রাগ
ভারতীয় সঙ্গীত পদ্ধতিতে
উপস্থাপিত- সুনির্দিষ্ট কিছু সুরশৈলী ও অন্যান্য কিছু স্বরের বিধিবদ্ধ সাঙ্গীতিক রূপ
বিশেষ।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ক্রমবিবর্তনের
ধারায় খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর
ভিতরে গ্রাম
থেকে উৎপন্ন হয়েছিল
মূর্ছনা।
পরবর্তীয় পর্যায়ে
মূর্ছনা থেকে তৈরি হয়েছিল
গ্রামরাগ।
সে সময়ের লৌকিক গানের নানা প্রকরণ প্রচলিত ছিল। দশটি রাগলক্ষণের দ্বারা কিছু গানকে
শাস্ত্রীয় রীতির অধীনে আনা হয়েছিল। এই সূত্রে তৈরি হয়েছিল গ্রাম
গ্রামরাগ।
খ্রিষ্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রচিত 'নারদীয় শিক্ষা' গ্রন্থে মাত্র ৭টি গ্রাম রাগের নাম
পাওয়া যায়। এগুলো হলো-ষড়জ গ্রামরাগ, পঞ্চম গ্রামরাগ,
কৈশিক গ্রামরাগ, কৈশিকমধ্যম গ্রামরাগ, মধ্যম গ্রামরাগ, সাধারিত গ্রামরাগ ও ষাড়ব
গ্রামরাগ।
ভরতের সময় যে সকল গ্রামরাগ ভিত্তিক যে সকল গীতের প্রচলন ছিল, তার সাথে আরও কিছু গ্রামরাগ যুক্ত হয়ে, গ্রামরাগের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত মতঙ্গের রচিত বৃহদ্দেশীতে এ সকল গ্রামরাগের শ্রেণিকরণ করা হয়েছিল।
বৃহদ্দেশীতে রাগভিত্তিক গীতকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। এই ভাগগুলো হলো-
মূলধারার এই রাগগুলোর বাইরে লৌকিক গানের সূত্রে আরও কিছু রাগকে বিবেচনায় আনা হয়েছিল। এই রাগগুলোকে বলা হয়েছে উপরাগ। উপরাগগুলো তৈরি হয়েছিল গ্রামরাগের ছায়া অবলম্বনে। বৃহদ্দেশীতে এইরূপ তিনটি উপরাগের নাম পাওয়া যায়। এগুলো হলো- পঞ্চমষাড়ব, রেবাগুপ্ত ও টক্কসৈন্ধব। শার্ঙ্গদেব তাঁর সঙ্গীতরত্নাকরে এর বাইরে আরো পাঁচটি উপরাগের উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো- শকতিলক, কোকিলাপঞ্চম, ভাবনাপঞ্চম, নাগগান্ধার ও নাগপঞ্চম।
বৃহদ্দেশীতে উল্লেখ করা হয়েছে- ভাষা গানের বিষয়। এখানে ভাষা ভেদের গানের বিচারে- ভাষা হলো প্রকরণ। মূলত রাগ হিসেবে ভাষা হলো গ্রাম রাগের প্রকারভেদ। এই শ্রেণির রাগগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো- মূল, সঙ্কীর্ণ, দেশজ ও ছায়ামাত্রাশ্রবা।
যাষ্টিক এই ভাষারাগের মূল গ্রামরাগ এবং এই গ্রামরাগ থেকে উৎপন্ন ভাষারাগগুলোর পরিচয় দিয়েছেন। যাষ্টিকের
মূলত খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর ভিতরে আরও বহুবিধ রাগের
উৎপত্তি হয়েছিল। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে সুলতান
আলাউদ্দীন খিলজির সভাকবি-
আমির খসরু,
দেশী রাগের চর্চার পাশাপাশি আরব-পারশ্যের রাগের
সংমিশ্রণে নতুন কিছু রাগ তৈরি করেছিলেন।
খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর ভিতরে ভারতীয় রাগসঙ্গীতের ধারায় বহু প্রচীন রাগ বিলুপ্ত
হয়ে গিয়েছিল। আবার দেশীর সুরাবলম্বনে নতুন নতুন রাগের উদ্ভব হয়েছিল।
খ্রিষ্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে লোচন শর্মার
রচিত 'রাগতরঙ্গিনী' গ্রন্থে এরূপ রাগের নাম পাওয়া যায়। এই গ্রন্থে ৬টি রাগকে আদি
রাগ হিসেবে চিহিত করা হয়েছিল। এগুলো হলো-
ভৈরব,
কৌশিক,
হিন্দোল,
দীপক ও শ্রী।
তিনি পারশ্যের রাগকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় কাঠামোতে তৈরি করেছিলেন
ইমন রাগ। পরে এই রাগের সাথে অন্যান্য রাগের মিশ্রণ ঘটিয়ে তৈরি করেছিলেন
ইমন-পুরিয়া, ইমন-ভূপালী, ইমন-বিলাবল, ইমন
বেহাগ, ইমন কল্যাণ।
ফকিরুল্লা'র রাগ দর্পণ গ্রন্থ থেকে ১২টি এরূপ ১২টি রাগের তালিকা পাওয়া যায়। এর
বাইরে পাওয়া যায়-
এছাড়া তিনি প্রণয়ন করেছিলেন- ঝিঁঝিট, যমনী,
তুরস্ক-গৌড়, তুরস্ক টোড়ি, বাহার, আলাইয়া বিলাবল, সাহানা, অাড়ানা, মোহনী. সুহ.
