নজরুল সঙ্গীতের বিষয়-সূচি

নজরুলসঙ্গীত
কাজী নজরুল ইসলাম -এর রচিত গানের সমগ্র সংকলনকে সাধারণভাবে নজরুল সঙ্গীত নামে অভিহিত করা হয়।

বাংলা সাহিত্যের সহস্রাধিক বৎসরের গৌরবান্বিত মহাসভায়, যে কয়েকজন তাঁদের স্বনামকে অতিক্রম করে মহিমান্বিত হয়েছেন, নজরুল তাঁদেরই একজন। বিশ্বকবি বলতে রবীন্দ্রনাথ, রায়গুণাকর বলতে ভারতচন্দ্র, সাহিত্যসম্রাট বলতে বঙ্কিমচন্দ্র, পল্লীকবি বলতে জসিমুদ্দীন- এমনি আরও অনেকে যেমন মানসলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন। তেমনি 'বিদ্রোহী কবি' বলতে সগৌরবে মনে পড়ে যায়- একমাত্র নাম 'কাজী নজরুল ইসলাম'। অথচ পরম কুণ্ঠার সাথেই বলতে হয়, নজরুলের সৃষ্টিকর্ম এবং জীবনাচারের বিচারে 'বিদ্রোহী কবি' অভিধাটি যথেষ্ঠ নয়। আমাদের এ‌ই সাড়ম্বরে উচ্চারিত 'বিদ্রোহী কবি' সম্ভাষণের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়- তাঁর অসাধারণ সঙ্গীত প্রতিভা, পরম অসাম্প্রদায়িক মানবহিতৈষী সত্তা, কিম্বা সর্বাঙ্গসুন্দর প্রেমের কবি-পরিচয়, এমনি আরও আরও অনেক কিছু।

বর্ধমানের ক্ষুদ্র লোক-নাট্যগীতি লেটো গানের মধ্য দিয়ে তাঁর সৃষ্টি-সত্তার আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল শৈশব-কৈশোরের সন্ধিক্ষণে। তারপর আমরা পাই গ্রামছাড়া সহায়সম্বলহীন এক বালকের ছন্নছাড়া জীবনের পরিভ্রমণের গল্পকথা। সে এক 'সৃষ্টি সুখের উল্লাস'-হীন অধ্যায়। তারপর তাঁর সৃষ্টির দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হলো- বাংলা থেকে বহুদূরে সৈনিকবেশে করাচির সেনানিবাসে। সেখানেই জন্ম নিলো তাঁর নতুন সৃষ্টি সত্তা, সূচনা হলো এক নূতন বিস্ময়কর অধ্যায়ের। সে অধ্যায়ে দেখি তাঁর এক হাতে বাঁশের বাঁশী, আর হাতে রণতূর্য। প্রবাসী-সৈনিক জীবনের এই সূচনা ছিল তাঁর সৃষ্টির দ্বিতীয় অধ্যায়ের কুঁড়ি-দশা। প্রবাস থেকে পত্রযোগে তিনি হানা দিলেন বঙ্গের বাংলা পত্রিকা জগতে। সে সব রচনার বেশিরভাগই অপাংক্তেয় বলে আশ্রয় নিয়েছিল আবর্জনার ঝুড়িতে। সে সবের মধ্যে কিছু টিকে গিয়েছিল সেকালের পত্রিকাসমূহের সম্পাদকদের বদান্যতায়।

অবশেষে সৈনিকজীবনের অবসান হলো, আর শুরু হলো- সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাব্য ও সঙ্গীত। প্রথম পর্বের সৃষ্টি-অন্তে যেন কুম্ভকর্ণ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পল্টন-ফেরত নজরুল যেনো কোনো এক অজানিত যাদুস্পর্শে জেগে উঠেছিলেন এবং জাগিয়ে দিয়েছিলেন। দ্রোহের দাবানল জ্বলে উঠেছিল 'বিদ্রোহী‌'-কাব্য বিস্ফোরণে। সেই তাঁর শুরু। নানা বৈচিত্র্যে ভরিয়ে দিয়েছিলেন বাংলা কাব্য-সঙ্গীত-জগত। তারপর আকস্মিকভাবে এলো বিদায় নেবার পালা। দেহ টিকে রইলো বটে, কিন্তু সৃষ্টির সুখের উল্লাস ধীরে ধীরে নিষ্প্রভ হতে হতে অন্ধকারে ডুবে গেল। পড়ে রইল তাঁর ফেলে যাওয়া আলোক-দীপিকার জ্যোতি-ঐশ্বরয। যা চিরায়ত সৃষ্টি হয়ে আজও আমদের বিমুগ্ধ-বিস্ময়ে অভিভূত করে চলেছে।

যদি নজরুল আর কিছু না লিখে শুধুই গানই রচনা করতেন, তাহলেও তিনি চিরায়ত সঙ্গীত স্রষ্টা হিসেবে বাঙালির মনে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল থাকতেন। এই গ্রন্থের দুটি পর্বে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল গানগুলোকে সংকলিত করা হয়েছে- কালানুক্রমিক ধারায়। এর সাথে যুক্ত করা হয়েছে, নানা প্রাসঙ্গিক বিষয়।

একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ডিসেম্বর মাসের শেষে রচিত বিদ্রোহী কবিতার মাধ্যমে নজরুল খ্যাতির শীর্ষে উঠে গিয়েছিলেন এবং এই সূত্রে তিনি হয়ে উঠেছিলেন 'বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম'। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়েছিল নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'অগ্নি-বীণা'। তখন তিনি 'বিদ্রোহী কবি' অভিধায় প্রতিষ্ঠিত। পরে এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত দুটি কবিতায় তিনি সুরারোপ করে গানে রূপান্তরিত করেছিলেন। এরপর কবিতা ও গানের সংকলন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল 'দোলন চাঁপা' (অক্টোবর ১৯২৩), 'বিষের বাঁশী' (আগষ্ট ১৯২৪), 'ভাঙার গান' (আগষ্ট ১৯২৪), 'চিত্তনামা' (আগষ্ট ১৯২৫), 'ছায়ানট' (সেপ্টেম্বর ১৯২৫), 'সাম্যবাদী' (ডিসেম্বর ১৯২৫), 'পূবের হাওয়া' (অক্টোবর ১৯২৫), 'সর্বহারা' (অক্টোবর ১৯২৫), 'ঝিঙেফুল' (এপ্রিল ১৯২৬), 'সর্বাহারা' (অক্টোবর ১৯২৬), 'ফণীমনসা' (জুলাই ১৯২৭)ও 'সিন্ধু-হিন্দোল' (জুলাই ১৯২৭) ইত্যাদি।

নজরুলের প্রথম সঙ্গীত সংকলন হিসেবে 'বুলবুল' প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে। এরপর থেকে বিভিন্ন সঙ্গীত সঙ্কলনে, স্বরলিপি গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে নজরুলের বহু গান। এছাড়াও পাওয়া গেছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অগ্রন্থিত গান। সকল গানের সংকলন হিসেবে প্রামণিক গ্রন্থ হিসেবে নজরুল ইনস্টিটিউট প্রকাশ করেছিল 'নজরুল সঙ্গীত সংগ্রহ‌'। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে। এর তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। অল্পবিস্তর ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে এই গ্রন্থটিকে নজরুলের গানের একটি আদর্শ সঙ্গীত-সংকলন হিসেবে মান্য করা হয়ে থাকে। সুকুমার শিল্পের যে কোনো বিষয়ের বিকাশের ধারা অনুসৃত হয় কালানুক্রমে। নজরুলের গানের সার্বিক মূল্যায়নে ক্রমিবকাশের ধারাও এর বাইরে নয়।

এখন পর্যন্ত নজরুলের রচিত যত গানের সন্ধান পাওয়া গেছে, তাকে কালানুক্রমে সাজাতে গেলে বড় পরিসরে দুটি ভাগে পাওয়া যায়। ভাগ দুটি হলো-

 


সংকলনের উৎস

১. কাজী নজরুল ইসলাম ও বাংলা সাহিত্য। আজিবুল হক। লেখা প্রকাশনী, কলকাতা। ২য় সংস্করণ। ১৯৯৯
২. দুখুমিয়ার লেটো গান। সংকলক ও সম্পাদনা মুহম্মদ আয়ুব হোসেন। বিশ্বকোষ পরিষদ। নজরুল ফাউণ্ডেশন, কলকাতা। প্রথম প্রকাশ: ১৯ অগ্রহায়ণ, ১৪১০/৬ ডিসেম্বর, ২০০৩।
৩. কাজী নজরুল। প্রাণতোষ ভট্টাচার্য। ন্যাশনাল বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড। কলকাতা-১২। ১৩৭৩ বঙ্গাব্দ
৪. কাজী নজরুল ইসলাম। বসুধা চক্রবর্তী। ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট ইন্ডিয়া। নয় দিল্লী। জানুয়ারি ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দ।
৫. নজরুল-চরিত মানস। সুশীলকুমার গুপ্ত। ভারতী লাইব্রেরী, কলিকাতা। ভাদ্র ১৩৬৭
৬. নজরুল জীবনী। অরুণকুমার বসু। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি। জানুয়ারি ২০০০।
৭. নজরুল-জীবনী। রফিকুল ইসলাম। নজরুল ইন্সটিটউট, ঢাকা। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ।
৮. নজরুল রচনা সম্ভার। আব্দুল কাদির সম্পাদিত। ইউনিভার্সল বুক ডিপো। কলিকাতা। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দ।
৯. নজরুল-সংগীত সংগ্রহ। সম্পাদনা রশিদুন্ নবী। কবি নজরুল ইনস্টিটিউট। ঢাকা। তৃতীয় সংস্করণ। পৌষ ১৪২৪/জানুয়ারি ২০১৮।
১০. বাংলা সাহিত্যে নজরুল। আজাহারউদ্দীন খান। ডিএম লাইব্রেরি। কলিকাতা। তৃতীয় সংস্করণ পৌষ ১৩৬৫
১১. বিদ্রোহী-রণক্লান্ত, নজরুল জীবনী। গোলাম মুরশিদ। প্রথমা, ঢাকা। ফেব্রুয়ারি ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ।
১২.মহাভারত। কালীপ্রসন্ন সিংহ-কর্তৃক অনূদিত। ত্রয়োদশ সংস্করণ। সাহিত্য তীর্থ। কলকাতা। জ্যৈষ্ঠ ১৪২১, জুন ২০১৪
১২. লেটো ও লোক-ঐতিহ্য। ওয়াকিল আহমদ। নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা। প্রথম প্রকাশ: বৈশাখ ১৪০৮/এপ্রিল ২০০১।
১৩. শত কথায় নজরুল। সম্পাদনায়: কল্যাণী কাজী। সাহিত্যম, কলকাতা। প্রথম প্রকাশ: ১৪০৫।
১৪.সচিত্র কৃত্তিবাসী রামায়ণ।ইন্ডিয়ান প্রেস পাব্লিকেশন্স। কলিকাতা। ১৩৩৯