আলবেনিয়া
ইংরেজি নাম:
Albania
রাষ্ট্রীয় নাম:
  Republic of Albania। 
সাংকেতিক নাম:
AL, ALB
রাজধানী: তিরানা।

আলবেনীয়ার লোকেরা নিজেদের দেশকে শকিপারিয়া (ঈগলের দেশ) নামে ডাকে। কিন্তু এই নামটির উৎস নির্ধারণ করা যায় নি। অনেকে মনে করে যে, শকিপারিয়া নামটি ১৬শ শতকে আলবেনিয়া নামটিকে প্রতিস্থাপন করে। খ্রিষ্টীয় ৮ম থেকে ১১শ শতকের মধ্যে ইলিরিয়া ধীরে ধীরে আলবেনিয়া নামে পরিচিত হতে শুরু করে। নামটি এসেছে মধ্য আলবেনিয়াতে বসবাসকারী আলবানোস জাতির লোকদের নাম থেকে।

আয়তন: ৮,৭৪৮ বর্গ কিমি, ১১,১০০ বর্গ মাইল। আয়তনের বিচারে ১৪৩তম বৃহত্তম রাষ্ট্র।
সীমানা: উত্তরে মোন্টেনেগ্রো, কোসোভা, পশ্চিমে মেসোডোনিয়া, গ্রিস, পূর্ব-দক্ষিণে
আর্ড্রিয়াক সাগর।

ভৌগোলিক বিবরণ: আলবেনিয়ার সমুদ্রতটরেখার দৈর্ঘ্য ৩৬২ কিলোমিটার। এর সামুদ্রিক বিস্তার ১২ নটিকাল মাইল। ২৭৫৪ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট গোলেম কোরাব সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। ৩৩৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দ্রিন নদী। ৫৩০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের শ্‌কোডের হ্রদ বৃহত্তম জলাধার। আলবেনিয়ার প্রায় ৭০% এলাকা পার্বত্যভূমি। বাকিটুকু সমুদ্র-উপকূলীয় সমভূমি। কিন্তু সমভূমি হলেও এর অল্পাংশই কৃষিকাজের যোগ্য।

জনসংখ্যা: ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের উপাত্ত অনুযায়ী আলবেনিয়ার জনসংখ্যা ৩১,৯৫,০০০। বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ০.৫৪৬%। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে জনবসতির ঘনত্ব ১১১ জন।

ভাষা:
আলবেনিয়ায় শতকরা ৯৫% শতাংশ লোক আলবেনীয় ভাষার কোনো না কোনো উপভাষায় কথা বলে। এর ভিতরে দক্ষিণে আলবেনিয়ায় তোস্ক এবং উত্তর আলেবনিয়া ঘেগ উপভাষার লোকের সংখ্যা বেশি। এই দুটি উপভাষা উপর ভিত্তি করে আদর্শ আলবেনীয় ভাষা গঠিত হয়েছে। এর পরে দ্বিতীয় ভাষা হলো গ্রিক। এছাড়া ম্যাসিডোনীয় ভাষা ও সার্বো-ক্রোটীয় ভাষাতেও স্বল্পসংখ্যক লোক কথা বলেন। আলবেনিয়ার গণমাধ্যমের ভাষা আলবেনীয়। তবে রেডিও তিরানা আটটি ভাষায় প্রোগ্রাম সম্প্রচার করে। এছাড়া অনেক আলবেনীয় স্যাটেলাইটের সাহায্যে ইতালীয় ও গ্রিক টিভির অনুষ্ঠান দেখে থাকেন।

ধর্ম: সরকারিভাবে আলবেনিয়ার জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুকের দেয়া তথ্য মতে, দেশটিতে ৭০ শতাংশ মুসলিম, ২০ শতাংশ অর্থোডক্স এবং ১০ শতাংশ রোমান ক্যাথলিক মানুষ রয়েছে।

শিক্ষা: আলবেনিয়া তুর্কি সাম্রাজ্যের অধীনে থাকার সময় শিক্ষার হার ছিল ৮৫ শতাংশ। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়টুকুতে দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দেশটির শিক্ষার হার বাড়াতে ব্যাপকাকারে উদ্যোগ নেওয়া হয়। দেশটিতে বর্তমান শিক্ষার হার ৯৮.৭ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষদের শিক্ষার হার ৯৯.২ শতাংশ এবং নারীদের শিক্ষার হার ৯৮.৩ শতাংশ। দেশটির প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে তিরানার ইউনিভার্সিটি অব আলবেনিয়া।

