ম্রো
অন্যান্য নাম : মুরং, ম্রু।
বাংলাদেশ ও মায়ানমারে বসবাসকারী একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী।

 

নৃতাত্ত্বিক পরিচয়
নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের বিচারে এরা মোঙ্গোলীয়। অনেকের মতে এরা মিশ্র। শারীরিক দিক থেকে মালয়েশিয়ার সেমাংদের সাথেও ম্রোদের মিল রয়েছে। ম্রোরা নিজেদেরকে 'ম্রো-চা'  হিসেবে পরিচয় দেয়। ম্রু ভাষায়
ম্রো শব্দের অর্থ হচ্ছে 'মানুষ' আর চা মানে 'সত্তা'। ম্রোদের আদি বাসস্থান ছিল আরাকান অঞ্চলে। আরাকান রাজাদের ধারাবিবরণী রাজওয়াং থেকে জানা যায় দু'জন 'ম্রো' দ্বাদশ শতাব্দীতে আরাকানের রাজা দাখা রাজাকে মহামুনি মূর্তির অবস্থান খুঁজে বের করতে সহায়তা করেছিলেন। ১৮শ শতাব্দীতে খুমিদের সাথে এদের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এদের একটি অংশ বান্দরবান অঞ্চলে চলে আসে এবং মাতামুহুরী নদীর তীর বরাবর সাঙ্গু উপত্যকায় পশ্চিমে এরা বসতি স্থাপন করে। বাকি ম্রোরা বর্তমান মায়ানমারের আরাকান অঞ্চলের মি নদীর (কোলাডান নদীর শাখা) তীরে আরণ্যক পরিবেশে বাস করে। এখনও মায়ানমারের ম্রোরা ওই অঞ্চলেই বসবাস করে।

 

ম্রোদের ভাষা
এরা তিব্বত-বর্মীয় ভাষাগোষ্ঠীর ম্রু ভাষায় কথা বলে। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেস্কো এই ভাষাকে বিপন্ন ভাষা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের আগে ম্রো ভাষা বর্ণমালা ছিল না। ১৯৮৫-৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ম্রো ভাষাবিজ্ঞানী মেনলে ম্রো এই ভাষার বর্ণমালা উদ্ভাবন করেন। ম্রোদের কোনো বর্ণমালা নেই এই অভাববোধ থেকে তিনি এই বর্ণমালার উদ্ভাবন করেন। তিনি প্রথম বর্মি বর্ণমালা শেখেন। তারপর সেই আদলে এই নতুন লিপি তৈরি করেন। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে মেনলের তার নিজের গ্রাম পোড়াপাড়ায় একটি ম্রো ভাষা শিক্ষাকেন্দ্র চালু করেন। এই বিদ্যালয়ের মাধ্যমে তিনি সেই সময় প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষকে সাক্ষরতা দান করতে সক্ষম হন। বর্তমানে আর্থ সামাজিক কারণে ম্রোরা প্রায় নিজের ভাষায় কথাই বলে না। ম্রোরা স্থানীয় অন্যান্য ভাষা ব্যবহার করলেও বাংলা ও মারমা সবেচেয়ে বেশি প্রচলিত।

 

আবাসস্থল
বাংলাদেশের বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি জেলায় বসবাসকারী ১১টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভিতরে ম্রো একটি। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের জনগণনা অনুসারে বাংলাদেশে এদের সংখ্যা ছিল ২২,১৭৮ জন। অধিকাংশ ম্রোরা বান্দরবান জেলায় বাস করে। রাঙ্গামাটিতে খুব অল্প সংখ্যক ম্রো বাস করে।

 

বান্দরবান জেলার বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে তোইন, তৈনস্কা, মঙ্গু, লুলোইং, উত্তর হানগড়, দক্ষিণ হানগড়, হরিণঝুড়ি, টেকের পানছড়ি, তন্ধাবতী, রেণিখ্যং, পানতলা, থানখ্যং, সোয়ালক, তিনডো, সিংপা, আলীখং এবং ভারিয়াতারি মৌজায় এদের বসবাস।

তবে সবচেয়ে বেশি ম্রো বসবাস করে বান্দরবান জেলার চিম্বুক পাহাড়ে।


বাংলাদেশের ম্রোরা পাহাড়ের চূড়ায় ছোট ছোট মাচাংঘর তৈরি করে বসবাস করে। তবে কিছুদিন পর পর ম্রোরা স্থান পরিবর্তন করে নতুন নতুন পাহাড়ে মাচাংঘর বানায়। একই পাহাড়ে বা স্থানে ম্রো জনগোষ্ঠীরা বেশিদিন থাকে না বা বসবাস করে না। তাদের বিশ্বাস একই স্থানে অনেকদিন বসবাস করলে তাদের অমঙ্গল হয়।

 

ম্রো-দের পোশাক
পোশাকের বিচারে আদি ম্রো গোষ্ঠীর লোকেরা অর্ধ নগ্ন । পুরুষরা অত্যন্ত ছোটো নেঙটি পড়ে। মেয়েরা নিম্নাঙ্গে  ওয়াংলাই  নামক একটু লম্বা পোশাক পরে। বর্তমানে এরা সবাই কাপড় পরে। তবে আগে থেকেই ম্রো মেয়েরা কোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে সাজগোজ করতো। বিশেষ করে
ক্লুবংপ্লাই নামক নবর্ষের উৎসবে এরা কানে, পায়ে এবং মাথায় অলংকার পড়তো। এখনও এর প্রচলন আছে। এদের অলঙ্কারের ধাতু ছিল রূপা এবং পিতল। এই সকল অলংকার আকারে অনেক বড়। 

জীবিকা

ম্রোরা মূলত কৃষিজীবী। এরা জুম চাষের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে ম্রোরা জুমের জন্য পাহাড়ে আগুন দেয়। মে-জুন মাসের দিকে ম্রো আদিবাসীরা আগুনে পোড়ানো পাহাড়ে জুম চাষ শুরু করে। ম্রোরা পাহাড়ের ধান, ভূট্টা, মরিচ, যব, সরিষা, মিষ্টি কুমড়া, মারমা, টকপাতাসহ বিভিন্ন রকম সবজির চাষ করে। এছাড়া ম্রো-রা ছোটো পাহাড়ি পশুপাখি শিকার করে। পাহাড়ি নদীর মাছও শিকার করে খায়।

 
খাদ্য

ম্রোদের প্রধান খাদ্য ভাত। ভাতের সাথে এরা মূলত সব্জি খায়। পাহাড়ি পশুপাখি, মাছও এদের খাদ্য তালিকায় আছে। উৎসবে এরা গরু, ছাগল, শুকর খায়। এরা তরকারীতে ঝোল রাখে না। মদ এদের প্রিয় পানীয়। এবং এই মদ এরা নিজেরাই তৈরি করে।

 

পরিবার ও বিবাহ

ম্রো মূলত পিতৃতান্ত্রিক পরিবার। তবে মেয়েরা বেশ স্বাধীনতা ভোগ করে। সম্পত্তির অধিকারী হয় ছেলেরা। তবে কনিষ্ঠ পুত্র সবচেয়ে বেশি সম্পত্তি পায়। বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতা কনিষ্ঠ পুত্রের সাথে থাকে। ম্রো সমাজে দু'ধরনের বিবাহ রীতি প্রচলিত আছে। একটি পদ্ধতিতে ছেলে ও মেয়ে পালিয়ে গিয়ে বিবাহ করে। দ্বিতীয় প্রকার হলো পারিবারিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিবাহ।

 

ম্রো-দের ধর্ম

ম্রোদের মূলত ছিল প্রকৃতি-পূজারী। খ্রিষ্টান মিশানরীদের দ্বারা এদের একটি বিরাট অংশ খ্রিষ্ট-ধর্মে বিশ্বাসী।
 

ম্রোদের সনাতন ধর্মমতে, পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন থুরাই নামক একজন মহাশক্তিমান দেবতা। নাম তার। তারা বিশ্বাস করে পৃথিবীর চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, জীব-জন্তু, গাছ-গাছালি সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা থুরাই।

এই দেবতা এই জীবকূলকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে বর্ণমালা সম্বলিত একটি ধর্মীয় গ্রন্থ দান করবেন বলে স্থির করলেন। তখন ম্রোরা জুমে ব্যস্ত। অন্যরা এই ধর্ম গ্রন্থ পেলেও ম্রোরা বঞ্চিত হয়। তখন থুরাই একটি গরুকে এই গ্রন্থটিকে ম্রোদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। গরু গ্রন্থটি নিয়ে আসার সময় প্রচণ্ড গরমে পথের মধ্যে গ্রন্থের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো। তারপর ঘুম থেকে জেগে প্রচণ্ড ক্ষুধায় গরু গ্রন্থটি খেয়ে ফেললো। ফলে ম্রোরা ওই গ্রন্থটি পেলো না। এই কারণে থুরাই গরুকে অভিশাপ দিয়ে বললেন, যতদিন ম্রোরা ধর্মগ্রন্থ না পাবে ততদিন গরুদের উপর নির্যাতন করা হবে। এই কারণে ম্রোরা গরুকে হত্যা করাটা পূণ্যের কাজ মনে করে। কালক্রমে গোহত্যা সামাজিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই অনুষ্ঠানে বাঁশের একটি খাঁচার মধ্যে গরুকে আটকে রাখঅ হয়। এরপর অনুষ্ঠানে আগত লোকেরা বল্লম দিয়ে খুঁচিয়ে গরুকে হত্যা করে। এরপর লোভী গরুর জিহ্বাটা কেটে লাঠির মাথায় গেঁথে রাখে। এরপর তারা সবাই মিলে সে গরুর মাংস খায়।
 

ম্রোদের লোককথা থেকে জানা যায়, আদিতে খ্যাং নারী গোষ্ঠীতে  খ্যাংমা ওয়াইডং কিং নামক এক ধনী নারী ছিল। তার প্রচুর সোনা, রূপা, মোহর ছিল। তার মৃত্যুর পর এই সকল সম্পদ পাথরে পরিণত হয়ে যায়। তাদের বিশ্বাস এই পাথর যে খুঁজে পাবে, খ্যাংমা সে ব্যক্তিকে বর দান করবে। তাই তারা পাথরকে ভক্তি, শ্রদ্ধা করে, পূজা করে।

জুমের প্রধান ফসল ধান। তাই প্রতিবছর জুমে ধানের ফলন ভালো পাওয়ার জন্য ম্রোরা ধানের দেবী মাইনোমাকে পূজা করে। ম্রো লোককাহিনি মতে
মাইনোমার মূল রূপ  বুড়ি, তবে তিনি বহুরূপী। জুমের মৌসুমে মাইনোমা শিশু, সুন্দরী নারী বা বুড়ি রূপে জুমের খেতে দেখা দেয়। প্রতি বছরই ম্রোদের কেউ না কেউ মাইনোমা-কে দেখতে পায়। এই সময় তারা যে রূপে, দেখতে পায়, সেই রূপেই তাকে পূজা করে। যে বছর ফসল ভালো হয় না, সে বছর পূজা ঠিক হয়নি বলে মনে করে তারা। তাই মাইনোমা তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেবী।

 

জীবন ধারণের জন্য এরা পাহাড়ি নদী বা ঝর্নার উপর নির্ভরশীল। তাই তারা নদীকে পূজা করে। এই পূজার নাম তুই বু তাই। সংসারের উন্নতি, সন্তান লাভের জন্য এরা নদীর পূজা করে। নদী পূজায় এরা ছাগল বা মুরগি বলি দেয়। পূজায় তারা বিভিন্ন ফুল ব্যবহার করলেও, পূজার প্রধান ফুল জবা। নদী পূজার পাশাপাশি এরা তাবিজ-কবচ গ্রহণ করে।

মরোদের কাছে ভয়ঙ্কর অপদেবী হলো রুখমা। এই দেবী পাহাড়ি মানুষকে ভয় দেখায়, মানুষকে পথভ্রষ্ট করে এবং শেষ পর্যন্ত পাগল করে দেয়। রুখমা বহুরূপী।  রুখমা কখনো কখনো লোভ দেখিয়ে বা সুন্দরী নারীর রূপ ধরে অল্প বয়সী পুরুষদেরকে বিপথে নিয়ে যায়। এই অপদেবীর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এরা শুকর, মুরগি, ছাগল প্রভৃতি বলি দিয়ে মাংস বিলি করে ও নিজেরা খায়।

 

ম্রোরা চন্দ্র ও সূর্যকে শ্রদ্ধা করলেও পূজা করে না। ম্রোদের কোনো ধর্মগ্রন্থ এবং মন্দির নেই। এদের ধর্মগুরু হলো সমাজের প্রবীন ব্যক্তিরা। এই বিচারে তাদের সমাজে পৃথক কোনো পুরোহিত নেই।


তথ্য নির্দেশক : প্রিয়াঙ্কা চাকমা (নিজস্ব প্রতিবেদক)

 

তথ্য সূত্র:

http://en.wikipedia.org/wiki/Mro_people