প্রহর
বানান বিশ্লেষণ : প্+র্+অ+হ্+অ+র্+অ
উচ্চারণ:
pro.ɦor (প্রো.হোর্)

প্রো.হোর্ [র-ফলাযুক্ত প্ ধ্বনি 'প্রো' হিসেবে উচ্চারিত হবে। পরবর্তী 'হ' ধ্বনি  পূর্ববর্তী অর্ধ-সংবৃত ধ্বনি প্রো-এর প্রভাবে হো ধ্বনিতে পরিণতে হবে। শেষের র ধ্বনি রুদ্ধ হয়ে হো-এর সাথে যুক্ত হয়ে একাক্ষর হোর্ ধ্বনিতে পরিণত হবে।]

শব্দ-উৎস: সংস্কৃত प्रहर (প্রহর্)>বাংলা প্রহর।
রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ: প্র+
হৃ (হরণ করা) +অ (অপ্), অধিকরণবাচ্য
পদ: বিশেষ্য
       ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা {
| সময় একক | পরিমা | বিমূর্তন | বিমূর্ত সত্ত | সত্তা |}

অর্থ: প্রাচীন ভারতীয় সময় পরিমাপক একক বিশেষ। তিন ঘণ্টা পরিমিত সময়কে প্রহর বলা হয়।
সমার্থক শব্দাবলি: প্রহর, যাম, দিবসের অষ্টম ভাগের প্রতিটি ভাগ।
ইংরেজি:
Prahar, Prahara

প্রাসঙ্গিক পাঠ: প্রাচীন ভারতের রাজদরবারে, ধাতব ঘণ্টায় বা ঢাকে প্রহার করে যাম (তিন ঘন্টার সমতূল্য সময়) ঘোষণা করা হতো। ধারণা করা হয়, প্রহার থেকে প্রহর শব্দটি সংস্কৃত ভাষায় প্রবেশ করেছিল। সংস্কৃত ব্যাকরণে প্রহার এবং প্রহর উভয়ই হৃ (হরণ করা) ক্রিয়ামূল থেকে উৎপন্ন হয়েছে। প্রহার শব্দটি তৈরি হয়েছে অ (ঘঞ্) প্রত্যয় থেকে। বলাই বাহুল্য প্রহার ভাববাচক বিশেষ্য। অন্যদিকে হৃ ক্রিয়ামূলের ভাব্গত অর্থ হলো 'হরণ করা'। যা সময়কে প্রকৃষ্টরূপে হরণ করে এই অর্থে প্রহর। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত 'বঙ্গীয় শব্দকোষে' প্রহর শব্দের অর্থগত ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে 'যামঢক্কাদিবাদন-কাল'। অনেকের মতে, রাজবাড়িতে তিন ঘণ্টা পর পর ঢাক বাজিয়ে সময় ঘোষণা করার সময়, প্রহরীরও পরিবর্তন ঘটতো। সেই কারণে যাম ঘোষণার সময়কে প্রহর নামে প্রচলিত হয়।

ভারতীয় সময় পরিমাপক একক অনুসারে

২৪ সেকেন্ড= ১ পল
৬০ পল= ১ দণ্ড= ২৪ মিনিট

সাড়ে সাত দণ্ড (৭৷৷৹)=১ প্রহর=১ যাম= ৩ ঘণ্টা
৮ প্রহর= ১ দিন =২৪ ঘণ্টা

ভারতীয় মতে দিবসের একটি অর্থ হলো যতক্ষণ সূর্যের আলো পৃথিবীকে আলোকিত করে। এই অর্থে দিবস হলো সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়। সূর্যোদয়ের মুহূর্তকে বলা হয় ব্রাহ্মমুহূর্ত। এই ব্রাহ্মমুহূর্তকে দিনের শুরু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উল্লেখ্য দিবারাত্রির ৩০ ভাগের এক ভাগ হলো মূহূর্ত। এই বিচারে ৪৮ মিনিটে এক মুহূর্ত হয়। কোনো স্থানে সূর্য দৃশ্যমান হওয়া থেকে পরবর্তী ৪৮ মিনিট হলো ব্রাহ্মমুহূর্ত। অন্যভাবে বলা যায়, সূর্যোদয়ের প্রথম ৪৮ মিনিট হলো ব্রাহ্মমুহূর্ত।

 

ভারতবর্ষ নামক বিশাল ভূখণ্ডের সকল স্থানে একই সময় ব্রাহ্মমুহূর্ত সংঘটিত হয় না। আবার ঋতু পরিবর্তনে কারণে প্রতিদিন একই সময়ে ব্রাহ্মমুহূর্ত হয় না। কিন্তু লক্ষ্য করা যায়, সূর্য যখন বিষুবরেখা অতিক্রম করে, তখ, এই রেখার নিকটবর্তী অঞ্চলে দিবারাত্রি সমান হয়। এই কারণে, সূর্যোদয়ের একটি আদর্শমান হিসেবে বিবেচনা করা হয় ৬.০০। এই সূত্রে দিবা প্রথম প্রহর শুরু হয় সকাল ৬টা থেকে। ঋতু পরিবর্তনে এই সময়ের হেরফেল হলেও এই মানকেই অনুসরণ করা হয়।


রাজবাড়িতে যামের শেষে ঢাক বা ধাতব ঘণ্টায় আঘাত করে সময়ের ঘোষণা দেওয়া হতো। এই ঘোষণাকে বলা হতো প্রহর ঘোষণা। এই ঘোষণা হতো প্রহরের শেষে। এর অর্থ হলো সকাল ৬টায় যে প্রহর ঘোষণা করা হতো, তাকে বলা হতো রাত্রি শেষ প্রহরের ঘণ্টা। এই কারণে বেলা দ্বিপ্রহর হলো বেলা ১২টার ঘণ্টা। উল্লিখিত এই সময় পরিমাপের বিচারে

            দিবা প্রথম প্রহর : ভোর ৬টা থেকে সকাল ৯টা [ঘণ্টা পড়বে ৯টায়]

            দিবা দ্বিতীয় প্রহর : সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা [ঘণ্টা পড়বে ১২টায়]

            দিবা তৃতীয় প্রহর : দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৩টা [ঘণ্টা পড়বে ৩টায়]

            দিবা চতুর্থ বা শেষ প্রহর : বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা [ঘণ্টা পড়বে ৬টায়। একে সন্ধ্যার ঘণ্টাও বলে থাকেন]

 

            রাত্রি প্রথম প্রহর : সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা [ঘণ্টা পড়বে ৯টায়]

            রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর : রাত ৯টা থেকে রাত ১২টা [ঘণ্টা পড়বে ১২টায়]

            রাত্রি তৃতীয় প্রহর : রাত ১২টা রাত ৩টা [ঘণ্টা পড়বে ৩টায়]

            রাত্রি চতুর্থ বা শেষ প্রহর : রাত ৩টা থেকে ভোর ৬ট [ঘণ্টা পড়বে ৬টায়, রাত্রি শেষ প্রহরের ঘণ্টা]

 

বর্তমানে প্রাত্যহিক কাজকর্মে প্রহরের ব্যবহার না থাকলেও ভারতীয় রাগসঙ্গীতে এবং জ্যোতিষশাস্ত্রে 'প্রহর' ব্যবহার আছে। অবশ্য ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্রে প্রহর নির্ধারণে মতভেদ আছে। পশ্চিম ভারতে রাগসঙ্গীতে দিবসের প্রথম প্রহর ধরা হয় ভোর ৪টা থেকে। কিন্তু একে সরসময় মান্য করা যায় না। ভাতখণ্ডেজী তাঁর 'ক্রমিক পুস্তক মালিকা (দুসরী পুস্তক)' গ্রন্থে ইমন রাগের লক্ষণগীতিতে এই রাগের গায়নকাল উল্লেখ করেছেন, 'রাত প্রথম প্রহর'। এই বিচারে দিবসের প্রথম প্রহর ভোর ৪টা থেকে ধরলে, ইমন গাওয়ার সময় হয় বিকেল ৪টা। কিন্তু রাত্রি প্রথম প্রহরকে সন্ধ্যা ৬টা ধরলে, ঋতু পরিবর্তনের সময়ের হেরফের হলেও তা বিকেল হয় না। প্রাতঃসন্ধি ও সায়ংসন্ধি রাগে সময়ের হেরফের সকল সন্ধ্যার বিচারে মান্য করা যায়। কিন্তু সন্ধি রাগের আগে পরের রাগে প্রহরের শুরু ৪টা ধরলে বিপত্তি ঘটে।


সূত্র: