সাঁচি'র বৌদ্ধস্তূপ
ভারতে মধ্যপ্রদেশের রাজধানী শহর ভূপাল থেকে  ৪৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সাঁচির বিদিশাগিরিতে অবস্থিত বৌদ্ধ স্তূপ। সম্রাট অশোক এই স্তূপ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০-৬৩ অব্দের দিকে অশোক কলিঙ্গ রাজ্য জয় করেন। এই যুদ্ধে কলিঙ্গবাসী সর্বশক্তি দিয়ে অশোককের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পরও কলিঙ্গবাসী পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষ নরনারী প্রাণ হারায় এবং প্রায় দেড়লক্ষ নরনারী বন্দী হয়। এই যুদ্ধের এই বীভৎসতা সম্রাট অশোককে বিষাদগ্রস্থ করে তোলে। পরে তিনি যুদ্ধের পথত্যাগ অহিংসার পথে সাম্রাজ্য পরিচালনার নীতি গ্রহণ করেন। এরপর তিনি ক্রমে ক্রমে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশেষভাবে আসক্ত হয়ে পড়েন এবং উপগুপ্ত নামক এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কাছে দীক্ষা নিয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন।  তিনি তাঁর গুরু উপগুপ্তকে সাথে নিয়ে কপিলাবস্তু, লুম্বিনী, কুশীনগর, বুদ্ধগয়া-সহ নানা স্থানে ভ্রমণ করেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার করেন। এই সময় তিনি নানা স্থানে স্তূপ, স্তম্ভ এবং পাহাড়ের গায়ে বুদ্ধের বাণী লিপিবদ্ধ করে রাখার ব্যবস্থা করেন। এই সূত্রে তিনি বর্তমান সাঁচি থেকে দশ কি.মি দুরে বিদিশাগিরি নামক পাহাড়ে একটি বৌদ্ধ স্তূপ তৈরি করেছিলেন।

 

সম্রাট অশোকের তৈরি মূল স্তূপটির ব্যাস প্রায় ৩৬.৬ মিটার ও উচ্চতা প্রায় ১৬.৫ মিটার। কথিত আছে অশোকের কন্যা সঙ্ঘমিত্রা ও পুত্র মহেন্দ্র শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধধর্ম প্রচারে যাওয়ার আগে, সাঁচিতে এই স্তূপ পরিদর্শন করেছিলেন। 

একসময় এই স্তূপে অনেক বসবাসের ও উপাসনার ঘর ছিল। মঠের পাশে ছিল একটি বিশাল পাথরের পাত্র। এতে সমস্ত দানসামগ্রী জমা হতো। পরে সেগুলি দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হতো।

বিদিশাগিরির শীর্ষে রয়েছে সম্রাট অশোকের তৈরি মহাস্তূপ। একে এক নম্বর স্তূপ বলা হয়। মনে করা হয় এই এক নম্বর স্তূপের মধ্যে বুদ্ধদেবের ভস্ম আছে। উল্লেখ্য সম্রাট অশোক যে স্তূপ গড়েছিলেন তা এখনকার স্তূপের নিচে চাপা পড়ে গেছে। একশ বছর পরে সেই স্তূপের উপর আরো বড় স্তূপ তৈরি হয়। তা ঘিরে তৈরি হয়েছিল পাথরের অলিন্দ। কালক্রমে সে অলিন্দের পাথর অনেকটা ক্ষয়ে গিয়েছিল। এই কারণে পরে স্তূপের পাশে গোল বারান্দার মতন প্রদক্ষিণ পথ তৈরি হয়। এরও প্রায় একশ বছর পর স্তূপের চারদিকে চারটি তোরণ নির্মাণ হয়। এক নম্বর স্তূপের উত্তরমুখী তোরণ এখনও অক্ষত। এতে আছে কাঠ বা হাতির দাঁতের সূক্ষ্ম কারু কাজ। তোরণের স্তম্ভ ও ফলকে বৌদ্ধ জাতকের গল্প খোদাই করা আছে। বুদ্ধের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু দৃশ্য এখানে দেখা যায়। তবে তোরণ বা স্তম্ভে বুদ্ধের কোন মূর্তি নেই। কখনও গাছ, কখনও ধর্মচক্র, কখনও পদচিহ্ন-এসব প্রতীক দিয়ে বুদ্ধের উপস্থিতি বোঝান হয়েছে। এর কারণ সম্ভবত এই যে সে সময় বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের ভিতর বুদ্ধমূর্তি পূজোর নিয়ম ছিল না। 

