রাস নৃত্য
ভারতীয় চিরায়ত নৃত্যশেলীর মণিপুরী নৃত্যধারা একটি অন্যতম অধ্যায়।

এটি মণিপুরী নৃত্যধারা উৎসবের আঙ্গিকে পরিবেশিত হয়। এর প্রধান বিষয় রাধাকৃষ্ণের লীলা। মণিপুরী উপকথা এবং পুরাণের রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত অভিনয় প্রযুক্ত নৃত্য-গীতের মাধ্যমে পরিবেশিত।
রাধাকৃষ্ণের নৃত্যলীলআকে সাধারণভাবে রাসলীলা বলা হয়। আর রাসলীলাকে কেন্দ্র করে উপস্থাপিত নৃত্য-উৎসবই হলো রাসনৃত্য।

 

পুরাণ এবং মণিপুরের উপকথা অনুসারে জানা যায়, শ্রীকৃষ্ণ একবার রাধাকে নিয়ে একটি রাসলীলা ব্যবস্থা করেন। মহাদেব এই লীলা দেখার আগ্রহ প্রকাশ করলে, কৃষ্ণ তাঁকে রাসলীলাস্থলের দ্বার রক্ষক হয়ে এই লীলা উপভোগের অনুমতি দেন। মহাদেব যথারীতি দ্বাররক্ষক হয়েই এই লীলা উপভোগ করেন। এই নৃত্যলীলা উপভোগ করতে করতে মহাদেব দ্বাররক্ষার কর্তব্য ভুলে যান। এই সময়, পার্বতী সেখানে উপস্থিত হন। মোহিত মহাদেবকে ফাঁকি দিয়ে, পার্বতী এই লীলা উপভোগ করেন। এই অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর, পার্বতী নিজেদের জন্য একটি রাসলীলার আয়োজন করার জন্য মহাদেবের কাছে আবদার করেন। মহাদেব তাতে সম্মত হয়ে রাসলীলার উপযোগী স্থান নির্বাচন করার জন্য সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ালেন। কিন্তু উপযুক্ত স্থান পেলেন না।  অবশেষে তাঁরা ঘুরতে ঘুরতে মণিপুর রাজ্যে এলেন। অবশেষে তিনি কোউব্রু পর্বত (কুমার পর্বত)-কে এই নাচের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করেলন। এই স্থানকে রাসলীলার উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য সূর্য, চন্দ্র এবং পাঁচটি গ্রহকে আহ্বান করলেন। মণিপুরী ভাষায় এদের নাম হলো নোঙমাইজিঙ (সূর্য), নিঙ্‌থোউকাবা (চন্দ্র), লেইপাক্‌পোকু (মঙ্গল), য়ুম-সাইকে-সা (বুধ), সাগোলসেল (বৃহস্পতি), ইরাই (শুক্র) এবং খাঙ্‌জা (শনি)। রাসলীলার ক্ষেত্র নির্মাণের সময় দেখা গেল, কুমারপর্বতের পাদদেশ জলমগ্ন। মহাদেব এই স্থানকে জলশুন্য এবং রাসক্ষেত্রে উপযোগী পরিচ্ছন্ন স্থানে পরিণত করার জন্য কৃষ্ণকে অনুরোধ করেন। কৃষ্ণ এই কাজের জন্য ১০জন দেবতার নিয়োগ করেলন। এঁরা হলেন হওবা শোরারেল (ইন্দ্র), মারজিঙ (কুবের), রাঙব্রেল (যম), খোরিকাবা (বরুণ), ইরুমলাকপা (বায়ু), নোঙসাবা ও কোঙবা-মেইরোম্বা।

 

এদের সমবেত চেষ্টায় রাসলীলার ক্ষেত্র তৈরি হলে, সাতদিন সাতরাত শিব-পার্বতীর রাসলীলা অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানের সঙ্গীত সহযোগী ছিলেন গন্ধর্ব এবং অন্যান্য দেবতারা। রাত্রিবেলার অনুষ্ঠানের জন্য নাগরাজ অনন্তদেব তাঁর মাথার মণি দান করেন। নাগদেবের মণির নামানুসারে এই স্থানের নাম হয় মণিপুর। কথিত আছে, রাসলীলা শেষে দেবতারা মণিপুরকে একটি জনপদের মর্যাদা দেন এবং এই অঞ্চলের প্রথম রাজা হন অনন্তদেব। এই থেকে মণিপুরে নৃত্যগীতের সূচনা হয়।

 

মণিপুরী নৃত্যের বিভিন্ন উপকরণের সাথে নানা ধরনের উপাখ্যান জড়িয়ে আছে। এই উপাখ্যানগুলোও মণিপুরী নাচের মতই চিরায়ত কাহিনীতে পরিণত হয়েছে। মণিপুরের সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। ধারণা করা এদের ঐতিহ্যগত লোক নাচই কালক্রমে চিরায়ত নৃত্যধারায় পরিণত হয়েছে। এদের নৃত্যগীতের প্রাচীন নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা হয় লাইহারাউবা নৃত্য। ১৭০৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পামহৈবা মণিপুরের রাজত্ব লাভের পর বৈষ্ণবদের আধিপত্য প্রবলতর হয়ে মণিপুরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। কারণ, রামানন্দীর ভাবদর্শের বিশ্বাসী বৈষ্ণব সাধক শান্তি দাস অধিকারীর অনুপ্রেরণায় রাজা পামহৈবা বৈষ্ণব মত গ্রহণ করেন। এরপর তিনি তাঁর মতকে একরকম জোর করেই মণিপুরে প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে এই অঞ্চলে শৈবমতাদর্শের লোকের একরকম কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এই সময় রাজা পামহৈবা অন্য মতের গ্রন্থাদি ও নিদর্শন ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে মণিপুরের ইতিহাসও ধ্বংস হয়ে যায়। মণিপুরের বৈষ্ণবরাও শিবকে শ্রদ্ধা এবং পূজা করতো। ফলে শিব-পার্বতীর লীলা ভিত্তিক গীত ও নৃত্য বিলুপ্ত হয়ে গেল না, সত্য কিন্তু বৈষ্ণবভক্তির প্রাবল্যে অন্যান্য দেবদেবী গৌণ হয়ে পড়েছিল। ফলে 'লাইহারাউবা'- নৃত্য মর্যাদা হারাতে হারাতে প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে যায়।

 

১৭৫৯ খ্রিষ্টাব্দে রাজা চিঙ্‌থাঙ খম্বা বা ভাগ্যচন্দ্র সিংহের শাসনামলে মণিপুরের নৃত্যগীতের চরম উৎকর্ষতায় পৌঁছায়। তারই চেষ্টায় মণিপুরে রাসনৃত্যের প্রবর্তন হয়। কথিত আছে, রাজা স্বপ্নে রাসলীলা করার আদেশ পেয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ স্বপ্নের ভিতর তাঁকে জানান যে, রাজকন্যা বিম্ববতীমঞ্জরীকে রাধা সাজিয়ে শ্রীকৃষ্ণের মূর্তিমণ্ডলীর ভিতরে রেখে নৃত্যলীলা করতে হবে। রাজা তাঁর কন্যাকে রাস নৃত্য শিখিয়ে, স্বপ্নের আদেশ পালন করেন। কালক্রমে এই নৃত্য রাসনৃত্য নামে মণিপুরে ছড়িয়ে পড়ে। তবে এই কাহিনির সাথে কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। রাজা ভাগ্যচন্দ্রই মহারাস, বসন্তরাস, কুঞ্জরাস ও ভঙ্গীপারেঙ প্রবর্তন করেন।

 

শৈবযুগে রাসনৃত্য পৃথক নৃত্য শৈলী হিসেবে বিকশিত না হলেও, তালরাস, দণ্ডরাস এবং মণ্ডলরাসে প্রচলন ছিল।  ভাগ্যচন্দ্র সিংহ রাসনৃত্যকে নাট্যাঙ্গিকে সাজান। তিনি এই বিষয়ে রচনা করেন 'গোবিন্দ সঙ্গীত লীলাবিলাস'। এই গ্রন্থে নাট্যকে রূপক (প্রাচীন নাট্য) ও রাসক (নৃত্যনাট্য) পর্যায়ে বর্ণনা করেছেন। আগে রাসলীলায় গান, নাচ এবং অভিনয় ছিল। কিন্তু সুসমন্বয়ে তা গ্রথিত ছিল না। তিনি এই গ্রন্থের রাসক অধ্যায়ে রাসনৃত্যের বিভিন্ন আঙ্গিক ও পদ্ধতি লিপিবদ্ধ করেন। এই গ্রন্থানুসারে রাস নৃত্যকে পর্যায়ে ভাগ করেন। এই ভাগগুলো হলো মহারাসক, মঞ্জুরাসক, নিত্যরাসক, নির্বেশরাসক ও গোপরাসক। বর্তমানে এই রাসকগুলো মহারাস, বসন্তরাস, নিত্যরাস, কুঞ্জরাস, গোপরাস বা গোষ্ঠরাস এবং উলুখল রাস নামে পরিচিত। রাজ ভাগ্যচন্দ্রের পৌত্র চন্দ্রকীর্তি সিংহাসনে বসে ১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে। তাঁর সময়ে রাসনৃত্য আরও সমৃদ্ধতর হয়ে উঠে। তিনি প্রথম নর্তনরাসের প্রবর্তন করেন। এছাড়া প্রায় বিলুপ্ত -'লাইহারাউবা' নৃত্যকে তিনি আবার প্রচলন করেন।

 

ভাগ্যচন্দ্র এবং চন্দ্রকীর্তির পরবর্তী সময়ে নিয়মিত চর্চার ভিতর দিয়ে রাসনৃত্য আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠে। কালক্রমে জয়দেব, বিদ্যাপতী, চণ্ডীদাসের বৈষ্ণব পদাকর্তাদের প্রভাব পড়ে রাসলীলার বাণী অংশে। অন্যদিকে বাংলার কীর্তন প্রভাব পড়ে এর সুরে। বর্তমানে রাসনৃত্য শৃঙ্গার, রসসম্ভূত, বিপ্রলম্ভ ও সম্ভোগ অংশ এই লীলায় প্রযুক্ত হতে দেখা যায়।

 

রাসনৃত্য বৎসরের বিভিন্ন সময়ে নবনব সাজ-সজ্জায় অনুষ্ঠিত হয়। যেমন-


সূত্র :