কেরালা
ভারত প্রজাতন্ত্রের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য। এর উত্তরে কর্নাটক (সাবেক মহীশূর, পূর্বে তামিলনাড়ু এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে আরব সাগর। এর উত্তর- পশ্চিম উপকূলে পণ্ডিচেরি রাজ্যের মাহে নামে একটি অংশ দ্বারাও পরিবেষ্টিত। এর রাজধানী তিরুবনন্তপুরম (ত্রিবান্দ্রাম)।

মালাবার উপকূল বরাবর কেরালার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৬০ মাইল (৫৮০ কিলোমিটার) এবং প্রস্থে প্রায় ২০ থেকে ৭৫ মাইল (৩০ থেকে ১২০ কিমি)। পশ্চিমঘাটের পবর্তমালার কারণে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এর মোট আয়তন ১৫ হাজার ৫ বর্গমাইল (৩৮ হাজার ৮ শত ৬৩ বর্গ কিমি)। এই রাজ্যের সমুদ্র উপকুল প্রায় ৫৯০ কিলোমিটার।

২০১১ খ্রিষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুসারে  এই রাজ্যের লোকসংখ্যা ৩ কোটি ২২ লাখ ৮৭ হাজার ৬ শো ৭৭।

এই রাজ্যের পূর্বাঞ্চলে আনাই শৃঙ্গ  (৮ হাজার ৮ শো ৪২ ফুট বা ২ হাজার ৬ শো ৯৫ মিটার)। একে বলা হয় পশ্চিমঘাটের মাথার মুকুট। পাবর্ত্য উচ্চভূমি থেকে পশ্চিম দিকে ক্রমশ ঢালু হয়ে উপকূলীয় সমভূমিতে মিশেছে।  এই সূত্রে বেশ কিছু নদী পাহাড়ি উচ্চভূমি থেকে কেরলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আরব সাগরে পতিত হয়েছে। এগুলোর মধ্য উল্লেখযোগ্য নদীগুলো হলো- পোন্নাই, পেরিয়ার, টালকুড়ি ও পামবার।

জলবায়ু
জলবায়ু কেরালার জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ এবং এক ঋতু থেকে অন্য ঋতুর পার্থক্য খুব বেশি লক্ষ্য করা যায় না। এই রাজ্যের বাঃসরিক গড় তাপমাত্রা ৭০ ডিগ্রি থেকে ৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইট (২৭ ডিগ্রি থেকে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর অবধি এই রাজ্যের উপর দিয়ে সরাসরি দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়। অক্টোবর-নভেম্বর মাসে বিপরীতমুখী (উত্তর-পূর্ব) মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত হয়। রাজ্যের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত প্রায় ১১৫ ইঞ্চি (৩ হাজার মিমি, কোনো কোনো স্থানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ২০০ ইঞ্চি (৫ হাজার মিমি)-রও বেশি লক্ষ্য করা যায়।

কেরালার জলবেষ্টিত উপকূলীয় এলাকায় প্রচুর নারকেল গাছ জন্মে। এছাড়া গ্রীষ্মমণ্ডলীয় পত্রমোচী বৃক্ষের দ্বারা বনাঞ্চল সৃষ্টি হয়েছি। রাজ্যের উচ্চভূমিতে রয়েছে প্রায় ঢেউ খেলানো তৃণণভূমি।

প্রাণী ও উদ্ভিদ
এই রাজ্যের স্তন্যপায়ী প্রাণিকুলের মধ্যে রয়েছে সম্বর হরিণ, গাউর (বুনো গরু), নীলগিরি তর (বুনো ছাগলজাতীয় প্রাণি), হাতি, চিতা, বাঘ, বনেট বানর  বিরল সিংহ-লেজওয়ালা ও হনুমান এবং নীলগিরি লেঙ্গুর।  সরীসৃপের মধ্য এই রাজ্যে ভয়ঙ্কর সাপ হলো- কাল কেউটে (কিং কোবরা)। পক্ষীকুলের মধ্যে ময়ূর ও হর্নবিল প্রচুর দেখা যায়। বন্য প্রাণী ও উদ্ভিদের জন্য রয়েছে বেশ কিছু  জাতীয় উদ্যান ও বণ্যপ্রাণি সংরক্ষণশালা। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য হলো 'পেরিয়ার জাতীয় উদ্যান ও ব্যাঘ্র সংরক্ষণশালা।