সুখরাই, রুলীক, মারু, পিলু, বারওয়া, লুম ইত্যাদি।
রাগের স্বরূপ
রাগ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো- যার উপস্থিতিতে মন
রঞ্জিত হয়। রাগের মনোরঞ্জনের প্রাথমিক রূপ সৃষ্টি হয় মনে। এর মৌলিক উপাদান অনাহত
নাদ। ভৌত জগতে আহত নাদের দ্বারা প্রকাশিত হয়। এই অনাহত সঙ্গীতকে অনাহত ছন্দ নিবদ্ধ
হলে, রাগের প্রাথমিক অরূপ মূর্তি তৈরি হয়। এর সাথে রসের আবির্ভাব হলে, রাগ পূর্ণতা
পায়।
নানা ধরনের স্বরবিন্যাসে রাগের নানা ধরণ তৈরি হয়। তার সবই অরূপমূর্তি রূপে অনাহতের আশ্রয়ে মনে বাজে। সুনির্দিষ্ট কোনো রাগ হলো- বহুবিধ অরূপমূর্তির একটি। এই অরূপমূর্তিকে প্রকাশ করার জন্য প্রয়োজন হয় আহত নাদজাত মূর্তিমান রূপ।
আহত
নাদ সৃষ্টির হয় আঘাতজনিত কারণে বস্তুর কম্পনের সূত্রে। সঙ্গীতোপযোগী
ধ্বনিকম্পাঙ্কের দ্বিগুণাত্মক সূত্রে সৃষ্টি হয় স্কেল। এই স্কেলের সমগুণান্বিত
দ্বাদশ ভাগের প্রতিটি ভাগ হলো স্বর। আর একাধিক স্বর মিলিত হয়ে তৈরি হয় সুর। সুর
নানা ভাবে তৈরি হতে পারে।
সঙ্গীতের রূপের বিচারে একে বলা যায়
সুরের মৌলিক রূপ। দুটি স্বর মিলে যত ধরনের সুর তৈরি হবে, তার সবগুলোই হবে মৌলিক
রূপ। দুইয়ের বেশি স্বর মিলে তৈরি হবে যৌগিক ক্ষুদ্ররূপ। এই রূপগুলো হতে পারে
বিচ্ছিন্ন ধারায়, অবিচ্ছন্ন ধারায়। অবিচ্ছিন্ন ধারার সুর হতে পারে সরল, বক্র বা
মীড়যুক্ত। আর অবিচ্ছিন্ন ধারার সুরে রয়েছে সরল ও বক্র।
ক্ষুদ্রসুর যখন কোনো নান্দনিক হয়ে উঠে এবং একটি ক্ষুদ্র সুরকাঠামো তৈরির
উপযোগী হয়ে উঠে, তখন তাকে বলা হয় সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ (phrase,
musical phrase)।
এরূপ নানা জাতীয় সুর ও স্বর মিলিত হয়ে তৈরি হয়, নানা ধরনের
সুরশৈলী। এক বা একাধিক
সুরশৈলীর সমন্বয়ে সৃষ্ট স্বরবিন্যাস যখন একটি বিশেষ শৈলীকে উপস্থাপন করে, তখন
সুরাঙ্গের (
musical
style)
সৃষ্টি হয়। ভারতীয় সঙ্গীতে সাধারণভাবে একে বলা হয় 'অঙ্গ'। যেমন-ভৈরব অঙ্গ, কাফি
অঙ্গ, কানাড়া অঙ্গ। এই সকল অঙ্গের সাথে আরও কিছু সুরশৈলী বা ক্ষুদ্রসুর যুক্ত হয়ে
যে সুরকাঠামো গড়ে উঠে, তাতে রাগাঙ্গের রূপ ফুটে উঠে। একে রাগ হিসেবে বিশেষভাবে
চিহ্নিত করা ক্ষেত্রে কতকগুলো বিধিকে অনুসরণ করা হয়। এই বিধির দ্বারা রাগের লক্ষণ
সৃষ্টি হয়।
রাগের গাঠনিক ভিত্তি হিসেবে প্রাথমিকভাবে একটি স্বরসপ্তক থেকে নির্বাচিত কিছু
স্বরকে গ্রহণ করা হয়। একে বলা যায় রাগের ব্যবহারিক স্বরতালিকা। যেমন ইমন রাগে
ব্যবহৃত স্বরসপ্তক হলো- স র গ হ্ম প ধ ন। স্কেলের বা স্বরাষ্টকের বিচারে এর রূপ স র
গ হ্ম প ধ ন র্স। এখানে কোনো স্বরকে দুইবার গ্রহণ করা হয় নি। ইট, কাঠ, লোহা ইত্যাদি
যেমন বাড়ি নয়, তেমনি 'স র গ হ্ম প ধ ন র' ইমন রাগ নয়। যে কোন রাগের নির্ধারিত রূপ
ফুটে, ওই রাগের জন্য নির্বাচিত স্বরের বিন্যাসের ভিতর দিয়ে। এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা
রাখে কিছু নির্বাচিত সুরশৈলী এবং অন্যান্য কিছু স্বরের বিধিবদ্ধ সমন্বিত প্রয়োগ।
একটি রাগকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা জন্য বিশেষ কিছু শর্ত বা বিধি মান্য করা হয়।
প্রাথমিকভাবে রাগ-পরিচিতিতে দুটি বিষয়কে মান্য করা হয়। এর একটি হলো আরোহণ-অবরোহণ,
দ্বিতীয়টি জাতি।
১. আরোহণ-অবরোহণ: প্রতিটি রাগের রয়েছে সুনির্দিষ্ট আরোহণ/অবরোহণের স্বরসমষ্টি। যেমন-
রাগ ভূপালী: স র গ প ধ র্স/র্স ধ প গ র স
রাগ মালকোষ: স জ্ঞ ম দ ণ র্স/র্স ণ দ ম জ্ঞ স
রাগ ভৈরবী: স ঋ জ্ঞ ম প দ ণ র্স/র্স ণ দ প ম জ্ঞ ঋ স।
২. জাতি: রাগের আরোহণ/অবরোহণে ব্যবহৃত স্বরের সংখ্যানুসারে রাগের জাতি নির্ধারিত হয়। সাধারণভাবে রাগে ৫, ৬ বা ৭টি স্বর ব্যবহৃত হয়। পাঁচ স্বরে রাগকে বলা হয় ঔড়ব, ছয় স্বরের রাগকে বলা হয় ষাড়ব আর সাত স্বরের রাগকে বলা হয় সম্পূর্ণ। রাগের জাতি নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এটি সাধারণ হিসাব। কিন্তু একটু বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, অনেক রাগের আরোহণ এবং অবরোহণের স্বরসংখ্যা একই রকমের হয় না। যেমন খাম্বাজ রাগের আরোহণে ব্যবহৃত হয় ৬টি স্বর (স গ ম প ধ ন র্স), অবরোহণে ব্যবহৃত হয় ৭টি স্বর (র্স ণ ধ প ম গ র স)। এই বিচারে জাতি হবে ষাড়ব সম্পূর্ণ। এই বিচারে রাগের জাতি হবে-সম্পূর্ণ-সম্পূর্ণ, সম্পূর্ণ-ষাড়ব, সম্পূর্ণ-ঔড়ব
ষাড়ব-সম্পূর্ণ, ষাড়ব-ষাড়ব, ষাড়ব-ঔড়ব
ঔড়ব-সম্পূর্ণ, ঔড়ব-ষাড়ব, ঔড়ব-ঔড়বএছাড়া চার স্বরের কিছু রাগ আছে যাদের স্বর সংখ্যা চারটি। এই জাতীয় রাগকে বলা হয় স্বরান্তর।
উপরের দুটি শর্তকে প্রাথমিক বিধি বলা হয়, রাগের স্বর-উপাদানের বিচারে। এই বিচার করা হয় একটি স্বরসপ্তকের বিচারে। রাগরূপ সৃষ্টি হয় এই দুটি বিধিকে ভিত্তি করে বিশেষ স্বরবিন্যাসের মাধ্যমে। রাগের রূপ নির্ণয়ে এই স্বরবিন্যাসকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়।
সুর: সঙ্গীততত্ত্বের বিচারে 'সুর' শব্দটি একটি বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এটি নিতান্তই সঙ্গীতের পারিভাষিক শব্দ। তাই ভিন্ন অর্থে সুর যাই হোক এখানে তা গ্রহণ করা হবে না। এক্ষেত্রে সুর হলো- দুই বা ততোধিক স্বরের বিন্যাস, যা স্বরগুলোর শ্রবণ-রেশের ভিতর ধ্বনিত হবে এবং ধ্বনি মাধুর্য তৈরি করবে। একটি স্বরকে দীর্ঘক্ষণ ধরে টানা বাজতে থাকলে তা হবে স্বর। কিন্তু একটি স্বরের শ্রবণ-রেশের ভিতরে ধ্বনিত হলে তা সুরে পরিণত হবে। এই বিচারে সুরকে প্রাথমিকভাবে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন-
১. বিচ্ছিন্ন সুর: যখন প্রতিটি স্বরের ভিতরে শ্রবণ বিরাম পাওয়া যায়। কিন্তু এই বিরাম সামান্য সময়ের জন্য ঘটে, ফলে শ্রোতা স্বরগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে শুনলেও শ্রবণ অনুভবের ভিতরে অবচ্ছিন্নভাবেই পায়। এই সুর হতে পারে তিন প্রকার। প্রকার তিনটি হলো- আরোহ, অবরোহ ও বক্র।
২. অবচ্ছিন্ন সুর: কোনো ধ্বনি মানুষের শ্রবণেন্দ্রিয়কে যখন উজ্জীবিত করে, তখন তার রেশ ১/১০ সেকেন্ড পর্যন্ত থেকে যায়। এই সময়ের মধ্যে দুটি ধ্বনি মানুষের কাছে অবচ্ছিন্ন মনে হয়। এই জাতীয় সুর হতে পারে- চার প্রকার। প্রকার চারটি হলো আরোহ, অবরোহ, বক্র ও মীড়।
সুরের প্রকৃতি বিচারে যে কোনো রাগ হলো- সুরের প্রবহমানতা। যেহেতু প্রতিটি রাগের নিজস্ব স্বর-সেট রয়েছে। তাই এক্ষেত্রে প্রতিটি রাগের নিজস্ব সুরের রূপ তৈরির একটি ধাপ সম্পন্ন হবে। এর দ্বারা চূড়ান্ত রূপ পাওয়া যাবে না অন্তত একটি কারণে, তা হলো একই স্বর ও স্বরসংখ্যা একাধিক রাগে থাকতে পারে।
একাধিক রাগের যখন একই স্বর ও স্বরসংখ্যা থাকে, তখন ওই রাগগুলো সমপ্রকৃতির রাগের ইঙ্গিতও দেয়। কিন্তু পরিপূর্ণভাবে সমপ্রকৃতির রাগ হয়ে উঠে না। এক্ষেত্রে বিশেষ নিয়ামক হয়ে হয়ে উঠে এর স্বরগুচ্ছ ও সুরশৈলী।
স্বরগুচ্ছ ও সুরশৈলী: কিছু স্বর একত্রিত হয়ে বিশেষ ধরনের সুর তৈরি করে। এই বিশেষ সুরগুলো ব্লক হিসেবে নিজস্ব ধ্বনিরূপ পায়। এই অবস্থায় এগুলোকে স্বরগুচ্ছ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন- সরগ, রগম, গমপ। অনেক সময়ই এদেরকে কোনো টানা সুরের ভিতরে আলাদা করে চেনা যায়। যেমন-
স স স। স র গ। র গ ম। গ মপ। প ম গ। র স স।
এখানে, প্রথম 'সসস' একটি পৃথক স্বরগুচ্ছ। এর পরে রয়েছে স র গ। র গ ম। গ ম প- তিনটি স্বরগুচ্ছ। কিন্তু বক্ররীতিতে একটি সুররূপ তৈরি করেছে। এই সুররূপগুলো যেন পরস্পরের অনুষঙ্গী হয়ে চলছে। কবিতার অনুপ্রাসের মতই এই তিনটি স্বরগুচ্ছ যেন এক ধরনের সুর-প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করে এগিয়ে চলে। আরে শেষের প ম গ। র স স হলো অবরোহী স্বরগুচ্ছ।
