িল; সুখু বলে- “গেঁলাম! গেঁলাম!” শিং বাঁকা করিয়া, গাই তাড়া করিল, ছুটিতে ছুটিতে হাঁপাইয়া আসিয়া সুখু বাড়ীতে উঠিল।
দুয়ারে আলপনা দিয়া, ঘট পল্লব বিয়া জোড়া পিঁড়ি সাজাইয়া সুখুর মা বসিয়া
ছিল। বারে বারে পথ চায়-
সুখুকে দেখিয়া, সুখুর মা
“ও মা! মা! ও মা গো, কি হবে গো!
কোথায় যাব গো!”
চোখের তারা কপালে, আছাড় খাইয়া পড়িয়া সুখুর মা মূর্ছা গেল। উঠিয়া সুখুর মা বলে,- “হ’ক হ’ক অভাগী, পেঁটরা নিয়ে ঘরে তোল্; দ্যাখ আগে, বর এলে বা সব ভাল হইবে!”
দুইজনে পেঁটরা নিয়া ঘরে তুলিল। রাত্রে পেঁটরা খুলিয়া, সুখুর বর বাহির হইল!- সুখু বলে,-“মা, পা কেন কন্ কন্?”
মা বলিল,-“মল পর।”
সুখু-“মা, গা কেন ছন্ ছন্?”
মা-“মা, গয়না পর।”
তারপর সুখুর হাত কট কট, গলা ঘড় ঘড়, মাথা কচ কচ ক-ত করিল,- সুখু হার পরিল, নথ নোলক, সিঁথি পরিয়া টরিয়া সুখু চুপ করিল। মনের আনন্দে, সুখুর মা ঘুমাইতে গেল।
পরদিন সুখু আর দোর খোলে না, “কেন লো,-কত বেলা, উঠবি না?”
নাঃ, নাওয়ার খাওয়ার বেলা হইল, সুখু
উঠে না। সুখুর মা গিয়া কবাট খুলিল।– “ও মা রে মা!”-সুখু নাই, সুখুর চিহ্ন নাই-ঘরের
মেজেতে হাড় গোড়, অজগরের খোলস!- অজগরে সুখুকে খাইয়া গিয়াছে!!- চেলাকাঠ মাথায় মারিয়া
সুখুর মা মরিয়া গেল।
১
এক যে ছিল ব্রাহ্মণী, আর তার যে ছিল পতি, -ব্রাহ্মণীটি বুদ্ধির ঘড়া, ব্রাহ্মণ বোকা অতি! কাজেই সংসারের যত কাজ ব্রাহ্মণীরই হ’ত করতে, ব্রাহ্মণ শুধু খেতেন বসে, ব্রাহ্মণীর হ’ত মরতে। ব্রাহ্মণীটি যে,-রণচণ্ডী!-নথের ঝাঁকিতে নাক ছিঁড়ে। -মাথার চুলে তৈল নাই, গা-গতরে খৈল নাই, ‘নিত্য ভিক্ষা তনু রক্ষা,’ তার উপর আবার বামুনের চাটাল চাটাল কথা। জ্বালাতন-পালাতন বামনী ধান ঝাড়ে, তা’র তুষ ফেলে, কি, ধান ফেলে!
এমন সময় ব্রাহ্মণ গিয়া বলিল-“বামনী, আজ বুঝি পিটে করবি, না?”
কূলো মূলো ফেলিয়া খ্যাংরা নিয়া ব্রাহ্মণী গর্জে উঠিল, “হ্যাঁ, পিটে করতেই বসেছি!
চাল বাড়ন্ত হাঁড়ি খট খট-এক কড়ার মুরোদ নাই পিটা খেকোর পুত পিটা খাবে!- বেরো আমার
বাড়ী থেকে!”
গর্জনে উঠান কাঁপে, গাছ থর থর পক্ষী উড়ে;- ব্রাহ্মণ ভাবলেন-
“কি? ব্রাহ্মণী, তার গালি সইব এত আমি?
তা’ হবে না!”
তখনি রাগে হলেন বনগামী!
২
বনে বনে ঘোরেন, এমন সময় এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে ব্রাহ্মণের দেখা। সকল কথা শুনিয়া, সন্ন্যাসী, ব্রাহ্মণকে আপন আশ্রমে নিয়া গেলেন। আশ্রমে গিয়া ব্রাহ্মণ সন্ন্যাসীর কাছে লেখাপড়া শিখেন।
কান নড়বড় বুড়ো বামুন
মুনির কাছে পড়েন কেমন?
এ বেলা পড়েন,-“ক-চ-প-অ-অ-অ”
ও বেলা পড়েন,-“খ-চ-ক-অ-অ-অ!
দিনে পড়েন,-“হগড়ং ডগড়ং বগ বগ বগড়ম।”
রাতে পড়েন,-“চং, ছং, খঁরঁরঁঅম্-ঘড়্-ড়্ ঘড়ম্!” নাকের ডাকে গলার
ডাকে নিশি ভোর!
এই রকম করিয়া ব্রাহ্মণ খুব অনেক বিদ্যা শিখিয়া ফেলিলেন। শিখিয়া শুখিয়া ব্রাহ্মণ
মনে মনে, ভাবলেন-আমি হনু একজন!
বিদ্যেয় এখন ছড়াছড়ি যাবে যশ ধন!
তখন-বামনীর সে বিষমুখ
দেখতে না আর হবে,-
হাঃ! হাঃ!
তখন আমি কোথায় রব, আর বামনী কোথা রবে!
ভারি স্ফূর্তি।–কিসের আবার সন্ন্যাসীর কাছে বলা টলা!-
খুঙ্গি পুঁথি লাঠি চাটি বাঁধিয়া পুঁটুলী
“জয় জগদম্বা!” বামুন, দেশে গেলেন চলি।
৩
ভাদ্দুরে’ রোদ, তাল পাকে, মাটি পাথর ফাটে,-সন্ধ্যাবেলায় ব্রাহ্মণ আপন গাঁয়ের সীমায় আসিলেন।–“ঠিক তো!- রাজার বাড়ী তো যাবই তো, তা মরিল কি রইল, বামনীটাকে একবার দেখে’-গেলেও-হয়।” একটু রাত হইয়াছে, তখন ব্রাহ্মণ, বাড়ীর আঙ্গিনায় উঠিয়াছেন।
ছ্যাঁক্ ছ্যাঁক্ শব্দ বামুন, শুনতে পেলেন কানে,-
“বামনী ভাজেন তালের বড়, বুঝি অনুমানে!’’