প্রতিরক্ষা বাহিনী
১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের হিসাব অনুসারে, ৬৫ হাজার সেনাসদস্য ছিল। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে এ সংখ্যা নামিয়ে নিয়ে আসে ১৪ হাজার ৫০০ আনা হয়। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে পুরনো বেশ কিছু অস্ত্র তারা ধ্বংস করে। ২০০৮ সালে দেশটি সেনাবাহিনী সংস্কারে জিডিপি'র ২.৭ শতাংশ খরচ করেছিল। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে দেশটি ন্যাটোর সাথে কাজ করতে শুরু করেছে।

ইতিহাস: যতদূর জানা যায়, বর্তমান আলবেনিয়া অঞ্চলে ইলিরীয় জাতির লোকেরা বসবাস করতো। পরে দক্ষিণ বলকান অঞ্চলে গ্রিক, রোমান ও স্লাভ জাতির লোকেরা এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করে। খ্রিষ্টপূর্ব ৭ম ও ৬ষ্ঠ শতকে আলবেনিয়ার উপকূলে এপিদামনুস (বর্তমান দুররেস) এবং আপোল্লোনিয়া (বর্তমান ভ্‌লোরে) গ্রিকরা কিছু বসতি স্থাপন করে। খ্রিষ্টাপূর্ব তৃতীয় শতকের দিকে এই বসতিগুলির পতন ঘটে এবং শেষ পর্যন্ত বসতিগুলো নিশ্চিহ্ন যায়। এরপর ইলিরীয়রা ধীরে ধীরে একটি  রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো তৈরি করতে সক্ষম হয়। এই সময় রোম সাম্রাজ্য ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠে। রাজ্যবিস্তারের জন্য রোম সম্রাট ২২৯ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দেই আড্রিয়াটিক সাগর পাড়ি দিয়ে ইলিরিয়া আক্রমণ করে। দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধবিগ্রহের পর, ১৬৮ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দ নাগাদ রোম সম্রাট ইলিরিয়াকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় এবং রোম সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত করে। রোমানরা এই প্রদেশের নামকরণ করে ইলিরিকুম। এরপর রোমানরা প্রায় ৬ শতাব্দী ধরে এলাকাটি নিজেদের অধিকারে রাখে। এই সময় ইলিরীয়রা রোমান সংস্কৃতির সাথে মিশে না গিয়ে নিজেদের স্বকীয় সংস্কৃতি ও ভাষা ধরে রাখতে সক্ষম হয়। এই সময়ের ভিতরে কিছু ইলিইরীয় রোমান সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জনে সক্ষম হন এবং রাজপদে অভিষিক্ত হন।  এদের মধ্যে আছেন আউরেলিয়ান (২৭০-২৭৫ খ্রিষ্টাব্দ), দিওক্লেতিয়ান (২৮৪-৩০৫ খ্রিষ্টাব্দ) এবং কনস্টান্টিন (৩০৬-৩৩৭ খ্রিষ্টাব্দ) রোমের সম্রাটও হয়েছিলেন।

খ্রিষ্টীয় ১ম শতকের মাঝামাঝি নাগাদ ইলিরিকুমে খ্রিষ্টধর্ম ছড়িয়ে পড়ে। ৫৮ খ্রিষ্টাব্দে সাধু পল এপিদামনুস নগরের জন্য একজন যাজক নিয়োগ করেন। পরবর্তীতে আপোল্লোনিয়া এবং স্কোদ্রা (বর্তমান শ্‌কোদার) শহরে বিশপদের কর্মস্থল নির্মাণ করা হয়।

