কোরান
ইসলাম ধর্মের মূল গ্রন্থ। ইসলাম ধর্ম মতে, আল্লাহ তাঁর প্রেরিত বাণী ফেরেস্তা জিবারাইলের দ্বারা, তাঁর নির্বাচিত প্রতিনিধি হজরত  মুহম্মদ (সাঃ) -এর কাছে প্রায় ২৩ বৎসর ধরে ধাপে ধাপে প্রেরণ করেছিলেন। এই বাণী প্রেরণ শুরু হয়েছিল ৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ আগষ্ট। আর শেষ হয়েছিল মুহম্মদ (সাঃ)-এর মৃত্যর বছর পর্যন্ত (৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ)। এ সকল বাণী বিক্ষিপ্তাকারে মুসলামনদের কণ্ঠস্থ ছিল। তাঁর মৃত্যর পর এসকল বাণী সংগ্রহ করে যে সংকলন তৈরি করা হয়- তাকে 'আল্‌-কোরান' নামে অভিহিত করা হয়। আল্লার প্রেরিত বাণীর সংকলন হিসেবে একে ঐশী গ্রন্থ হিসেবে উল্লেখ্য করা হয়। বাংলা ভাষাভাষীরা একে অনেক সময় 'আসমানী কিতাব' হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

রোমান রীতিতে কোরান লেখা হয়
Qur'an বা Koran। তবে গ্রন্থ হিসেবে আরবিতে একে উল্লেখ করা হয়- 'আল্ কোরান' হিসেবে। ‌এই গ্রন্থে কোরান শব্দটি ৭০ বার ব্যবহার করা হয়েছে। সমগ্র কোরানের ১১৪টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত রয়েছে। এই অধ্যায়গুলোকে বলা হয় সুরাহ। প্রতিটি সুরাহ গঠিত হয়েছে ছোটো ছোটো কাব্যধর্মী পংক্তিতে। এই পংক্তিগুলোকে বলা হয় আয়াত।

আরবি
رآن‎ (কোরান) শব্দের অর্থ হলো- আবৃত্তিকরণ।   ব্যাকরণের  বিধি অনুসারে শব্দটি ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য (verbal noun)। এই শব্দের ক্রিয়ামূল হলো-কারা'আ qaraʼa (قر) । এর অর্থ হলো- পড়্ বা পঠ্। এই দুটি ক্রিয়ামূল থেকে উৎপন্ন অর্থ হতে পারে পড়া বা পাঠ করা। কিন্তু আরবি ক্রিয়ামূল 'কারা'আ' এর অর্থ যদি আবৃত্ত হয়, তা হলে এর থেকে উৎপন্ন ক্রিয়াবচক শব্দ হবে আবৃত্তিকরণ। সিরিয়ান আরামাইক ভাষায় এর সমতূল্য শব্দ ( ܩܪܝܢܐ) qeryānā (কেরিয়ানা)। এই শব্দের অর্থ লিপি পঠন বা রচনা পঠন। এর অন্য অর্থ হলো- পাঠ্যবিষয়। অনেকে মনে করেন কোরান শব্দটি সিরিয়ান আরামাইক ভাষা থেকে আরবিতে গৃহীত হয়েছিল। কোরান শব্দের গঠন প্রণালী যাই থাক। বর্তমানে কোরান শব্দটি গ্রন্থ হিসেবে নামবাচক বিশেষ্য।

