সংস্কৃতি
বানান বিশ্লেষণ :
স্+ং+স্+ক্+ঋ+ত্+ই।
উচ্চারণ: ʃɔŋs.kri.t̪i
(শঙ্স্.কৃ.তি)
শব্দ-উৎস:
সংস্কৃত
সংস্কৃতি>বাংলা
সংস্কৃতি।
রূপতাত্ত্বিক
বিশ্লেষণ: সম্ +
√কৃ
(করা)+তি
(ক্তিন্),
ভাববাচ্য
পদ :
বিশেষ্য
ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা {
|
মনোভাব
|
জ্ঞান |
মনস্তাত্ত্বিক বিষয়
|
বিমূর্তন
|
বিমূর্ত সত্তা
|
সত্তা
|}
অর্থ:
কোনো সুনির্দিষ্ট সমাজের ভিতরে প্রচলিত এমন একটি সমন্বিত জীবন-প্রণালী, যা
দীর্ঘদিনের অনুশীলেনর ভিতর দিয়ে সংস্কারকৃত দশায় সমাজের প্রতিটি সদস্য চর্চা করে
এবং মান্য করে।
ইংরেজি:
Culture
সমাজবিজ্ঞানের বিচারে সংস্কৃতি
কোনো সুনির্দিষ্ট সমাজের সুনির্দিষ্ট সময়ের ভিতরে প্রচলিত এমন একটি সমন্বিত জীবন-প্রণালী, যা
দীর্ঘদিনের অনুশীলেনর ভিতর দিয়ে সংস্কারকৃত দশায় পৌঁছেছেম এবং
যা সমাজের প্রতিটি সদস্য চর্চা করে
এবং মান্য করে। এই কারণে সংস্কৃতিকে বলা
হয় কোনো সুনির্দিষ্ট সমাজের পরিচয়
বহনকারী উপাদান। এই উপাদানের ভিতরে রয়েছে একটি সমাজ দ্বারা স্বীকৃত প্রথাগত
আচরণ, ভাষাশৈলী, শিল্পকলা, নীতিবোধ, আইন
ইত্যাদির সমষ্টিগত
বৈশিষ্ট্যসমূহ। একটি সমাজ দীর্ঘদিন ধরে এই বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে এবং তা অনুশীলনের
মধ্য দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চালিত করে। এই বিষয়টি সমাজের প্রতিটি মানুষ সামাজিক
শিক্ষার মধ্য দিয়ে গ্রহণ করে এবং তা সযত্নে লালন করে। এই কারণে
একটি সমাজের সংস্কৃতির ভিতরে পাওয়া যায়, ওই সমাজের সামগ্রিক বুদ্ধিবৃত্তির পরিচয়।
মানুষ জীবন-যাপনের
প্রচেষ্টায় তার অভ্যাস নানাভাবে পাল্টায়। মানুষ প্রতিনিয়ত জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে উন্নতর দশায়
পৌঁছাতে চায়। এরই ফলে নতুন নতুন বিষয় উদ্ভাবন ঘটে। শিক্ষা, বিজ্ঞান, সাহিত্য,
শিল্পকলাতেও তার প্রভাব পড়ে। এর ফলে মানুষের সার্বিক জীবন-যাপনে পরিবর্তন ঘটতে
থাকে। ফলে মানুষের সংস্কৃতিরও পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তন এক প্রজন্ম থেকে অন্য
প্রজন্ম গ্রহণ করে এবং তা ক্রমবিবর্তনের রূপটিকে ধরে রাখে অতীতের সাথে বর্তমানের
সমন্বয় করে।
যেহেতু সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল
এবং
এতে নতুন নতুন উপাদান যুক্ত হয়, পুরাতন উপাদানের সাথে সমন্বয় করে। তাই সংস্কৃতি
বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যখন বহিরাগত কোনো
উপাদান কোনো সুনির্দিষ্ট সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধের সাথে সমন্বিত হয় না বা বিকৃত বা বিপর্যস্ত করে
তোলে, তখন তা ওই সমাজের কাছে অপসংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত হয়।
সংস্কৃতির উপাদান :
মানুষ তার জীবধারনের জন্য নানা ধরনের উপকরণ ব্যবহার করে। এর ভিতরে রয়েছে মানুষের
দৈহিক সত্তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় রসদ, চিত্ত-বিনোদনের উপাদান, শিক্ষা
