রাজবংশী

ভারত ও বাংলাদেশের ক্ষুদ্রগোষ্ঠী বিশেষ। রাজবংশীদের প্রাচীন বসতি ছিল তিব্বত ও ব্রহ্মদেশের পাহাড়ি ও মালভূমি এলাকায়। পরে ধীরে ধীরে এরা কুচবিহার, বিহার, মুর্শিদাবাদ,  রংপুর, দিনাজপুর ও আসাম অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। এদেররই বর্ধিত অংশ বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, জয়পুরহাট, পাবনা, বগুড়া, যশোর, ঢাকা প্রভৃতি জেলায় বসবাস করা শুরু করে।

নৃতাত্ত্বিক ও বংশ পরিচয়: ভারতের কোচবিহার অঞ্চল থেকে আগত মঙ্গোলীয় নৃগোষ্ঠীর কোচ-জাতির অংশ। তবে এদের ভিতর প্রোটো-অষ্ট্রালয়েডদের মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। সাধারণভাবে এরা খর্বাকার, নাক চ্যাপ্টা
, উঁচু চোয়ালবিশিষ্ট। বর্তমানে বাঙালিদের মতই এরা সংকর জাতি। এদের দৈহিক এবং জীবন-যাপনের ধারা আদি কোচ থেকে পৃথক হয়ে গেছে। ষোল শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কোচ রাজা হাজোরের বংশধরদের নেতা বিশুসিংহ সদলবলে আদিধর্ম ত্যাগ করে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করেন। কোচ রাজবংশের সন্তান হিসেবে এঁরা নিজেদেরকে 'রাজবংশী' নামে নিজেদের পরিচয় দিতে থাকেন। অন্যদিকে এদের একটি অংশ মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করে, এবং 'কেওট রাজবংশী' নামে পরিচিতি পান। হিন্দু ধর্মাবলম্বী রাজবংশীরা নিজেদেরকে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত করে নিজেদের আভিজাত্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন সেই সময়েই। তবে এদের এই পরিচয় জ্ঞাপনের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মত ছিল। সেই সূত্রে কোচদের ভিতরে কয়েকটি গোত্র বা গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে।  যেমন-

ব্রিটিশ ভারতে রাজবংশীরা উল্লেখিত শ্রেণিভাগগুলো নিষ্ঠার সাথে মেনে চললেও, বর্তমানে এই বিভাজন তীব্রতর নেই। জীবন-জীবিকার জন্য এরা প্রায় সকল ধরণের পেশার কাজ করে। আধুনিকতার ছোঁওয়ায় এদের ঘরবাড়ি, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক ইত্যাদির নানা পরিবর্তন ঘটেছে।

পরিবার ও বিবাহ: কোচরা আদিতে ছিল মাতৃতান্ত্রিক। হিন্দু বা ইসলাম ধর্মগ্রহণের পর রাজবংশী বা কেওট রাজবংশীরা পিতৃতান্ত্রিক জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়। তাই পিতাই পরিবারের প্রধান। পিতার মৃত্যুর পর পুত্রসন্তান সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে থাকে। বিবাহ পরিবারের অভিভাবক ঠিক করেন। বিবাহের জন্য ঘটক নিয়োগ করা হয়। পাত্রপক্ষের ঘটক বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে পাত্রীপক্ষের বাড়িতে অবস্থান করে, কন্যাকে পর্যবেক্ষণ এবং পরিবারে আচার-আচরণ লক্ষ্য করে। এই সময় কাপড়ে আগুন লাগলে, জলের কলসী বা ভাতের হাড়ি ভাঙলে, বিবাহ বাতিল করা হয়।