ব্রাহ্মণ চু-প্ করিয়া কানাচে কান পাতিয়া রহিলেন।
“কটা হল ছ্যাঁক?-মনে মনে ল্যাখ্।
চার, পাঁচ, সাত, আট-এক কুড়ি এক।’’
তখন আর ‘ছ্যাঁক’ নাই-ব্রাহ্মণী হাত পা ধুইয়া যেই বাহিরে আসিলেন,
ব্রাহ্মণ ডাকিলা উচ্চে-“ব্রাহ্মণী আছ বাড়ী?
এবার আমি শিখে এলাম বিদ্যে ভারি ভারি!”
চমকিয়া ব্রাহ্মণী ছুটিয়া আসিয়া দেখেন- সারা-অঙ্গে তিলক ফোঁটা ব্রাহ্মণ আসিয়া হাজির! ব্যস্তে স্বস্তে ব্রাহ্মণী বলিলেন,- “এতদিন কোথায় ছিলে?” ব্রাহ্মণ বলিলেন,- “ব্রাহ্মণী! আমি খুব ভারি ভারি বিদ্যা শিখিয়া আসিয়াছি, তাই তোকে বলিয়া যাইতে আসিয়াছি!”
ব্রাহ্মণী বলিলেন,-“দূর পাগল!”
ব্রাহ্মণ বলিলেন,-
‘জানিসনে তাই বলছিস্ অমন, নইলে এতক্ষণ
এককুড়ি এক বড়া সাজিয়ে দিতিস নেমন্তন।”
“অ্যাঁ? তুমি কি করে জানিলে?”
ব্রাহ্মণ বলিলেন,-“বামনি!-
ঐ তো বিদ্যের মা
জননী! বল্লেম আমি গণে’;-
যেখানে যে ভাজুক বড়া
সবি আমার মনে!”
শুনিয়া ব্রাহ্মণী অবাক!-“আহা, আহা, সত্যি কি, সত্যি কি?” ব্রাহ্মণী
মনের আনন্দে-
ছুটে গিয়ে যত পাড়ার
লোকের কাছে কয়,-
“বামুন এল বিদ্যে
শিখে, যেমন বিদ্যে নয়।”
পাড়ার লোকে আশ্চর্য!-আসিয়া দেখে,-
মেলাই পুঁথি খুলে’ বামুন
ঘন টিকি নাড়ে
হং লং বং চং লম্বা বচন
ঝাড়ে-
সে সব কি যে-সে বোঝে? সকলের চমক লাগিয়া গেল।
দেখতে দেখতে সারা গাঁয়ে রাষ্ট্র হল যে,
চমৎকার বিদ্যে বামুন শিখে
এসেছে।
৪
খুব জাঁকে দিন যায়। এর হাত গণেন, ওর চুরি গণেন, দেশে দেশে ব্রাহ্মণের
বিদ্যার নামে জয় জয় উঠিল।
একদিন, মতি ধোপার গাধা হারাইয়াছে।–মতি ব্রাহ্মণের দুয়ারে আসিয়া ধর্ণা দিল-
“বলে দাও দেবতা আমার উপায় হবে কি গো-
সবে ধন হারিয়েছি খোঁড়া গাধাটি গো।”
ব্রাহ্মণ বলিলেন,-
“চুপ্ থাক্-এখন আমি চণ্ডীপূজো করে
তবে এসে বলব বসে’ থাকগে ওই দোরে।”
না খাইয়া না দাইয়া মতি দুয়ারে পড়িয়া রহিল।
ব্রাহ্মণ ঘরে গিয়া বলেন, -“বামনি এখন কি করি?-দাও তো দেখি ছাতাটা।”
ছাতা নিয়া ব্রাহ্মণ ঝাঁ ঝাঁ রৌদ্রে সারা মাঠ ঘুরিয়াও গাধা পাইলেন না।
তখন, হাঁপাতে হাঁপাতে এসে, ক্ষুণ্ণ অতি মন,
বলিলেন,-“ওরে মতে’! বলি তোরে শোন-
আজ গাধাটা পাবি নাক, যা,
চণ্ডী রেগেছেন বড় কি জানি কি করে;
কাল এসে গাধা তুই নিয়ে যাস ঘরে।”
দেবীর রাগের কথায় মতি
ভয়ে ভয়ে চলে গেল।
তখন সূয্যি ডুবে গেছে,
তারপর রাত্রি হয়ে এল।
ব্রাহ্মণের চিন্তা বড়,-
“বুঝি এইবার
হায় হায় ভেঙ্গে যায় সব ভুরিভাড়।”
রাত্রি হইল; বসিয়া বসিয়া মাথে হাত ব্রাহ্মণ ভাবিতে লাগিলেন-
“যত বিদ্যা খুঙ্গি পুঁথি এইবার ফাঁক
জগদম্বা! কি করিলে!-বিষম বিপাক!”
ভাবিয়া ভাবিয়া ব্রাহ্মণ ঘুমাইয়া পড়িলেন।
অনেক রাত্রে, বা’র আঙ্গিনার কোণে কিসের শব্দ! ব্রাহ্মণ ধড়্ফড়্ করিয়া
জাগিয়া উঠিলেন-
“বামনি বামনি শুনছো,-ওটা হলো কিসের শব্দ?”
ব্রাহ্মণী-
“হাঁ হাঁ- বুঝি চোর এসেছে-করতে হবে জব্দ।”
ব্রাহ্মণটি আবার চোরের নামে ভয় খেতেন; কাঁদ-কাঁদ সুরে বলিলেন,-“বামনি,
তবে আমি নুকুই!”
ব্রাহ্মণী বলিলেন-“তাই তো! এতেই এত বড় পণ্ডিত?-অত পণ্ডিতি ঢালাইয়া কাজ নাই, আমি আলো
ধরছি, চোর ধরবে চল।
পরের চোর গণে’ নিত্য বেড়ান বাড়ী বাড়ী,
আপন ঘরে সেঁধোলে চোর, করেন তড়বড়ি।”
কি করেন বামুন, ‘জারে লোহা কোঁকড়’, ডরে ভয়ে কেন্নটি, ঘরে থাকলে রাবণে মারে, বাইরে গেলে রামে মারে,-দশ আঙ্গুলে পৈতা জড়াইয়া “দুর্গা,-দুর্গা,-জগদম্বা” জপিতে জপিতে ব্রাহ্মণ চোর ধরিতে গেলেন।
“ঐ যে চোর, ধর না!” ধাক্কা দিয়া বামনী বামুনকে ঠেলিয়া দিল!-
“গ্যাঁ-গ্যাঁ-গ্যাঁ-ঘ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ।”
“ওমা! ও আবার কি!”
প্রদীপ নিয়া গিয়া ব্রাহ্মণী দেখেন-
ওমা-এটা তো চোর নয় গো মা-
উব্ড়ো থুবড়ো পড়ে আছে মস্ত
গাধাটা!