প্রতিটি রাগের রয়েছে কিছু নিজস্ব স্বরগুচ্ছ। এগুলো ছোটো ছোটো সুরের নকশা তৈরি করে, একটি সুরশৈলীকে প্রকাশ করে। মূলত এই স্বরগুচ্ছ রাগের মৌলিক রূপকে ধারণ করে। তাই রাগের ক্ষেত্রে এই স্বরগুচ্ছকে সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ (phrase, musical phrase)। অবশ্যই সাধারণ স্বরগুচ্ছ থেকে সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ স্বতন্ত্র। সাধারণ সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ সাধারণভাবে সুরের প্রয়োজনে যেকোনো ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু বিশেষ রাগের ক্ষেত্রের জন্য বিশেষ সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ ব্যবহার করতেই হয়, তা না হলে রাগ-রূপ নষ্ট হয়ে যায়।
শুধু সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছ দিয়ে রাগরূপ ফুটে উঠে না। এর জন্য রাগে ব্যবহৃত অন্যান্য স্বরগুলোরও প্রয়োজন হয়। মূলত রাগের মূল সাঙ্গীতিক স্বরগুচ্ছের সাথে অন্যান্য স্বরের সুসমন্বয়ে রাগরূপ ফুটে উঠে। এক্ষেত্রে অন্যান্য স্বরগুলোর প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিবেচনা করতে হয়, প্রতিটি স্বরের স্থিতিকাল। একটি স্বর থেকে পরের স্বরের যাওয়ার সময়টা কতটুকু হবে, সেখানে মীড়ের ব্যবহার হবে কিনা, কোনো বিশেষ প্রয়োগের সময় অন্য স্বরের স্পর্শ লাগবে কিনা, অবরোহণের রীতিতে স্বরের চলন হবে না কি উলম্ফন হবে- এই জাতীয় বিষয়গুলো বিশেষ বিবেচনায় রাখতেই হবে। এছাড়া আছে রাগের শুরুতে কোন স্বর ব্যবহার করতে হয় (গ্রহস্বর) এবং রাগের চলনের সময় কোনো কোন স্বরে থামতে হয় (ন্যাসস্বর) ইত্যাদিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এছাড়াও রয়েছে রাগের জন্য বাদীস্বর, সম্বাদী স্বর, বিবাদীস্বর, বর্জিত স্বর ইত্যাদি। আরও রয়েছে রাগরূপায়ণে নানা ধরনের অলঙ্কার। পরিবেশনের অঙ্গ হিসেবে অলঙ্কারে প্রকৃতিতেও রয়েছে বিভিন্নতা। যেমন- খেয়াল, ধ্রুপদ, টপ্পা, গজল, ঠুমরি, ভজন ইত্যাদির রয়েছে কিছু সাধারণ সুরালঙ্কার, আবার কিছু রয়েছে বিশেষিত অলঙ্কার। সব মিলিয়ে প্রতিটি রাগ যে বিশেষ ধ্বনি সৌন্দর্য তৈরি করে, তাই হলো ওই রাগের রূপ। রাগরূপে উল্লেখিত বৈশিষ্ট্যের বিচারে প্রতিটি রাগের তৈরি হয় নিজস্ব ধ্বনিসৌর্ভ ও ধ্বনি-আভিজাত্য। যা দিয়ে সৃষ্টি হয় প্রতিটি রাগের স্বতন্ত্র রূপ, বলা যায় রাগ-ব্যক্তিত্ব। এর উদাহরণ হিসেবে ইমন রাগের রূপ যৎকিঞ্চিৎ আলোচনা করবো।
ইমনের রাগরূপ:
ইমন রাগের আরোহণ-অবরোহণের স্বরগুলো হলো- স র গ হ্ম প ধ ন