বিশ্বকোষ চতুর্থ খণ্ড নগেন্দ্রনাথ বসু। (১৩০০ বঙ্গাব্দ।)-থেকে গৃহীত।

হিন্দুরীতির মতো উঠোনে অস্থায়ী আটচালা তৈরি করে, তার ভিতরে কলাগাছ ও পানিভরা কলসি দিয়ে বিবাহস্থল তৈরি করা হয়। একটি কলাগাছ এবং একাটি জলভরা কলসী দিয়ে কয়েকটি একক তৈরি করা হয়। এর ভিতরে ৫টি একক থাকে কন্যাসনের জন্য। বরাসনে থাকে দুটি পূর্ণ কলসী একটি চালনী এবং একটি কুলা দিয়ে সাজানো। এইভাবে সাজানো বিবাহস্থলকে বলা হয় মারুয়া। বিবাহের সময় বরকে সামনে রেখে কনে পাঁচবার এই মারুয়া প্রদক্ষিণ করে। প্রতিবার প্রদক্ষিণ শেষে বরকনে পরস্পরকে আতপ চাল সোলার কড়ি ছুঁড়ে পারে। এছাড়া অঞ্চলভেদে নানা ধরনের বিবাহের আচার অনুসরণ করা হয়। এই বিবাহ পরিচালিত হয় একজন পুরোহিতের মাধ্যমে। পুরোহিত ছাড়া উচ্চবংশীয় রাজবংশীদের ভিতরে সংক্ষিপ্ত বিবাহের প্রচলন আছে। মালাবদল, চালনী কাপড়, শঙ্খ স্থাপনের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন এই বিবাহকে বলা হয় গান্ধর্ব বিবাহ।

এদের কোনো কোনো শ্রেণিতে বিধবা বিবাহের প্রচলন আছে। তবে বিধবা তার মৃত স্বামীর নিকট আত্মীয়কে বিবাহ করতে পারে না। সংসারের গৃহকর্তা মারা গেলে, ওই গৃহকর্তী স্বামীর ঘনিষ্ট আত্মীয় ব্যতীত অন্যকোনো পুরুষের সাথে স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকতে পারে। তাকে বিবাহ করতে হয় না। বিধবা বিবাহের সূত্রে এদের একটি অভিজাত গোত্র নির্ধারিত হয়েছে। যে পরিবারে কোনো বিধবা বিবাহ হয় নি, সেই পরিবার কুলীন হিসেবে বিবেচিত হয়। রাজবংশীরা এই বংশকে বলে মহৎ। এই বংশের কন্যাকে বিবাহের ক্ষেত্রে বরপক্ষকে বড় অঙ্কের কন্যাপণ দিতে হয়।

স্ত্রী গুরুতর অপরাধ, অবাধ্যতা ইত্যাদির কারণে, গ্রাম্যপঞ্চায়েতের কাছে বিচার উপস্থাপন করা হয়। স্ত্রীর অপরাধ প্রমাণিত হলে, নাপিত তার চুল কেটে দেয়। এরপর স্বামী তার নিজগোত্র থেকে ওই নারীকে বহিস্কার করে।

বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান:

পেশা: রাজবংশীরা ছিল মূলত কৃষিজীবী। এর বাইরে কিছু কিছু শ্রেণি মাছধরা এবং মাছ বিক্রয় করার মতো পেশায় দক্ষ হয়ে উঠেছিল। বর্তমানে এই কাজগুলো সকল রাজবংশীরাই করে থাকে। দেশজ উপদান দিয়ে এরা নানা গৃহস্থালী উপকরণ তৈরিতে বেশ দক্ষ। বিশেষ করে রাজবংশী মেয়েরা কুটির শিল্পের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই দক্ষ।

পোশাক: পাহাড়ি আদি রাজবংশীদের পুরুষরা নেংটি জাতীয় কাপড় কোমড়ে জড়িয়ে রাখতো। মেয়েরা একটু লম্বাঝুলের কাপড় কোমড়ের পেঁচিয়ে রাখতো। এছাড়া ছিল বক্ষবন্ধনীর মতো আবরণ ছিল ঊর্ধাঙ্গে। সমতলভূমিতে নেমে আসার পর, বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রভাবে ধুতি, শাড়ি পড়া শুরু করে। পরবরতী সময়ের পোশাকের পরিবর্তন ঘটেছে পাহাড়ি বাঙালিদের মতই। বিয়ের সময় বর কনে উভয়ই পাড়বিহীন সাদা কাপড় পরে। একসময় রাজবংশী নারীরা চারহাত দৈর্ঘ্য এবং আড়াই হাত প্রস্থের হাতে বোনা মোটা ধরনের বহু বর্ণ রঞ্জিত এক বস্ত্র পরিধান করতো। এর নাম ছিল ‘ফতা’। বর্তমানে সুতার অভাবে এটি আর তৈরি হয় না।

অলঙ্কার: আদি রাজবংশী মেয়েরা কাঠের মাটির গহনা ব্যবহার করতো। চুলের অলংকার হিসেবে তারা সিঁথা-পাটি, সেঁদ, বন ব্যবহার করতো। বাঙালিদের সংস্পর্শে আসার পর, ধাতব অলঙ্কার ব্যবহার করা শুরু করে। এদের মধ্যে ছিল কানের, হাতের, গলার ও কোমরের নানা ধরনের অলঙ্কার। বর্তমানে এদের যে সকল অলঙ্কারের নাম পাওয়া যায়, তা হলো-

ভাষা: ভাষা বিচারে এরা বৃহত্তর বোড়ো ভাষা গোত্রভুক্ত হলেও বর্তমানে তা লুপ্ত হয়ে গেছে। এই ভাষার কোনো নিজস্ব লিপি ছিল না। এদের সাহিত্যের-নিদর্শন কোনো লিপিতেই রচিত হয় নি। এদের ভাষায় ‘বোড়ো ভাষার উৎস জাত শব্দাবলী ও বোড়ো ভাষার অপভ্রংশ শব্দ পরিলক্ষিত হয়। এদের ভাষায় বাংলা ক্রিয়া পদে ও বিশেষ্য পদের শেষে ও মাঝে ‘ঙ’, ‘ং’ এবং ‘ম’-এর উচ্চারণ ও ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এসব শব্দ রাজবংশীদের কথ্য ভাষায় বহুল প্রচলন রয়েছে।

ধর্ম: ধর্মের বিচারে এরা বহু-ঈশ্বরবাদী। আদিতে এদের প্রধান দেবতা ছিল শিব। কালক্রমে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সূত্রে বৈষ্ণবপন্থী ধর্ম-দর্শন চালু হয়েছে। রংপুর ও কোচবিহারের রাজবংশীদের অধিকাংশই বৈষ্ণব ও শৈব। অন্যান্য অঞ্চলে এই দুই পন্থী ছাড়াও প্রকৃতি-পূজারী দেখা যায়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শৈব, বৈষ্ণব, বৌদ্ধ, তান্ত্রিক প্রভৃতি বিশ্বাসের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায়। তাই এদের দেবতার তালিকায় পাওয়া যায় শিব, বিষহরী (মনসা, দুর্গা, কালী (শ্যামা), লক্ষ্মী, জগন্নাথ, নারায়ণ, বিষ্ণু প্রভৃতি দেবদেবীদের। এর বাইরে রয়েছে প্রাচীন কৃষিসংস্কৃতির প্রতীক ‘বারিধারা’ ব্রত কিংবা উর্বরতা ও প্রজননের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্রত বা অনুষ্ঠানাদি এবং এদের সাথে যুক্ত দেবদেবী। যেমন শস্য রোপণের পূর্বে এরা বলিভদ্র ঠাকুরের পূজা করে। আবার খরা, অনাবৃষ্টি উপলক্ষে ‘হুদুমা’ পূজা করে। প্রকৃতি উপাসক হিসেবে এরা পাহাড়, নদী, অরণ্য ও মৃত্তিকার পূজা করে। সংসারের মঙ্গল কামনায় এরা বাস্তুদেবতা হিসেবে 'বাহাস্তো' বা 'বাহুস্তো' পূজা করে।  এরা হিন্দুদের মতো এরা শবদাহ করে। তবে, কুষ্ঠরোগী, শিশু ও সর্পদংশনে মৃতদের মাটিতে গর্ত করে পুঁতে ফেলা হয়।

সঙ্গীত সংস্কৃতি:
এদের পূজা-পার্বণে নৃত্যগীতোৎসব আদিবাসীসুলভ সামাজিক প্রথারূপেই ব্যাপকভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। আদিতে এদের গানে ধামসা, বাঁশীই বেশি ব্যবহৃত হতো। বাঙালিদের সংস্পর্শে আসার পর লোকবাদ্যযন্ত্র হিসেবে দোতরা, সারিন্দার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এদের লোকসুর থেকে কালক্রমে  বিকাশলাভ করেছে, উত্তর বঙ্গের ভাওয়াইয়া সুরশৈলী।


সূত্র: