মধ্য প্রস্তরযুগ
এই সময়ে বিকাশ ঘটেছিল-
লেভাল্লোইস অস্ত্র-নির্মাণ কৌশল। যার নমুনা পাওয়া গেছে - আফ্রিকা এবং
ইউরেশিয়ার বিভিন্ন প্রত্নক্ষেত্রের। সাধারণভাবে এই অস্ত্রনির্মাণ কৌশলভিত্তিক
সংস্কৃতিকে বলা হয়- মুষ্টারিয়ান সংস্কৃত। উল্লেখ্য নিয়ানডার্থালদের দ্বারা লেভাল্লোইস অস্ত্র-নির্মাণ
কৌশলের উন্নয়ন ঘটেছিল প্রায় ৩ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ ৫০ হাজার অব্দের ভিতরো। এই
অস্ত্র নির্মাণে সমতলীয় ত্রিভুজ আকৃতির পাথরখণ্ড ব্যবহার করা হতো এবং এর শীর্ষবিন্দু
হতো তীক্ষ্ণ। এছাড়া শীর্ষবিন্দু থেকে প্রসারিত দুই বাহুর প্রান্ত তীক্ষ্ণ করা হতো।
এই বিশেষ ধরনের অস্ত্র পাওয়া গেছে- উত্তর আফ্রিকার লাইবেরিয়ার হায়ুয়া এফটিয়াহ-
গুহায়, সিরিয়ার বিভিন্ন গুহায়,আফগানিস্তানে হাইবাক উপত্যাকায়, মধ্য ইরান এবং ইরানের
জাগ্রোস পার্বত্য এলাকায়, স্পেনের গাটাপুরেকায় প্রত্নক্ষেত্রেসমূহে, জিব্রাল্টারের
গোরহাম গুহায়, উজবেকিস্তানে, তুর্কমেনিস্তানে, সাইবেরিয়ায়, ইস্রায়েলে, ইংল্যান্ডে।
এরই মধ্যে লম্বাটে ধরনের
কিছু অস্ত্র তৈরি করেছিল ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডের বিভিন্ন
প্রত্নতাত্ত্বিক-ক্ষেত্রে। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের যন্ত্রপাতিগুলোকে বলা হয়- মিকোকুইন
কালের অস্ত্র। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১ লক্ষ ৩০ হাজার
থেকে ৭০ হাজার অব্দের ভিতরে এই অস্ত্রের ব্যহার ছিল। এই অস্ত্রগুলো প্রথম পাওয়া
গিয়েছিল ফ্রান্সের লা মিকোকু অঞ্চলে খননের মাধ্যমে।
মিকোকুইন কালের
অস্ত্র
পরবর্তী সময়ে ১ লক্ষ ৩০ হাজার থেকে ১০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দে হোমো স্যাপিয়েন্সরা
এই বিশেষ ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছিল। হোমো স্যাপিয়েন্সদের ব্যবহৃত সময়কে স্যাঙ্গোন
অস্ত্র নির্মাণশৈলী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। উগাণ্ডার স্যাঙ্গো বে- অঞ্চলে ১৯২০
খ্রিষ্টাব্দে এই অস্ত্র উদ্ধারের পর- এর এরূপ নামকরণ করা হয়েছিল।
আধুনিক মানুষের
বৈজ্ঞানিক নাম হলো-
Homo sapiens
। ল্যাটিন
sapiens
-এর অর্থ হলো জ্ঞানী মানুষ। হোমো গণের আগের প্রজাতিগুলোর থেকে এই প্রজাতির মূল
পার্থক্য হলো- এর বুদ্ধিমত্তা। এমন কি নিয়ানডার্থালদের (হোমো
নিয়ানডার্থালেনসিস)
সাথে মস্তিষ্কের পরিমাপগত মিল (১৭০০ সিসি) থাকলেও বুদ্ধিমত্তার বিচারে
Homo sapiens
আরও অনেক বেশি এগিয়ে রয়েছে।
কালসূচি অনুসারে ১.২৬ থেকে ১১.৭
খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত ছিল-
টারান্টিয়ান আমল। এর পূর্বর্তী
আয়োনিয়ান
আমলের-১ লক্ষ থেকে ৭৫ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে
হোমো স্যাপিয়েন্সরা
মূলত আফ্রিকা ভিতরে ছড়িয়ে পড়েছিল। ১ লক্ষ
খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এমনি একটি ভ্রাম্যমান দল বর্তমান দক্ষিণ আফ্রিকা অঞ্চলে
প্রবেশ করেছিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন শহরের নিকটবর্তী অঞ্চলে বসতি স্থাপন
করেছিল। এই অঞ্চলে ব্লোম্বোস গুহায় পাওয়া গিয়েছে কিছু প্রাপ্ত প্রস্তরে খোদিত
