নবরাগ
নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে প্রকাশিত
কাজী নজরুল ইসলাম সুস্থ থাকাকালীন সময়ে তিনটি স্বরলিপি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। এই গ্রন্থ তিনটি হলো- নজরুল-স্বরলিপি (১৯৩১), সুরলিপি (১৯৩৪) এবং সুর -মুকুর (১৯৩৪)। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে 'নবরাগ' নামক স্বরলিপি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির পরিবেশক ছিল কলকাতার হরফ প্রকাশনী আর প্রকাশক ছিলেন বেগম মাশহুদা। গ্রন্থটিতে মোট ৩০টি গানের স্বরলিপি গৃহীত হয়েছিল। এর ভিতরে ২৪টি গানের স্বরলিপি জগৎ ঘটক, ৪টি গানের স্বরলিপি করেছেন কাজী অনিরুদ্ধ এবং ১টি করে গানের স্বরলিপি করেছেন অরুণা মজুমদার ও শুভ্রা মিত্র। এই গ্রন্থের কয়েকটি ছিল নজরুল-সৃষ্ট রাগে নিবদ্ধ গানের স্বরলিপি।
এই গ্রন্থের প্রথম মুদ্রণে জগৎ ঘটক যে ভূমিকা পত্রটি লিখেছিলেন, তা নিচে তুলে ধরা হলো।
"সংগীত শাস্ত্রের কয়েকটি রাগকে অবলম্বন করে যুগ যুগ ধরে নব নব রাগের উদ্ভব হয়ে এসেছে। এইরূপে সৃষ্টি হয়েছে ছয় রাগ ও ছত্রিশ রাগিণীর এবং পরবর্তীকালে আরও নব নব রাগের উদ্ভব হয়ে মার্গ সংগীতের ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়ে পড়েছে। অধুনা শ্রেষ্ঠ সংগীত-সাধকগণ এইভাবে অনেক রাগের সৃষ্টি করে ভারতীয় সংগীত ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধশালী করে তুলেছেন ।
কবি কাজী নজরুলও এইভাবে কয়েকটি রাগের সৃষ্টি করে বাংলা গানের ওপর সেই সুর আরোপ করে বাংলা গানের ভাণ্ডারও সমৃদ্ধ করেছেন। উত্তরকালে যখন তিনি রাগ-সংগীত অবলম্বন করে বাংলা গান রচনায় আত্মনিয়োগ করেন, সেই সময় তাঁর ভাব-সমাহিত মনের অবচেতনায় কয়েকটি নতুন রাগ-সৃষ্টির প্রেরণা পান। এই সময়ে তিনি দুর্লভ সংগীত গ্রন্থ সংগ্রহ করে বহু অপ্রচলিত রাগের গান রচনায় তন্ময় হয়ে যান, এবং সেই সকল গানে সুরারোপের সঙ্গে সঙ্গে আমাকে দিয়ে স্বরলিপি করাতে থাকেন। এই গানগুলি রচনাকালে তাঁর হারামণি, নবরাগ প্রভৃতির সৃষ্টি। 'নব-রাগ' তাঁর স্বরচিত রাগের গানগুলি দ্বারা পূর্ণ করবার বাসনা ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মাত্র কয়েকটি গানই রচিত হয়েছিল। এই স্বরলিপির বইতে সেই কয়টি রাগের গান দেওয়া হল; কিন্তু গানগুলি একখানি স্বরলিপির বইতে পর্যাপ্ত না হওয়ায় এর সঙ্গে আরও কয়েকখানি অপ্রচলিত রাগের গান যোগ করেছি। নতুন রাগগুলি সম্বন্ধে কবি বলতেন— এগুলো আমার 'স্বপ্নে পাওয়া' রাগ। মার্গ সংগীত রচনাকালে তাঁর একনিষ্ঠ মন আহার নিদ্রা ভুলে এমনি বিভোর হয়ে থাকতো যে, নিদ্রাকালেও তিনি ওরই স্বপ্ন দেখতেন। সেই সময়ে তিনি অবচেতন মনে এইসব নতুন রাগের যে আভাস পেতেন, তাকেই অবলম্বন করে তাঁর এই সকল গান-রচনা। কবির ইচ্ছা ছিল যে আমি তাঁর এইসব রাগগুলি দিয়ে একখানি পৃথক স্বরলিপির বই রচনা করি। তাই কয়েকখানা ছাড়া ঐ গানগুলি কোনো সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়নি। এই রাগগুলির তিনি নামকরণ করেছিলেন —অরুণ-রঞ্জনী, দেবযানী, মীণাক্ষী, সন্ধ্যামালতী, অরুণ-ভৈরব, আশা-ভৈরবী, শিবানী-ভৈরবী, রুদ্র-ভৈরবী, যোগিনী, নির্ঝরিণী, রূপ-মঞ্জরী, বনকুন্তলা, উদাসী-ভৈরব ইত্যাদি। সবগুলির স্বরলিপিই এই বইখানিতে আছে ।