৩৯৫ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সাম্রাজ্যটি, পূর্ব ও পশ্চিমে দুইটি সাম্রাজ্যে ভাগ হয়ে যায়। এই সময় বর্তমান আলবেনিয়া এলাকাটি পূর্ব বাইজেন্টীয় সাম্রাজ্যে পড়ে। খ্রিষ্টীয় ৫ম শতক নাগাদ খ্রিষ্টধর্ম এই অঞ্চলের প্রধান ধর্মে পরিণত হয়। এই সময় আলেবেনিয়ার খ্রিষ্টানেরা বাইজেন্টীয় সাম্রাজ্যের প্রজা হয়েও রোমান পোপের অধীনে ছিলেন। ৫ম শতকে ভিজিগথ, হুন এবং অস্ট্রোগথেরা অঞ্চলটি আক্রমণ করে অশেষ ক্ষতিসাধন করে। ৬ষ্ঠ ও ৮ম শতকের মধ্যবর্তী সময়ে ইলিরিয়া অঞ্চলটিতে স্লাভ জাতির লোকেরা বসতি স্থাপন করে। বহু ইলিরীয় স্লাভদের সাথে মিশে যায় এবং বর্তমান স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, সার্বিয়া এলাকাগুলির মানুষদের পূর্বপুরুষ গঠন করে। কিন্তু দক্ষিণ ইলিরীয় অঞ্চলের লোকেরা, স্লাভদের সাথে মিশ্রণ রোধ করে। ৭৩২ খ্রিষ্টাব্দে বাইজেন্টীয় সম্রাট ৩য় লিও আলবেনীয় গির্জার সাথে রোমের সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দেন এবং একে কনসতান্তিনোপলের (বর্তমান ইস্তাম্বুল) ধর্মগুরুর অধীনে আনেন।

খ্রিষ্টীয় ৮ম থেকে ১১শ শতকের মধ্যে ইলিরিয়া ধীরে ধীরে আলবেনিয়া নামে পরিচিত হতে শুরু করে। বর্তমানে এই নামেই ইলিরিয়া পরিচিত।

খ্রিষ্টীয় ৯ম শতকে বাইজেন্টীয় সম্রাটের সামরিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে প্রথমে বুলগেরীয় স্লাভ, নর্মান ক্রুসেডার, ইতালীয় আঙ্গেভিন, সার্ব এবং ভেনিসীয় জাতির লোকেরা পর্যায়ক্রমে অঞ্চলটি আক্রমণ করে। ১০ম শতকের পরে এখানে একটি জমিদারী প্রথা গড়ে ওঠে। এসময় অঞ্চলটির কিছু প্রদেশ কন্সতানিনোপল থেকে প্রায় সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে চলতে থাকে। ১০৫৪ খ্রিষ্টাব্দে খ্রিষ্টান গির্জাগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পূর্ব ও পশ্চিমে ভাগ হয়ে যায়। তখন দক্ষিণ আলবেনিয়া পূর্ব বা অর্থডক্স গির্জার সাথে সম্পর্ক অক্ষুন্ন রাখে। অন্যদিকে উত্তর আলবেনিয়া রোমের রোমান ক্যাথলিক গির্জার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে।

রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় এই সকল উত্থানপতনের ভিতরেই খ্রিষ্টীয় ৫ম থেকে ১৫শ শতকের ভিতরে আলবেনিয়ার শহরগুলির প্রসার ঘটে এবং সেই সাথে বাণিজ্যেরও উন্নতি ঘটে। শহরগুলোর উন্নতির সাথে সাথে শিল্পকলা, সংস্কৃতি, এবং শিক্ষারও উন্নতি ঘটে। এই সময়ে আলবেনীয়দের নিজস্ব ভাষা ছিল, কিন্তু গির্জা, সরকার ও শিক্ষাব্যবস্থায় এই ভাষার ব্যবহার ছিল না। মূলত গ্রিক ও লাতিন ভাষাই সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং সরকারী ভাষা হিসেবে থেকে যায়।

 

১৩৪৭ খ্রিষ্টাব্দে স্তেফান দুসানের অধীনে সার্বীয়রা আলবেনিয়া দখল করে। এই সময় আলবেনীয়রা গণহারে গ্রিসে পালিয়ে যায়। ১৪শ শতকের মাঝামাঝি সময়েই বাইজেন্টীয় শাসনের পতন ঘটে। বর্তমান তুরস্কের উসমানীয়রা সুলতানরা ১৩৮৮ খ্রিষ্টাব্দে আলবেনিয়া আক্রমণ করে। দুই বছর পর, ১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে উসমানীয়রা আলবেনিয়া সম্পূর্ণ জয় করে নেয়। এই পরিস্থিতিতে ১৪৪০-এর দশকে গিয়ের্গি কাস্ত্রিওতি দেশটির জমিদারদের একত্রিত ও সংগঠিত করে উসমানীয়দের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। রোম, নাপোলি, এবং ভেনিসের সামরিক সাহায্য নিয়ে কাস্ত্রিওতি প্রায় ২৫ বছর সফলভাবে উসমানীয়দের ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর আলেবেনিয়ার প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে এবং ১৫০৬ সালে উসমানীয়রা পুনরায় আলবেনিয়া দখলে আনতে সক্ষম হয়। এই সময় দেশটির জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ লোক ইতালি, সিসিলি, এবং আড্রিয়াটিক সাগরের ডালমেশীয় উপকূলে পালিয়ে যায়।