এই রাজ্যের বনাঞ্চলে পাওয়া যায় বেশকিছু মূল্যবান গাছ। এর ভিতরে রয়েছে  আবলুস, রোজউড ও সেগুন কাঠ। এছাড়া কেরালায় বনাঞ্চল-ভিত্তিক গড়ে উঠেছে  কাগজ ও রেয়ন শিল্পের বনজ উপকরণ, কাঠের মণ্ড, কয়লা, বনজ আঠা ও রজন কারখানা।

ভাষা
কেরালার বাস করে মিশ্র জাতিসত্তার মানুষ। ঐতিহ্যগতভাবে অধিকাংশ মানুষ দ্রাবিড়ি ভাষাগোষ্ঠীর মালয়ালমে ভাষায় কথা বলে। ধারণা করা হয়- খ্রিষ্টপূর্বে ১৮০০ থেকে ১৫০০ অব্দের ভিতরে উত্তর ভারতে ইন্দো-আর্য ভাষাভাষীদের আক্রমণে, ভারতের দক্ষিণ চলে যেতে বাধ্য হয়। পরবর্তী সময়ে আর্য ও দ্রাবিড়দের সংমিশ্রণে মিশ্র জাতিসত্তার উদ্ভব ঘটে। গোঁড়া হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন নামবুদ্রীরা হচ্ছে ইন্দো-আর্য উত্তরসূরী। মালায়ম ভাষী মানুষ ছাড়াও, কেরালায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তামিল বসবাস করে।

এই রাজ্যে মালায়লাম ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহৃত হলেও, সরকারি ভাষা মালায়লাম

ধর্ম:
কেরালার অর্ধেকের বেশি মানুষ হিন্দুধর্মের অনুসারী। জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। মালাবার উপকূল বরাবর মোপলা (মোপিল্লা) রাজ্যের অধিকাংশ মানুষ মুসলামান। জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ খ্রিস্টান। এদের অধিকাংশই অর্থোডক্স সিরীয় ও রোমান ক্যাথলিক। তবে সামান্য কিছু প্রোটেস্টান্ট খ্রিষ্টান বাস করে। এছাড়া কেরালায় অল্প কিছু জৈন, শিখ, বৌদ্ধ ও ইহুদী সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে। এই রাজ্যের কোচিতে আছে প্রাচীন সিনগত সম্প্রদায়ের মানুষ। 

রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ১.১০ শতাংশ দেশীয় উপজাতিদের নিয়ে গঠিত। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের সর্বশেষ জনগণনা অনুযায়ী, কেরালার অধিবাসীদের প্রায় ৫৬.২ শতাংশ হিন্দু, ২৪.৭ শতাংশ মুসলিম, ১৯ শতাংশ খ্রিষ্টান এবং অন্যান্য সম্প্রদায় বাকি ১.১ শতাংশ। 

অর্থনীতি:
কেরালার অধিবাসীরা মূলত কৃষিজীবী। রাজ্যের প্রধান অর্থনৈতিক ভিত্তি হলো কৃষিকাজ এবং প্রধান কৃষিপণ্য হলো ধান। কেরালার অন্যান্য অর্থকরী ফসল হচ্ছে রবার, কফি ও চা, সুপারি, এলাচ, কাজু বাদাম, নারকেল, আদা,  মরিচ, ভ্যানিল্যা, ডাল (মটরদানা ও সিম বিচি) ও গোলমরিচ।

এদের প্রধান খাদ্য তালিকায় রয়েছে ধান, , জোয়ার ও টেপিওকা। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে বহু হাঁস-মুরগীর খামার গড়ে উঠেছে। কেরালা মৎস্য উৎপাদন ও সংগ্রহের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। মৎস্য সম্পদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য মাছগুলো হলো- সার্ডিন, টুনা, ম্যাকারেল ও চিংড়ি।