বামুনে-গাধায় ঝড়-কম্পন, কুকুর-কুণ্ডলী!
হুমড়ি খেয়ে যখন বামুন উপড়ে
পড়ল আসি’,
গলায়-দড়া খোঁড়া গাধার লেজে
গেছে ফাঁসি।
গলায় গলায় ঘড়্ ঘড়্, বামুন করেন ধড়্ফড়্-
চোখ উল্টে পড়ে, বামুন
হয়েছে হাঁ;-
বামনী উঠলেন চেঁচিয়ে-“হায়!
কি হল গো মা!”
পাড়ার লোক ছুটিয়া আসে,-“কি, কি, কি হয়েছে,-ভয় নাই!”
ব্রাহ্মণী বলিলেন,- “না না, কিছু না এই গাধাটা দেখছিলেম।” তাড়াতাড়ি ব্রাহ্মণী গাধা
নিয়া খুঁটিতে বাঁধিলেন, বামুনকে নিয়া বিছানায় শোয়াইলেন,- তেল, জল, ফুঁ-বাতাস,- সকলে
আসিয়া বলে, “কি, কি, হইয়াছে কি?”
ব্রাক্ষণী বলিলেন,-
“এমন কিছু না,-ঠাকুর বসেছিলেন জপে,
গণে’ এনে মতির গাধা এই শুয়েছেন তবে।
হারানো গাধা গণে’ আনা শক্ত কম তো
নয়?-
তাই একটু অস্থির আছেন
জ্যোতিষ মহাশয়।”
কি আশ্চর্য! মন্ত্রের জোরে হারানো গাধা আসিয়া উপস্থিত!
সকলে
অবাক!!!
এত তেল জল বাতাস! মূর্ছা ভাঙ্গতেই “চোর! চোর!” বলে বামুন উঠিয়া বসিল! ব্রাহ্মণী
বলিলেন,-
“চোর কোথায়
তোমার মাথা,-
ওই দ্যাখ না মতির গাধা খুঁটিতে
বাঁধা।”
ব্রাহ্মণ বলিল,- “গাধা?-কৈ, কৈ,মতে’কে ডাক!”
তাড়াতাড়ি ব্রাহ্মণী বলেন, -“চুপ্ কর, চুপ্ কর- এতরাত্রে মতে’! ওগো বাছারা, রাত
গেল, তোমরা এখন বাড়ী যাও,- বামুন ঘুমুক।” সকলে চলে গেল। বামুন জিজ্ঞাসেন,- “তাই তো
বামনী, হয়েছিল কি!”
পরদিন মতি আসিয়া দেখে,-গাধা! মতি লম্বা গড়াগড়ি- আঙ্গিনার অর্ধেক ধূলাই, মতি, খাইয়া
ফেলিল!
এখন, অমনি বামুনের কাপড় কাচে- তারপর মতি-
এ আশ্চর্য কথা আরো ঘটা ছটা দিয়ে-
রটনা করিল সব গাঁয়ে গাঁয়ে গিয়ে
তখন,
ব্রাহ্মণী ধন্য ধন্য প’ল দেশময়।–
ক্রমে এ কাহিনী
রাজ-কর্ণগোচর হয়
৫
রাজকন্যার লক্ষ টাকার হার পাওয়া যায়
না। কত জ্যোতিষ, কত পণ্ডিত আসিয়া হার মানিল। ‘রুই কাৎলার আটকাট সবই কেবল মালসাট’-
শেষে ডাক বামুনকে।
ঢেঙ্গা ঢেঙ্গা পাইক, এ-ই আশা-সোটা!-বামুন ভাবেন ‘ভাল ভাল ছিলাম বোকা, কপালের না
জানি লেখা’- খাঁড়ার তলে ধাড়ি ছাগল, কাঁপিতে কাঁপিতে বামুন রাজ-সভায় গেলেন।
রাজার হুকুম,-
‘হার গণে দিতে পার পাবে পুরস্কার,
নৈলে বামুন শেষকালে বাস কারাগার।”
সিধা পত্র চুলোয় যাক, পূজা অর্চনা
মাথায় থাক, ব্রাহ্মণ বলিলেন,-“মহারাজ দু’দিন সময় চাই।”
“আচ্ছা।”
দিনের মতন দিন গেল, রাত এল,
এক, ঘরে, বামুনের ঠাঁই
ঘটি ঘটি জল খায় বামুন করে আই ঢাই,-
“হায় মাগো জগদম্বা, বিপাকে ফেলিলি,
ছায়ে পোয়ে সর্বনাশ, প্রাণে ধনে নিলি
কি করি উঠায় মাগো কি করি উপায়-
জগদম্বা! এই তোর মনে ছিল হায়!”
রাজবাড়ীর জগা মালিনী, জগদম্বা নাম,-
সেইখান দিয়া যাচ্ছিল,-
খপ করে থামে জগা-ধুকু ধুকু প্রাণ।
আর কথা, আর বার্তা-“দোহাই ঠাকুর,
দোহাই বাবা!-যা’ বল বাবা তাই করি-রাজার কাছে যেন আমার নামটি করো না!” জগা ছুটিয়া
গিয়া বামুনের দুই পা সাপটিয়া পড়িল।
বামুন চমৎকার!-“এ আবার কি!-কে তুমি কে তুমি! আমি কি করেছি-আমাকে কেন?”
“না বাবা ঠাকুর, তুমি সব জেনেছ, আমি আর এমন কর্ম করব না;- দোহাই বাবা, আমাকে রক্ষা
কর, লোভে পড়ে’ আমি রাজকন্যার হার নিয়েছিলাম।– দোহাই বাবা, পায়ে তোর পড়ি বাবা!”
তখন বুঝিলা
ব্রাহ্মণ, কি করে কি হ’ল-
‘জগদম্বা’ নাম নিতে জগা
ধরা দিল!
তখন, ব্রাহ্মণের ধড়ে এল প্রাণ,- ধীর সুস্থির মহাপণ্ডিত হইয়া বলিলেন,-“যা করেছিস,
করেছিস, তোর ভয় নাই, হাঁড়ির ভিতর যেন হার থাকে; রাখ নিয়া খিড়কী পুকুরের পাঁকে; তাতে
যেন ভুলটি না হয়।”
দুই চক্ষের জল ছেড়ে, জগা বাঁচে,-তখনি হার নিয়া খিড়কী পুকুরে রাখিয়া আসিল।
পরদিন,- গা-ময় তিলক ছাপা চিতা-বাঘের ঠাকুর-জামাই,-তিন নামাবলী গায়ে, তিন নামাবলী
গলায়, বড় বড় রুদ্রাক্ষের মালা, ফুলের ভারে টিকি ঝোলা, খুঙ্গি, পুঁথি, ছাতি, লাঠি,
সকল নিয়া ব্রাহ্মণ রাজার সভায় গিয়া উপস্থিত।
টিকি নাড়ে মন্ত্র
পড়ে, ভঙ্গী ছঙ্গী কত
এ পুঁথি ও পুঁথি
খোলে পুঁথি শত শত!