উসমানীয়রা চার শতাব্দী ধরে আলবেনিয়া শাসন করে। তবে মাঝেমধ্যেই উসমানীয়দেরকে আলবেনীয় বিদ্রোহীদের মুকাবিলা করতে হতো। এ সব বিদ্রোহের পিছনে বিদ্রোহীরা খ্রিষ্টধর্মের ধর্মীয় আবেগ ব্যবহার করতো। ১৬শ শতকের শেষে উসমানীয়রা ভবিষ্যৎ বিদ্রোহ প্রতিরোধের লক্ষ্যে আলবেনীয়দের ইসলামীকরণের নীতি গ্রহণ করে। ১৭শ শতকের মাঝামাঝি আলবেনীয় জনগণের দুই-তৃতীয়াংশ ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়। অনেকেই খ্রিষ্টানদের উপর কর ধার্য করা হয়। উসমানীয়রা একটি সামন্ত-সামরিক মিশ্র ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের নিয়ন্ত্রণ সম্প্রসারিত করে। এই ব্যবস্থায় সামরিক নেতারা সাম্রাজ্যের প্রতি বিশেষ আনুগত্য দেখিয়ে জমিদারি লাভ করতেন।

১৮শ শতকে উসমানীয় ক্ষমতার ক্ষয় ঘটতে শুরু করে এবং ফলে আলবেনিয়ার কিছু সামরিক নেতার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৭৫০ থেকে ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে উত্তর আলবেনিয়ার অধিকাংশ এলাকা বুশাতি পরিবারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। অন্যদিকে আলি পাশা তেপেলিন ১৭৮৮ থেকে ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত দক্ষিণ আলবেনিয়া ও উত্তর গ্রিস নিয়ন্ত্রণ করেন। এই স্থানীয় শাসকেরা নিজেদের আলাদা রাজ্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু উসমানীয় সুলতান ২য় মাহমুদ তাদেরকে পরাজিত করেন। ১৮শ ও ১৯শ শতকে অনেক আলবেনীয় উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রশাসনে উচ্চপর্যায়ে অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়। দুই ডজনেরও বেশি আলবেনীয় বংশোদ্ভূত লোক উসমানীয় সুলতানের প্রধানমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন।

১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দে আলবেনীয় নেতারা কসভোর প্রিজরেন শহরে মিলিত হন এবং প্রিজরেনের লিগ তথা আলবেনীয় লিগ গঠন করেন। লিগের উদ্দেশ্য ছিল সমস্ত আলবেনীয় অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে একটি একত্রিত স্বাধীন আলবেনিয়া রাষ্ট্র গঠন করা। এই প্রত্যাশায়
আলবেনীয় ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নেরও লক্ষ্য হাতে নেওয়া হয়।

১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে আলবেনীয় নেতারা লাতিন লিপির উপর ভিত্তি করে একটি জাতীয় বর্ণমালা প্রবর্তন করেন। ১৯১০ থেকে ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে আলবেনীয় জাতীয়তাবাদীরা উসমানীয়দের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধকে প্রথম বলকান যুদ্ধ নামে অভিহিত করা হয়। এই যুদ্ধে সার্ব, গ্রিক ও বুলগেরীয় সেনারাও যোগ দেয়। এই যুদ্ধে উসমানীয়রা পরাজয় বরণ করে। এবং যুদ্ধ শেষে আলবেনিয়া স্বাধীনতা দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যুদ্ধের শেষে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স ও ইতালি (মহাশক্তিসমূহ) একটি সম্মেলনে আলবেনিয়ার স্বাধীনতা মেনে নেয়। কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলির প্রবল চাপের মুখে তারা আলবেনীয় অধ্যুষিত কসোভো অঞ্চলটি সার্বিয়াকে এবং কামেরিয়া অঞ্চলটির অধিকাংশ গ্রিসকে দেয়। এর ফলে আলবেনীয় জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই, সদ্যপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের সীমানার বাইরে পড়ে যায়। মহাশক্তি রাষ্ট্রগুলি একজন জার্মান রাজপুত্র ভিলহেল্ম ৎসু ভিডকে আলবেনিয়ার শাসক নিয়োগ করে, কিন্তু তিনি মাত্র ছয় মাস ক্ষমতায় ছিলেন। এর পরই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এসময় অস্ট্রীয়, ফরাসি, ইতালীয়, গ্রিক, মন্টেনেগ্রীয় এবং সার্বীয় সেনারা আলবেনিয়া দখল করে। এর ফলে দেশটিতে রাজনৈতিক নেতৃত্বহীনতা দেখা দেয়। বিশ্বযুদ্ধের পরে প্যারিস শান্তি সম্মেলনে  ব্রিটিশ ফরাসি ইতালীয় সরকার আলবেনিয়াকে ভাগ করে তার প্রতিবেশীদের দিয়ে দিয়ে দেবার পরিকল্পনা করে। কিন্তু মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসনের ভেটোর কারণে তা বাতিল হয়ে যায়। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে আলবেনিয়াকে সদ্য সংগঠিত লিগ অফ নেশন্‌স-এ অন্তর্ভুক্ত করা হয়, ফলে দেশটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে।