সাঁচির প্রতিটি তোরণের ওপর ধর্মচক্র ও তার নিচে জীবজন্তু, বুদ্ধের জীবনের ঘটনাবলী, জাতকের কাহিনি, সমকালীন ঐতিহাসিক তথ্যগুলি বর্ণিত হয়েছে। পশ্চিম তোরণের উপরিভাগে আছে মানবরূপী বুদ্ধের সাত জন্মের কাহিনী। মাঝে সারনাথে উপদেশরত বুদ্ধ। দক্ষিণ তোরণে রয়েছে বুদ্ধের জন্ম কাহিনি। সিদ্ধার্থমাতা মায়াদেবী পদ্মের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর ডানদিকে যূথপতি বারি সিঞ্চনরত। নিচে কীচকের বামন মূর্তির হাতে মালা। পূর্বতোরণে গর্ভাবস্থায় মায়াদেবীর স্বপ্নদর্শন, শাক্যমুনির জলের ওপর ভ্রমণ ও কপিলাবস্তু থেকে গৃহত্যাগ। এখানে একটি তোরণে আছে। এতে অঙ্কিত হয়েছে
একটি আম্রবৃক্ষের নিচে উপদেশ দানের পর বুদ্ধ হেঁটে চলেছেন লেলিহান শিখার মাঝখান দিয়ে শূন্যপথে।

গুপ্ত যুগে সাঁচিতে মূর্তি যুক্ত হয়। এই মূর্তি আনা হয়েছিল মথুরা থেকে।  বৌদ্ধ ধর্মের ক্রমবিবর্তনের সূত্রে এই মূর্তি যুক্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। উল্লেখ্য, বুদ্ধের মৃত্যুর কিছু পর থেকেই তার প্রবর্তিত ধর্ম নিয়ে তর্ক শুরু হয়। কৌসাম্বির দলটি পুরানো ও রক্ষণশীল ছিল। অন্যদিকে মথুরার কেন্দ্রটি অপেক্ষাকৃত নতুন। নতুন দলটি বুদ্ধদেবের মূর্তি বানিয়ে ঈশ্বরের মতো পূজা করা শুরু করে।  এই সূত্রে মথুরাকেন্দ্রিক দলটির সদস্যেরাও বুদ্ধের পাথরের খোদাই মূর্তি গড়ে পূজো শুরু করে। গুপ্ত যুগে সাঁচিতে যে বুদ্ধ মূর্তি আসে সেগুলি মথুরা থেকেই আনা হয়েছিল বলে ধারণ করা হয়।

স্তূপের ঠিক বাইরে দুটো অতি প্রাচীন মন্দির আছে। মন্দিরের উপরে  কোনো গম্বুজ নেই। উপরিভাগ অনেকটা প্রাচীন গ্রিক বা রোমান মন্দিরের মতো সমান। এর ডানদিকে আরেকটি মন্দিরের ভগ্নাবশেষ দেখা যায়। এর থাম ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট নেই। প্রথমদিকে তোরণের চারদিকে চারটি মূর্তি ছিল। এখন একটি ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় টিকে আছে।

