মানচিত্র : বাংলাপেডিয়া।

যশোর
সমনাম: যশোহর

বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের একটি জেলা।  

ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক: ২২°৪৮´ থেকে ২৩°২২´ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮°৫১´ থেকে ৮৯°৩৪´ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ।

ভৌগোলিক অবস্থান: জেলার উত্তরে ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলা, দক্ষিণ পূর্বে সাতক্ষীরা, দক্ষিণে খুলনা, পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং পূর্বে নড়াইল জেলা ।

প্রশাসনিক বিভাজন

বর্তমানে এই জেলাটি ৮টি উপজেলায় বিভক্ত। এই উপজেলাগুলো হলো
যশোর সদর, অভয়নগর, কেশবপুর, চৌগাছা, ঝিকরগাছা, বাঘারপাড়া, মনিরামপুর শার্শা

যশোরের ইতিহাস
যশোর একটি অতি প্রাচীন জনপদ।  হিন্দু পৌরাণিক গ্রন্থ মহাভারত, রঘুবংশের বর্ণনায় দেখা যায়, বঙ্গীয় ব-দ্বীপের এই অঞ্চল দু'টি শক্তিশালী 'তাম্রলিপি' ও'বঙ্গ'  রাজ্যের মধ্যবর্তী স্থানে ছিল।  খ্রিষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে টলেমীর মানচিত্রে দেখা যায়, বঙ্গীয় ব-দ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলের ভূ-ভাগে গঙ্গার দু'টি প্রধান শাখা পদ্মা ও ভাগীরথীর বাহিত পলি দ্বারা গঠিত হয়েছিল। টলেমীর বর্ণনায় দেখা যায় যে, খ্রিষ্টীয় প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে বর্তমান যশোর জেলাসহ বঙ্গীয় ব-দ্বীপের সম্পূর্ণ অংশ নিয়ে একটি শক্তিশালী রাজ্য গঠিত হয়েছিল। এ রাজ্যের রাজধানী স্থাপিত হয়েছিল 'গঙ্গা' নামক স্থানে। টলেমীর বর্ণনানুযায়ী রাজধানী শহরটি তাম্রলিপির দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে অবস্থিত ছিল।

খ্রিষ্টীয় ৪র্থ শতকের শুরুর দিকে 'বঙ্গ'-এ বেশ কিছু স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব হয়েছিল। কিন্তু ভারতবর্ষের উত্তরাংশে গুপ্ত রাজবংশ (২৪০ থেকে ৫১০ খ্রিষ্টাব্দ) উত্থান এবং এদের সাম্রাজ্যের বিস্তারের সূত্রে, এ সব ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো স্বাধীনতা হারায়। এলাহাবাদে প্রাপ্ত (স্তম্ভ) শিলালিপি থেকে দেখা যায়, রাজা সমুদ্রগুপ্ত (৩২৫-৩৮০ খ্রিষ্টাব্দেৱ) বঙ্গদেশের পশ্চিম এবং উত্তরাঞ্চল গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এই সময় সমতটের (পূর্ববঙ্গ) শাসনকর্তাও গুপ্ত সম্রাটের সার্বভৌম কর্তৃত্বকে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। এই সূত্রে যশোর অঞ্চলটিও গুপ্ত শাসকবর্গের অধীনে আসে। গুপ্তরাজবংশের দশম রাজা স্কন্ধগুপ্ত  ৪৬৭ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তাঁর পুত্র পুরগুপ্ত রাজা হন। তিনি ঠিক কতদিন রাজত্ব করেন তা জানা যায় না। এরপর রাজা হন কুমারগুপ্ত (দ্বিতীয়)। এই রাজা সম্পর্কেও তেমন কিছু জানা যায় না। এরপর রাজত্ব লাভ করেন বুধগুপ্ত। আনুমানিক ৫০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বুধগুপ্ত মৃত্যুবরণ করেন। বুধগুপ্তের আমলে গুপ্তরাজ্য বিশাল ছিল বলে জানা যায়।  এই রাজাদের দুর্বলতার সুযোগে গাঙ্গেয় উপত্যাকায় মৌখরীদের রাজাদের উত্থান ঘটে। এর ফলে খ্রিষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি সময়ে গুপ্ত সাম্রাজ্যের বঙ্গদেশেও দু'টি স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। প্রথমটি ছিল বঙ্গ এবং দ্বিতীয়টি ছিল গৌড়। এই ধারাবাহিকতায় বর্তমান যশোর জেলা বঙ্গ রাজ্যের অধীনে আসে।

