ঢাকা কলেজ
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে অবস্থিত একটি স্বনামধন্য কলেজ।

১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ২০ এপ্রিল তৎকালীন ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কিত দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ- জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন (General Committee of Public Instruction) লর্ড বেন্টিকের নিকট শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান তৈরির বিষয়ে প্রতিবেদন পেশ করে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিলো- সরকারের তত্ত্বাবধানে বাংলা প্রেসিডেন্সির প্রধান প্রধান জনবহুল শহরে ইংরেজি সাহিত্য এবং বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য যতগুলো সম্ভব বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক।'  এরই সূত্র ধরে ঢাকাতে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ঢাকাতে একটি কলেজ স্থাপনের গ্রহণযোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য ঢাকার কর্মকর্তাদের নিকট এ সংক্রান্ত চিঠি প্রদান করা হয়। সে সময়ের সিভিল সার্জন ডা: জেমস টেইলার (Dr. James Tailer) জানান যে, এখানে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা যে কেবল উচিতই নয়, বরং এর জন্য প্রয়োজনীয় সকল প্রকারের সুবিধা (আর্থিক এবং সামাজিক) পাওয়া যাবে। এই প্রতিবেদন পর সরকার বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ১৮৩৫ সালের ১৫ জুলাই থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছিলো ঢাকা ইংলিশ সেমিনারী চালু করে।

এই কলেজের শিক্ষার ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করে সে সময়ের গভর্নর জেনারেল লর্ড অকল্যান্ড এবং জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন (General Committee of Public Instruction) কতগুলো কেন্দ্রীয় কলেজ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেন।

১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠানটিকে স্কুল ও কলেজে বিভাজিত করা হয়। এর স্কুল শাখার নাম হয় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। আর কলেজ শাখার নাম দেওয়া হয়- ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ বা সংক্ষেপে ঢাকা কলেজ। এই সময় ঢাকা কলেজের পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দের ২০ নভেম্বর কলকাতার তৎকালীন বিশপ রেভারেন্ড ড্যানিয়েল "ঢাকা কলেজ" হিসেবে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রতিষ্ঠালগ্নে ঢাকা কলেজের ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো বুড়িগঙ্গার তীরে । সদরঘাটের স্থপতি কর্নেল গ্যাসর্টিন, এর নকশা করেছিলেন। খাঁটি ব্রিটিশ ঢঙে, বিলাতি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আদলে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানটি পালন করা হয়। অনুষ্ঠান উপলক্ষে রেভারেন্ড ড্যানিয়েল একটি যথাযথ এবং প্রাসঙ্গিক বক্তৃতা প্রদান করেন।

প্রথম দুই বছরে ঢাকা কলেজের পড়তো ঢাকার স্থানীয় কিছু শিক্ষার্থী। ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার বাইরে থেকে শিক্ষার্থী ভর্তি হতে থাকে। এই বছরে ১৫জন ছাত্র বিভিন্ন জেলা থেকে এসে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়। এদের মধ্যে ৭জন ফরিদপুর, ২জন বরিশাল, ২জন যশোহর, ২জন ময়মনসিংহ এবং এমনকি ২জন ভারতের উত্তর প্রদেশ থেকেও এসেছিল।

১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ২৪ জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পর, ঢাকা কলেজকে এর অধিভুক্ত করা হয়। সে সময় সরকার বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে। ফলে কলেজের শিক্ষা ব্যবস্থায় নানাবিধ সমস্যায় পড়ে ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে গণিতশাস্ত্রের অধ্যাপক ব্রেনান্ডকে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া হয়। এরপর থেকে ঢাকা কলেজের শিক্ষা ও সার্বিক ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটে।

১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের সিপাহী বিদ্রোহের পর ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে যায়। ফলে সরকার ঢাকা কলেজের জন্য বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়। ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ৪ জন ছাত্র প্রথমবারের মতো স্নাতক বা বি.এ. পরীক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে কোলকাতা পাড়ি দেয়। এখানে উল্লেখ্য যে, সেমসয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিলো একমাত্র পরীক্ষাকেন্দ্র।

১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে কোম্পানি বিলুপ্ত ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার ভারতশাসনের দায়িত্ব সরাসরি গ্রহণ করে। পরে ধীরে ধীরে ভারত-সরকারে আর্থিক অবস্থার উন্নতি হতে থাকলে, ঢাকা কলেজের অবস্থার উন্নতি ঘটে। এই সময় ঢাকা কলজের ছাত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৮৫৯-৬০ খ্রিষ্টাব্দে ছাত্রের সংখ্যা ৫১জন ছিল। এদের মধ্যে ২জন খ্রিস্টান, ১জন মুসলমান এবং অবশিষ্ট ৪৮জন ছিলো হিন্দু ধর্মাবলম্বী।

১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা কলেজ বিজ্ঞান ক্লাশ খোলা হয়, অর্থাৎ বিজ্ঞান বিষয়ক নতুন নতুন বিষয় পড়ানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সময় কলেজের অবকাঠামোগত পরিবর্তনও হয়।

১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ছাত্রাবাস তৈরি করা হয়। তবে তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সবশেষে বাংলা সরকারের অনুমতিসাপেক্ষে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অনুদানে বাংলাবাজারের শ্রীদাস লেনে রাজচন্দ্র হিন্দু ছাত্র হোস্টেল নামে প্রথম ছাত্রাবাস নির্মিত হয়। হোস্টেলের ছাত্রসংখ্যা দ্রুত বাড়তে থাকে এবং ১৮৮৩-৮৪ খ্রিষ্টাব্দে বোর্ডারের সংখ্যা ৯০জনে এসে দাঁড়ায়। তবে এতো অধিক ছাত্রের জন্য ভবনটি যথেষ্ট ছিলো না।

১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ মে এক সরকারি সভায় ঢাকা কলেজের জন্য একটি আধুনিক ছাত্রাবাস নির্মাণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেসময়ের অন্যতম স্থাপত্যবিদ পি. ডব্লিউ. ডি. কর্তৃক একটি নকশা পেশ করা হয়। বলা বাহুল্য, এ নকশাটিই ছিলো বাংলাদেশে প্রথম আধুনিক ধারার ছাত্রাবাস নির্মাণের নকশা। তিনি ঘরগুলোকে ২০X১৪ ফুট আয়াতাকারভাবে তৈরি করার প্রস্তাব দেন। প্রতিঘরে ৪জন করে থাকতে পারবে বলে মতামত প্রকাশ করেন।  

সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং-এ নতুন দুটি ছাত্রাবাস প্রতিষ্ঠিত হয়। হোস্টেলের নামকরণ করা হয় সেক্রেটারিয়েট মুসলিম হোস্টেল । এ ছাত্রাবাসের খাবার কক্ষটি ছিলো বিশাল। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে এখানেই বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের একাদশ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯২১ খ্রিষটাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ঢাকা কলেজের হিন্দু হোস্টেলের নামকরণ করা হয় ঢাকা হল, যা বর্তমান শহীদুল্লাহ হল। এছাড়া সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিংয়ের মুসলিম হোস্টেলটি হয়ে যায় মুসলিম হল, যা বর্তমানে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। এই সময় কলেজটিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়।

১৯৫৫ সালে ঢাকা কলেজ বর্তমান জায়গায় (মিরপুর রোড, ধানমন্ডি , ঢাকা , ১২০৫ , বাংলাদেশ) চলে আসে। ২৪ একর জমির ওপর ছিল ঢাকা কলেজ। তবে এরশাদ সরকারের সময় ৬ একর জমি ছেড়ে দিতে হয়।