চিত্রকর্ম। যদিও এই চিত্রকর্ম গুহার গায়ের দেয়ালে বা ছাদে আঁকা হয় নি, তারপরেও
গুহায় প্রাপ্ত বলে একে গুহাচিত্র বলা হয়। প্রাপ্তি স্থানের বিচারে এ সকল
শিল্পকর্মকে
ব্লোম্বোস-গুহাচিত্র বলা হয়। আভিধানিক বিচারে এই চিত্রগুলো গুহাচিত্র হিসেবে
বিবেচিত হয় না। ধারণা করা হয়, প্রায় ৭৫-৭০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই
চিত্রগুলো অঙ্কিত হয়েছিল। আফ্রিকায় প্রাপ্ত প্রাগৈতিহাসিক চিত্রকর্মসমূহের ভিতরে
ব্লোম্বোস গুহাচিত্রের ভিতরে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
খ্রিষ্টপূর্ব ৭০ থেকে ৪০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে উত্তর-পশ্চিম ফ্রান্সের পারব্ত্য অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। এখানে এদের দ্বারা এখানে পত্তন হয়েছিল মস্টারিন সভ্যতার। এই সময় এরা আগুন জ্বালাতে শিখেছিল। সম্ভবত এরা শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পশুর চামড়া গায়ে জড়িয়ে রাখতো। হিংস্র পশু এবং প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পর্বত গুহায় বসবাস করতো। নিজেদের ভিতরে তথ্য আদান প্রদানের মতো নিম্নস্তরের ভাষার বিকাশ ঘটেছিল। এদের খাদ্য তালিকায় ছিল পশুর মাংস এবং নানা ধরনের ফলমূল। এদের ভিতরে মৃতদেহ কবরস্থ করার রীতি গড়ে উঠেছিল।
এরূপ একটি দল ৬০,০০০
খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার নর্থ কেপ শহরের নিকটবর্তী ডিয়েপক্লুফ গুহা
এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে বসবাস শুরু করেছিল। এখানে পাওয়া গেছে
অস্ট্রিকের ডিমের খোলসের উপর অঙ্কিত চিত্র। এই চিত্রগুলোকে
ডিয়েপক্লুফ
চিত্র অভিহিত করা হয়। এই গুহায় পাওয়া গেছে ২৭০টি চিত্রকর্ম। সম্ভবত ২৫টি
অস্ট্রিকের ডিমের খোলসের ভাঙা অংশে এই ছবিগুলো অঙ্কিত হয়েছিল। ছবিগুলোতে রয়েছে নানা
ধরনের সাঙ্কেতিক চিহ্ন। এই চিহ্নগুলো দিয়ে কোনো বার্তা প্রকাশ করা হয়েছিল কিনা তা
জানা যায় নি।
সম্ভবত
এদের ভিতরে আদিম গান এবং নৃত্যের চর্চা ছিল। এছাড়া চিত্র অঙ্কনের অভ্যাস গড়ে
উঠেছিল। এরা গুহারে পাথুরে দেওয়ালে পেয়ালার অবয়ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। এগুলো
এরা তৈরি করেছিল গুহাগুলোকে শৈল্পিকভাবে সাজানোর তাগিদে। এর অন্যতম নমুনা স্থান
হিসেবে উল্লেখ করা যায়- ফ্রান্দের লা ফেরাসসিয়ের গুহাকে। ধারণা করা হয়, এই দেওয়াল
সজ্জার নমুনা'র বয়স ধরা হয়েছে ৬০ হাজার খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। এই দেওয়াল সজ্জার নাম
দেওয়া হয়েছে
'La
Ferrassie Cave Cupules'।
টান-টানের ভেনাস-এর মতো এখানে কোনো নারী মূর্তি পাওয়া
যায় নি বটে, তবে দেওয়াল খোদিত করে নারী যোনী'র চিত্র অঙ্কন করেছিল। সম্ভবত এটিও ছিল
আদি দেবীর প্রতীক।
সাধারণভাবে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০.০০০ অব্দ পর্যন্ত মধ্যপ্রস্তর যুগ বলা হয়। কিন্তু কোনো
কোনো অঞ্চলে নিম্নপ্রস্তর যুগের সূচনা হয়ে গিয়েছিল এর আগেই। আবার কোনো কোনো অঞ্চলে
মধ্য প্রস্তরযুগের প্রভাব খ্রিষ্টপূর্ব ৫০.০০০ অব্দের পরেও দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত
ছিল।