ইত্যাদি। এর সবই সংস্কৃতির উপাদান হতে পারে আবার নাও হতে পারে। একটি সুনির্দিষ্ট
সংস্কৃতির জন্য যে উপাদানগুলো বিশেষভাবে সক্রিয় থাকে, সেগুলো হলো―
প্রকৃতি ও
প্রাকৃতিক উপাদান : একটি মনুষ্য সমাজ যে জায়গায় বসতি গড়ে তোলে, তার
সংস্কৃতি গড়ে উঠে প্রকৃতি নির্ভর। যাযাবরদের সংস্কৃতিতে প্রাকৃতিক উপাদান
স্থায়ী রূপ নেয় না। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন স্থানের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যকে তারা
সমীহ করে।
স্থায়ীভাবে একটি স্থানে যে সমাজ দীর্ঘকাল ধরে অবস্থান করে, তাদের ভিতরে
শীতগ্রীষ্ম, বন, নদী পশু-পাখি, শস্য প্রকৃতি ইত্যাদির প্রভাবিত করে। পাহাড়ি
মানুষ এবং সমতল মানুষের জীবন-যাপন প্রকৃতি একরকম হয়
না, শীত-প্রধান এবং
গ্রীষ্ম-প্রধান অঞ্চলের মানুষের জীবন-যাপন পদ্ধতি ভিন্ন রকম হতে বাধ্য। একই
ভাবে মরুভূমি এবং সুজলা দেশের মানুষের জীবন-যাপনে পার্থক্য গড়ে উঠে। এই
পার্থক্যের সূত্রে প্রতিটি সমাজের পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক উৎসব ইত্যাদির
পার্থক্য গড়ে উঠে। এর প্রভাব পড়ে সাহিত্য, সঙ্গীত ও অন্যান্য সুকুমার শিল্পের
ক্ষেত্রেও। স্থানীয় জীবন-চর্চার ভিতরে মানুষে ভাষাগত বৈশিষ্ট্যও ভিন্নতর হয়।
বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিতে বাঘ-শিয়ালের গল্প রয়েছে কিন্তু ক্যাঙারু নিয়ে কোনো
গল্প নেই। সাইবেরিয়ায় বরফ নিয়ে কবিতা, গান আছে। বাংলাদেশে আছে বর্ষা, বৃষ্টি,
প্লাবনের গান বা কবিতা।
প্রাকৃতিক উপাদান হিসেবে মানুষ জন্মসূত্রে পায় কথা বলার ক্ষমতা। মানব শিশু বেড়ে
উঠার সময় তার চারপাশের মানুষের কাছ থেকে ভাষাজ্ঞান অর্জন করে। একটি সুনির্দিষ্ট
সমাজ যে কথ্যরীতি অনুসরণ করে ভাব বিনিময় করে, তা ওই সমাজের জীবন-প্রণালীর অংশ
হয়ে যায়। ফলে ভাষা হয়ে ওঠে একটি সমাজের সাংস্কৃতিক উপাদান।
মানুষের ভাষার প্রতিটি শব্দের সাথে থাকে একটি চিত্রময় রূপ। বাস্তবধর্মী শব্দের
সাথে সাথে বাস্তব চিত্রটিও কাজ করে। ভিন্ন ভিন্ন স্থান থেকে আসা কিছু মানুষের
আসরে যদি 'গ্রামের বাড়ি' কথা বলা যায়, তাহলে, প্রতিটি মানুষ প্রথমে দেখবে তার
নিজের গ্রামের বাড়ির ছবি। বাংলা দেশের মানুষ ছবিতে দেখে যে 'মরুভূমি' শব্দের
সাথে ছবিটি দেখবে, আলজেরিয়ার মানুষ দেখবো অন্যভাবে। এই ভাবে ভাষার শব্দরূপ,
বাচনিক সুর, ওজস প্রভৃতি গড়ে ওঠে সমাজ ও প্রাকৃতিক পরিবেশের মাধ্যমে। যা ধীরে
ধীরে সুদঢ়ভাবে মিশে থাকে সংস্কৃতির সাথে।
বিশ্বাস ও প্রথা :
একটি মনুষ্য সমাজে ধর্ম বা কুসংস্কারের সূত্রে কিছু বিশ্বাস জন্মে। সেই
বিশ্বাসের সূত্রে কিছু আচর-আচরণ মনুষ্য সমাজে প্রথায় পরিণত হয়। আবার দীর্ঘকাল
ধরে চলে আসা সমাজের অনুমোদিত এবং পালিত কোনো রীতি প্রথায় পরিণত হয়। ঈদ,
পূজা বা বড়দিনের মতো ধর্মীয় আচার অনেক সমাজে সংস্কৃতির অংশ। বাংলাদেশের মতো
