আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ
ভারত প্রজাতন্ত্রের একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল।
ভৌগোলিক অবস্থান : অক্ষাংশ ৬-১৪ ডিগ্রী উত্তর, দ্রাঘিমাংশ ৯২-৯৪ ডিগ্রী পূর্ব।

এই দুটি দ্বীপপুঞ্জ ভারত মহাসাগরে অবস্থিত। ভৌগোলিকভাবে অঞ্চলটিকে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অংশ হিসেবে বিবেচনা হয়। আবার
ভারত প্রজাতন্ত্রের অংশ হিসেবে একে ভারতবর্ষের অংশ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটির রাজধানী আন্দামানের শহর পোর্ট ব্লেয়ার।

 

আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দুটি ১০° উত্তর অক্ষরেখা দ্বারা বিচ্ছিন্ন। আন্দামান এই অক্ষরেখার উত্তরে ও নিকোবর এর দক্ষিণে অবস্থিত। এই অঞ্চলের পূর্বে আন্দামান সাগর ও পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর অবস্থিত।

 

ছোট বড় প্রায় ৫৭২টি দ্বীপ নিয়ে এই আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। এর মধ্যে মাত্র ৩৬টিতে জনবসতি গড়ে উঠেছে। মোট স্থলভূমি ৮২৪৯ বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে বনভূমি ৭০৯৮ বর্গ কিলোমিটার।  সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৬.১ সেন্টিগ্রেড, সর্বনিম্ন ১৬.৭ ডিগ্রি। সামুদ্রিক তটরেখা ১৯৬২ কিলোমিটার। চাষযোগ্য জমির পরিমান ১৫০ বর্গ কিলোমিটার। বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ ও পশু পাখি মিলিয়ে দ্বীপটির অন্যরকম আবহ তৈরী হয়েছে। দ্বীপপুঞ্জের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কোরাল সমৃদ্ধ অজস্র সমুদ্র সৈকত, বিস্তীর্ণ সমুদ্র তটরেখা। তটরেখা অলংকৃত করে আছে সারি সারি নারিকেল সুপারি গাছ।

২০০১  খ্রিষ্টাব্দের ভারতের জনগণনা অনুসারে, অঞ্চলের জনসংখ্যা ৩৫৬,১৫২। অঞ্চলের স্থলভাগের সামগ্রিক আয়তন ৬,৪৯৬ বর্গকিলোমিটার। এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলটি কলকাতা হাইকোর্টের অধিকারক্ষেত্রের অন্তর্গত।

 

আন্দামান-নিকোবর-এর ইতিহাস
ভূতাত্ত্বিকদের গবেষণা অনুসারে যাবা - এই দ্বীপপুঞ্জ দুটির সাথে যোগসূত্র ছিল আসামের নাগা ও লুসাই পর্বতমালা এবং ইয়াংগুনের ইয়োমা পর্বতমালার সাথে। প্রায়
১৪ কোটি বছর আগে মেসোজোয়িক যুগের শেষভাগে ক্রেটাসিয়াস (Cretaceous) অধিযুগে, ইন্দো-অস্ট্রেলীয় প্লেট এবং ইউরেশীয় প্লেটের সংঘর্ষের সূত্রে হিমালয় পর্বতমালার সৃষ্টি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হয়েছিল এই দ্বীপুঞ্জ দুটি। আন্দামানের ভূ-প্রকৃতি, মাটি জলবায়ু, সবুজ বন-বনানী গাছপালা, প্রাণীজ ও দেশীয় জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই দ্বীপে রয়েছে ছয় স্তর বিশিষ্ট মাটি। সবচেয়ে পুরনো স্তরটির বয়স প্রায় দশ কোটি বছর। এর নতুন স্তরটির বয়স প্রায় দশ হাজার বছর। প্রাচীন তলার স্তরগুলিতে আগ্নেয়গিরি ও পরবর্তী স্তরগুলোতে বিচিত্র সামুদ্রিক জীবাশ্ম লক্ষণীয়।
 

আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের নেগ্রিটো জনগোষ্ঠীর মানুষ

নৃবিজ্ঞানী এবং ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে প্রায় ২ লক্ষ বৎসর আগে, নর-বানর থেকে আধুনিক মানুষ তথা Homo sapiens (হোমো স্যাপিয়েন্স) নামক প্রজাতিটির আবির্ভাব ঘটেছিল আফ্রিকাইথিওপিয়া অঞ্চলে। আদি মানুষের একটি দল প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার বৎসর আগে এরা ইথিওপিয়া সংলগ্ন ইরিত্রিয়া, সুদান এবং মিশরের দিকে ছড়িয়ে পড়া শুরু করে। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০-২০ হাজার বৎসরের মধ্যে এরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। এদের দ্বারাই সূচিত হয়েছিল ভারতের  প্রাচীন প্রস্তরযুগ। এই আদি জনগোষ্ঠীকে নেগ্রিটো হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এদের কয়েকটি দল সাগর পাড়ি দিয়ে আন্দামান-নিকোবর দ্বীপে পৌঁছেছিল। ফলে ভারতে আগত অন্যান্য জনগোষ্ঠী থেকে নিজেদেরকে পৃথক জাতিসত্তা হিসেবে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা এই অঞ্চলে একটি নৃতাত্ত্বিক সমীক্ষা চালায়। এই সমীক্ষা অনুসারে জানা যায় যে, নেগ্রিটো ছাড়াও  প্রোটো-অস্ট্রালয়েড মোঙ্গলীয় জাতিগোষ্ঠীর লোকেরাও এই দ্বীপাঞ্চলে এসেছিল।