গণিয়া গণিয়া আঙ্গুল ক্ষয়,-কত শত খড়ি পাতে, কত শত মাটি আঁকে,-অনেক ক্ষণের পর,
“শুন শুন মহাশয়!
পেয়ে গেছি হার,
নিশ্চয় সে
রহিয়াছে পুকুরে তোমার।”
“খোঁজ্ খোঁজ্!”- পুকুরের জল দৈ,-কিন্তু হার মিলিল কৈ?- রাজা বলেন,
“হা রে হা রে,
চতুরালী করেছ বচন,
না রাখ
প্রাণের ভয়, কেমন ব্রাহ্মণ!”
“দোহাই মহারাজ!”- ভ্যাঁ করে’ বামুন কাঁদে আর কি,-
“আমার ভুল নাই, - মহারাজ, তবে সত্যি এ সব জগদম্বার কাজ!” রাজা বলিলেন,-“ঠিক!-হতে
পারে দশার দশা, আচ্ছা, না হয় আবার খোঁজ!-তা, বামুনকে বাঁধ, যেন না পালায়।” আবার
খোঁজ্ খোঁজ-
কাদার তলেতে এক পাওয়া গেল ভাঁড়;
ভেঙ্গে দেখে, ঝলমল হার
মাঝে তার।
পাওয়া গেল, পাওয়া গেল! বামুনের বাঁধ খুলে’ গেল,
সিংহাসন ছেড়ে রাজা পড়ে এসে পায়-
“আজ হতে হৈলা তুমি পণ্ডিত
সভায়।”
আনন্দে ব্রাহ্মণ মূর্ছা-ই গেল। এবার কিন্তু সে চোর ধরার মূর্ছা নয়। তা’ না হক তা’
ভালই,-তা’র পর? তারপর?
ধন রত্ন, মণি মোতি, ছাড়াছড়ি যায়
নিত্য গিয়া বসে ব্রাহ্মণ,
রাজায় সভায়।
দিকে দিকে হতে আসে পণ্ডিত
বড় বড়,
আমাদের পণ্ডিতের নামে ভয়ে
জড়সড়।
রাজা দেন পাদ্য অর্ঘ্য
রাণী দেন পূজা,
জগা নিত্য যোগায় ফুল,-
ঠাকুর পূজেন দশভূজা।
তখন-
ত্রিতল প্রাসাদে সেই আগের
ব্রাহ্মণ
সোনার খাটেতে রন করিয়া
শয়ন।
আর-
তেলে ভাণ্ডার ভেসে যায়,
গায়ে ধরে না গয়না,
ব্রাহ্মণী তো ভারী
খুশী,-হেসে ছাড়া কয়-ই না।
এখন-
রোজই বামুন পিটা খায়-
‘আহা লক্ষ্মী অতি।’
শুনে’ বামনী হেসে কুটি কুটি,-মনের সুখে-
পতিসেবা করিতে লাগিলা সুখে সতী।
১
এক কাঠুরিয়া। ছেলে হয় না পিলে হয় না, সকলে “আঁটকুড়ে আঁটকুড়ে” বলিয়া গালি দেয়, কাঠুরিয়া মনের দুঃখে থাকে।
কাঠুরিয়া-বউ আচারনিয়ম ব্রত উপোস করে,
মা-ষষ্ঠীর-তলায় হত্যা দেয়-“জন্মে জন্মে, কত পাপই অর্জে ছিলাম মা, কাচ্চা হক্ বাচ্চ
হক্ অভাগীর কোলে একটা কিছু দে মা, ভিটে বাতির নি’র্শন থাক।”
কাঁদিতে, কাঁদিতে-মা ষষ্ঠী এক রাতে
স্বপন দিলেন,-“উঠ্ লো উঠ্,
তেল সিঁদুরে না’বি ধুবি, শশা পা’বি শশা
খা’বি।
কোলে পাবি সোনার পুত বুকজুড়ানো মাণিকটুক্।”
কাঁচা পোয়াতীর ঘুম ভাঙ্গে নাই, কাক
পক্ষী মাটি ছোঁয় নাই, ভোর জ্যোছনায়, এক কপাল সিঁদুর আঁজলপূরা তেল মাথায় দিয়া
কাঠুরে- বউ ষষ্ঠীমা’র ঘাটে নাইয়া ধুইয়া ডুব দিয়া আসিল।
আদেশ হইয়াছে, আর কি! “শশা যদি পাস
শশা খাস্” বলিয়া, মনের আনন্দে কাঠুরিয়া কাঠ কাটিতে বনে গেল।
বনে ঝরণার পাড়ে একশ’ বচ্ছুরে
খুনখুনে’ এক একরত্তি বুড়ী! “কে বাছা আঁটকুড়ে’ কাঠুরিয়া? চক্ষেও দেখি না মক্ষেও দেখি
না ছাই,- এই নে বাছা, এইটে নিয়ে বউকে দিস, কিছু যেন ফেলে না, সাতদিন পরে যেন খায়,
চাঁদপানা টলটল হাতী হেন ছেলেটা-কোলজোড়া-ঘর আলো করবে।” এতটুকু এক থলে খুলিয়া ছোট্ট
এক শশা কাঠুরের হাতে দিয়া গুটি গুটি বনের মধ্যে চলিয়া গেল।
আর কাঠ কাটা!-এক দৌড়ে কাঠুরিয়া বাড়ী, “ও অভাগী আঁটকুড়ি! –এই দ্যাখ, এই নে হাতে-পাতে মা-ষষ্ঠীর বর! আজ যেন খাস নি, সিকায় তুলে রাখ, সাত দিন পরে খা’বি।” মনের আহ্লাদে তিন খবল তেল মাথায় দিয়া কাঠুরিয়া নাইতে গেল। কিছু যে ফেলিতে মানা, মনের ভুলে কাঠুরিয়া তা’ বলিয়া গেল না।
“সাত দিন না সাত দিন! মা ষষ্ঠী বলেছেন,- ‘শশা পা’বি শশা খা’বি।’ হাতে পায়ে জল দিয়া “মা ষষ্ঠী, মা ষষ্ঠী” নাম নিয়া, কাঠুরে-বউ বোঁটা সোটা ফেলিয়া কপালে কণ্ঠায় ছোঁয়াইয়া কুচ্মুচ্ শশাটি খাইয়া ফেলিল।
নাইয়া দাইয়া আসিয়া কাঠুরিয়া দাওয়ায় খাইতে বসিবে, দেখে শশার বোঁটাটা!-“ও সর্বনাশি!”-শশা তো খাইয়াছে!-“আ অভাগী কুলোকানি!- করেছিস কি রাক্ষসী!-খেলি তো খেলি, বোঁটা কেন ফেললি! শীগগির তুলে খা!”