র্স/র্স ন ধ প হ্ম গ র স। একে বলা যায়, ইমন রাগের স্বরাষ্টক। স্বরের সংখ্যার বিচারে
সম্পূর্ণ-সম্পূর্ণ। এই স্বরাষ্টক আর ইমন রাগ এক নয়। মূলত ইমন পরিবেশন করতে গেলে
স্বরাষ্টকের কোনো কোন স্বর ব্যবহার করা হবে, তার একটি সাধারণ উল্লেখ মাত্র। তাই
পরিবেশেনের সময় স্বরাষ্টককের সরল কাঠামো ভেঙে বক্র কাঠামো তৈরি করতে হয়।
প্রথাগতভাবে এর শুরু হওয়া উচিৎ ষড়্জ থেকে। কিন্তু স্কেলের এক স্বর নিচে অর্থাৎ
উদারার শুদ্ধ নিষাদ থেকে। সঙ্গীত শাস্ত্রে বলা হয় এর প্রধান সুরশৈলী হলো ন্ র গ। এই
সুরশৈলীকে কেন্দ্র করে অন্যান্য স্বরগুলো আবর্তিত হয়, এবং এর ন্যাস স্বর হিসেবে
স্থিতি লাভ করে ষড়্জতে।
ন্ ধ্ ন্ র স।
ন্ র গ
ন্ র গ হ্ম প-- র গ
ন্ র স
শাস্ত্রী এই বিধি অনুসরণ করলেও ইমন রূপ পাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না অন্যান্য
স্বরগুলোর প্রয়োগ যথাযথভাবে না হবে। যেমন ন্ র স-এর র- স্বর কিছুটা মীড়ের মতো হয়ে
প্রলম্বিত হবে। এখানে র স্বরের উপরে কতটুকু সময় থাকবে হবে সেটাও বিবেচনা করতে হবে।
ন্ র গ-কে মূল সুরশৈলী বলা হয়, এককভাবে এই স্বর তিনটি পরিবেশন করে
বিশ্রাম নেওয়া যায়। কিন্তু এর সাথে হ্ম প যোগ করে এগিয়েও যাওয়া যায়। এরপর প-থেকে
র-তে ফিরে আসলে রাগের রূপ বজায় থাকে, তবে প থেকে র-তে আসতে হয় মীড় দিয়ে। তাতে যুক্ত
করতে হয়, কোমল ধ্বনিপ্রক্ষেপণ।
এরপর এই রাগরূপকে এগিয়ে নিতে গেলে পঞ্চমকে অতিক্রম করতেই হয়। কিন্তু এখানেই ঘটে
স্বরের উলম্ফন। এই উলম্ফন ঘটে কড়ি মধ্যম থেকে শুদ্ধ ধৈবতে। এখানে প্রয়োগ ইমনের
দ্বিতীয় সুরশৈলী। এই সুরশৈলী হলো হ্ম ধ ন। অবশ্য এর যুক্ত থাকে ন্ র গ। সব মিলিয়ে
এর আরোহ রূপ দাঁড়ায়-
ন্ র গ হ্ম ধ ন র্র র্স
যদিও এই
রাগের আরোহণে পঞ্চম বর্জন করা হয়। তারপরেও গান্ধার ও নিষাদের
পরে প্রবল উপস্থিতি রয়েছে পঞ্চমের। বিশেষ করে প-স এবং
প র গ -এর প্রয়োগে এই রাগে ফুটে কল্যাণ অঙ্গ। এতকিছু
বলার পরও ইমন রাগ বই থেকে পরিবেশন করতে পারবেন না, যতক্ষণ না কোনো গুরু কাছে
বসে শিখবেন না।
ভারতীয় সঙ্গীতের রাগ বিধিমালায়
একটি বিতর্কিত বিষয় যুক্ত হয়ে আছে। এই বিষয়টি হলো
ঠাট।
অনেকেই ঠাটকে মান্য করতে চান না। তারপরে রাগের শ্রেণিকরণে ঠাটের উল্লেখ করা হয়।
আধুনিক কালে
কোনো স্বরবিন্যাসকে রাগ হিসাবে চিহ্নিত করা
জন্য কিছু বৈশিষ্ট্যকে বিশেষ বিবেচনায় আনা হয়। এগুলো হলো–
১. রাগ নাম: রাগ হিসাবে
যাকে বিবেচনা করা হবে, তার একটি সুনির্দিষ্ট নাম থাকবে।
২.
