হোরি/হোলি
সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বৈষ্ণব-পন্থীদের মধ্যে প্রচলিত একটি উৎসব। ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবে রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহকে শুকনো আবির এবং রঙিন জলে স্নান করিয়ে দোলায় বসানো হয়। এই আনুষ্ঠানিকতার সাথে ভক্তদের রং ছিটানো বা রং মাখার খেলা। এর সাথে থাকে রাধাকৃষ্ণের লীলা-বিষয়ক সঙ্গীত। হোরি উৎসবের গান হিসেবে এই গানকেও হোরি গান বলা হয়।

হিন্দু শাস্ত্র মতে ফাল্গুন মাসের পৌর্ণমাসীতে দোল উৎসব হয়। উল্লেখ্য, যে দিন চান্দ্রমাস পূর্ণ হয় সেদিনকে পৌর্ণমাসী বলা হয়। চান্দ্রমাসের পূর্ণতা পায় পূর্ণিমায়। আর এই পূর্ণিমাতে দোল-উৎসবের শুরু হয়। শাস্ত্র মতে- যে দিন অরুণোদয়কালে পৌর্ণমাসী হবে, সেদিনই দোলযাত্রা হবে। যদি অরুণোদয় কালের পূর্বে পৌর্ণমাসী হয়, তা হলে দোলযাত্রা  আগের দিন হবে। এ বিষয়ে নগেন্দ্রনাথ বসুর বিশ্বকোষ নবম খণ্ডে -উল্লেখ আছে-

'কলিযুগে এই দোলোৎসব.সকল উৎসবের মধ্যে প্রধান। ফাল্গুন মাসের চতুর্দ্দশী তিথির অষ্টমযামে অথবা প্রতিপৎ সন্ধিকালে যথাবিধি ভক্তিপূর্বক সিত, রক্ত, গৌর ও পীত এই চতুর্বিধ ফল্গুচূর্ণ দ্বারা এবং নানাবিধ সুগন্ধ দ্রব্য ইহাতে মিশ্রিত করিয়া শ্রীকৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করিবে। একাদশী হইতে আরম্ভ করিয়া পঞ্চমীতে ইহা সমাপন কবে, এই উৎসব পাঁচদিন বা তিনদিন ধরিয়া করিতে হয়। দক্ষিণামুখে
কৃষ্ণকে দোলযানে স্থাপন করিবে, যাহারা এই দোলস্থ কৃষ্ণকে দর্শন করে, তাহারা অপরাধসমূহ হইতে মুক্তিলাভ করে, ইহাতে কিছুমাত্র সংশয় নাই। (পদ্মপুরাণ )'

দোলযাত্রার পৌরাণিক আখ্যান
হিন্দু পৌরাণিক আখ্যান থেকে জানা যায়-হিরণ্যকশিপু ব্রহ্মার তপস্যা করে বর লাভ করেন। এই বরটি ছিল- দেব, মানব, দানব, যক্ষ, রক্ষ, পৃথিবীর সকল শ্রেণীর প্রাণীর অবধ্য হবেন এবং দিন-রাত্রি, আকাশ, ভূমি, জলে, পাতালে তাঁর মৃত্যু হবে না। ব্রহ্মা সেইরূপ বরই প্রদান করেন। এই বর লাভ করে হিরণ্যকশিপু অহংকারী ও উদ্ধত হয়ে ওঠে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, কেবল তাকেই দেবতা হিসেবে পূজা করা হবে। কেউ তার আদেশ পালন না করলে তিনি তাকে শাস্তি দেবেন বা হত্যা করবেন। বিশেষ করে এঁরা বিষ্ণুকে অবজ্ঞা করা শুরু করেন। এই কারণে বিষ্ণু বরাহমূর্তি ধারণ করে হিরণ্যকশিপু'র ভাই হিরণ্যাক্ষকে হত্যা করেন।

এই সময় হিরণ্যকশিপুর তিন পুত্র অনুহ্লাদ, সংহ্লাদ ও হ্লাদ বিষ্ণুবিদ্বেষী হলেও তাঁর অপর পুত্র প্রহ্লাদের বিষ্ণুভক্ত হয়ে পড়েন। প্রথমে হিরণ্যকশিপু ছেলেকে বিষ্ণু পূজা থেকে বিরত থাকতে বলে ব্যর্থ হন। পরে ইনি প্রহ্লাদকে খড়্গ দ্বারা হত্যা করার চেষ্টা করেন। এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে- তিনি প্রহ্লাদকে হাতির পায়ের তলে ও সাগরে নিক্ষেপ করে হত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রতিবারই বিষ্ণু তাঁকে রক্ষা করেন। হিরণ্যকশিপু একাবার প্রহ্লাদকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপের জন্য একটি কৌশল অবলম্বন করেন।  তিনি তাঁর বোন হোলিকার কাছে সাহায্য চান। উল্লেখ্য, হোলিকার কাছে একটি বিশেষ পোশাক ছিল যা তাকে আগুনে পুড়ে যাবার হাত থেকে রক্ষা করতো। হিরণ্যকশিপু হোলিকাকে ও পোশাকে আবৃত করে, তা  প্রহলাদকে বসিয়ে আগুনে নিক্ষেপ করেন। অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশর পর হোলিকার শরীর থেকে সেই বস্ত্র খুলে গিয়ে প্রহ্লাদের শরীরকে আবৃত করে। এর ফলে এতে হোলিকা আগুনে পুড়ে যায়, আর প্রহ্লাদ ক্ষতি থেকে বেঁচে যায়। হোলিকার এই অগ্নিদগ্ধ হওয়ার কাহিনিই দোলের পূর্বদিনে অনুষ্ঠিত হোলিকাদহন বা চাঁচর উৎসবের সঙ্গে যুক্ত।