১৭৮৮ খ্রিষ্টাব্দে দুই নৌসেনাদের সুপারিশক্রমে, ১৭৮৯ খ্রিষ্টাব্দে তদনীন্তন গভর্নর-জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিশ পোর্ট কর্নওয়ালিশের কাছে চ্যাথাম দ্বীপে একটি ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপন করেন। এই বছরই লেফটানেন্ট রেজিনল্ড ব্লেয়ার এই অঞ্চলে একটি সমীক্ষার কাজ চালান। তাঁর নামানুসারে পোর্ট কর্নওয়ালিশের নাম হয় পোর্ট ব্লেয়ার। কিন্তু স্কার্ভি রোগের কারণে ১৭৯৬ সালে উপনিবেশ স্থাপন বন্ধ হয়ে যায়।

১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার আন্দামানে একটি বন্দীনিবাস স্থাপনের পরিকল্পনা করে।
১৮৫৮ সালের জানুয়ারী মাসে লেঃ হেনরিম্যানের নেতৃত্বে চ্যাথাম দ্বীপে পুনরায় বৃটিশ পতাকা উত্তোলন করা হয়। কাগজে কলমে উপনিবেশের হেডকোয়ার্টার চ্যাথাম দ্বীপে থাকলেও পরবর্তীতে এটা রস দ্বীপে স্থানান্তর করা হয়। এই সময় ভাইপার আন্দামানে একটি কারাগার, একটি গ্যালো তৈরি করে এবং একটি জনবসতি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়। নবনির্মিত এই কারাগারে প্রথমে ২০০ জন বন্দীকে  রাখা হয়। এঁদের অধিকাংশই ছিলেন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী সৈনিক।

 

১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে পোর্ট ব্লেয়ারে সেলুলার জেল তৈরি হলে আগের কারাগারটি পরিত্যক্ত হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চলাকালে ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের জাপানিরা রেঙ্গুন দখলের পর, ভারতের ভাইসরয় লর্ড ওয়েভেল ব্রিটিশ ও গুর্খা সৈন্যদেরভ আন্দামান থেকে সরিয়ে নেয়। এরপর আন্দামানের কাছে মাইন বিস্ফোরণে কয়েকটি ব্রিটিশ ভারতীয় জাহাজ ডুবে যায়। জাপানি ডুবো জাহাজের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ব্রিটিশ নৌ-বাহিনির জাহাজ চেন্নাই এবং কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।


জাপানিরা পূর্ব পরিকল্পনা মতো আন্দামানে বিমান আক্রমণ চালায় ২৩শে মার্চ ভোর চারটায়।  এই আক্রমণে পোর্ট ব্লেয়ারের বেতার এবং টেলিগ্রাম সদর দফতর উড়িয়ে দেয়। একই সাথে জাপানি নৌবাহিনীর একটি দল চ্যাথাম দ্বীপ আক্রমণ করে। এরপর অতি সহজে জাপানিরা আন্দামান নিকোবর দখল করে নেয়। পরে জাপানিরা এই দ্বীপপুঞ্জ
নেতাজী  সুভাষচন্দ্র বসু' নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দ সরকারের হাতে তুলে দেয়। ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর নেতাজী পোর্ট ব্লেয়ারে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এই অঞ্চল ব্রিটিশদের অধিকারমুক্ত ছিল। এই সময় আন্দামান খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভর হয়ে ওঠে। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ৮ অক্টোবর জাপানি সেনাবাহিনীর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া কম্যান্ড পোর্ট ব্লেয়ারে আত্মসমর্পণ করলে ব্রিটিশরা এই দ্বীপপুঞ্জের অধিকার আবার ফিরে পায়।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগষ্ট আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ একত্রে স্বাধীন ভারতের অঙ্গীভূত হয়।
 

আন্দামান নিকোবরের উদ্ভিদ ও প্রাণিকূল
 
ক্রেটাসিয়াস (Cretaceous) অধিযুগের পরে এই দ্বীপদুটিতে যে নতুন মাটির স্তর পড়েছে, তার বয়স প্রায় দশ হাজার বছর। এই স্তরে পাওয়া গেছে ছোট ছোট আণুবীক্ষণিক রেডিয়োলেরিয়া ও রাশি রাশি মৃত প্রবালের কংকাল। এ দ্বীপের চারপাশে রয়েছে প্রচুর প্রবাল।  এখানে প্রায় ২২৩ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ আছে। ৫০৩টি প্রজাতির প্রাণী। সামুদ্রিক প্রাণীর ২২০ প্রজাতি এবং ৩৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, এছাড়া আছে ৯৬ প্রজাতির পাখি এবং ৬৬ প্রজাতির সরীসৃপ ।


তথ্য
http://www.viswayan.com/archive/samudramanthan8.htm