“ওমা-কি হয়েছে?” থতমত কাঠুরে-বউ বোঁটা তুলিয়া খাইল। গালে মাথায় চাপড় দিয়া কাঠুরিয়া ভাতের থাল ছুঁড়িয়া ফেলিল।
২
আর কিসে কি!-এত ধর্ণা, এত কর্ণা, কাঠুরে-বউর যে ছেলে হইল-ও মা!- ‘জন্মিতে জন্মিতে বুড়ীর চুল দাড়ি আঠারো কুড়ি। এক দেড় আঙ্গুলে’ ছেলে’, তা’র তিন আঙ্গুলে’ টিকি!
“না বলতে শশা খেলি, বুড়ির শাপে পাতাল
গেলি!” দুই চক্ষু কপালে তুলিয়া রাগিয়া মাগিয়া দড়িকুড়াল নিয়া কাঠুরিয়া একদিকে চলিয়া
যায়!-“সাত দিন পরে খেলে হাতীর মতন ছেলে হইত, বোঁটাটা হাতীর শুঁড় হইত!-তা নয়,-
হয়েছেন এক টিকটিকি,-বোঁটা হয়েছেন তিন আঙ্গুলে’ এক টিকি-এক বিঘত ধানের চৌদ্দ বিঘত
চাল।
কাঠুরে-বউ তো ডুকরিয়া
কাঁদিয়া উঠিল।
“ওঙা, ওঙা!” ছেলে কাঁদে, কে নেয়
কোলে, কে করে যতন, কাঠুরে’ তো গেলই, কাঠুরে-বউ নদীর জলে ঝাঁপ দিয়া মরিতে চলিল-“দিলি
দিলি এমন দিলি! মা ষষ্ঠী, তোর মনে এই ছিল!”
আঙ্গুল চুষিয়া দেড় আঙ্গুলে’ ছেলে
খাড়া হইল! দৌড়িয়া গিয়া তিন আঙ্গুলে’ টিকি দিয়া মায়ের পা জড়াইয়া ধরিয়া বলিল,-“মা,
মা! যাসনি আমায় একটু দুধ দে।”
“মা!- জন্মিয়াই ছেলে কথা কয়!
সামান্যি তো নয় মা, সামান্যি তো নয়!” চোখের জল মুছিয়া “ষাঠ্ ষাঠ্” ধূলা ঝাড়িয়া
কাঠুরে-বউ ছেলে তুলিয়া কোলে নিল।
পেট ভরিয়া দুধ খাইয়া দেড় আঙ্গুলে’
বলিল, “মা, এখন নামিয়ে দে, বাবাকে নিয়ে আসি!”
৩
বাবা কোন্ রাজ্যে কোথায় গেছে,
তুরতুর করিয়া দেড় আঙ্গুলে’ পথ ঘাট ছাড়ায়। পিঁপড়ে আসে, গুবরে আসে, ফড়িং যায়- দেড়
আঙ্গুলে’র সঙ্গে কেউ পারে না; দেড় আঙ্গুলে’ হটিং হটিং করিয়া হাঁটে, ফড়িং ফড়িং
করিয়া নাচে। হাঁটিতে হাঁটিতে, নাচিতে নাচিতে এক রাজার বাড়ীর কাছে গিয়া দেড়
আঙ্গুলে’ দেখে, ঠা ঠা রৌদ্রে মাথার ঘাম পায়ে, তার বাবা, কাঠ কাটিতেছে।
দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“বাবা, আমায় ফেলে
এলি কেন?-বাড়ী চল। মা কত কাঁদছে।”
কাঠুরে অবাক!-ছেলে তো সামান্য
নয়!-বুকে তুলিয়া চুমা খাইয়া বলিল,-“বাপ আমার সোনা কি করে যাই, রাজার কাছে আপনা
বেচেছি।”
দেড় আঙ্গুলে’ রাজার কাছে গেল।
“রাজা মশাই, রাজা মশাই, রাজ-রাজ্যের
কাঠ কাটে কে?”
রাজা-“কে রে তুই?-কাঠ কাটে অচিন
দেশের নচিন কাঠুরে।”
দেড় আঙ্গুলে’-“কাঠুরেটি
কোথায় থাকে?
কাঠুরেটি দাও না মোকে।”
রাজা-“নিয়ে এল হাটুরে’, কড়ি দিয়ে
কিনলাম কাঠুরে’-
ব্যাটা বড় মস্তকী, সেই কাঠুরে’ তোরে
দি।”
দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“তবে কি?”
রাজা-“নিয়ে এসে কড়ি,
তবে আসিস রাজ-রাজড়ার পুরী।”
শুনিয়া, দেড় আঙ্গুলে’ গিয়া বলিল,-“বাবা, তুমি কিছু ভেবো না, আমি দেখি, কড়ি আনতে চল্লাম।”
৪
ভাঁটার মতন ছোটে, কুতুর কুতুর
হাঁটে-একখানে আসিয়া দেড় আঙ্গুলে’ দেখিল; এক খাল। কেমন করিয়া পার হইবে? বসিয়া বসিয়া
দেড় আঙ্গুলে’ ভাবিতে লাগিল।
পিছনে, টিকিতে ইয়া এক টান!- “হেই দেড়
আঙ্গুলে’ মানুষ তিন আঙ্গুলে’ টিকি! তুই কে রে?” টিকির টানে চিৎপটাঙ, তিন গড়াগড়ি
দিয়া উঠিয়া চটিয়া মটিয়া দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“আমি যে হই সে হই, তুই বেটা কে রে?”
ব্যাঙ বলিল,-“ব্যাঙ রাজার রাজপুত্তুর
রঙ, সুন্দর ব্যাঙ।”
দেড় আঙ্গুলে বলিল,-“তোর নাক কাটব কান
কাটব,
কাটবো দুটো ঠ্যাং।”
ব্যাঙ “হো হো” করিয়া হাসিয়া ফেলিল,-
“টিং টিঙা টিং টিঙা। কাটবি কি তুই
ঝিঙা।
নাকও নাই, কানও নাই, ঘ্যাঙর
ঘ্যাঙ্গ্ ঘিঙা।”
বলিয়া ব্যাঙ নাচিতে লাগিল। দেড়
আঙ্গুলে’ বড়ই ঠকিয়া গেল।
নাচিয়া নুচিয়া ব্যাঙ বলিল-“ভাই, তুই
কি রে?”