১৯২০-এর দশকে আলবেনিয়ার জনগণ দুটি রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত ছিল। এর ভিতরে আহমেদ বেই জোগুর নেতৃত্বাধীন দলটি জমিদার ও গোত্রপ্রধানদের দ্বারা পরিচালিত রক্ষণশীল শ্রেণীকাঠামো ধরে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। অন্যদিকে উদারপন্থী বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, ও ব্যবসায়ীরা আলবেনিয়ায় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সক্রীয় হয়ে উঠেছিল। এই  উদারপন্থীদের নেতৃত্বে ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষাপ্রাপ্ত অর্থডক্স গির্জার বিশপ ফান নোলি। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে রক্ষণশীলদের বিরুদ্ধে এক গণবিপ্লব হয়। এর ফলে আহমেদ বেই জোগু যুগোস্লাভিয়াতে পালিয়ে যান। নোলি নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হন এবং পশ্চিমা ধাঁচের একটি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মন দেন। কিন্তু মাত্র ছয় মাসের মাথায়, আন্তর্জাতিক সমর্থনের অভাবে ও আভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার হয়ে নোলি ক্ষমতাচ্যুত হন। এই সময় জোগু যুগোস্লাভিয়ার সহায়তায় আবার ক্ষমতায় আসেন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আলবেনিয়ার প্রথমে রাষ্ট্রপতি হন। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজা প্রথম জোগ হিসেবে ক্ষমতায় আসেন এবং ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকেন। জোগের স্বৈরশাসনে আলবেনিয়ার অর্থনীতি স্থবির হয়ে যায়। তবে তাঁর সময়ে আলবেনিয়াতে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়। দেশটি একটি স্থিতিশীল অবস্থায় আসলেও, ভূমি সংস্কারের সমস্যা সমাধানে তিনি ব্যর্থ হন এবং কৃষকেরা দরিদ্র থেকে যায়। এই সময়  আলবেনিয়ার অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ইতালির এতটাই প্রভাব ছিল যে এ সময় আলবেনিয়া দৃশ্যত ইতালির একটি প্রদেশে পরিণত হয়।

১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছু আগে ইতালি আলবেনিয়া আক্রমণ ও দখল করে। এই সময় জোগ পালিয়ে গ্রিসে চলে যান। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে নাৎসি জার্মানি যুগোগোস্লাভিয়া ও গ্রিস দখল করে। এই সময় কসোভো ও কামেরিয়াকে আলবেনিয়ার সাথে যুক্ত করা হয়। যুদ্ধকালীন আলবেনিয়া ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইতালির অধীনে ছিল। এরপর জার্মান সেনারা এর নিয়ন্ত্রণ নেয়। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে জার্মানরা পিছু হটে গেলে, আলবেনিয়ার যুদ্ধকালীন রাষ্ট্রের পতন ঘটে। এই সময় কসোভোকে সার্বিয়ার কাছে এবং কামেরিয়াকে গ্রিসের কাছে ফেরত দিতে হয়।
 

১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর সাম্যবাদী দল যুগোশ্লাভিয়ার সমর্থনে আলবেনিয়ার ক্ষমতা দখল করে। সাম্যবাদী দলের মহাসচিব এনভার হোক্সহা দেশের নতুন নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। নতুন সরকার জমিদারদের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয় এবং শিল্প, ব্যাংক, এবং বাণিজ্যিক সম্পত্তি জাতীয়তাকরণ করে।

