বিন্ধ্য পর্বতমালা
ভারতের আর্যাবর্ত ও দাক্ষিণ্যাত্যের ভূ-বিভাজক পর্বতমালা। একে বলা হয় গাঙ্গেয় উপত্যকা ও দাক্ষণাত্যের মালভুমির মধ্যবর্তী প্রাকৃতিক প্রাচীর। মূলত বিন্ধ্য পর্বতমালা ও সাতপুরা পর্বতমালা উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় সমভূমি থেকে দাক্ষিণাত্যের মালভূমিকে পৃথক করেছে।

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এর অংশ বিশেষের ভিন্ন ভিন্ন নাম পাওয়া যায়। এর পশ্চিমাংশ বিন্ধ্যপর্বত নামে পরিচিত। মালব মালভূমির দক্ষিণ প্রান্ত মালব পার্বত্য অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। বুন্দেলখণ্ডের দক্ষিণের (বিন্ধ্যপর্বতের মধ্যাঞ্চল) পর্বতশ্রেণিকে বলা হয় ভাঁড়ার বা পান্না পর্বতমালা। এই পর্বতমালার পূর্বের পর্বত কৈমুর নামে পরিচিত। বিন্ধ্য পর্ববতমালাকে অনেক সময় মালব, বুন্দেলখণ্ড এবং রেওয় মালভূমির দক্ষিণ প্রান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আবার এসকল মালভূমিকে কখনো কখনো বিন্ধ্যপর্বতমালার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ভৌগোলিক স্থানাঙ্ক:
এর পশ্চিম প্রান্ত গুজরাটের জোবাত (২২°২৭' উত্তর ৭৪°৩৫' পূর্ব)। জোবাত থেকে শুরু হয়ে ইন্দোর, ভূপাল, বুন্দেলখণ্ড, বাঘেলখণ্ড প্রভৃতির মধ্য দিয়ে পশ্চিম বিহারের সাসারামে (২৪°৫৭' উত্তর ৮৪°০২' পূর্ব) শেষ হয়েছে।

আয়তন: এটি মোটামুটি ভারতের পূর্ব-পশ্চিমে বারানসী থেকে গুজরাট পর্যন্ত প্রায় ১,১০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য জুড়ে বিস্তৃত।

উচ্চতা: গড় উচ্চতা প্রায় ৪৫৬ থেকে ৬১০ মিটার। কোথাও কোথাও উচ্চতা ৭৬১ মিটারেরও বেশি। চম্বল নদীর উৎসের কাছে মানপুরের উচ্চতা ৮৮১ মিটার। এটি বিন্ধ্যপর্বমালার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ। ভাঁড়ার পার্বত্য অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কালুমার। এর উচ্চতা ৭৭৫ মিটার। কৈমুর পার্বত্য অঞ্চলে কিছু অঞ্চলের উচ্চতা প্রায় ৭৭০ মিটার।

ভূপ্রকৃতি: বিন্ধ্যপর্বতমালা অধিকাংশ অঞ্চল পাললিক শিলা দ্বারা গঠিত। ধারণা করা হয়
প্রিক্যাম্ব্রিয়ান মহাকালে এই অঞ্চলের ভূমি তৈরি হয়েছিল। পাহড়গুলোর নিম্নভাগে রয়েছে প্রচর চুনাপাথর ও কাদামাটির স্তূপীকৃত কঠিন শিলা। জব্বলপুরের কিছু অংশ এই পাললিক শিলা বেসল্ট নামক আগ্নেয় শিলার নিচে চাপা পড়েছে। এছাড়া ঝাঁসি অঞ্চলে পাওয়া যায় রূপান্তরিত শিলারাশি।

গিরিপথ: কৈমুর ও ভাঁড়ার পর্বতমালার মধ্যে রয়েছে নিম্ন গিরিপথ। এই গিরিপথের ভিতর দিয়ে দুটি রেলপথ রয়েছে। এর একটি গিয়েছে এলাহাবাদ থেকে জব্বলপুর, অপরটি কোটা থেকে দামো।

নদী: বিন্ধ্য পার্বত্য অঞ্চলের উল্লেখযোগ্য নদীগুলোর মধ্যে রয়েছে চম্বল, পার্বতী, বেতোয়া, সোনার ও কেন, ধঁসন, শোন ও নর্মদা। এছাড়া রয়েছে অসংখ্য শাখা উপনদী।

উদ্ভিদ: এই পর্বতের বহু স্থান অরণ্যাবৃত। এসকল অরণ্যের প্রধান বৃক্ষশ্রণির মধ্যে রয়েছে অর্জুন, করঞ্জ, তিন্দুক (গাব) বহেড়া, সীতাশাল, হরিতকী ইত্যাদি।

ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনিতে বিন্ধ্যপর্বত
পৌরাণিক যুগে বিন্ধ্যপর্বত সমস্ত পর্বতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও মাননীয় ছিল। একদিন দেবর্ষি নারদ বিন্ধ্যের কাছে এসে বলেন যে, সুমেরু পর্বতের সমৃদ্ধি বিন্ধ্যের অপেক্ষা বেশি। সমস্ত দেবতা সুমেরুতে দিন যাপন করেন ও সূর্য সমস্ত নক্ষত্রকে নিয়ে এই পর্বত পরিভ্রমণ করেন। এ কথা শোনার পর বিন্ধ্য সূর্যকে বললেন যে, উদয়াস্তকালে সুমেরু পর্বতের মতো করে তাঁকেও প্রদক্ষিণ করতে হবে। সূর্য এতে অসম্মত হলে, বিন্ধ্য নিজ দেহকে বর্ধিত করে সূর্যের পথ রোধ করে ফেললেন। ফলে সূর্যের উত্তাপে পর্বতের একদিকে জ্বলে পুড়ে যেতে থাকলো, অন্যদিকে প্রচণ্ড শীত ও অন্ধকারে জীবন বিপন্ন হয়ে পড়লো। দেবতারা এর প্রতিকারের উপায় না দেখে অগস্ত্যের শরণাপন্ন হলেন, অগস্ত্য বিন্ধ্যপর্বতের কাছে এলেন। উল্লেখ্য অগস্ত্য ছিলেন বিন্ধ্যপর্বতের গুরু। অগস্ত্যকে দেখে বিন্ধ্য গুরুভক্তিতে তাঁর মস্তক অবনত করলে, অগস্ত্য তাঁকে বললেন যে,— যতক্ষণ তিনি প্রত্যাবর্তন না করবেন, ততক্ষণ সে (বিন্ধ্য) এরূপ অবনতমস্তকে থাকবে। বিন্ধ্যকে এই অবস্থায় রেখে অগস্ত্য ১লা ভাদ্র তারিখে দক্ষিণদিকে যাত্রা করেন এবং কখনোই আর সেখানে ফিরে আসেন নি। অগস্ত্যের এই চির-প্রস্থানের কাহিনী অনুসারে বাংলাতে অগস্ত্যযাত্রা বাগধারা প্রচলিত রয়েছে।