কাজরি
সমনাম: কাজরী, কাজলি, কাজলী
শব্দের উৎপত্তিগত ধারায় বলা হয়- সংস্কৃত কজ্জল>
বাংলা মৈথিল, ভোজপুরি কাজল, কাজর> কাজর+ঈ, ই।
পুরানো বাংলা বানান ছিল কাজরী। আধুনিক বানানে কাজরি।
কাজরী ভারতীয় লোকগীতি এবং লোকনৃত্যের একটি ধারা।
একই সাথে স্থানান্তের লোক-উৎসবও বটে। ধারণা করা হয়,
গ্রীষ্মের শেষে আকাশের
কাজল-কালো মেঘের রূপ থেকে কাজরা শব্দের উৎপত্তি ঘটেছিল।
শুরুর দিকে এটি ভারতের ভোজপুরি ভাষা রচিত
বর্ষাভিত্তিক লোকগান এবং লোক-উৎসব ছিল। উল্লেখ্য, ভারতের উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারের
অংশবিশেষ ও ঝাড়খণ্ড এবং তৎসংলগ্ন নেপালের
অংশবিশেষের মানুষ ভোজপুরি ভাষায় কথা বলে। এই কারণে এই অঞ্চলটি অনেক সময় ভোজপুরি
অঞ্চল নামে আখ্যায়িত হয়ে থাকে। ঐতিহাসিক সূত্রে থেকে জানা যায়- প্রাচীন বিহারের সাবেক শাহাবাদ জেলার উজ্জয়িনীয় রাজপুতরা তাদের সদরদপ্তর ভোজপুর জেলার আরা শহরে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এরপর থেকে সমগ্র অঞ্চলটি ভোজপুরি নামে পরিচিত হয়ে
উঠে। ভোজপুরি ভাষার এই গানে প্রভাবিত হয়ে কাজরি মৈথিলি এবং মগধী ভাষায় ছড়িয়ে পড়েছিল।
আআদিতে কাজরি ছিল ভোজপুরি অঞ্চলের কুমারীর আকাঙ্ক্ষার রূপরেখায় বর্ণিত
লোক গীতি-নৃত্য। এই কারণে এই গানের মূল বিষয়কে শৃঙ্গার্ধর্মী গান হিসেবে বিবেচনা করা
হয়। এই গানের বিষয় ছিল অল্পবয়সী মেয়েদের কৌতুকপূর্ণ এবং প্রেম। এ
ছাড়া ছিল- স্বামী-স্ত্রীর প্রেমের সংলাপ বা বিরহের গান, ননদ বৌদির খুনশুটি, শাশুড়ি এবং পুত্রবধূর মধ্যে ঝগড়া
ইত্যাদি। ভোজপুরি অঞ্চলে বিয়ের পর শ্রাবণের প্রথমার্ধে পিত্রালয়ে আসা কন্যাদের, মানসিক অবস্থা থেকে বিচ্ছেদী কাজরি গানের
উদ্ভব হয়েছিল।
বেনারস-মির্জাপুর অঞ্চলের বৈষ্ণবরা রাধাকৃষ্ণের লীলা অবলম্বনে বর্ষা-উৎসবকে কাজরি
গানে রূপ দিয়েছিল। এই সূত্রে কাজরি হয়ে
উঠেছিল বৈষ্ণব ধর্মাম্বলম্বীদের কাছে উৎসব এবং কাজরি ভক্তিমার্গের গান। এই ধারা থেকে
উদ্ভব হয়েছিল রাধাকৃষ্ণের ঝুলন-উৎসব। এই উৎসবে তমালের
ডালে
দোলনা বেঁধে রাধাকৃষ্ণের যুগলমূর্তি স্থাপন করে মেয়েরা রাধাকৃ্ষ্ণের সখি হিসেবে গান
করা হতো। এছাড়াও বেনারস-মির্জাপুর অঞ্চলের শক্তি পূজা বা গৌরী পূজা উপলক্ষে কাজরি
গান গাওয়ার রীতি প্রচলিত হয়েছিল।
ভক্তিমার্গের কাজরির বাইরে-
বিশেষ উৎসব
হিসেবেও কাজরি
পালিত হয়।
ভাদ্র মাসের কৃষ্ণা-তৃতীয়া তিথিতে, উত্তর প্রদেশের
কিছু
অঞ্চলের মেয়েরা 'কাজলী ব্রত'
পালন করে। এই ব্রত উপলক্ষে মেয়েরা নতুন শাড়ি ও অলঙ্কারে সুজ্জিতা হয়। এরা হাত-পায়ে
মেহেদি পাতার রঙ দিয়ে আল্পনা আঁকে বা রঙের ছাপ দেয়। এই ব্রত উপলক্ষে এরা
ভাইদের হাতে 'জরঙ্গ' পরিয়ে দেয়। এটা অনেকটা বাংলাদেশের 'রাখি' র মতো।
এই উৎসবের
মত করেই উৎসব পালিত হয় ভোজপুরির বিভিন্ন অঞ্চলে। এই উৎসব জৈষ্ঠের প্রথম রবিবার থেকে শুরু হয় এবং ভাদ্রের শুক্ল পক্ষের দ্বাদশী পর্যন্ত চলে।
একে অনেক সময় পার্বণ পূজা নামেও অভিহিত করেন। বুন্দেলখণ্ডের লোকজীবনে 'কাজরি নবমী' এবং
'কাজরি পূর্ণিমা' উৎসবের প্রচলন আছে। বেনারস ও মির্জাপুর শ্রাবণ মাসের শুক্লপক্ষের নবমীতে কাজরি বপন করা হয়, এই সময় মহিলারা বাইরে থেকে মাটি এনে ঘরের অন্ধকার কোণে রাখে এবং তাতে যব বপন করে। পূর্ণিমাতে এই যব দিয়ে কাজরি শোভাযাত্রা বের করা হয়।
ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়, "সুরাজি কাজরি" নামে দেশভক্তি মূলক অনেক কাজরি গান তৈরি হয়েছিল।
বাংলা গানে প্রথম সার্থক কাজরি অঙ্গের গানের প্রচলন করেন কাজি নজরুল ইসলাম।ইসলাম।