মৌর্য বংশের অবসানের পর, ব্রাহ্মণরা বেশ কয়েকবার সাঁচির স্তূপ আক্রমণ করে ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালায়। এই সময় অশোকের স্তূপ ছাড়াও সাঁচির সমস্ত সৌধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও স্থানীয় গৃহী বৌদ্ধরা নতুন উদ্যমে কিছুটা মেরামত শুরু করেন। কিন্তু তৎকালীন রাজনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক ধাক্কা সাঁচির উপরেও পরে। ফলে নতুন উদ্যমে মঠ স্তম্ভ নির্মাণের কাজেও ভাঁটা পড়ে। এবং শেষে একেবারে থেমে যায়। গুপ্তযুগে দেশে কিছু শান্তি ও সমৃদ্ধি এলে সাঁচিতে কারুশিল্প ও স্থাপত্যের কাজ নতুন ভাবে শুরু হয়। এ সময়ই মূর্তির দেখা মেলে। এসময়ে সতেরো নম্বর মন্দিরটি নির্মিত হয়। এভাবে দুশো বছর কাজ চলতে থাকে। তারপর হুনেরা ভারত আক্রমণ করে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। ফলে এই স্তূপের নিয়মিত সংস্কার বন্ধ হয়ে যায়।
 

৬০৬ খ্রিষ্টাব্দে রাজা হর্ষবর্ধনের শাসনকালে বৌদ্ধধর্ম বিস্তার লাভ করে। এই সময় সাঁচিতে বেশ কিছু মঠ ও মন্দির বানানো হয়। এই ধারা প্রায় ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এরপর হিন্দু আধিপত্যের কারণে সাঁচিতে বৌদ্ধ-ধর্মাবলম্বীরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ক্রমে স্তূপে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ফলক স্থাপিত হতে থাকে। একসময় সাঁচি বৌদ্ধশূন্য এলাকায় পরিণত হয়। উনবিংশ শতাব্দীর দিকে সাঁচির বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকা একটি পরিত্যাক্ত এলাকায় পরিণত হয়। কালক্রমে স্তূপটি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায়।

 

১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ জেনারেল টেলার সাঁচির ধ্বংসস্তূপ আবিষ্কার করেন। এই সময় গুপ্তধনের আশায় লোকজন শেষবারের মতো স্তূপটির ক্ষতি করে। ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দে ক্যাপটেন জনসন এক নম্বর স্তূপটি উপর থেকে নিচ পর্যন্ত কেটে ফেলে। ফলে স্তূপের গায়ে প্রকাণ্ড ফাটলের সৃষ্টি হয় এবং পশ্চিমের তোরণ ভেঙ্গে পড়ে। একইভাবে দু নম্বর স্তূপও ধ্বংস হয়। ১৮৫১ খ্রিষ্টাব্দে আবার দুই ও তিন নম্বর স্তূপ খোঁড়া হয়। এক নম্বর স্তূপের মধ্যে রত্নরাজির সন্ধানে লোহার রড ঢুকিয়ে পরীক্ষা করা হয়। এই সময় স্থানীয় এক হিন্দু জমিদার অশোক স্তম্ভটি তিন টুকরো করে বাড়ি নিয়ে যান।

১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দের পরে স্তূপটি সংরক্ষণের চেষ্টা করেন মেজর কোল। পরের তিন বছর তিনি এই উদ্যম সচল রাখেন। এর বেশ পরে পরে ভারতের আর্কিওলজিকাল সার্ভের ডিরেক্টর এ কাজে এগিয়ে আসেন। মেজর কোল বিদিশাগিরির জঙ্গল কেটে গোটা পাহাড় পরিষ্কার করান। এক নম্বর স্তূপের ফাটল মেরামত করেন। পশ্চিম ও দক্ষিণদিকের তোরণগুলি তুলে যথাস্থানে স্থাপন করেন। এরপর বাকি কাজ করেন স্যার জন মার্শাল। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে এই স্তূপের যে সংস্কার করা হয়, বর্তমানে তাই পুরাকীর্তি হিসেবে দেখা যায়। বর্তমানে সাঁচির এই স্তূপটি বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।