“কাঠুরে।”
“তবে তোর কুড়ুল কৈ রে?”
“নাই রে!”
“দুয়ো!-উতরে এক কামার আছে, এক কড়া
কড়ি দিয়া কুড়ুল নিয়া আয়।”
দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“না ভাই, আমি কড়ি
কোথায় পাব? কড়ি নাই বলেই তো বাবাকে আনতে পারলেম না। আমি ছোট ছেলে মানুষ, আমার কিছু
আছে কি না। তোর থাকে তো ধার দে না ভাই?”
“ও বাবা”-ব্যাঙ চমকিয়া উঠিল-“আমার
মোটে কানা এক কড়ি, তাই তোমাকে দি!-ঘ্যাংঙ ঘ্যাংঙর ঘ্যাঙ।”-লাফে লাফে ব্যাঙ চলিয়া
যায়।–“তা যদি কুড়ুল আনিস তো-”
দেড় আঙ্গুলে’
বলিল,-“আচ্ছা,-কুড়ুল-কোন্ পথে বলিয়া দে।”
“তবে যা!”
পথের কথা বলিয়া দিয়া ব্যাঙ কচুর পাতার নীচে বসিয়া রহিল।
একখানে এক ছোট্ট ঘর, তারি মধ্যে এক
আড়াই আঙ্গুলে’ কামার তিন আঙ্গুল দাড়ি নাড়িয়া এক পৌনে আঙ্গুল কুড়াল আর এক কাস্তে
গড়িতেছে। কড়ি নাই ফড়ি নাই, কি দিয়া কি করে?-তা কুড়ুল না নিলেও তো নয়! চুপ্টি
চুপ্টি, আড়াই আঙ্গুলে’ কামারের পিছনে গিয়া, দাড়ির সঙ্গে টিকিটি বাঁধিয়া দিয়া দেড়
আঙ্গুলে’ “চ্যাঁ ম্যাঁ” করিয়া চেঁচাইয়া একলাফে একেবারে আড়াই আঙ্গুলে’র ঘাড়ে!
“আ-আ আমঃ! রাম রাম-
দুগ্গা-দুগ্গা!! দুগ্গা!!!” বুড়া ছিটকাইয়া উঠিয়া ডরে ঠি ঠি করিয়া কাঁপে। কি না
কি,-ভূত না প্রেত!!
হাসিতে হাসিতে পেট ফাটে, হাসিতে
হাসিতে গলিয়া পড়ে, নামিয়া আসিয়া দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“কামার ভাই, কামার ভাই; ডরিও
না, তোমার সঙ্গে মিতালী!”
মিতালী আর ফিতালী-আড়াই আঙ্গুলে’ খুব
রাগিয়া গিয়াছে, বলিল, -“কে রে তুই? ঘরে যে উঠিয়াছিস, কড়ি এনেছিস?”
ও বাবা! সকলেই কড়ি!-“সে কি ভাই, কড়া
কড়ি আবার কিসের?”
“আমার ঘরে উঠলেই কড়ি!”
“তবে ভাই টিকি খুলিয়া দাও, আমি যাই!”
আড়াই আঙ্গুলে’ টিকি খুলিতে খুলিতে
টিকির এক চুল ছিঁড়িয়া গেল। চোখ রক্ত করিয়া তখন দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“এইও বড়ো! আমার
টিকি ছিঁড়লি যে!-এইবার কড়ি ফ্যাল।”
কামার বুড়ো ভ্যাবাচাকা;
বলিল,-“অ্যাঁ-অ্যাঁ-তা’ ভাই, কড়ির বদল কি নিবে নাও।”
তখন দেড় আঙ্গুলে’ কড়ির বদলে কুড়ুলটি
চাহিয়া, বলিল,-“আজ থেকে তোমায় আমায় মিতালী।”
কুড়ুল আনিলে ব্যাঙ বলিল,-“ভাই দেড়
আঙ্গুলে’, আমি ব্যাঙ-রাজার ব্যাঙ রাজপুত্র, এক কুনোব্যাঙী বিয়ে করেছিলাম, তাই বাবা
আমাকে বনবাস দিলেন। আমার কুনোরাণী ঐ ভেরেণ্ডা গাছে লাউয়ের খোলসের মধ্যে,-তার সঙ্গে
আর কিছুই নাই, কেবল এক ঘাসের চাপাটী আর এক সাতনলা আছে। তুমি ভাই গাছটা কাটিয়া আমার
কুনোরাণীকে পড়িয়া দাও।”
বলতে না বলতে পৌনে আঙ্গুল’ কুড়ুল ঠকাঠক! দেখিতে দেখিতে হড়্ মড়্ করিয়া গাছ পড়িল।
খোলসটি কিনা মস্ত বড় উঁচু? হাঁ করিয়া খাড়া হইয়া খাড়া হইয়া রহিল! টানিয়া টুনিয়া
ব্যাঙ বলিল,-“ভাই, এত করিলে অত করিলে, সব মিছা!” চক্ষের জলে ব্যাঙের বুক ভাসে।
দেড় আঙ্গুলে’ বলিল-“রও!” চট্পট ডালের উপর উঠিয়া চিৎ হইয়া, টিকিটি খোলসের মুখে
ঝুলাইয়া দিয়া বলিল,-
“কুনোরাণী, কুনোরাণী জেগে আছ কি?
শক্ত করে ধরে উঠ, সিঁড়ি দিয়েছি।”
টিকি ধরিয়া কুনোরাণী উঠিয়া আসিল!
ব্যাঙ বলিল.-“ভাই, ভাই, আমার কানা
কড়িটি নাও। এইটি দিয়ে তোমার বাপকে কিনিয়া নিও।”
কুনোরাণী বলিল,-“রাজার জামাই দেড় আঙ্গুলে’, আমার এই থুথুটুকু নাও, রাজার কানা
রাজকন্যা-ইহাই নিয়া রাজকন্যার কানা চোখ ফুটাইও!”
সাতনলা আর খোলসটি বলিল.-
“রাজার জামাই দেড় আঙ্গুলে’ সাবাস সিপাহি!
মোদের নাও সাথে করে’ পাবে রাজার ঝি।”
সব নিয়া দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“এখন ভাই
আসি?”