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে স্তালিন যুগোস্লাভিয়াকে সাম্যবাদী ব্লক থেকে আদর্শগত কারণে বহিষ্কার করেন। এই সময় আলবেনিয়া স্তালিনকে সমর্থন দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ের সমর্থনে আলবেনিয়ায় ইউগোস্লাভ-সমর্থক দলগুলি নিষিদ্ধ হয়। উল্লেখ্য, এই দলগুলির নেতৃত্বে ছিল কোসি খোখে, হোক্সহার প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। এরপর সোভিয়েত ইউনিয়নের স্তালিনের শুরু করা মডেল অনুসরণে কৃষির আলবেনিয়ায় সমবায়ীকরণ করা শুরু হয় এবং ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে  প্রায় সব কৃষক এই প্রকল্পের আওতায় আসে।

১৯৬০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন বিশ্ব সাম্যবাদী আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠে। এই সময় আলবেনিয়া চীনকে সমর্থন দেয়। ফলে হোহক্সা রুশ ব্লকের সাম্যবাদী বন্ধু দেশগুলোর বন্ধুত্ব হারায়। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে আলবেনিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। এই সূত্রে ১৯৬০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত আলবেনিয়া বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল।

১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়ন চেকোস্লোভাকিয়া দখল করলে আলবেনিয়া নিজেকে রক্ষার জন্য পার্শ্ববর্তী ইউরোপীয় দেশগুলির সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করে। ১৯৭০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের আঁতাতের প্রেক্ষিতে চীনের সাথে আলবেনিয়ার সম্পর্ক খারাপের দিকে মোড় নেয়। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে চীন আলবেনিয়ার সাথে বাণিজ্য চুক্তি ও সাহায্য বন্ধ করে দেয়। এসকল ঘটনার প্রতিক্রয়ায় আলবেনিয়ার অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। এদের দমন করার জন্য হোক্সহার ভয়াবহ রাজনৈতিক নিপীড়ন চালায়। হোক্সহার বিরুদ্ধ মত দূর করার জন্য সাম্যবাদী দল বাদে বাকী সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই সময় হাজার হাজার লোককে চাকুরিচ্যুত করা হয়, শ্রম ক্যাম্পে অন্তরীণ করা হয়। অনেকে হত্যা করা হয়। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে সমস্ত ধর্মীয় সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয়, খ্রিষ্টান ও মুসলিম ধর্মালয়গুলির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং দেশটিকে বিশ্বের প্রথম নাস্তিক রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়।

১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে প্রধানমন্ত্রী মেহমেট শেহু অজানা রহস্যময় কারণে মারা যান। ধারণা করা হয় তিনি হোক্সহাকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করলে, তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে সিগুরিমি বেশ কয়েকজন দলীয় কর্মকর্তাকে ফাঁসি দেন। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে হোক্সহা মারা গেলে দলের প্রথম সচিব রামিজ আলিয়া তার পদে আসেন। আলিয়া সাম্যবাদী ব্যবস্থা বজায় রেখে অবনতিশীল অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য সংস্কারকাজ উপস্থাপন করেন।

১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব ইউরোপে সাম্যবাদী শাসনের অবসান ঘটলে, আলবেনীয়া সংস্কারের দাবি উঠে। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে রাজনৈতিক দলের সৃষ্টির অনুমতি দেওয়া হয়। অর্থনেতিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এই বছরেই বহু আলবেনীয় পশ্চিমা দেশগুলির দূতাবাসের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে এক মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে অনেকে নিহত হয়। মার্চে সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। একই মাসে আইনসভার জন্য বহুদলীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সাম্যবাদী দল ও তাদের মিত্ররা ২৫০টি আসনের মধ্যে ১৬৯টি আসন জেতে। অন্যদিকে নবগঠিত ডেমোক্রাট দল ৭৫টি আসন জেতে। সাম্যবাদীদের বিজয়ের পর আরেক দফা বিক্ষোভ শুরু হয়। এবার শকোডার শহরে পুলিশের গুলিতে চার জন মারা যায়।