বহু-ধর্মমতের দেশে ধর্মীয় আচারণের সাথে অন্যান্য বিষয় সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ভিতর একাদশী বা এই জাতীয় কোনো দিনে উপবাস করে, মুসলমানরা
রোজা ছাড়াও নানা উপলক্ষে রোজা রাখেন।
ধর্মীয় আচরণের কিছু অংশ প্রথাগত ভাবে সংস্কৃতির ভিতর ঢুকে পড়ে। হিন্দু, বৌদ্ধ,
খ্রিষ্টান সম্প্রদায় জল বলে এবং মুসলমানরা পানি বলে―
এটা ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত প্রথা। যে কেউ জল বা পানি বললে ধর্ম হানি হয় না। এই
কারণে ভাষাগত এই প্রথা ধর্মভিত্তিক সামাজিক আচার। এরূপ আসাস্লামুয়ালায়কুম,
নমস্কার, আদাব এসব ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত সামাজিক শিষ্টাচার মাত্র।
আবার বিবাহের মতো সামাজিক প্রথা ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হয়। কিন্তু সকল ধর্ম মতেই
নারীপুরুষে যৌন-সম্পর্ককে বৈধরূপ দেওয়ার জন্য বিষয়টি থাকে। তাই ভিন্ন ভিন্ন
ধর্মমত অনুসারে বিবাহের বিধিতে পার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু উদ্দেশ্যের বিচারে
সামগ্রিকভাবে বিবাহটা সংস্কৃতির অংশ হিসেবেই বিবেচিত হয়।
পোশাক
: প্রাকৃতিক
পরিবেশের সাথে অভিযোজনের সূত্রে মানুষ পোশাক পড়ে এবং একই সাথে নগ্নতাকে পোশাক
দ্বারা ঢাকার জন্যও পোশাক পড়ে। আধুনিক সমাজে পোশাকপড়ার অভ্যাসটা হলো সংস্কৃতির
অংশ। আবার দেশ-কাল-পাত্রের বিচারে পোশাকের ধরন বা শৈলী একই রকম হয় না। কোনো
কোনো পোশাক দীর্ঘদিন ধরে একটি সুনির্দষ্ট সমাজ ব্যবহার করার ফলে, এক সময় ওই
পোশাক ওই সমাজের জীবন-প্রণালীর স্বাভাবিক চর্চায় পরিণত হয়। ফলে ওই পোশাক সমাজের
স্বাভাবিক সংস্কৃতিকে অতিক্রম করে যায়। তখন শুধু ওই বিশেষ পোশাকই সংস্কৃতির
উপাদানে পরিণত হয়। যেমন বাঙালি মেয়েদের শাড়ি।
আচরণবিধি :
প্রতিটি সমাজে কিছু সাধারণ আচরণবিধি থাকে, যা সমাজের সকল সদস্য সযত্নে লালন
করে। এই আচরণ ভাষায়, দৈহিক ভঙ্গিমা, পোশাক ইত্যাদির দ্বারা উপস্থাপিত হয়।
বাঙালিরা গুরুজনদের প্রতি ভাষায় এবং আচরণে যেভাবে নিজেদেরকে উপস্থাপন করে, তা
সংস্কৃতির উপদান হিসেবেই বিবেচিত হয়।
পেশা : মানুষের জীবন-যাপনের যে কাজ করে, তাকে পেশা বলা হয়। সংস্কৃতি যেহেতু জীবন-প্রণালী তাই, পেশাকে সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই কারণে কৃষি নির্ভর সমাজের জীবন-প্রণালী একরকম হয় আবার শিল্প এলাকার শ্রমিকদের জীবনযাপন একরকম হয়। ফলে একই দেশে একই ভাষার দুই পেশার মানুষের সংস্কৃতি ভিন্ন ভিন্ন হতে বাধ্য। একটি বৃহত্তর মানবগোষ্ঠীর ভিতরে ভিন্ন ভিন্ন পেশার মানুষ থাকে। সামাজিক প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে এই সকল ভিন্ন ভিন্ন পেশার মানুষের ভিতের একটি মিশ্র সংস্কৃতির জন্ম নেয়। এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রক্ষা করে, ওই সমাজের ভাষা, ধর্মীয়, পোশাক, প্রথা, আচরণবিধি ইত্যাদি।