  অন্যান্য উৎপাদিত ফসলগুলি হল- নারকেল, চা, কফি, রাবার, কাজু-বাদাম, এলাচ, দারুচিনি এবং জায়ফল। এর বাইরে কেরালার অর্থনীতিতে  গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে, এখানকার ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্প। এর ভিতরে রয়েছে যেমন তাঁতের কাপড়, নারকেল ছোবড়ার নানা পণ্য উল্লেখযোগ্য। কাজু প্রক্রিয়াজাতকরণের শিল্প বহু লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে। এছাড় রয়েছে মাঝারি থেকে বৃহৎ শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প। এসব শিল্প-কারখানার ভিতরে রয়েছে সার, রাসায়নিক ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, টিটানিয়াম, এ্যালুমিনিয়াম, প্লাইউড, সিরামিক ও কৃত্রিম ফেব্রিকস ইত্যাদি।

খনিজ সম্পদ
কেরালার খনিজ সম্পদের ভিতরে রয়েছে ইলমেনাইট (টিটানিয়ামের প্রধান আকরিক), রুটাইল (টিটানিয়াম ডাই-অক্সাইড) ও মোনাজাইট (সেরিয়াম ও থোরিয়াম ফসফেট মিশ্রিত খনিজ)-এর মাঝারি আকারের ভাণ্ডার। উল্লেখ্য এ সবই পাওয়া যায়, উপকূলের বালুকারাশিতে। অন্যান্য খনিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে চুনাপাথর, লৌহ আকরিক ও বক্সাইট (এলুমিনিয়ামের প্রধান আকরিক)। কেরালা এর উচ্চমানের কাওলিন (চিনামাটি)-এর জন্য বিখ্যাত।

কেরালার জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। অন্তত ২০-২৫টি প্রায় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র এই রাজ্যের বিদ্যুতের যোগান দিয়ে থাকে। এর পাশাপশি কেরলায় আছে বেশ কয়েকটি বিভিন্ন তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। বেশ কিছুদিন ধরে রাজ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বায়ুকল ব্যবহার করা হচ্ছে। এত কিছুর পরেই কেরালাকে ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে হয়।

পরিবহন

কেরালার পরিবহনের ক্ষেত্রে সড়ক ও রেলপথ ব্যবস্থা খুবই উন্নত। জাতীয় মহাসড়কের মাধ্যমে কেরালার সাথে তামিলনাড়ু ও কর্নাটকের যোগাযোগ রয়েছে। কেরালায় প্রায় ১৪৫,৭০৪ কিলোমিটার মোটরোপযোগী সড়ক রয়েছে। এখানকার জাতীয় সড়কের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫২৪ কিলোমিটার। কেরালা ৪৭-নং এবং ১৭-নং জাতীয় সড়ক এবং অন্যান্য কিছু রাজ্য সড়ক দ্বারা সংযুক্ত রয়েছে। ভারতীয় রেলপথের অন্তর্গত দক্ষিণী রেলপথের মাধ্যমে রাজ্যেটি ইড়ুক্কি ও ওয়ানদ ব্যতীত সমস্ত প্রধান নগর ও শহরগুলির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। রাজ্যের রেলপথ সংযোগ ব্যবস্থা তিরুবনন্তপুরম রেলপথ বিভাগ এবং পালকড রেলপথ বিভাগ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। রাজ্যের পূর্ব দিক থেকে একটা রেলপথ পশ্চিমঘাটের পালঘাট গ্যাপ হয়ে উত্তর-দক্ষিণের রেলপথের সঙ্গে মিশেছে। এই পথটি যুক্ত করেছে ভারতের সর্বদক্ষিণের শহর কন্যাকুমারীর সাথে। রাজ্যের প্রধান বন্দর কোচি। এছাড়া রয়েছে কোজিকোড়ে, আলাপ্পুজা ও নিনদাকারায় (তিরুবনন্তপুরমের নিকটবর্তী) উল্লেখযোগ্য বন্দর। কোচিতে রয়েছে একটি বড় শিপইয়ার্ড এবং তৈল শোধনাগার। এছাড়া ভারতীয় উপকূলীয় রক্ষী বাহিনির জেলা সদর দফতর এবং ভারতীয় নৌ বাহিনির একটি আঞ্চলিক সদর দফতর রয়েছে কোচিতে। বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনের জন্য রয়েছে ১ হাজার মাইল (১৬০০ কিমি)-এর বেশি জলপথ। তিরুবনন্তপুরম, কোজিকোড়ে ও কোচিতে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর রয়েছে।