৫
আবার হটিং হটিং, আবার ফটিং ফটিং;
রাজার কাছে গিয়া দেড় আঙ্গুলে’ হাঁক ছাড়িল,-
“রাজা মশাই, রাজা মশাই, কড়ি গুণে’ নাও,
আপন কুড়ি বুঝ পড়; কাঠুরেটি দাও।”
রাজা কড়ি গুণে, বুঝে নিয়ে,- টিকিতে তিন টান, দুই গালে দুই চাপড়, দেড় আঙ্গুলে’কে
খেদাইয়া দিলেন,-
“তের নদীর পারে আছে সাত চোরের থানা,
তারি কাছে দিব বিয়ে রাজকন্যা কানা।
সেই চোরদিগে আগে নিয়ে এসে, কথা ক’।”
দেড় আঙ্গুলে’ আবার ব্যাঙের কাছে
গেল,-
“রঙসুন্দর রাজপুত্তুর কোথায় আছ ভাই!
তের নদী পার হব, দুটো কড়ি চাই।”
ব্যাঙের তখন মেলাই কড়ি; বলিতে না বলিতে ব্যাঙ কড়ি আনিয়া দিল। দুই কড়ির এক কড়ি দিয়া
দেড় আঙ্গুলে’ তের নদী পার হইয়া, কোথায় সাত চোর, তাদের খোঁজে চলিতে লাগিল!
সারাদিন খুঁজিয়া পাইল না,-অনেক দূরে এক উইয়ের ঢিপির কাছে গিয়া সন্ধ্যা। সারাটি দিন
খায় নাই, আজো বাবাকে পায় নাই; গা অলস, মন অবশ, উইয়ের ঢিপির তলে কুড়ুল শিয়রে দিয়া
দেড় আঙ্গুলে শুইতে শুইতেই ঘুমাইয়া পড়িল।
অনেক রাত্রে, সাত চোর তো নয়,-সাড়ে সাত চোর সেইখান দিয়া চুরি করিতে যায়। অন্ধকারে
কিছু দেখে না, সাড়ে সাত চোরের আধখানা-চোর ছোট-চোরের পা দেড় আঙ্গুলে’র ঘাড়ে পড়িল;
ধড়্মড়্ উঠিয়া দেড় আঙ্গুলে’ চোরের পায়ে কুড়ুলের এক কোপ।–“কে রে ব্যাটা নিমকানা,
চলেন তিনি পথ দেখেন না।”
ছোট চোর হাঁউ হাঁউ করিয়া চেঁচাইয়া
তিন লাফে সরিয়া গেল; সকল চোর অবাক,-জন নাই প্রাণী নাই, মাটির নীচে কথা! “দোহাই বাবা
দৈত্য দানা, ঘাট হয়েছে, আর হবে না।”
শুনিয়া দেড় আঙ্গুলে’ বড় খুসী হইল, বলিল,-“যাক ভাই, যাক ভাই-তা ভাই, তোরা কে রে?”
সাড়ে সাত চোর বলে,-“আমরা সাড়ে সাত চোর,-
মাটি ফুঁড়ে কথা কও, তুমি তো ভাই কম নও,
তুমি ভাই কে?”
“আমি ভাই, মানুষ,- এই যে আমি, এই
যে!- তোমরা ভাই, কোথা যাচ্ছ ভাই?”
উঁকি ঝুঁকি, হাতাড়ি পিতাড়ি-শেযে ছোট্ট চোর দেখে- ও বাব্বা-এক একটুখানি দেড়
আঙ্গুলে,’ তার আবার
কুড়ুল হাতে! হাত তুলিয়া চোখের কাছে নিয়া দেখে,-ওঁম্মা!-
তিনি আবার টিকি ফর্ ফর্ তিন ভঙ্গী
রাগে গর্ গর্-
টিকির আগে ভোমরা, ইনি আবার কোন্ দেশী চেঙ্গরা?
হো হো! হি হি! হু হু! হা হা! হে হে!
হৈ হৈ! হৌ হৌ!!-হঃ হঃ। সাড়ে সাত চোরে যে হাসি। গলিয়া ঢালিয়া গড়া-গড়ি!!
শেযে কোন মতে তো হাসি থামুক; চোরেরা বলিল,-“চল্ রে চল্ আড়াইয়ের বাড়ীতে যাই।”
দেড় আঙ্গুলে’ জিজ্ঞাসা করিল,-“আড়াইয়ে কে ভাই?”
“তুই হলি দেড়কো, তুই জানিস নে? ওপারে আড়াইয়ে এক কামার আছে, সাড়ে সাতটা সিঁদ-কাটি
দিবে, ব্যাটা রোজ ফাঁকি দেয়, আজ সেই বুড়োকে দেখাব।”
দেড় আঙ্গুলে’ দেখিল,-ওরে! তা’র সঙ্গে আমার মিতালী, তারি ঘরে সিঁদ দেবে?-বলিল,-
“ও ভাই! সে বাড়ী যাস নি,
সে বাড়ীতে আছে শাকচুন্নী;
ঘাড়টি ভেঙ্গে রক্ত খাবে,
সাড়ে সাত গুষ্টি এক্কেবারে যাবে।
তা’ তো নয়, রাজকন্যা বিয়ে করিস তো,
রাজার বাড়ী চল।”
চোরেরা “হি হি হি! হে হে হে! হৈ হৈ হৈ! সে তো ভালই, সে তো ভালই!” তা রাজার জামাই
হবে, তারা কি যে সে! গোঁফে তা, গায়ে মোড়ান চোড়ান, বলিল,-“তা
যেখানে যেতে উথাল পাতাল তের নদীর জল।”
দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“কেন, এই যে ওপার
যাচ্ছিলি!”
“যাচ্ছিলুম তো যাচ্ছিলুম, করতে যেতুম চুরি,-
রাজার জামাই হব, তাও দিয়ে আপন কড়ি?”
দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“আচ্ছা, একটা কড়ি আছে, নিয়ে চল!”
কড়ি নিয়া ভারী খুসী সাড়ে সাত চোর নদীর পাড়ে দিয়া ডাকিল,-
“হেই হেই পাটনি! রাত জাগা খাটুনী,-
করবি পার পাবি কড়ি তাতে কেন
গড়িমড়ি?-
পাটনী না পাটুড়ী বজ্জর বাঁধের আঁটুনী।
কানা কড়ির আশটা কানা কড়ির বাসটা
রাজবাড়ীর মাছটা বিড়ালে খায়,
হেদে হেদে পাটনি, ঝট্ পট্ পার করে
নে ভাঙ্গা নায়!!”