আরোহণ
ও
অবরোহণ
৩.
ঠাট
৪.
জাতি
৫.
বাদীস্বর
ও
সমবাদী
৬.
অঙ্গ
৭. সময়
৮.
পকড়
এছাড়াও রাগের প্রকৃতি নির্ণনয়ে যে সকল বিষয়কে বিবেচনা করা হয়, সেগুলো হলো-
লয়, গ্রহস্বর, ন্যাস
স্বর, স্থান (মন্দ্র, মধ্য, তারের বিচারে), শ্রেণি (শুদ্ধ, ছায়ালগ, সঙ্কীর্ণ), চলন
(শুদ্ধ, সরল ও বক্রের বিচারে)।
রাগের প্রকাশরূপ:
রাগের প্রাথমিক প্রকাশরূপ তৈরি অনাহত নাদ, আহত নাদ ও ছন্দের
সুসমন্বয়ে। রাগের প্রাথমিক দশায় আহত নাদ ও ছন্দ বা তাল রাগের যান্ত্রিক রূপ প্রদান
করে। কারণ এক্ষেত্রে প্রতিটি রাগের শাস্ত্রীবিধি অনুসারে কিছু রাগভিত্তিক সুরশৈলী
উপস্থাপন করা হয়। আহতনাদের চর্চার ভিতর দিয়ে মনের ভিতরে রাগের অরূপ মূর্তির
কাঠামোটা তৈরি হয়। এই কাঠামো অনাহত নাদ হয়ে নৈশব্দে মনের ভিতরে বাজে। তাই রাগের
শাস্ত্রীবিধিতে বাঁধা রাগ, শুধু রাগের গায়ক তৈরি করে, শিল্পী তৈরি করে না।
রাগ শৈল্পিক হয়ে ওঠে, স্বরবিন্যাসের সাথে রস যুক্ত হয়। এটা যতটা না গুরুমুখী, তার
চেয়ে বেশি আত্মমুখী। আহত নাদের জগতের স্বর প্রয়োগের কৌশল গুরুমুখী। সেখানে গুরু
-শিষ্যের স্বরধ্যান একই। কিন্তু রসের জগত গুরু-শিষ্যের একই হয় না। রসভেদের স্বরের
প্রয়োগ সম্পর্কে গুরু শিষ্যকে যান্ত্রিক পরামর্শ দিতে পারেন। কিন্তু রসের অনুভূতিকে
শিষ্যের মনে আরোপ করতে পারেন না। তাই রসের সাগরে ডুব দিতে হলে, শিষ্যকই রসিক হয়ে
উঠতে হয়। নইলে চিরকাল গুরুর কার্বনকপি হয়ে থাকতে হয়।
দেখুন: ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের ক্রমবিবর্তনের ধারা
সূত্র:
বঙ্গীয় শব্দকোষ। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ভারতীয় সঙ্গীতের
ইতিহাস । প্রথম খণ্ড। স্বামী প্রজ্ঞানন্দ
ভারতীয় সঙ্গীতকোষ। শ্রীবিমলাকান্ত রায়চৌধুরী। বৈশাখ ১৩৭২।
রাগ ও রূপ। স্বামী প্রজ্ঞানন্দ। জুলাই ১৯৯৯।
সঙ্গীত কথা। অপূর্বসুন্দর মৈত্র।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যপুস্তক পর্ষদ। এপ্রিল ১৯৮৬।
সঙ্গীত পরিচিত (উত্তরভাগ)।
শ্রীনীলরতন বন্দ্যোপাধ্যায়। হসন্তিকা প্রকাশিকা। জন্মাষ্টমী: ৫ই ভাদ্র '৮০। ২১
আগষ্ট '৭৩
সঙ্গীত শাস্ত্র। তৃতীয় খণ্ড। শ্রীইন্দু ভূষণ রায়।
সরল বাংলা অভিধান। সুবলচন্দ্র মিত্র
हिन्दुस्थानी
सङ्गीत
पद्धति क्रमिक
पुस्तक
मालिका दुसरी
पुस्तक।
পণ্ডিত বিষ্ণুনারায়ণ
ভাতখণ্ডে। এপ্রিল ১৯৫৪।