ফরিদপুর জেলার নিকটবর্তী কোটালিপাড়া থেকে আবিষ্কৃত পাঁচটি এবং বর্ধমান (ভারতে অবস্থিত) জেলা থেকে আবিষ্কৃত অপর একটি শিলালিপি থেকে  বঙ্গের তিনজন শাসনকর্তার নাম জানা যায়। তাঁরা হলেন গোপচন্দ্র, ধর্মাদিত্য এবং শ্যামচার দেব। তাদের নামের আগে যুক্ত ‘মহারাজা’ পদবি প্রমাণ করে যে তারা প্রত্যেকেই ছিলেন স্বাধীন এবং ক্ষমতাধর রাজা ছিলেন। কিন্তু এ তিনজন রাজার  পারস্পারিক সম্পর্ক এবং তাদের উত্তরাধিকারের ক্রম সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয় নি। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষ করে সাভার (ঢাকা জেলা) এবং (ফরিদপুর জেলা) থেকে বিপুল সংখ্যক স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায়। এসব স্বর্ণমুদ্রা থেকে ধারণা করা যায় যে, শ্যামচার দেবের পরেও এ অঞ্চলে বেশ কয়েকজন রাজার অস্তিত্ব ছিল। খ্রিষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতকের শেষ ভাগে চালুক্যের নৃপতি কীর্তিবর্মন (৫৬৭-৫৯৭ খ্রিঃ) বঙ্গ রাজ্য আক্রমণ করেন। কীর্তিবর্মণ-এর আক্রমণে বঙ্গ হীনবল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে গৌড় শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত হলে, বঙ্গের একটি অংশ গৌড়ের অধীনে চলে যায়। এই সময় উত্তর ভারতের রাজা মৌখরী গৌড়ে বারবার আক্রমণ করতে থাকে।  মৌখরী রাজ বংশের ঈশান বর্মণ গৌড় রাজাকে পরাজিত করে, তাঁর রাজ্য থেকে বিতারিত করেন। একই সময় চালুক্য রাজারাও গৌড় আক্রমণ করা শুরু করে। ফলে অচিরেই গৌড় রাজ্য ক্ষীণবল হয়ে পড়ে। গৌড় রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে শশাঙ্ক গৌড়ের রাজ হন। সম্ভবত তিনি মগধ ও গৌড়ের অধিপতি মহাসেনের অধীনে মহাসামন্ত হিসেবে কিছুদিন রাজ্য শাসন করেন। ইনি উত্তর ও পশ্চিম বঙ্গের গুপ্তবংশীয় শাসকদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে, ৬০৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে গুপ্তশাসকদের নিয়ন্ত্রণ থেকে গৌড়কে মুক্ত করে একটি স্বাধীন রাজ্যের পত্তন ঘটিয়েছিলেন। গঞ্জামের তাম্রলিপি থেকে জানা যায়, শশাঙ্কের ৬১৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬৩৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছিলেন। এই সময় যশোহর শশাঙ্কের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়।

শশাঙ্ক-এর সাথে রাজা হর্ষবর্ধনের যুদ্ধ হলে, শশাঙ্ক পরাজিত হন। এই সময় যশোর রাজা হর্ষবর্ধনের অধিকারে আসে। বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ এর বর্ণনায় যায় যে, তিনি হর্ষবর্ধনের শাসনামলে বঙ্গদেশ পরিভ্রমণ করেন। তিনি ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে বঙ্গীয় ব-দ্বীপের নিম্নাঞ্চলে সমতট ও তাম্রলিপি অঞ্চলের উল্লেখ করেছেন। ভিন্নদেশী শাসকদের দ্বারা বাংলাদেশ যখন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন, সেই সময় বাংলাদেশের প্রবীন ও প্রাজ্ঞ নেতারা আত্মকলহ ত্যাগ করে, গোপাল নামক এক জনপ্রিয় সামন্তকে রাজা হিসেবে নির্বাচিত করেন। এই গোপাল থেকেই বঙ্গদেশে পাল বংশের শুরু হয়। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে গোপাল তাঁর রাজত্ব শুরু করেন। ১১৬২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পাল বংশ বাংলাদেশ শাসন করেছিল। [পালবংশীয় রাজত্বকাল]

খ্রিষ্টীয় ৮ম শতকের মাঝামাঝি সময়ে পালগণ উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। খুব সম্ভবত পাল রাজবংশের দ্বিতীয় শাসক ধর্মপাল (৭৭০-৮১০ খ্রিষ্টাব্দ) শাসনামলে বর্তমান যশোর জেলার উপর তাদের কর্তৃত্ব কায়েম হয়। রাজা ধর্মপাল তার পিতার নিকট থেকে একটি ক্ষুদ্র রাজ্যের উত্তরাধিকার লাভ করেছিলেন। কিন্তু তার পরাক্রম ও কূটনীতি এবং সেই সাথে ভাগ্যের পরশ তাকে ভারতবর্ষের উত্তরাংশে একট সুবিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেছিল। তিনিই পাল রাজাগণের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি যিনি ‘পরমেশ্বর’ এবং ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধিতে ভূষিত হন। তিনিও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী এবং পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।

ধর্মপালের পর তার পুত্র দেবপাল (৮১০-৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ)  সিংহাসনে আরোহণ করেন। ধর্মপালের ন্যায় দেবপালও দীর্ঘ সময় পর্যন্ত শাসন করেন এবং যশোর জেলার উপরও তার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব বজায় ছিল। তিনিও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। সেকারণে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে তিনি বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। দেবপালের পর পাল রাজবংশের রজত্ব লাভ করেন রাজা প্রথম শূরপাল (৮৫৫-৮৬০)। এই সময়ের ভিতরে বিগ্রহ পাল (৮৫৫-৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দ) কিছুদিন রাজত্ব করেন। এরপর রাজ হবন নারায়ণ পাল (৮৫৪-৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ), রাজ্যপাল (৯০৮-৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ), দ্বিতীয় গোপাল (৯৪০-৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ) এবং দ্বিতীয় বিগ্রহপাল (৯৬০-৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দ)। এরা ছিলেন অপেক্ষাকৃত দুর্বল শাসক। তাদের শাসনামলে বিদেশী আগ্রাসনের কারণে সুবিশাল পাল সাম্রাজ্য ক্রমশ ছোট হতে থাকে। এ সময়ে যশোহর এলাকার পালরাজাদের অধিকার বিনষ্ট হয়। মহীপাল প্রথম (৯৮৮-১০৩৮ খ্রিষ্টাব্দ) সিংহাসনে আরোহণের সাথে সাথে ক্ষয়িষ্ণু পাল সাম্রাজ্যের সুদিন ফিরে আসতে শুরু করে। তিনি সফলতার সাথে তাঁর হারানো এলাকাগুলোকে মুক্ত করেন। তাঁর সময়ে যশোর জেলার উপরও পাল কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপরের পাল রাজারা ছিলেন নয়াপাল (১০৩৮-১০৬৪ খ্রিষ্টাব্দ), তৃতীয় বিগ্রহপাল (১০৫৪-১০৭২ খ্রিষ্টাব্দ)দ্বিতীয় মহীপাল (১০৭২-১০৭৫ খ্রিষ্টাব্দ)। দ্বিতীয় মহীপাল তার শাসনামলের প্রথমদিকে যশোর জেলার উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরবর্তী দুর্বল শাসকদের কারণে, ক্রমে ক্রমে পালরাজাদের ক্ষমতা বিনষ্ট হয় এবং ১০৮০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যেই দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। উল্লেখ্য ১১৪৪ খ্রিষ্টাব্দে পাল রাজবংশের সপ্তদশতম রাজা তৃতীয় গোপাল (১১৪০-১১৪৪ খ্রিষ্টাব্দ)-এর মৃত্যুর পরে মদনপাল (১১৪৪-১১৫২ খ্রিষ্টাব্দ) রাজত্ব লাভ করেন। তাঁর পুত্র গোবিন্দপাল (১১৫২-১১৬২ খ্রিষ্টাব্দ) ছিলেন পালবংশের শেষ রাজা।

পাল রাজত্বকালের শেষের দিকে ১১২৫ খ্রিষ্টাব্দেই সেনবংশের প্রথম রাজা বিজয় সেন রাজত্ব কায়েম করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু তখনও সমগ্র বাংলাদেশের উপর অধিকার পাল রাজাদের ছিল। পাল রাজবংশের অন্তিম দশায়, বিজয়সেন (১০৯৭-১১৬০ খ্রিষ্টাব্দ) -এর আমলে যশোর জেলার উপর সেন রাজবংশের শাসনের সূত্রপাত হয়। তার উত্তরসূরি বল্লালসেন (১১৬০-১১৭৯ খ্রিষ্টাব্দ) এবং লক্ষ্মণসেন (১১৭৯-১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ) এই অঞ্চলের উপর তাদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১২০৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি নামক জনৈক তুর্কি সেনাপতি আকস্মিকভাব সেনবংশের রাজা লক্ষ্মণসেন (১১৭৯-১২০৬ খ্রিষ্টাব্দ)-এর অস্থায়ী রাজধানী নদীয়া আক্রমণ করে দখল করে নেন। এই সময়  লক্ষ্মণসেন পালিয়ে পূর্ববঙ্গে আশ্রয় নেন। এই সূত্রে বাংলাদেশের খিলজী শাসনের সূত্রপাত হয়। তবে যশোর অঞ্চল খিলজি শাসনামলে সেন রাজত্বের অংশ হিসেবে ছিল। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকের শাসনামলে এ অঞ্চল মুসলমানদের শাসনাধীনে আসে।

১২৬৫ খ্রিষ্টাব্দে নাসিরুদ্দিন মাহমুদ ৃত্যুবরণ করলে, দিল্লীর ক্ষমতায় আসেন গিয়াসউদ্দিন বলবন১২৬৬ খ্রিষ্টাব্দে গৌড়ের অধিকার গিয়াসউদ্দিনের ছিল। তিনি আমিন খাঁকে শাসনকর্তা এবং মুঘিসউদ্দিন তুঘ্রালকে সহকারী-শাসনকর্তা পদে নিযুক্ত করেন। আমিন খাঁ নামে মাত্র শাসনকর্তা ছিলেন। তাঁর নামে বাংলার শাসক হয়ে উঠেন তুঘ্রাল। তিনি ঢাকা,  ফরিদপুর এবং ত্রিপুরা দখলের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এছাড়া তিনি বরিশাল অঞ্চলে দনুজ রাই নামক কায়স্থ রাজার সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। এই যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না।

তুঘ্রালের এই সকল বিজয়ের পর তিনি নিজেকে অত্যন্ত শক্তিশালী শাসক হিসেবে ভাবা শুরু করেন। এর ভিতর গিয়াসউদ্দিন বলবন-এর মিথ্যা মৃত্যু সংবাদ প্রচারতি হলে, নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা দেন এবং আমিন খাঁকে বিতারিত করেন। ফলে ১২৮০ খ্রিষ্টাব্দে তুঘ্রালকে শায়েস্তা করার জন্য বাংলা আক্রমণ করেন। তুঘ্রাল দিল্লীর সেনাবাহিনীর মুখোমুখী না হয়ে লক্ষ্মণাবতী ত্যাগ করেন। সুলতানের বাহিনী লক্ষ্মণাবতী দখল করেন এবং তুঘ্রালকে বন্দী করার জন্য তাঁর পশ্চাদানুসরণ করেন। উড়িষ্যা সীমান্তের কাছে, সুলতান বাহিনী তাঁকে আকস্মিকভাবে আক্রমণ করেন। যুদ্ধে তিনি পরাজিত হলে, তাঁকে বন্দী করে লক্ষ্মণাবতীতে আনা হয়। ১২৮৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সুলতান তাঁকে সপরিবারে হত্যা করেন।
তুঘ্রালের পতনের পর,  গিয়াসউদ্দিন কিছুদিন লক্ষ্মণাবতীতে কাটান। তারপর তাঁর পুত্র বঘরা খাঁর কাছে বাংলার শাসনভার ন্যস্ত করে তিনি দিল্লীতে ফিরে যান। এরপর বখরা খাঁ সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ উপাধি ধারণ করে স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করতে থাকেন।  

১৩২৮ খ্রিষ্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন তুঘলক তাঁর অধিকৃত বাংলাকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করেন। এই ভাগ তিনটি হলো লক্ষ্মণাবতী, সাতগাঁও এবং সোনারগাঁও। উচ্চাভিলাষী বাহাদুর শাহ সোনারগাঁ-এর ক্ষমতা দখল করার উদ্যোগ নিলে, বাহারাম খাঁ তাঁকে পরাজিত করেন। পরে তাঁকে হত্যা করা হয়। এরপর বাহরাম শাহ সোনারগাঁ-এর একমাত্র শাসকে পরিণত হন। ১৩৩৮ বাহরাম শাহ মৃত্যুবরণ করেন। এই সময় বাহরাম শাহ-এর ফখরুদ্দিন নামক একজন অনুচর সোনারগাঁও-এ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর লক্ষ্মণাবতীর শাসক কাদর খাঁ এবং সাতগাঁ-এর শাসক ইজউদ্দিন সোনারগাঁও আক্রমণ করেন। এই আক্রমণের মুখে ফখরুদ্দিন পালিয়ে যান। এই বিদ্রোহ দমনের সূত্রে কাদর খাঁ লক্ষ্মণাবতী ও সোনারগাঁও-এর শাসক হিসেবে নিযুক্ত হন। এর কিছুদিন পর কাদর খাঁ-এর সেনাবাহিনী বিদ্রোহ করে তাঁকে হত্যা করে। এই সুযোগে কাদর খাঁ-এর আলিমোবারক লক্ষ্মণাবতীর শাসনভার গ্রহণ করেন। ইতিমধ্যে মহম্মদ-বিন-তুঘলকের বিরুদ্ধে পুরো তুঘলকি সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ সৃষ্টি হলে, আলিমোবারক 'আলাউদ্দিন-আলি-শাহ' উপাধি গ্রহণ করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর কিছুদিন পরে তাঁর ইলিয়াস শাহ নামক এক ভাই দিল্লী থেকে এসে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে হাজির হন। ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দে ইলিয়াস শাহ তাঁকে পরাজিত করে লক্ষ্মণাবতীর সিংহাসনে বসেন। এই সূত্রে বাংলার ইতিহাস একটি নবতর রূপ লাভ করে। তাঁর মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয় ইলিয়াস শাহী রাজবংশ । এই সময় যশোর জেলা পুনরায় লক্ষণাবতীর অধীনে চলে যায়।  

ইলিয়াস শাহী রাজবংশের চতুর্থ শাসক হামজা শাহ (১৪০৯-১৪১৩ খ্রিষ্টাব্দ)-এর মৃত্যুর পর, শিহাবউদ্দিন বায়াজিদ অল্প সময়ের জন্য সিংহাসনের অধিকারী হন। এই সময় রাজা গণেশ নামক জমিদার ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসেন। তিনি হামজা শাহ -এর আমলেই একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। ১৪১৫ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ-কে হত্যা করে, সিংহাসন দখল করেন। এই সূত্রে ইলিয়াস শাহী রাজবংশ প্রথম পর্যায় (১৩৪২-১৪১৫) শেষ হয় এবং শুরু হয় রাজা গণেশের রাজত্বকাল। এই সময় বাংলার মুসলমান দরবেশরা হিন্দু রাজার বিরুদ্ধে মুসলমান প্রজাদের বিরুদ্ধে  ক্ষেপিয়ে তোলেন। এই সময় গণেশ কয়েকজন বিদ্রোহী দরবেশকে হত্যা করেন। ফলে মুসলমান প্রজাদের বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করে। এই সময় বিদ্রোহীদের নেতা নূরকুৎব আলম জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কিকে বাংলা আক্রমণের আমন্ত্রণ জানান। ইব্রাহিম শর্কি বাংলা আক্রমণ করলে, গণেশ সিংহাসন ত্যাগ করেন। এই সময় তাঁর পুত্র যদু সেন (ভিন্ননাম জিৎমল), ইব্রাহিমের পক্ষে চলে যান। পরে রাজ্য লোভে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে জালালউদ্দিন নাম ধারণ করেন। ইব্রাহিম শাহ, জালালুদ্দিনকে সিংহাসনে বসিয়ে জৌনপুরে ফিরে যান। ইব্রাহিম শাহ ফিরে যাওয়ার পরপরই, গণেশ ক্রম ক্রমে আবার ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসেন এবং পুত্রের ছায়ায় তিনি রাজ্য শাসন করা শুরু করেন। এই সময় তিনি বাংলার বিদ্রোহী দরবেশদের কঠোর হাতে দমন করেন। এরপর তিনি জালালউদ্দিনকে ক্ষমতাচ্যুত করে, সিংহাসন অধিকার করেন। এই সময় তিনি 'দনুজমর্দনদেব' নাম ধারণ করেন। তিনি মুসলমান দরবেশদের প্রতি হিংসাত্মক আচরণ করলেও, সাধারণ মুসলমানদের প্রতি সদয় ব্যবহার করেছেন বলেই জানা যায়। এই কারণে সাধারণ মুসলমানদের সমর্থন তাঁর প্রতি ছিল।

ইতিমধ্যে ১৪১২-১৪ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে হজরত খানজাহান আলী (রঃ) তাঁর অনুগত শিষ্যদের নিয়ে ঝিনাইদহের বাগবাজারের  আস্তানা গড়ে তোলেন এবং সেখানে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। অচিরেই এই অঞ্চলে বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। এরা রাজার চেয়েএই ইসলাম প্রচারকের অনুগত ছিল অনেক বেশি। রাজা গণেশের বিরুদ্ধে দরবেশদের বিদ্রোহের সময় খানজাহান আলী অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়। কথিত আছে, রাজা গণেশের সৈন্যরা এই বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য সৈন্য পাঠালে, তারা খানজাহান আলীর অনুগত শিষ্যদের কাছে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। যতদূর জানা যায়, এর কিছু পরে খানজাহান আলী তাঁর শিষ্যদের নিয়ে যশোর জেলার বারবাজার হয়ে ভৈরব নদী অতিক্রম করে বাগেরহাটে পৌঁছেছিলেন। বাগেরহাট অঞ্চলে অবস্থানকালে তিনি স্থানীয় মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি এই অঞ্চলের পানীয় জলের অভাব দূর করার জন্য বহু দীঘি খনন করেন।  এই সময়ে এখানে ষাটগম্বুজসহ অসংখ্য মসজিদ,  অগণিত হাট-বাজার তৈরি করেন। ইলিয়াস শাহী রাজবংশ, দ্বিতীয় পর্যায়ে (১৪৪২-১৪৮৭ খ্রিষ্টাব্দ) বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ (১৪৪২-১৪৫৯)। তখন হযরত খানজাহান(রঃ) এ অঞ্চলের নামকরণ করলেন ‘খলিফাত-ই-আবাদ’ বা প্রতিনিধির অঞ্চল। তাঁর মাজারগাত্রে উৎকীর্ণ শীলালিপি হতে জানা যায় ২৬ জিলহজ্ব ৮৬৩ হিজরী (১৪৫৯ খ্রিঃ) তে তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

১৪১৮ খ্রিষ্টাব্দে রাজা গণেশ মৃত্যুবরণ করেন। এরপর তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র মহেন্দ্রদেব রাজত্ব লাভ করেন।  পরে জালালউদ্দিন মুসলমানদের আমিরদের সহায়তায় মহেন্দ্রদেবকে অপসারিত করে সিংহাসন দখল করেন। জালালউদ্দিন পূর্ববঙ্গ ও চট্টগ্রাম অঞ্চলসহ প্রায় সমগ্র বাংলা অধিকার কৱতে সক্ষম হন। জালালউদ্দিন ১৪৩১ 'খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ক্ষমতায় বসেন তাঁর পুত্র সামস্‌উদ্দিন আহমেদ। কিন্তু তাঁর কুশাসনে দেশে অরাজকতার সৃষ্টি হয়। এই সময় সাদি খাঁ এবং নাসির খাঁ নামক দুইজন আমির তাঁকে হত্যা করেন। এর ভিতর দিয়ে রাজা গণেশ-এর বংশধরদের রাজত্বকালের অবসান হয়। সামস্‌উদ্দিন আহমেদ দুই হত্যাকারী আমির পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং উভয়ই নিহত হন। এরপর অন্যান্য আমিররা ইলিয়াস শাহ বংশের নাসিরউদ্দিন মাহমুদকে ১৪৪২ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসান। এর ফলে ইলিয়াস শাহী বংশের রাজত্বকাল দ্বিতীয়বারের মতো শুরু হয়। নাসিরউদ্দিন মাহমুদ ১৪৪২ খ্রিষ্টাব্দে থেকে ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁর মৃ্ত্যুর পর সিংহাসন লাভ করেন তাঁর পুত্র রুকনদ্দিন বরবক। ১৪৭৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বরবক মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর রাজত্বকালের উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল চট্টগ্রাম, যশোহর, খুলনা ও বাখেরগঞ্জ অঞ্চলকে নিজ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ১৪৭৪ খ্রিষ্টাব্দে রুকনদ্দিন-এর পুত্র সামসউদ্দিন রাজত্ব লাভ করেন। তিনি রাজত্ব করেন ১৪৮১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। সিংহাসনের নিরাপত্তার জন্য, রুকনউদ্দিন বরবক্ আফ্রিকা থেকে বহু হাবসী ক্রীতদাস এনেছিলেন। কালক্রমে এরাই শক্তিশালী হয়ে উঠে।   ১৪৮৭ খ্রিষ্টাব্দে মুজফ্‌ফর নামক এক হাবসী  ইলিয়াসশাহী রাজবংশের শেষ সুলতান জালালউদ্দিনকে হত্যা করে ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসে। কিন্তু কুশাসনের জন্য বাংলায় আবার ঘোরতর অরাজকতা সৃষ্টি হয়। এই কারণে এদের শাসনামলকেও অন্ধকারযুগ বলা হয়। ১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত হাবসি শাসন চলে। এই সময় রাজ্যের প্রধান মন্ত্রী হুসেন শাহ-এর নেতৃত্বে বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করে। বিদ্রোহীরা মুজফ্ফরকে হত্যা করে। ১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার সিংহাসনে আলাউদ্দিন হুসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দ) বসেন। এর দ্বারা সূচিত হয়, হুসেনশাহী রাজবংশের। ১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে  হুসেন শাহ-এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নসরৎ শাহ (১৫১৯-১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দ) সিংহাসন লাভ করেন।

১৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে নসরৎ শাহ আততায়ীর হাতে নিহত হন।  এরপর সিংহাসনে বসেন তাঁর পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ।
ফিরোজ শাসনকার্যে অনুপযুক্ত ছিলেন। তাঁর কুশাসনের বিরুদ্ধে আমিররা বিদ্রোহ করেন। এই সময় বিহারের লোহানী আমিররা শের শাহ-এর ক্ষমতা বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে, শেরশাহকে আক্রমণ করার জন্য সুলতান মাহমুদ শাহকে উদ্বুদ্ধ করেন। ফলে ১৫৩৪ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ সম্মিলিত বাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়েন। সুরজগড়ের যুদ্ধে শের খাঁ সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন। এই যুদ্ধ জয়ের পর শের খাঁ সমগ্র বিহারের সুলতান হয়ে উঠেন। ১৫৩৬ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ পুনরায় বাংলা আক্রমণ করেন। প্রথমে তিনি বাংলার কিছু অংশ দখল করেন। এই সময় মাহমুদ শাহ শেরখাঁকে ১৩ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করে সন্ধি করেন। ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দে শেরখাঁ পুনরায় বাংলা আক্রমণ করে গৌড় অধিকার করেন। এবং শেষ পর্যন্ত মাহমুদকে সম্পূর্ণ পরাজিত করে বাংলা থেকে বিতারিত করেন। এর ফলে বাংলাদেশে হুসেনশাহী রাজবংশের শাসনের অবসান হয়। এরপর শুরু হয় শের শাহ-এর রাজত্ব কাল।

১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ কনৌজের যুদ্ধে হুমায়ুনকে পরাজিত করে, দিল্লীর সিংহাসন দখল করেন। এই যুদ্ধে জয়ের পর, শেরশাহ একে একে দিল্লী. আগ্রা, জৌনপুর, বিহার ও বাংলাদেশের সম্রাট হন। কিন্তু ১৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে মাহমুদ শাহ'র জামাতা খিজির খাঁ বাংলাদেশে নিজেকে স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা দেন। শের শাহ বাংলা আক্রমণ করে  খিজির খাঁকে বন্দী করেন। এই সময় তিনি বাংলাকে দুর্বল করার জন্য, বাংলাকে ১৯টি সরকারে বিভাজিত করেন। এই সরকারগুলোর শাসনভার অর্পণ করেন 'কাজী-ফজল' নামক জনৈক কর্মচারির উপর।

১৫৪৫ খ্রিষ্টাব্দে শের শাহ-এর মৃত্যুর পর, তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র জালাল খাঁ সিংহাসন লাভ করেন। সিংহাসন লাভের পর তিনি নামগ্রহণ করেন ইসলাম খাঁ। ১৫৫৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাতে আর কোনো বিদ্রোহ হয় নি। ১৫৫৩ খ্রিষ্টাব্দ ইসলাম খাঁ'র মৃত্যুর পর, বাংলার সুর-শাসক মহম্মদ খাঁ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং জৌনপুর দখল করেন। এরপর আগ্রা অভিমুখে যাত্রা করলে, ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দে মহম্মদ শাহ আদিলের সেনাপতি হিমু তাঁকে বাধা দেন। যুদ্ধে মহম্মদ শাহ পরাজিত হলে, মহম্মদ শাহ আদিল নিজ অনুচর শাহবাজ খাঁকে বাংলার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। কিন্তু অচিরেই মহম্মদ খাঁর পুত্র খিজির খাঁ পরাস্ত করেন এবং গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ উপাধি ধারণ করে বাংলার সিংহাসন দখল করেন।

১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে হিমুকে পরাজিত করে আগ্রার সিংহাসন অধিকার করেন। এই সময় বাংলার শাসনকর্তা গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর পলায়মান আদিল শাহকে সুরকগড়ের কাছে পরাজিত ও হত্যা করেন। ফলে বাংলার শাসন ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপই গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর অধিকার করেন। ১৫৬০ খ্রিষ্টাব্দে এই প্রথম গিয়াসউদ্দিন মৃত্যুবরণ করলে, তাঁর পুত্র দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ ১৫৬৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁর মৃ্ত্যুর পর, তাঁর এক আমির তৃতীয় গিয়াসউদ্দিন নাম ধারণ করে ১ বৎসর রাজত্ব করেন। ১৫৬৩ খ্রিষ্টাব্দে কর্‌রানী এই গিয়াজউদ্দিনকে পরাজিত করে বাংলায় কররানী রাজ বংশের প্রতিষ্ঠা করে। এর ভিতর দিয়ে বাংলাদেশে শেরশাহ সুরি রাজবংশের শাসন বিলুপ্ত হয়ে যায়। ১৬৭২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পর সুলতান কর্‌রানি মৃত্যুবরণ করলে, তাঁর পুত্র বায়েজিদ কর্‌রানি সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর দুঃশাসনে অতীষ্ট হয়ে, হান্সু নামক একি আমির তাঁকে হত্যা করেন। এরপরই সুলেমানের বিশ্বস্ত মন্ত্রী মিঞা লুদি হান্সুকে হত্যা করে সুলেমানের কনিষ্ঠ পুত্র দাউদ কর্‌রানিকে সিংহাসনে বসান।

১৫৭৪ খ্রিষ্টাব্দে দাউদের একজন বিশ্বস্ত সহযোগী শ্রীহরি যশোরে একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। দাউদ তাঁকে  বিক্রমাদিত্য উপাধি দেন। বিক্রমাদিত্যের রাজধানী ছিল ঈশ্বরপুর এবং ত্রেকাটিয়াতে।

