গুরুদুয়ারা নানকশাহী
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে অবস্থিত একটি শিখ ধর্মের উপাসনালয়। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের কলাভবনের পাশে অবস্থিত।

১৪৯৯ খ্রিষ্টাব্দে গুরু নানক নিজ ধর্মমত প্রচারের জন্য মিথিলা থেকে দিনাজপুরে আসেন এবং সেখানে কান্তজীর মন্দির পরিদর্শন করেন। এরপর তিনি কামরূপ ঘুরে সিলেটে যান। এখানে কিছুদিন কাটিয় নৌপথে ঢাকা আসেন। তিনি উত্তর ঢাকার শিবপুরে (বর্তমান রায়ের বাজার, ধানমণ্ডি এলাকার কোনো এক স্থানে) নৌকা থেকে অবতরণ করেন।  শিবপুরের মানুষের পানীয় জলের অভাব দূর করার জন্য সে সময়ের শিবপুর গ্রামের জাফরাবাদ এলাকায় একটি কূপ খনন করিয়েছিলেন। পরে সেখানে বিদেশি অতিথিদের স্নানের সুবিধার্থে এক স্থানীয় শাসক পুকুর খনন করিয়েছিলেন। ১৯৫৯ অবধি সে কূপটি স্থানীয় শিখরা দেখভাল করতেন। পরে আবাসন প্রকল্পের জন্য সরকার জমি বণ্টন করে দিলে পুকুরটি ভরাট করা হয়। কথিত আছে নানকের এই কুয়াটি বর্তমানে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ২৬ নং সড়কের ২৭৮ বাড়িতে অবস্থিত। তিনি ঢাকার নীলক্ষেত (তৎকালীন সুজাতপুর মৌজার অন্তর্গত ছিল) অঞ্চলে একটি মাঞ্জি প্রতিষ্ঠা করে ধর্মীয় উপদেশ দেন। উল্লেখ্য, পাঞ্জাবি শব্দ মাঞ্জি-র অর্থ হলো— আধ্যাত্মিক আলোচনার কেন্দ্র। পরে এটাই হয়ে ওঠে নানকশাহী গুরুদুয়ারা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

সোবা সিং অঙ্কিত গুরু নানকের ছবি

পরবর্তী সময় শিখ ধর্মের ৬ষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ সিং-এর সময়কালে (১৫৯৫-১৬৪৪ খ্রিঃ) ভাইনাথ (মতান্তরে আলমাস্ত) নামের জনৈক শিখ ধর্ম প্রচারক এই গুরুদুয়ারাটি সংস্কার করে নতুনভাবে নির্মাণের কাজ শুরু করেন। কারো কারো মতে, গুরুদুয়ারাটি নির্মাণের কাজ শুরু হয় ৯ম শিখ গুরু তেগ বাহাদুর সিং এর সময়কালে (১৬২১-১৬৭৫ খ্রিষ্টাব্দ)। কথিত আছে শিখ গুরু তেগ বাহাদুর সিং ১৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকাতে এসেছিলেন। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে এর নির্মাণকার্য সমাপ্ত হয়। পরবর্তী সময়ে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ে।

১৯১৫ থেকে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শ্রীচন্দ্র জ্যোতি নামে এক শিখসাধু এই উপাসনালয়ের পুরোহিত ছিলেন। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে ষাট দশক পর্যন্ত উপাসনালয়টি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে এই প্রার্থনালয়টির কিছু সংস্কার করা হয়। ১৯৮৮-৮৯ খ্রিষ্টাব্দে এটির ব্যাপক সংস্কার সাধন করা হয়। এই সময় এর বাইরের বারান্দা যুক্ত করা হয়। এই সংস্কার কাজের অর্থায়ন করেছিল বাংলাদেশে ও বিদেশে অবস্থানরত শিখ ধর্মাবলম্বীরা। ঢাকার আন্তর্জাতিক পাট সংস্থার তদানিন্তন প্রধান সর্দার হরবংশ সিং এর নির্মাণকার্য তদারক করেছিলেন।

অতীতে এর উত্তর দিকে একটি প্রবেশদ্বার ছিল। এর দক্ষিণদিকে ছিল একটি কূপ ও একটি সমাধিস্থল, পশ্চিম দিকে ছিল একটি শান বাঁধানো পুকুর। এছাড়া ভক্তদের থাকার জন্য জন্য কয়েকটি কক্ষ। এখন তার অনেক কিছুই নাই। বর্তমানে এই উপাসনালয়টি উঁচু প্রাচীরবেষ্টিত। এর প্রবেশপথটি রয়েছে দক্ষিণদিকে। উপাসনালয়টির সামনে রয়েছে চমৎকার সবুজ লন। এর বাম দিকে আছে শিখ রিসার্চ সেন্টার। সামনে পতাকা টাঙানোর খুঁটি। উপাসনালয়টির ওপর পৃথিবী আকৃতির একটি কাঠামো আছে, আর তার চারদিকে রয়েছে শিখ ধর্মীয় চিহ্ন খাণ্ডা। উপাসনালয়ের শীর্ষে রয়েছে শিখদের উপাসনালয়ের চিহ্ন ছাত্রার।

উপাসনালয়ের মাঝখানে রয়েছে একটি বড় কক্ষ। এই কক্ষের চারদিকে চারটি দরজা আছে। মাঝখানে কাঠের তৈরি বেদির ওপর রয়েছে শিখ ধর্মগ্রন্থ গ্রন্থসাহেব। বেদির সামনে নবম শিখগুরু তেগ বাহাদুর সিংয়ের ব্যবহৃত একজোড়া খড়ম একটি কাচের বাক্সের মধ্যে যত্নসহকারে রাখা আছে। এ কক্ষের মেঝেতে লাল রঙের কার্পেট পাতা,  এখানে বসে ভক্তরা গ্রন্থসাহেব পাঠ শোনেন। এখানে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা দুবার গ্রন্থসাহেব পাঠ ও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। তা ছাড়া প্রতি শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত সাপ্তাহিক জমায়েত ও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। এই সময় পুরোহিত গ্রন্থসাহেব পাঠ ও কীর্তন করেন। কীর্তন ও প্রার্থনা শেষে প্রসাদ বিতরণ করা হয়। এখানে শুক্রবারে আগত অতিথিদের জন্য মধ্যাহ্নভোজেরও ব্যবস্থা আছে। গুরুদুয়ারায় আয়োজিত বার্ষিক অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে গুরু নানকের জন্মবার্ষিকী এবং পয়লা বৈশাখ। এ দুটি পর্ব এখানে অত্যন্ত ধুমধামের সঙ্গে পালন করা হয়।

এই প্রার্থনালয়ে  কারও প্রবেশে বাধা নেই। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সব বয়সী নারী ও পুরুষ এখানে প্রবেশ করতে পারেন। কেউ মনে করলে প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করে প্রসাদ পেতে পারেন। ঢাকায় বসবাসরত শিখ সম্প্রদায়ের লোকজন নিয়মিত এই গুরুদুয়ারায় আসেন। তা ছাড়া অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকজনকেও শুক্রবার এই উপাসনালয়ে আসতে দেখা যায়। বর্তমানে স্থানীয় ভক্ত ও বিদেশী দাতাদের সাহায্যে প্রতিষ্ঠানটির ব্যয় নির্বাহ হয়।


সূত্র :