স্বরাজ দল
ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম রাজনৈতিক সংগঠন।

মহাত্মা গান্ধী ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে ১২ ফেব্রুয়ারিতে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে, কংগ্রেসের কতিপয় নেতা, স্বাধীনতা  আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে অগ্রসর হওয়ার জন্য নতুন দল তৈরি করার উদ্যোগ নেন। এই সূত্রে তৈরি হয়েছিল স্বরাজ দল। তবের এই দল গঠনের পিছনে ছিল তৎকালীন ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কিছু ধারবাহিক ঘটনা।

১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে১৮ই মার্চ একটি সন্ত্রাস বিরোধী এবং দমনমূলক আইন হিসেবে  রাওলাট আইন ১৯১৯ (The Rowlatt Act of 1919) পাশ হয়। গান্ধীজি এই আইন বাতিলের জন্য দরখাস্ত করেন। এপ্রিল মাসে গান্ধীজি সর্বভারতীয় সত্যগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন এবং এর স্বপক্ষে হরতাল পালিত হয়।

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে ১লা আগষ্ট তিনি গান্ধীজির পক্ষে অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেন সরোজিনী নাইডু অসহযোগ আন্দোলনের সূত্রে  স্বদেশী ভাবপুষ্ট লেখা প্রকাশের জন্য, ব্রিটিশ-ভারতের পুলিশ ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই ডিসেম্বর চিত্তরঞ্জন দাশ-কে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল। এই সময় তাঁর স্ত্রী বাসন্তী দেবী চিত্তরঞ্জনের দাবী নিয়ে সক্রিয় প্রচারণা চালাতে থাকেন।

১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ভাইসরয়কে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, গুজরাটের বরদৌলিতে সত্যাগ্রহ অভিযান চালনা করা হবে। কিন্তু ৫ই ফেব্রুয়ারিতে উত্তর প্রদেশের চৌরিচোরাতে জনতা ২১জন কনস্টেবল ও একজন সাব ইন্সপেক্টরকে অগ্নিদগ্ধ করে মেরে ফেলেন। এই সহিংস ঘটনার জন্য টানা ৫ দিন উপবাস করেন। এরপর সত্যাগ্রহ আন্দোলন পরিত্যাগ করেন। ১৯২২ সালের ১০ মার্চ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় এবং ১৮ মার্চে বিচারে তাঁকে ছয় বছরের কারাদণ্ড প্রদান করা হয়।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ইতিমধ্যে কংগ্রসের দুটি পরস্পর-বিরোধী দুটি গোষ্ঠী। এর একটি দ্ল চেয়েছিল ভারতের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশের আইন সভায় প্রবেশ করে, ব্রিটিশের সকল কাজের বিরোধিতা করা। সাধারণভাবে এই মতবাদের অনুসারীরা Pro-changer (পরিবর্তনকামী গোষ্ঠী) নামে অভিহিত করা হয়েছিল। এই দলে ছিলেন
চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিরাল নেহেরু প্রমুখ, বিঠলভাই প্যাটেল, সত্যমূর্তি, আজমল খান প্রমুখ। এই মতাদর্শের বিরোধীরা অভিহিত হয়েছিলেন No-changer (পরিবর্তন-বিরোধী গোষ্ঠী)। এই দলে ছিলেন
গান্ধীজি, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, গোপালচারী, বল্লভভাই প্যাটেল, আনসারি, কদ্তুরীবাঈ আবেঙ্গার প্রমুখ।

পরিবর্তনকামী গোষ্ঠীর শর্তাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য শর্তসমূহ

১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে সভানেত্রী রূপে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের স্ত্রী বাসন্তী দেবী তাঁর স্বামীর দেয়া প্রস্তাবের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। কিন্তু তিনি প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যর্থ হন। জুন মাসে চিত্তরঞ্জন দাশ ও মতিরাল নেহেরু কারামুক্ত হয়ে এ প্রস্তাবের পক্ষে জনমত গঠনে আত্মনিয়োগ করেন।

১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে গয়ায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে চিত্তরঞ্জন দাশের প্রণীত পরিবর্তনকামী গোষ্ঠীর প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। ভোটে পরিবর্তনকামী গোষ্ঠী ভোট পায় ৮৯০টি এবং পরিবর্তন বিরোধী গোষ্ঠী পায় ১৭৪০ ভোট। ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেস  চিত্তরঞ্জন দাশের প্রণীত পরিবর্তনকামী গোষ্ঠীর প্রস্তাব বাতিল করে দেয়। এই ঘটনার পর, চিত্তরঞ্জন কংগ্রসের সভাপতির পদ ত্যাগ করেন।

১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়রি কংগ্রেসের ভিতরে থেকেই চিত্তরঞ্জন দাশ ‌'কংগ্রেস খিলাফৎ স্বরাজ দল‌‌' গঠন করেন। এই দল গঠনের মধ্য দিয়ে তিনি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যের রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নির্ধরাণ করে দিয়েছিলেন। এই দল গঠনে তিনি সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছিলেন মতিলাল নেহেরু ও
সুভাষচন্দ্র বসু-সহ বহু কংগ্রেসী নেতাকর্মীকে। পরে কংগ্রেস থেকে পৃথক হয়ে এই দলের নামকরণ হয়েছিল 'স্বরাজ্ দল। এ সভাপতি ছিলেন- চিত্তরঞ্জন দাশ এবং সম্পাদক হন মতিলাল নেহেরু।

১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে স্বরাজ দল তৎকালীন বোম্বাই, মধ্যপ্রদেশ, আসাম ও যুক্তপ্রদেশে ব্যাপক সাফল্য লাভ করে। বঙ্গদেশে ৮৫টি আসনের ভিতরে স্বরাজ দল পেয়েছিল ৪৫টি আসন। এর ভিতরে ২১টি ছিল মুসলিম আসন। কেন্দরীয় আইন সভায় ১০১টি আসনের ভিতরে ৪৫টি আসন লাভ করেছিল।

প্রাদেশিক এবং কেন্দ্রীয় আইন সভায় স্বরাজ দলের বিরোধিতা নীতি গ্রহণের ফলে, সরকার ১৯২৪-২৫, ১৯২৫-২৬ এবং ১৯২৬-২৭ অর্থবছরের কেন্দ্রীয় আইন সভার অর্থবিল ও বাজেট পাশ করতে ব্যর্থ হয়।


১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে  
চিত্তরঞ্জন দাশের  মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাবে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে। মূলত ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে দলটি ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে চলে গিয়েছিল।