কেরালা সরকার
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় সাংবিধানিক অনুসারে কেরালা কেরালা রাজ্যের নিজস্ব সরকার ব্যবস্থা আছে। রাষ্ট্রপতির নিযুক্ত গভর্নর, রাজ্যের প্রধান হিসেবে বিবেচিত হন। তাঁকে পরামর্শ দেন মুখ্য দেন রাজ্যের ̈মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিপরিষদ। রাজ্যের সরকার পরিকচালনার জন্য রয়েছে একটি এক কক্ষবিশিষ্ট নির্বাচিত বিধানসভা রয়েছে। বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে রয়েছেন একজন  প্রধান বিচারপতি এবং হাইকোর্টের আপিলসমূহ পর্যালোচনার জন্য রয়েছে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট। হাইকোর্টের নিচের নিম্ন আদালত হিসেবে রয়েছে- জেলা কোর্ট, মহকুমা কোর্ট, মুন্সেফ কোর্ট এবং মুন্সেফ ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট। এছাড়াও বিশেষ বিচারের জন্য রয়েছে পারিবারিক ও অন্যান্য বিশেষ আদালত। প্রশাসনিক পর্যায়ে কেরালা ১৪টি জেলায় বিভক্ত। এই জেলাগুলো হলো-  অলাপুঝা, এর্নাকুলম, ইড়ুক্কি, কন্নুর, কাসারাগড়, কোল্লাম, কোট্টায়ম, কোঝিকোড়, মলাপ্পুরম, পালকড, পাঠানমথিত্তা, তিরুবনন্তপুরম, ত্রিশূর এবং ওয়ানদ। জেলাগুলি আবার ৭৫-টি তালুকে উপবিভক্ত রয়েছে, যেগুলি আবার ১৪৫৩-টি রাজস্ব গ্রামে বিভক্ত। স্থানীয় সরকার ১৪-টি জেলা পঞ্চায়েত, ১৫২-টি ব্লক পঞ্চাযেত, ৯৭৮-টি গ্রাম পঞ্চাযেত, সঙ্গে ৬০-টি পৌরসভা, ৫-টি পৌরনিগম, ১-টি শহরাঞ্চল নিয়ে গঠিত।

কেরালার শিক্ষা ব্যবস্থা
শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর হিসেবে কেরালা ভারতের সর্বোচ্চ স্থানে রয়েছে। এই রাজ্যে ৬ থেকে ১১ বছরের শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। প্রাথমিক শিক্ষার পর পর্যায়ক্রমে রয়েছে  মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যাবস্থা। এর পাশাপাশি রয়েছে পলিটেকনিক, শিল্প-প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান, কলা ও বিজ্ঞান কলেজ ও পেশাভিত্তিক নানা ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। উচ্চ শিক্ষার জন্য ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তিরুবনন্তপুরমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল  কেরালা বিশ্ববিদ্যলয়। ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কালিকট বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে কোচিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কোচিন ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি। একই বছরে ত্রিচুরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কেরালা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

সাহিত্য
খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে কেরালায় একটি ধারায় তামিল ও সংস্কৃত সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছিল। অন্যদিকে দিকে মালয়ালম সাহিত্যের বিকাশও ঘটেছিল এই রাজ্যে। মালয়ালম ভাষার- প্রসিদ্ধ কবিরা হলেন তুনচাট্টু ইলুট্টাকন ও কুলচান নামপিয়ার। বিংশ শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য কবি হলেন কুমারণ আসান ও বল্লঠোল।

১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে চান্দু মেনন ইন্দুলেখা মালয়ালম ভাষার অন্যতম উপন্যাসিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। এছাড়া জনপ্রিয়া উপন্যাসিক হিসেবে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছেন শিবশংকর পিল্লাই।

সঙ্গীত
কেরালার চিরায়ত নৃত্য হিসেবে পাওয়া যায় কথাকলি। এছাড়া তামিলযুগের প্রথম দিকে অপর চিরায়ত নৃত্য ভরতনাট্যম বিকশিত হয়েছিল। দক্ষিণ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চার ক্ষেত্রে কেরালা বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে।

ইতিহাস
আদিবাসী নেগ্রিটো এই অঞ্চলের আদিবাসী ছিল। এরপরে এই অঞ্চলে দ্রাবিড়দের অনুপ্রবেশ ঘটে। আজ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষের দিকে আগে মৌর্য সম্রাট অশোকের শিলালিপিতে প্রথম কেরালা ( কেরালাপুত্রা)-র উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর শেষভাগে গ্রিক ও রোমানদের কাছে অঞ্চলটি বিখ্যাত হয়ে ওঠেছিল এই অঞ্চলের গোলমরিচের জন্য। খ্রিষ্টীয় প্রথম ৫টি শতাব্দী এটি তামিল অঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠেছিল। এই সময় এর নাম ছিল তামিলাকম। এ সময়কালে কেরালা ছিল পাণ্ডিয়া, চোল ও চেরা রাজবংশের শাসনাধী। খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে এখানে কিছু ইহুদি অভিবাসীদের আগমন ঘটে। সিরীয় অর্থডক্স খ্রিষ্টানদের মতে, সেন্ট টমাস দগয অপোস্টল এই সময় কেরালা সফর করেছিলেন। খ্রিষ্টীয় ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শতাব্দীকালের ভিতরে কেরালার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে খ্রিষ্টীয় ৮ম শতাব্দীর শেষের দিকে আরব ব্যবসায়ীরা এখানে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আসা শুরু করে। এই সময় এই অঞ্চলে ইসলামের বিকাশ ঘটে।

কুলশেখর রাজবংশ (খ্রিষ্টীয় ৮০০-১১০২)-এর শাসনামলে একটা স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণে গড়ে উঠে মালয়ালম ভাষা।  একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীকালে কেরালা মূলত চোলরাজাদের অধীনে ছিল। চতুর্দশ শতাব্দীর সূচনায় বেনাদ রাজ্যের রবি বর্মা কুলশেখর দক্ষিণ ভারতে খুব অল্প সময়ের জন্য প্রধান্য বিস্তার করেছিলেন। কালিকটে ভাস্কো ডা গামার কালিকটে আসার পর কেরালায় বিদেশী হস্তক্ষেপ শুরু হয়। খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগিজরা আরব বণিকদের তাড়িয়ে দেয় এবং মালাবার উপকূলে তাদের ব্যবসায় প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা করে। তাদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা কালিকটের জামোরিন (উত্তরাধিকারসূত্রে ক্ষমতাবান শাসক) প্রতিহত করেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে ডাচরা পর্তুগিজদের বিতাড়িত করে। ১৭২৯ খ্রিস্টাব্দে বেনাদের সিংহাসনে বসেন মার্তণ্ড বর্মা এবং ১২ বছর পরে কোলাচেলের যুদ্ধে ডাচদের সম্প্রসারণবাদী পরিকল্পনা নসাৎ করে দেন। তারপর মার্তণ্ড বর্মা ইউরোপীয় ধারার সৈনিক-শৃঙ্খলা গ্রহণ করে চারপাশের এলাকার প্রভুত্ব বিস্তার। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে জামোরিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পরেন এবং তিনি মধ্যাঞ্চলীয় কোচিনরাজের সহযোগিতায় কোচিনকে নিজ অধিকারে রাখতে সক্ষম হন। ১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কোচিন, ত্রাবাঙ্কুর ও উত্তরের মালাবার উপকূল ব্রিটিশ মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অধীনস্থ একটি রাজ্যে পরিণত হয়। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘ দু’বছর পর কোচিন ও ত্রাবাঙ্কুর একত্রিত হয়ে ‘ত্রাবাঙ্কুর- কোচিন’ রাজ্য নামে আত্মপ্রকাশ করে।

বর্তমান কেরালা রাজ্য ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ভাষার ভিত্তিতে গঠিত হয়। এসময় মালাবার উপকূল ও দক্ষিণের কানারার কাসারগড় তালুক (প্রশাসনিক মহকুমা) ত্রাবাঙ্কুর-কোচিনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। সাবেক ত্রাবাঙ্কুর-কোচিন রাজ্যের দক্ষিণাংশ তামিলনাড়ুর সঙ্গে যুক্ত করা হয়।

 সূত্র: