খাসিয়া
ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্য এবং বাংলাদেশের সিলেটের সীমান্ত-সংলগ্ন অঞ্চলে বসবাসকারী মোঙ্গলীয় মহাজাতি একটি ক্ষুদ্র নরগোষ্ঠী। দেহের আকার মধ্যমাকার। মুখমণ্ডল গোলাকার, নাক চ্যাপ্টা, গণ্ডদেশ উন্নত। চুল অকুঞ্চিত, পুরুষদের মুখমণ্ডলে দাড়ি উঠে না। এদের গায়ের রঙ চাপা তাম্রবর্ণের হয়।

এদের ভাষার নাম খাসিয়া বা খাসি। বর্তমানে খাসিয়া জনসংখ্যা প্রায় ১২,২৮০ জন। ভারতের মেঘালয় ও আসাম রাজ্য মিলিয়ে প্রায় দশ লক্ষ লোক খাসি ভাষায় কথা বলে। খাসিয়া ভাষার সাথে বার্মার মোঁয়ে, পলং ভাষার এবং উপমহাদেশের তালাং, খেড়, সুক, আনাম, খামেন, চোয়েম, ক্ষং, লেমেত, ওয়া প্রভৃতি আদিবাসীদের ভাষার মিল আছে। এই ভাষার কোন নিজস্ব বর্ণমালা নেই। তবে ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে কৃষ্ণচন্দ্র পাল নামক একজন ধর্মযাজক সর্বপ্রথম বাংলা বর্ণমালায় ও খাসি ভাষায় বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট অনুবাদ করেন। ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দের পরে ওয়েলস মিশনারি দলের টমাস জোনস রোমান হরফে খাসিয়া ভাষা লেখার প্রচলন করেন। বর্তমানে খাসি ভাষা রোমান হরফেই লেখা হয়। খাসি ভাষার উপভাষা রয়েছে বেশ কয়েকটি। 

খাসিয়ারা মূলত মাতৃতান্ত্রিক সম্প্রদায়। এই কারণে খাসিয়া সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের সম্মান ও আলাদা মর্যাদা রয়েছে। খাসিয়াদের মধ্যে প্রবাদ রয়েছে ‘লংজেইদ না কিন থেই’ অর্থাৎ নারীদের হাতে মানব জাতির উৎপত্তি। এদের পরিবারের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন নারীরা। নারীরা কনে যাত্রী নিয়ে বিয়ে করে বর নিয়ে আসেন বাড়িতে। আর নারীরা নিজেদের বাড়িতেই পিতা মাতার সঙ্গে স্বামী-সন্তানসহ বসবাস করে থাকেন। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় পরিচালিত খাসিয়াদের কোনো পুরুষ সম্পত্তির মালিক হন না। স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পদের মালিক হন নারীরা। পুরুষদের বিয়ে হলে তারা গিয়ে ওঠেন শ্বশুরবাড়িতে তারা বাড়ির কাজে ও পানের জুমে কাজ করে পরিবারকে সহায়তা করেন। স্ত্রীর বাড়িতে পুরুষরা কাটিয়ে দেন জীবনের বাকি দিনগুলো। পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ মেয়ের ধন সম্পদে বেশি প্রাধান্য থাকে। এদের বংশ পরিচয় দেয়া হয় মায়ের বংশানুক্রমে।

খাসিয়া সম্প্রদায়ে ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশার সুযোগ থাকায় তাদের অধিকাংশ বিয়ে হয় প্রেম-ভালোবাসার মাধ্যমে। স্বগোত্রে বিয়ে খাসিয়া সমাজে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী মেয়ের বাড়িতে যৌথ পরিবারে কমপক্ষে পাঁচ বছর থাকতে হয়। পরে প্রয়োজনে তারা আলাদা বসবাস করতে পারেন। খাসিয়া নারীরা সাধারণত পুরুষদের তুলনায় অধিক পরিশ্রমি হয়ে থাকেন। খাসিয়াদের বিয়ে ও পূজানুষ্ঠানে নাচ-গানের আয়োজন হয়ে থাকে। এতে সাধারণত খাসিয়া নারীরাই অংশ নেন।

গভীর অরণ্যে পান চাষ করে খাসিয়ারা জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বিশেষ করে ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন গভীর অরণ্যই খাসিয়াদের আবাসের জন্য পছন্দনীয় স্থান। খাসিয়ারা মূলত মাতৃতান্ত্রিক সম্প্রদায়। এদের পরিবারের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন নারীরা। নারীরা কনে যাত্রী নিয়ে বিয়ে করে বর নিয়ে আসেন নিজ নিজ পান পুঞ্জিতে। এ কারণে কোনো খাসিয়া পরিবারে তিন ভাই থাকলে বিয়ে করে তিন পুঞ্জিতে চলে যান। আর নারীরা নিজেদের বাড়িতেই পিতা মাতার সঙ্গে স্বামী-সন্তানসহ বসবাস করে থাকেন। এদের পরিবারে নারীদের ভূমিকাই মুখ্য। - See more at: http://www.dailybartoman.com/index.php?page=details&nc=67&news_id=18380#sthash.VwuINpQi.dpuf

ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন গভীর অরণ্যই খাসিয়াদের আবাসের জন্য পছন্দনীয় স্থান। সিলেট অঞ্চলের খাসিয়ারা সিনতেং গোত্রভুক্ত জাতি। এরা কৃষিজীবী কিন্তু পান চাষও করে থাকে। খাসিয়াদের উৎপাদিত পান বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয়।

খাসিয়ারা এক সময় প্রকৃতি পূজারী ছিল। খ্রিষ্টান মিশনারিদের মাধ্যমে এদের প্রায় অধিকাংশই খ্রিষ্টাব্। তবে এর পাশাপাশি এরা বিভিন্ন দেবদেবীর পূজা করে। তাদের বিশ্বাস ‘উব্লাই নাথউ’-ই পৃথিবী সৃষ্টিকারী আদি দেবতা।