বহুকাল পূর্বের কথা। উদাসী ভৈরব নামে একখানি নাটিকা, বেতারে অভিনীত হবার জন্যে কবি আমাকে দিয়া লিখিয়েছিলেন— এবং এর ছয়খানি গান তিনি রচনা ও উহাতে সুরারোপ করেন। সুরগুলি রাগ-ধর্মী ও তাঁর সৃষ্ট নবরাগ। বাসন্তী বিদ্যাবীথির প্রযোজনায় নাটিকাটি বেতারে সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে গানগুলি অপ্রকাশিতই রয়ে গেল। বর্তমান গ্রন্থে সেগুলি সংযোজিত হলো। গানগুলি— অরুণ-ভৈরব, আশা-ভৈরব, শিবানী-ভৈরবী, রুদ্র-ভৈরব, যোগিনী ও উদাসী-ভৈরব।
এছাড়া এই বইতে আছে কতকগুলি অপ্রচলিত রাগের গান বা কবির রচনা। পাছে পরে সুরের কোনো তারতম্য ঘটে সেইজন্য তিনি প্রতিটি গান রচনাকালে আমাকে সঙ্গে নিয়ে বসতেন ও সঙ্গে সঙ্গে স্বরলিপি করিয়ে নিতেন। এইসব গান কোথাও গাইবার প্রয়োজন হলে তিনি আমার কাছ থেকে স্বরলিপির পাণ্ডুলিপি নিয়ে যেতেন ও তার সাহায্যে গাইতেন। এইভাবে একদিন আমার এক স্বরলিপির পাণ্ডুলিপি কবি রেডিওতে demonstration দেবার পর অন্যমনস্কভাবে কোথায় হারিয়ে ফেলেন, সে শোক তিনি অনেক দিন ভুলতে পারেননি। তিনি বড় দুঃখেই আমার কাছে বলেছিলেন,— 'যে জিনিস গেল, আর কোনোদিন ফিরে আসবে না, সে রচনাও আসবে না, সুরও নয়।' এরপর মনের দুঃখে তিনি কয়েকদিন শয্যাও নিয়েছিলেন— মনে পড়ে ।
যাই হোক, স্বরলিপি যথাসম্ভব সরল অথচ যথাসম্ভব আলঙ্করিক স্পর্শ দিয়ে তৈরি করা আছে। সুতরাং সকলেই এর সাহয্যে গানগুলির প্রকৃত সুর তুলতে পারবেন বলে আশা করি। খেয়াল ঢংয়ের গানগুলিতে গায়কীর কাজ লাগাবার যথেষ্ট অবকাশ আছে, কিন্তু লক্ষ্য রাখতে হবে যে তাতে মূল সুর ব্যাহত না হয়। কবি নজরুল কখনও চাইতেন না যে তাঁর গানগুলির মূল কাঠামো গায়কীর আতিশয্যে ক্ষুণ্ণ হয় বা সুরান্তরে পরিণত হয়। কিন্তু ইদানিং গাইবার কালে অনেকেই তাঁর গানগুলির সুরের ব্যতিক্রম ঘটাচ্ছেন। এটা দুঃখের বিষয় ও আদৌ বাঞ্জীনীয় নয়। কবি সুস্থ থাকলে তিনি শুধু দুঃখিতই হতেন না, হয়তো এটা বন্ধ করবার কোনো পন্থা নিশ্চয়ই নিতেন।
এই বইতে আমার পরম স্নেহভাজন ও সন্তান-সম, কবির কনিষ্ঠ পুত্র কাজী অনিরুদ্ধের কয়েকটি স্বরলিপিও শেষের দিকে যোগ করে দিলাম। এই গানগুলি যথাক্রমে— 'না মিটিতে আশা', 'জানি জানি প্রিয়', 'তুমি সুন্দর তাই', 'স্বপ্নে দেখি একটি নূতন ঘর'।
শ্রীমতি অরুণা মজুমদার 'নীলাম্বরী শাড়ী পরি' গানটির স্বরলিপি করেছেন, আর 'শাওন আসিল ফিরে' গানটির স্বরলিপি করেছেন আমার স্নেহভাজন কল্যাণীয়া শ্রীমতী শুভ্রা মিত্র। গান দু'খানির স্বরলিপি অনুজোপম আবদুল আজীজ আল্-আমান্-এর একান্ত আগ্রহে দেওয়া হলো। অসুস্থতার জন্য আমার পক্ষে সত্বর স্বরলিপি তৈরী করে প্রেসে পাঠানো সম্ভব না হওয়ায় স্বরলিপি দু'খানি শ্রীমতী অরুণা ও শ্রীমতী শুভ্রাকে দিয়ে রচিত হলো। অবশ্য স্বরলিপি আমি দেখে দিয়েছি। এঁদের জন্য আমার সস্নেহ আর্শীবাদ ও ধন্যবাদ রইল ।
পরিশেষে,এই বইখানির প্রকাশে যাঁরা সহায়তা করেছেন তাঁদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ।
জগৎ ঘটক।
এই গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল নজরুল ইসলামের ৭৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মে। এই সংস্করণটিও প্রকাশ করেছিল হরফ। নবরাগের প্রথম সংস্করণ কিছু ভুল ছিল। সে সকল ত্রুটি সংশোধন করে নবরাগের দ্বিতীয় সংস্করণটি প্রকাশিত হয়।
এই গ্রন্থে গৃহীত গানের তালিকা
জাগো অরুণ-ভৈরব জাগো হে [গান-১৪০০] [তথ্য]
দেবযানীর মন প্রথম প্রীতির কলি জাগে [গান-১৪৯১] [তথ্য]
দোলন চাঁপা বনে দোলে [গান-১৪৯৩] [তথ্য]
ভগবান শিব জাগো জাগো [গান-১৬৩৯] [তথ্য]
মৃত্যু নাই, নাই দুঃখ আছে শুধু প্রাণ [গান-১৬৭৮] [তথ্য]