ছিয়াত্তরের মন্বন্তর
১১৭৬ বঙ্গব্দ (
১৭৭০ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলাদেশের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষকে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বলা হয়। এই দুর্ভিক্ষে প্রায় ১ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের জন্য তৎকালীন লোভী ইষ্ট কোম্পানির শাসন ব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়।

মোগল শাসনকালে কৃষকদের মোট সংগৃহীত অর্থকরী ফসলের ১০-১৫ শতাংশ রাজস্ব খাতে দিতে হত। এই রাজস্ব প্রাপ্তির সুবাদে বাংলা সেকালে লোভনীয় প্রদেশ ছিল। সম্রাটের কোষাগারে তখন পর্যাপ্ত খাদ্য শষ্য মজুদ থাকতো। কিন্তু কোনো বছরে ফসলের আকাল দেখা দিলে, রাজ-শস্য ভাণ্ডার থেকে প্রজাদের খাদ্য শস্য সরবরাহ করা হত।

১৭৬৫ খ্রিষ্টব্দের ১লা  আগষ্ট, ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিল্লির বাদশাহ শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করেন। নবাবের হাতে থাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব, আর রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের পূর্ণ কর্তৃত্ব পায় কোম্পানি। এতে বাংলার নবাব আসলে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে। আর এই সুযোগে কোম্পানির লোকেরা খাজনা আদায়ের নামে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার শুরু করে দেয়। পূর্ব ভারতের এই অঞ্চলে যে শাসন-ব্যবস্থা চালু হয় তা দ্বৈত শাসন নামে পরিচিত। এই অবস্থায় ক্লাইভের উত্তরাধিকারী গভর্নরদ্বয় ভেরলষ্ট ও কার্টিয়ার, ক্লাইভের প্রবর্তিত শাসন ব্যবস্থা বহাল রাখেন।

ইংরেজরা বিদ্রোহের ভয়ে তাঁদের এই ‘রাজস্ব’ আদায় কে লোক ভোলানোর জন্য নাম দিলেন ‘নজরানা’। আর মুঘল আমলের রাজস্ব বাবদ ১০-১৫ শতাংশের রাজস্বের হার বাড়িয়ে পঞ্চাশ শতাংশ করেন। এই পাহাড় প্রমাণ রাজস্ব দিয়ে নবাবের নামেই আদায় হতো। ১৭৬৮ সালে যখন যথারীতি ফলনের ঘাটতি দেখা দেয়। ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দে অনাবৃষ্টির কারণে বাংলাদেশে ফসল উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হলে, দুর্ভিক্ষের সূচনা ঘটে। এই সময় প্রজাদের জন্য শাসকদের কেউ খাদ্যশস্য সরবরাহ করেনি। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই  দুর্ভিক্ষের প্রাথমিক রূপ প্রকাশ পায় বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বীরভূম অঞ্চলে। ১৭৭১ খ্রিষ্টাব্দে কৃষকদের মৃত্যু মহামারীর রূপ নিলে, কোম্পানির রাজস্ব আদায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য কোম্পানি ৬০ শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধি করে।
এর ফলে  ১৭৭১ খ্রিষ্টাব্দে ঘোর দুর্ভিক্ষের বছরে, বিত্তবানদের কাছ থেকে যে রাজস্ব আদায় হয়েছিল, তা ছিল ১৭৬৮ খ্রিষ্টাব্দের রাজস্বের চেয়ে বেশি। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ে পশ্চিম বঙ্গের সর্বত্র এবং পূর্ব-বাংলার পশ্চিমাঞ্চল। তবে এর ভয়াবহ রূপ পেয়েছিলে বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও বিহারে। এর ফলে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে প্রায় ১ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়।


সূত্র :
ভারতের ইতিহাস। অতুল চন্দ্র রায়, প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায়। ২০০০।