শ্রীনিকেতন
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশের বীরভূম
জেলার অন্তর্গত বোলপুর মহকুমার একটি শহর। শান্তিনিকেতন থেকে এর দূরত্ব মাত্র ৩
কিলোমিটার। ভৌগোলিক অবস্থান : ২৩.৪০ ডিগ্রি উত্তর, ৮৭.৪০ ডিগ্রি পূর্ব। গড় উচ্চতা
৪৯ মিটার। বোলপুর-শ্রীনিকেতন ব্লকটির প্রধান কার্যালয়টি শ্রীনিকেতনে অবস্থিত। এই
ব্লকের পঞ্চায়েতগুলো হলো―
বাহিরি-পাঁচশোয়া, রায়পুর-সুপুর, সরপলেহানা-আলবাঁধা, সিংঘি, কঙ্কালিতলা, রূপপুর,
কসবা, সাত্তোর, ও সিয়ান মুলুক।
সুরুল মৌজার প্রধান অংশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী অবস্থিত। এক সময় এই অঞ্চলে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিচু
বর্ণের লোকেরা বসবাস করতো। বিশেষ করে বাগ্দী, বাউরি, ডোম এবং জোলা সম্প্রদায়ের
লোকেরা বসবাস করতো।
একসময় সুরুল বেশ জনবহুল গ্রাম ছিল। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এখানে বেশ কিছু হিন্দু
মন্দির স্থাপিত হয়। এখান ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বারা কলকাতা
কেন্দ্রিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের দ্রুত বিকাশ ঘটলে থাকলে, এই অঞ্চলের মানুষ
কর্ম সংস্থানের জন্য বাস্তুভিটা ত্যাগ করে।
১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর
রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয়
(ব্রহ্মাশ্রম) স্থাপন করেন। এরপর থেকে তিনি পল্লিসংস্কার নিয়ে ভাবনা
শুরু করেন।
১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ রায়পুরের জমিদার কর্নেল নরেন্দ্রপ্রসন্ন
সিংহের কাছ থেকে সুরুলের নিকটে অবস্থিত একটি কুঠিবাড়ি দশ হাজার টাকায় কেনেন।
এরপর পল্লিসংস্কার নিয়ে বিস্তর পরিকল্পনা করেন। এরই সূত্র ধরে তিনি ১৯২১
খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগে তিনি 'পল্লীসংগঠন কেন্দ্র' স্থাপনের উদ্যোগ নেন।। ১৯২২
খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে এসে লেনার্ড নাইট এলমহার্স্ট এই সংস্থার
পরিচালনভার গ্রহণ করেন। এই সময় তাঁর সঙ্গে কাজে যোগ দেন কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এবং সন্তোষচন্দ্র মজুমদার, গৌরগোপাল ঘোষ, কালীমোহন ঘোষ, সচ্চিদানন্দ রায়, কিম তারো
কাসাহারা প্রমুখ কয়েকজন শিক্ষক। এছাড়া ছিলেন সুবীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কুলপ্রসাদ সেন,
দেবব্রত ভট্টাচার্য, হরিহরণ প্রমুখ শান্তিনিকেতনের দশ জন ছাত্র। এই সময় এটিকে বলা
হত ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচার, শান্তিনিকেতন।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শ্রীনিকেতন নামটির উল্লেখ পাওয়া যায় থেকে। এই বৎসরে
সুরুলে পল্লীসংগঠন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
শ্রীনিকেতনের কাজের উদ্দেশ্য ছিল কৃষির উন্নতি, রোগ নিবারণ, সমবায় প্রথায় ধর্মগোলা
স্থাপন, চিকিৎসার সুব্যবস্থা, ও স্বাস্থ্য বিষয়ে গ্রামবাসীদের সচেতন করে তোলা।
পল্লী সংগঠন বিভাগ থেকে শিল্পভবন, শিক্ষাসত্র ও শিক্ষাচর্চাসদন ইত্যাদি কর্মকাণ্ড
শান্তিনিকেতনের পাশাপাশি শ্রীনিকেতনেও বিস্তার লাভ করে।
শান্তিনিকেতনে ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় 'শিক্ষাসত্র'। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে
'শিক্ষাসত্র' শ্রীনিকেতনে স্থাপন করা হয়। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে দরিদ্রসাধারণের শিক্ষার
সুযোগকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য স্থাপিত হয় 'লোক-শিক্ষা সংসদ'। পরের বছর গ্রামীণ
স্কুল শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য চালু হয় শিক্ষাচর্চা। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে একটি
কৃষি মহাবিদ্যালয় “পল্লীশিক্ষাসদন” এবং ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে “পল্লীচর্চাকেন্দ্র”
স্থাপিত হয় শ্রীনিকেতনে।
১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি সহযোগিতায় শ্রীনিকেতনে প্রতিষ্ঠিত হয় 'শিশু ও মাতৃমঙ্গল
কেন্দ্র'। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে 'পল্লী সংগঠন কেন্দ্র' ও 'শিল্পসদন' সংযুক্ত হয়ে 'পল্লীসংগঠন বিভাগ' গঠিত হয়। এই বিভাগের অন্তর্গত ছিল স্বাস্থ্য, শিক্ষা,
শিল্প-প্রশিক্ষণ ও উৎপাদন, গো-পালন ইত্যাদি। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে “শিক্ষাসত্র”
বিদ্যালয়টিকে শান্তিনিকেতনের 'পাঠভবন' নামক বিদ্যালয়ের আদর্শে একটি বিদ্যালয়ে
পরিণত করা হয়। পরে একর পল্লীসংগঠন বিভাগের অধীনে আনা হয়।
বর্তমানে শ্রীনিকতেন-এর পল্লীসংগঠন বিভাগের অধীনে রয়েছে 'পল্লী সম্প্রসারণ
কেন্দ্র', 'শিল্পসদন', 'পল্লীচর্চাকেন্দ্র', 'সংগীত-বিভাগ' ও 'গ্রামীণ গ্রন্থাগার'।
বর্তমানে 'পল্লীশিক্ষাভবন' (ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচার) একটি স্বতন্ত্র ভবনের
মর্যাদা পেয়েছে। এছাড়াও রয়েছে 'শিক্ষাসত্র', 'শিক্ষাচর্চা' ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান ও
অঙ্গনওয়াড়ি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে কুঠিবাড়িটি কিনেছিলেন, তা সংস্কার করে, শ্রীনিকেতন জনসংযোগ দপ্তর, ডাকঘর ও পল্লীচর্চাকেন্দ্রের দপ্তর স্থাপন করা হয়েছে। শ্রীনিকেতনের বার্ষিক উৎসব পালিত হয় প্রতি বছর ৬-৯ ফেব্রুয়ারি।