১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে দাউদের সাথে মোগল বাহিনীর যুদ্ধে দাউদ পরাজিত হয়ে বন্দী হন। পরে তাঁকে হত্যা করা হয়। এর ভিতর দিয়ে বাংলার কর্‌রানি বংশের শাসন শেষ হয়ে যায়। এই জয়ের দ্বারা বাংলাতে মোগল শাসনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। কিন্তু বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে তখনও আফগান শাসকরাই স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতেন। সে সময় বাংলার শাসনকর্তা হন মুনিম খাঁ। মুনিম খাঁ-এর মৃত্যুর পর মোগল শিবিরে ভাঙন ধরে। এই সময় অনেকেই মোগল শিবির ত্যাগ করে দিল্লীতে চলে যায়। এই অবসরে মীর্জা হাকিম নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা দেন। ক্রমে ক্রমে বাংলা ও বিহার মোগল সাম্রাজ্য থেকে বিচ্যুত হয়। আকবর মীর্জা হাকিম ও অন্যান্য বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য টোডরমল এবং মানসিংহকে পাঠান। মূল দমনের কাজটি করেন টোডরমল। আর মীর্জা হাকিম-এর সাম্ভাব্য পাল্টা আক্রমণ ঠেকানোর জন্য সাথে থাকেন মানসিংহ। উভয়ের প্রচেষ্টায় বাংলা আবার মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে টোডরমলকে বাংলার ওয়াজির পদ দেওয়া হয়।

১৫৮৩ খ্রিষ্টাব্দে যশোরের রাজা বিক্রমাদিত্য মৃত্যুবরণ করেন। বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর পর তাঁর জ্ঞাতি ভাই বসন্তরায় যশোরের রাজা হন।  ১৫৮৭ খ্রিষ্টাব্দে বসন্ত রায় রাজ্য ত্যাগ করে, বিক্রমাদিত্যের পুত্র প্রতাপাদিত্যের () যশোরের রাজা বলে ঘোষণা দেন। উল্লেখ্য প্রতাপাদিত্য ১৫৬০ খ্রিষ্টাব্দে গৌড়ে জন্মগ্রহণ করেন।  তাঁর প্রকৃত নাম ছিল গোপীনাথ। প্রতাপাদিত্য ছিল তার প্রাপ্ত উপাধি। সুন্দরবন অঞ্চলের ধুমঘাট ছিল তার রাজধানী।

১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলায় মোগল-আফগান সংঘাত অব্যাহত ছিল। ১৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার শাসনকর্তা হিসেবে আসেন রাজা মানসিংহ। এই সময় মোগল-আফগান সংঘাতের নতুন পর্ব শুরু হয়। এই পর্বের প্রধান প্রতিপক্ষের এক দিকে ছিলে বাংলার মোগল শাসক রাজা মানসিংহ, অন্যদিকে ছিল বাংলার বার ভূঁইয়ারা।

১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আকবর অসুস্থ হয়ে পড়লে, মানসিংহ দিল্লিতে ফিরে যান। ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মানসিংহের নামেই স্থানীয় মোগল শাসকরা শাসন করতেন। ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলায় মোগল শাসক হিসেবে আসেন ইসলাম খাঁ। ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম খান প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে অভিযান চালান। মুসা খাঁর সাথে যুদ্ধের সময় তিনি চুক্তি অনুসারে মোগলদের সাহায্য করেন নি, এই অজুহাতে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছিল। বাখেরগঞ্জের ভুঁইয়া রামচন্দ্র ছিলেন প্রতাপাদিত্যের জামাতা। রামচন্দ্র যাতে প্রতাপাদিত্যকে সাহায্য না করতে পারেন, সে কারণে ইসলাম খাঁ একই সাথে রামচন্দ্র-এর বিরুদ্ধে অপর একটি সেনাদল পাঠান।  প্রতাপাদিত্য যশোহর রক্ষার জন্য তাঁর পুত্র উদয়াদিত্যকে নিয়োগ করেন আর নিজে তাঁর রাজ্যের রাজধানী ধুমঘাট প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করেন। যুদ্ধে প্রথমে উদয়াদিত্য এবং পরে প্রতাপাদিত্য পরাজিত বন্দী হন। পরে বন্দী অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এরপর দীর্ঘসময় এই অঞ্চল মোগলদের অধিকারেই থেকে যায়।

১৭১২ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বাহাদুর শাহ মৃত্যুবরণ করলে, দিল্লির সিংহাসন নিয়ে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়। শেষ পর্যন্ত আজিম-উস-শান্-এর পুত্র ফারুকশিয়ার দিল্লির সিংহাসনে বসেন। মুর্শিদকুলি খান নতুন সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ১৭১৩ খ্রিষ্টাব্দে দেওয়ান পদ-সহ বাংলার সুবেদার করেন। ১৭১৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে উড়িষ্যার সুবেদার করেন এবং 'জাফর খাঁ' উপাধি দেন। ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে মুর্শিদকুলি খান বাংলার সুবেদার হন। এই সময় তিনি ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে বাংলার রাজধানী স্থানান্তর করেন।

মুর্শিদকুলী খাঁ সীতারাম রায় নামক একজন স্থানীয় রাজা যশোর অঞ্চলের শাসনের জন্য নিয়োগ দেন। উল্লেখ্য সীতারাম ছিলেন উত্তর রাঢ় বংশীয় কায়স্থ। তাঁর পিতা উদয় নারায়ণ ভূষণার ফৌজদারের অধীনে একজন তহশিলদার ছিলেন। রাজা সীতারাম রায়ের রাজধানী ছিল মহম্মদপুর। রাজা সীতারাম রায় ক্রমে ক্রমে শক্তি অর্জন করেন এবং এক সময় মুর্শিদকুলী খাঁর আনুগত্য অস্বীকার করেন। ফলে  মুর্শিদকুলী খাঁর সীতারামের বিরুদ্ধ সৈন্য প্রেরণ করেন। যুদ্ধে সীতারাম পরাজিত হন। এরপর যশোর অঞ্চল কয়েকটি জমিদারিতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই সময় নাটোর এর জমিদার, এ অঞ্চলের পূর্বাংশ, চাঁচড়ার জমিদার জেলার দক্ষিণাংশ এবং নলডাঙ্গার জমিদার জেলার উত্তরাংশ তাঁদের জমিদারির অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নবাব আলীবর্দী খান এবং সিরাজউদ্দৌলা শাসনামলে যশোর এঁদের শাসনাধীন ছিল। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে  ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি ধীরে ধীরে বাংলার শাসক হয়ে উঠে।

১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই আগষ্ট দিল্লীর সম্রাট শাহ আলম কোম্পানির সাথে সন্ধি চুক্তি করে। এই চুক্তি অনুসারে কোম্পানি অযোধ্যার কাছ থেকে প্রাপ্ত কারা এবং এলাহাবাদ সম্রাটকে উপহার দেয়। এছাড়া বাৎসরিক ২৬ লক্ষ টাকা কর প্রদানের বিনিময়ে, কোম্পানি বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা তথা দেওয়ানি লাভ করে। ফলে যশোর জেলা কোম্পানীর রাজস্ব প্রশাসনের অধীনে চলে যায়। প্রায় দুইশত বৎসর ইংরেজগণ উপমহাদেশে তাদের শোষণ ও নির্যাতনের শাসনকাল অব্যাহত রাখে।

কালেক্টর ভবন

১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে যশোরকে একটি পৃথক জেলায় পরিণত করা হয়। প্রথম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন  Mr. Tilman Henckell (1781-1789)। এই ম্যাজিষ্ট্রেটে কালেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। ১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে যশোরে কালেক্টরে অফিস স্থাপিত হয় জেলা অফিসেই।  ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে যশোরে নিজস্ব কালেক্টর ভবন তৈরি হয়। কালেক্টরেট ভবনটি বর্তমানে যশোরের দড়াটানাতে অবস্থিত। এটি শহরের প্রাচীনতম স্থাপনারগুলোর মধ্যে একটি। ভবনটি বর্তমানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। বর্তমান ভবনের একতলা স্থাপিত হয় ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে  তখনকার ২ লাখ ৬৩ হাজার ৬শ' ৭৯ টাকা ব্যয়ে। বাংলায় দীর্ঘতম এই ভবনটি ছিল সেই সময়ে দর্শনীয় এবং তা ৩৬০ দরজার ঘর নামে সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিত ছিল দীর্ঘকাল। এর দোতলা নির্মিত হয় ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে।

১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে যশোর জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৩২ জন শিক্ষার্থী নিয়ে স্থানীয় জমিদার পত্নী ক্যাত্যারিনীর কাছারীতে এর কার্যক্রম শুরু হয়। তখন এর নাম ছিল 'যশোর সরকারী মডেল স্কুল'। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় যশোর পাবলিক লাইব্রেরি।
১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে ঘোষিত হয় যশোর পৌরসভা।

ইংরেজ শাসনামলে এই অঞ্চলে কিছু বিদ্রোহ ঘটে। ইংরেজরা এই সকল বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ ভারত বিভাজনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ হিসেবে পূর্ব-পাকিস্তানের উদ্ভব হয়। এই সময় যশোর পূর্ব-পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। এই সময় নতুন সীমানারেখা নির্ধারণের ফলে, যশোর জেলার ভৌগোলিক আকারের পরিবর্তন ঘটে। এসময় যশোরের বনগ্রাম মহকুমাকে ভারতের সাথে সংযুক্ত করা হয়। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে এই জেলার মাগুরা মহুকুমার মহম্মদপুর থানার অংশ এবং নড়াইলের আলফাডাংগা থানাকে ফরিদপুর জেলার সাথে যুক্ত করা হয়।

১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, যশোর প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়, বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো, এই জেলাতেও গণহত্যা, ধর্ষণ সংঘটিত হয়। এছাড়া এই অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা বহু পাকসেনা এবং তাদের দোসর রাজাকার ও শান্তিকমিটির সদস্যদের হত্যা করে। ২৭শে মার্চ, পাকসেনাদের গুলিতে অভয়নগরে নওয়াপাড়া রেলস্টেশনের অফিস কক্ষে রেলওয়ের কয়েকজন স্টাফ শহিদ হন। এছাড়া নওয়াপাড়া আওয়ামী লীগের সহ-সম্পাদক নজিবর রহমানসহ আরও কয়েকজনকে হত্যা করা হয়। ২৯শে মার্চ, যশোর সদর উপজেলায় ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন ও লে. আনোয়ার এর নেতৃত্বে যশোর সেনানিবাসের বাঙালি সৈনিকরা বিদ্রোহ করে বেরিয়ে আসার সময় সংঘর্ষে প্রায় ৩০০ বাঙালি সৈন্য শহিদ হন। ২৮শে এপ্রিল যশোরে এ যশোর সদর উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রামে পাকবাহিনী গণহত্যা চালায় [বিস্তারিত] । ৫ই সেপ্টেম্বর যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গঙ্গানন্দপুর ইউনিয়নের গোয়ালহাটি গ্রামে, পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধের সময় বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ যুদ্ধে শহীদ হন।

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে স্বাধীন হলে, এই অঞ্চল বাংলাদেশের অংশে পরিণত হয়। ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ সরকার জেলার চার মহকুমাকে চারটি জেলায় পরিণত করা হয়। এই জেলাগুলো হলো নড়াইল, মাগুরা, ঝিনাইদহ এবং যশোর সদর।


সূত্র :