কড়ি নিয়া, পাটনী ভাঙ্গা নায়ে করিয়া পার করিয়া দিল।
নামিবার সময় চোরেরা আবার কড়িটি চুরি করিয়া নিল। দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“না ভাই, কড়ি
ফিরিয়ে দিয়ে এস।”
“হুঁ! দিব না তো কি, সাত হাঁড়ি ঘি!” চোরেরা মুখটা নাড়া দিয়া উঠিল। দেড় আঙ্গুলে’ আর
কিছুই বলিল না।
যাইতে যাইতে রাজার বাড়ী। দেড় আঙ্গুলে’ গিয়া রাজার দুয়ারে ঘা দিল,-
“রাজামশাই, রাজামশাই, খাট পালঙ্ক ছাড়,
পার হয়ে না দেয় পারের কড়ি, কেমনে ঘুম
পাড়?”
চোরেরা থরথর কাঁপে। রাজা বলিলেন,-“কে! পারের কড়ি না-দেয় তারে শূলে চড়িয়া দে।” সাড়ে
সাত চোর শূলে গেল।
“শূলে গেল কি সাত চোরেরা? হায়! হায়! হায়!” রাজা কাঁদেন, রাণী কাঁদেন, কানা কন্যা
কাঁদেন, দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“চোর তো আমি এনে দিয়েইছিলাম, তা’ রাজকন্যার বর হবে, না,
আপন দোষে শূলে গেল,-তা’র আমি জানি কি? রাজামশাই, কাঠুরে’ দাও!”
“কিরে!-বারে বারে ভ্যান্ ভ্যান্ বারে বারে ঘ্যান্ ঘ্যান্!
দে তো নিয়ে ক্ষুদে’টাকে চোরেদের
সঙ্গে!”
ফুট্!-দেড় আঙ্গুলে’কে কেউ খুঁজিয়াই পাইল না।
চোরের রাজ্যে, চোরের রাজা, সাড়ে সাত চোরের শূলের কথা শুনিল। নায়ে নায়ে ভরা দিয়ে যত
রাজ্যের চোর আসিয়া রাজার রাজপুরীময় চুরি আরম্ভ করিল। সিপাহী শান্ত্রী ধোঁকা, রাজা
হলেন বোকা!- নিতে নিতে-
চাটি নিল বাটি নিল, সব নিল চোরে,
মাটি পেতে পান্তা খান, রাজা মনে মনে
পুড়ে’।
তখন,-“চোরের বাদী সেই ক্ষুদে’
তারে এখন এনে দে!”
কোথায় বা ক্ষুদে,’ কোথা খুঁজিয়া পায়!
দেড় আঙ্গুলে’ ঘাসবন থেকে হাসিতে হাসিতে আসিয়া বলিল,-“রাজামশাই, রাজামশাই,
এত এত সিপাই চোরের কাছে
ঢিপাই;
আমার কাছে ঘুরসুড়নি এমন
সিপাই জন্মেও নি।
তা’ যদি বল’ তো সব চোর তাড়িয়ে দি!”
“আচ্ছা, কি
চাও?”
“রাজকন্যা
চাই।”
“ইস্ কথা দেখ!-আর কি?”
“পুরীর রাজা হুলো বেড়ালটি।”
“আর কি?”
“পোযাক আষাক, হীরের পাগড়ী।”
রাজা সব দিলেন, কেবল বলিলেন,-“চোর যদি ছাড়ে পুরী, তবে কন্যা দিতে পারি।” কানা কন্যা
গেলেই কি, থাকলেই কি।
তখন কেশ-বেশ পোষাক করিয়া, হুলোবেড়াল ঘোড়া, সাতনলা হাতে, টিকির নিশান মাথে, টিকিতে
খোলস বেঁধে, দেড় আঙ্গুলে’ চোরের রাজ্যে গিয়া হানা দিল।
কোথা দিয়া কোথা দিয়া যায়, বিড়ালে হাঁড়ি খায়,-যত চোরনী পরেশান! খোনা, খুন্তি, পোলো,
থোলো, রায়বাঁশ, গলফাঁস, সকল নিয়া রাজ্যের যত চোর অলিতে গলিতে খাড়া হইল, খানা খুঞ্জি
ঘিরিয়া দাঁড়াইল। দেড় আঙ্গুলে’ বলিল,-“আচ্ছা রও!
সাতনলা, সাতনলা, করছ এখন কি?
চুপটি করে আছ কেন লাউয়ের খোলসটি?’
সাতনলা বলিল,-“কি?”
খোলস বলিল,-“কি?”
নল চিরিয়া হাজার চুল, খোলস ফেটে ভীমরুল! চেরা চেরা নল সূঁচ হেন ছোটে, ভীমরুলের হুল
পুট্পুট্ ফোটে।–
“আঁই মাঁই কাঁই; বাবা রে! মা রে! তালুই রে! শ্বশুর রে।”-চোরের রাজ্যে হুড়াহুড়ি
গড়াগড়ি, লটাপটি ছুটাছুটি!- তিন রাত্তিরে ঘর দোর ফেলে যত চোর চোরনী দেশ ছেড়ে পালিয়ে
পুলিয়ে দূর!-চোরের রাজা ‘চ্যাং পিছলে’; চ্যাং পিছলেকে বাঁধিয়া নিয়া দেড় আঙ্গুলে’
টিকি ফরর্ ফরর্ পাগড়ী ফুলাইয়া নল ঘুরাইয়া রাজার কাছে গেল,-
“রাজামশাই, রাজামশাই, রাজকন্যা আর
কাঠুরে দাও।”
তখন রাজা বলেন,-“তাই তো! তাই তো!-
বীরের চূড়া পিপ্পল কুমার, এস রে
বাপ, এস,
তোমার তরে রাজ্য ধন, সিংহাসনে
বস।
কন্যা আছে চোখ-বিঁধুলী, দিলাম তোমার দান-
কাঠুরেরে আন দিয়ে পুষ্পরথ
খান।”
পুষ্পরথে চড়িয়া কাঠুরিয়া
আসিল।
তখন, কুনোরাণীর থুথু দিয়া দেড় আঙ্গুলে’ পিপ্পল কুমার রাজকন্যার চোখ ফুটাইল;-ব্যাঙ
এল, কুনোরাণী এল; দেড় আঙ্গুলে’ গিয়া কামার মিতাকে আনিল। ধুম ধাম বিয়ে সিয়েয়
রাজ-রাজ্য তোল-পাড়!
লাফে লাফে ব্যাঙ
নাচে,
দাড়ি নাড়িয়া কামার
হাসে।
মায়ের দুঃখ গেল, বাপকে সোনার কুড়ুল গড়ে’ দিল; তখন রাজা শ্বশুর, রাণী শাশুড়ী, জামাই
বেয়াইকে’ রাজ্য দিয়া; তপস্যায় গেলেন;-দেড় আঙ্গুলে’ পিপ্পল কুমার এক বেলা রাজ্য করে,
এক বেলা বাপের সাথে কাঠ কাটে-
খুট্-খুট্-খুট্!!