কোরান সৃষ্টি কথা

কোরাণের ৮৫ সংখ্যক সুরার ২১ ও ২২ সংখ্যক আয়তে আছে- বরং এটা মহান কোরান, লাওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ। ইসলাম ধর্ম মতে- 'লাওহে মাহফুজ' স্রষ্টার সকল সৃষ্টর জন্য পূর্ব-পরিকল্পিত বিধান। যে বিধানের একটি অধ্যায় হিসেবে কোরান অবতীর্ণ হয়েছে। যে বিধান একটি আদর্শিক প্রোগ্রামের মাধ্যমে ঘটনাপ্রবাহের দ্বারা পরিবর্তিত হয়ে থাকে। কিন্তু এই প্রোগ্রামের বাইরে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো কিছুই পরিবর্তন হয় না। এই কারণেই 'লাওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ' প্রোগ্রামের দ্বারা কিছু নির্দেশে হজরত  মুহম্মদ (সাঃ)
-এর কাছে প্রেরিত হয়েছিল। এই প্রেক্ষিতে আরব-ভূখণ্ডে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তার উপর ভিত্তি করে প্রোগ্রামের ফলাফল বিভিন্ন রূপ লাভ করেছিল। পরে ওই ফলাফলের ভিত্তিতে প্রোগ্রামের পরবর্তী নির্দেশ নির্ধারিত হয়েছে। এই বিচারে প্রচলিত কোরান 'লাওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ' ছিল না। ঘটনা পরম্পরায় তা নতুন নতুন ভাবে বিন্যস্ত হয়েছে। এই বিচারে শুধু কোরান নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল সম্ভাবনার বিধি পরিচালিত হচ্ছে ৱলাওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ' প্রোগ্রামের দ্বারা। এই বিচারে লাওহে মাহফুজ-এ লিপিবদ্ধ জ্ঞানসমগ্রের একটি ক্ষুদ্র অংশ হলো কোরান। বাকি অংশ রয়েছে মানুষের কাছে অপ্রকাশিত।

'লাওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ'- এই ধারণাকে ফলে পার্থিব গ্রন্থ কোরানের দিকে দৃষ্টি দিলে- দেখা যায়, এর শুরু হয়েছিল আরবের হেরা পর্বতের একটি গুহায়। এই গুহায় হজরত  মুহম্মদ (সাঃ), দীর্ঘ দিন ধরে আল্লাহর ধ্যান করতেন। ৬১০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ আগষ্ট (সোমবার ২১শে রমজান) রাতে, ফেরেস্তা জিব্রাইল তাঁর কাছে আসেন- এবং নবীকে বলেন- 
১. 'তুমি পড় তোমার সেই রব্বের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।
২. সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্তপিণ্ড থেকে।
৩. পড় এবং তোমার রব্ব মহামহিমান্বিত,
৪. যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন।
৫. তিনি শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে (এমন জ্ঞান) যা সে জানতো না।

কোরান শরীফে এই পাঁচটি আয়াত-সহ মোট ১৭টি আয়াত সুরা 'আলাক' নামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এরপর দীর্ঘকাল কোনো আয়াত বা সুরা অবতীর্ণ হয় নি। এরপর অবতীর্ণ হয়েছিল সুরা 'আল মুদ্দাসির'। এরপর একে একে ১১৪টি সুরা অবতীর্ণ হয়েছিল। ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে (১৮ জিলহজ ১০ হিজরি) শেষ সুরা অবতীর্ণ হয়েছিল। মুহম্মদ (সাঃ)-এর জীবদ্দাশয় তাঁর অনুসারীদের একটি অংশ কোরান মুখস্থ করেছিলেন। এদের বলা হতো হাফিজ। ৬৩৩ খ্রিষ্টাব্দে খালিদ বিন ওয়ালেদের সাথে ভণ্ড নবী মুসায়লামা'র ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয়।
উল্লেখ্য, এই সময় ইসলামের প্রথম খলিফা ছিলেন আবু বকর সিদ্দিকী (রাঃ)। এই যুদ্ধে মুসলমানরা জয়ী হলেও এই যুদ্ধে প্রায় তিনশত হাফিজ মারা যায়। এত অধিক সংখ্যক হাফিজের মৃত্যু এবং ভবিষ্যতে বিভিন্ন যুদ্ধে আরও হাফিজের নিহত হতে পারে চিন্তা করে আবু বকর সিদ্দিকী (রাঃ) কুরআনের অস্তিত্ব রক্ষার ব্যাপারে আতঙ্কিত হয়ে উঠেন। এই কারণে তিনি খলিফা যায়েদ বিন সাবিতকে কুরানের সুরাগুলি সংগ্রহ ও সংকলনের কাজে নিয়োগ করেন। তাঁর সময়ই কুরআনের প্রথম সংকলন তৈরি হয়।

৫৩৪ খ্রিষ্টাব্দে আবু বকর সিদ্দিকী (রাঃ)।-এর মৃত্যুর পর, কোরান লিখিতভাবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই সূত্রে ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিকী (রাঃ) ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে জায়েদ বিন থাবিতের উপর কোরানের আয়াত এবং সুরাসমূহ সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়। জায়েদ সংগৃহীত আয়াতগুলো হাতে লিখে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থে রূপ দেন।
[কোরানের বাংলা অনুবাদের সংকলন]