এই কাহিনিভিত্তিক উৎসব হোলিকা নামক উৎসব প্রাচীন আর্যাবর্তে শুরু হয়েছিল। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকে রচিত শ্রীকৃষ্ণের 'রত্নাবলী' এবং অষ্টম শতকের 'মালতী-মাধব' নাটকে এবং জীমূতবাহনের 'কালবিবেক' ও ষোড়শ শতকের 'রঘুনন্দন' গ্রন্থেও এই উৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়।

 মূলত পুরীতে দোলোৎসব ফাল্গুন মাসে প্রবর্তনের যে রেওয়াজ হয়, সেখান থেকেই বাংলায় চলে আসে এই সমারোহ। দোলযাত্রা বা হোলি উৎসব সংক্রান্ত পৌরাণিক উপাখ্যান ও লোককথাগুলো মূলত দুই প্রকার: প্রথমটি দোলযাত্রার পূর্বদিন পালিত বহ্ন্যুৎসব হোলিকাদহন বা মেড়াপোড়া সংক্রান্ত, এবং দ্বিতীয়টি রাধা ও কৃষ্ণের দোললীলা বা ফাগুখেলা কেন্দ্রিক কাহিনি। বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, ফাল্গুনী পূর্ণিমা বা দোলপূর্ণিমার দিন বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ শুকনো আবির এবং তরল রঙের জন্য পিচ্‌কারি নিয়ে রাধিকা ও অন্যান্য গোপীদের সাথে নিয়ে রং খেলায় মেতেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি হয়। দোলযাত্রার দিন সকালে তাই রাধা ও কৃষ্ণের মূর্তি আবির ও গুলালে স্নাত করে দোলনায় চড়িয়ে কীর্তনগান সহকারে শোভাযাত্রা বের করা হয়। এরপর ভক্তেরা আবির ও গুলাল নিয়ে পরস্পরের সঙ্গে রং খেলেন। দোল উৎসবের অনুষঙ্গে ফাল্গুনী পূর্ণিমাকে দোলপূর্ণিমা বলা হয়। আবার এই পূর্ণিমা তিথিতেই চৈতন্য মহাপ্রভুর জন্ম বলে একে গৌরপূর্ণিমা নামেও অভিহিত করা হয়।

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে হোলি উৎসব পালন করা হয়। যেমন- ভারতের উত্তর প্রদেশের মথুরা অঞ্চলে কৃষ্ণের বাল্য লীলা এবং রাধা-কৃষ্ণ লীলা ভিত্তিক উৎসবটি রঙ পঞ্চমী নামে পালিত হয়। এই অঞ্চলের মানুষ  মনে করেন যে,  কৃষ্ণ বাল্যকালে যে পুতনা রাক্ষসীকে হত্যা করেছিলেন, সে রাক্ষসী হলো হিরণ্যকশিপু'র বোন হোলিকা। এই কারণে রঙ-পঞ্চমীর আগের রাতে পুতনা দহন উৎযাপন করা হয়। এক্ষেত্রে খড় জাতীয় উপকরণ দিয়ে হোলিকার মূর্তি তৈরি করে, তাতে আগুন দিয়ে এই উৎসব করা হয়।

ঐতিহ্যগতভাবে এই উৎসবটি হিন্দু ছাড়া, অন্যান্য কিছু ধর্মে পালন করা হয়।  যেমন জৈন এবং নেপালের নেওয়ার বৌদ্ধরা হিন্দু পৌরাণিক কাহিনিতে বিশ্বাসী না হলেও সামজিক উৎসব হিসেবে হোলি উৎসব করে থাকেন। সনাতন ধর্মীরা আদিতে সনাতনধর্মী ছিলেন। এঁরা নতুন ধর্মের অনুসারী হলেও ঐতিহ্যগতভাবে এই উৎসব পালন করেন। শিখদের শেষ মানবগুরু গুরু গোবিন্দ সিংহ হোলিকে পরিবর্তন করে তিন দিনের হোলা মহল্লা উৎসবে পরিণত করেছিলেন। আনন্দপুর সাহিব-এর উৎসবের পর হোলি উৎসবের এই বৃদ্ধির সূচনা ঘটে। আনন্দপুর সাহিবে শিখ সৈন্যরা একটি নকল যুদ্ধের খেলায় অংশগ্রহণ করে। এর সাথে থাকে ঘোড়দৌড়, শরীরচর্চা, তীর চালানো ও সামরিক-চর্চা করে। ব্রাহ্মধর্মে হোলি উৎসবের বিধান নেই। শান্তিনিকেতনে হোলি উৎসব হয়ে থাকে বসন্তোৎসব হিসেব।

হোলি উৎসব বঙ্গদেশের বাইরে থেকে আগত উৎসব। নগরকেন্দ্রিক বৈষ্ণবরা এই উৎসব পালন করলেও, গ্রামাঞ্চলে বৈষ্ণবরা দোল-উৎসবকে যথার্থ রঙের খেলায় মেতে উঠেন না। এই কারণে হোরি বা হোলি গান বঙ্গদেশের লোকজ গানের অংশ হয়ে ওঠে নি।