১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান পাস করা হয় এবং দেশের নাম গণপ্রজাতন্ত্রী আলবেনিয়ার পরিবর্তে আলবেনিয়া প্রজাতন্ত্র রাখা হয়। আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্যবাদীরা আলিয়াকে নব্যসৃষ্ট রাষ্ট্রপতি পদে বসায় এবং অর্থনীতিবিদ ফাতোস নানো প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু হাজার হাজার শ্রমিকের সাধারণ ধর্মঘটের মুখে এই সরকার পদত্যাগ করেন এবং জুনে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করা হয়। এতে সাম্যবাদী, গণতন্ত্রী, প্রজাতন্ত্রী এবং সামাজিক গণতন্ত্রীরা অন্তর্ভুক্ত হন। কিন্তু রাস্তায় মিছিল চলতে থাকে এবং প্রতিবাদকারীরা প্রাক্তন সাম্যবাদী নেতাদের গ্রেপ্তার ও গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবী করতে থাকে। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে ডিসেম্বরে কোয়ালিশন সরকারের পতন ঘটে এবং একটী অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে গণতন্ত্রীরা আইনসভার ১৪০টি আসনের মধ্যে ৯২টিতে বিজয়ী হয়। সমাজবাদীরা ৩৮টি, সমাজবাদী গণতন্ত্রীরা ৭টি এবং গ্রিক সংখ্যালঘু একতা দল ২টি আসন জেতে। আইনসভা গণতন্ত্রী দলের নেতা সালি বেরিশাকে রাষ্ট্রপতি এবং বেরিশা আলেক্সান্দর মেক্‌সিকে প্রধানমন্ত্রী হন। এই সময় ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির দায়ে বিচার করা হয় কিছু নেতাকে গরেফতার ও দীর্ঘমেয়াদের শাস্তি দেয়া হয়। তবে অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন এই বিচারগুলি ন্যায়সম্মত ছিল না। আলিয়া ও নানো উভয়েই কয়েক বছরের মধ্যেই ছাড়া পান। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে নভেম্বরে গণতন্ত্রীরা একটি নতুন সংবিধান প্রস্তাব করা হলে, জনগণ একটি গণভোটে তা প্রত্যাখ্যান করেন। বিরোধীরা রাষ্ট্রপতিকে স্বৈরাচারী আখ্যা দেয়া দেন। তাঁদের মতে সরকার প্রেসের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, প্রাক্তন সাম্যবাদী নেতাদের জুলুম এবং আদালতসমূহ নিয়ন্ত্রণ করেছেন। সরকারের সমর্থকেরা পাল্টা দাবি করে যে সমাজবাদীরা দেশের নতুন গণতন্ত্র বানচাল করে দিতে চাচ্ছে।

১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে সার্বিয়া কসভোর স্বায়ত্বশাসন রদ করে এবং ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে কসভোর আলবেনীয় নেতারা প্রদেশটির স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। যদিও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে কসোভো স্বীকৃতি পায়নি, আলবেনিয়া কসোভোকে সমর্থন দেয় এবং জাতিসংঘকে প্রদেশটিতে পর্যবেক্ষক পাঠাতে অনুরোধ জানায়। কিন্তু জাতিসংঘ এই অনুরোধে সাড়া দেয়নি।

১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে আলবেনিয়াতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু রাষ্ট্রপতি সালি বেরিশার গণতন্ত্রী দল বিজয় লাভ করে। তবে এই বিজয়ের পিছনে তাদের কারচুপি আছে বলে অভিযোগ আনা হয়। বিরোধী দলগুলি সংসদ বর্জন করে। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে এই সংসদ বেরিশাকে আরও ৫ বছরের জন্য নির্বাচিত করে। এই বছরের শুরুতে অনেকগুলি জাল বিনিয়োগ কার্যক্রম ধরা পড়ে। এর ফলে হাজার হাজার আলবেনীয় তাদের সঞ্চয় হারান। সরকার বহু বিনিয়োগকারীকে আংশিক ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দিলেও অর্থনৈতিক বিপর্যয় রোধ করা যায় নি। অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও রাজনৈতিক প্রচারণার প্রেক্ষিতে আলবেনীয়রা প্রথমে বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদ শুরু হয় এবং পরে সেগুলি সংঘাতে রূপ নেয়। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের মার্চের মধ্যে দেশব্যাপী বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশের অনেক অংশে প্রশাসন বিকল হয়ে যায়। দেশের দক্ষিণাংশ, বিশেষ করে ভলোরে এবং সারান্দে শহর, স্থানীয় মিলিশিয়া বাহিনী ও সশস্ত্র নাগরিকেরা লুটেরাদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা নিজেদের হাতে তুলে নেন। দেশব্যাপী গৃহযুদ্ধের সম্ভবনা দেখা দিলে, রাষ্ট্রপতি বেরিশা একটি অন্তর্বতীকালীন সরকার গঠন করেন। এই সরকারে প্রধান ছিলেন সমাজবাদী বাশকিম ফানো। বেরিশা জুনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেন এবং তার দল হেরে গেলে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগের প্রতিশ্রুতি দেন। নতুন সরকার দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য কামনা করে। এই সময় ইতালীয় কমান্ডারের অধীনে আগত বহুজাতিক বাহিনীটিকে কেবল আলবেনিয়ার দুর্গম এলাকাগুলিতে ত্রাণ সরবরাহে কাজে লাগানো হয়।

১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের জুনের নির্বাচনে সমাজবাদীরা ৬৫% ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আসে। বেরিশা জুলাইয়ে পদত্যাগ করেন। কারাগার থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত নেতা ফাতোস নানো প্রধানমন্ত্রী হন। রেক্সহেপ মেজদানী নামের আরেকজন সমাজবাদী নেতাকে রাষ্ট্রপতি পদ দেওয়া হয়। গণতন্ত্রীরা ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ পর্যন্ত সংসদ বয়কট করেন। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী নানো কোয়ালিশন সরকারের সাথে মন্ত্রীসভায় পরিবর্তনের ব্যাপারে মতভেদের কারণে পদত্যাগ করেন। পান্ডেলি মাজকো নামের একজন সমাজবাদী নেতাকে প্রধানমন্ত্রী বানানো হয়। কসোভোতে জাতিগত আলবেনীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বহু সার্বীয় পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এই সূত্রে ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার (বর্তমান সার্বিয়া ও মন্টেনিগ্রো) সাথে আলবেনিয়ার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সার্বীয় পুলিশ ও যুগোস্লাভ সেনাবাহিনীর দল কসোভোর সাধারণ জনগণের উপর হামলা করে। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর অধিকাংশ সময় জুড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী কসভো মুক্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে। যুগোস্লাভিয়া কসোভোর ব্যাপারে শান্তিচুক্তিতে আসতে অসম্মতি জানালে, ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে ন্যাটো যুগোস্লাভ সামরিক স্থাপনাগুলিতে বিমান হামলা চালানো শুরু করে। সার্বীয় সেনারা কসোভোর গ্রামগুলিতে আরও বেশি আক্রমণ শুরু করে, ফলে লাখ লাখ লোক নিজেদের বাসস্থান ছেড়ে চলে যায়। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই আলবেনিয়া কসোভো-আগত উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিয়ে আসছিল, কিন্তু ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের বিমান হামলার ফলে উদ্বাস্তুর ঢেউ সামলাতে আলবেনিয়া হিমশিম খেয়ে যায়। দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতিতে চাপের সৃষ্টি হয়। জুন মাসের মধ্যেই প্রায় সাড়ে চার লাখ কসোভোবাসী আলবেনিয়াতে আশ্রয় নেয়। ঐ মাসেই যুগোস্লাভ সরকার একটি আন্তর্জাতিক শান্তি চুক্তিতে সম্মত হয়। চুক্তির শর্ত অনুসারে কসোভোতে একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা বাহিনী স্থাপন করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল, উদ্বাস্তুদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা।

১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে মাজকো সাম্যবাদী দলের আভ্যন্তরীণ আস্থা হারিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অবসর নেন। তার স্থানে আসেন ইলির মেতা। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে অনুষ্ঠিত সংসদীয় নির্বাচনে সমাজতান্ত্রিক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে সমর্থ হয়। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে ফাতোস নানোর সাথে তিক্ত বিবাদের জের ধরে মেতা হঠাৎ করে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে অবসর নেন। সমাজতান্ত্রিক দলও এতে দুই ভাগ হয়ে যায়। নানো মেতার সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনেন এবং মন্ত্রীসভাতে আমূল পরিবর্তন আনতে বলেন। মেতার পদত্যাগের পর পরই গণতন্ত্রী দলের সদস্যরা সাত মাসের বয়কট শেষ করে সংসদে ফেরত আসেন। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে সমাজতান্ত্রিক দলের নেতারা মাজকোকে মেতার উত্তরসূরী হিসেবে নির্বাচিত করেন এবং জুন মাসে সংসদ বিদায়ী রেক্সহেপ মেজদানির স্থলে আলফ্রেড মোইসিউ-কে রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ দেয়। উল্লেখ্য, মোইসিউ ছিলেন একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল এবং প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। তিনি জুলাই মাসে পদ গ্রহণ করেন। একই মাসে মাজকোকে সরিয়ে নানো প্রধানমন্ত্রী হন।
        [২০০২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত]