হিন্দুস্থান রেকর্ড
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে আত্মপ্রকাশ করে রেকর্ড বিশেষ।


এই রেকর্ড কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা চণ্ডীচরণ সাহা ছিলেন পৈত্রিকসূত্রে রেকর্ড ব্যবসা লাভ করেছিলেন। তাঁর পিতা মতিলাল সাহা কলকাতার ধর্মতলায় একটি হারমোনিয়াম তৈরির ব্যবসা শুরু করেছিলেন। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি '
নিকোল রেকর্ড' এবং 'নিকোলফোন' যন্ত্র বিক্রয়ের একমাত্র বিক্রয় পরিবেশক নিযুক্ত হন। খুব অল্প সময়ের ভিতরেই মতিলাল এই ব্যবসায়ে অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেন। ফলে ধর্মতলার আদিস্থান থেকে, ধর্মতলারই অন্য একটি বড় জায়গা নির্বাচন করে তাঁর ব্যবসায়ীক সকল  কার্যক্রম স্থানান্তর করেন। এই সময় মতিলাল তাঁর প্রতিষ্ঠানের 'বীণা' হারমোনিয়াম এবং এইচএমভির সামগ্রী বিক্রয়ের ভিতরে ব্যবসাকে ধরে রেখেছিলেন। এরপর ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে এই ব্যবসার সাথে যুক্ত হন তাঁর পুত্র চণ্ডীচরণ সাহা। এবং তিনি পিতার ব্যবসাকে আরও সম্প্রসারিত করেন। এই বছরের শেষের দিকে 'প্যাথি-বেবি' হোম-সিনেমার পরিবেশক হয় তাঁদের প্রতিষ্ঠান।  ফলে ৬/১ অক্রুর দত্ত লেনে তাঁদের নতুন কারখানা স্থাপন করতে হয়।

ভারতবর্ষে রেকর্ড ব্যবসার বিকাশের ধারা লক্ষ্য করে, মতিলাল পুত্রকে রেকর্ডিং  বিদ্যা শেখার জন্য বিলেতে পাঠান। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল তৎকালীন ভারতীয় গ্রামোফোন কোম্পানি। মূলত এই কোম্পানির সুপারিশেই বিলেতে রেকর্ডিং শেখার সুযোগ লাভ করেছিলেন। শিক্ষা শেষে ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের চণ্ডীচরণ কলকাতায় ফিরে আসেন এবং একটি রেকর্ড তৈরির কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেন। এক্ষেত্রে তাঁকে বিশেষভাবে সহায়তা করেছিলেন মেগাফোন কোম্পানির জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ এবং সেনোলা রেকর্ড কোম্পানির বিভূতিভূষণ সেন। সে সময়ে গ্রামোফোন কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর জর্জ কুপার ভারতে তাঁদের ব্যাবসা নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন কোন ভারতীয় ব্যবসায়ী এই ধরনের উদ্যোগ নিলে, তাঁদের ব্যবসার ক্ষতি হবে। তাই কুপার তাঁদের দমদমস্থ রেকর্ড কারখানা থেকে সহজ শর্তে রেকর্ড ছাপানোর সুযোগ করে দেন। চণ্ডীচরণ এই সুযোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু এর পাশাপাশি চণ্ডিচরণ ধর্মতলায় 'সিসি সাহা লিমিটেড' নামে চলচ্চিত্র-সম্পর্কিত সামগ্রী এবং রেডিও বিক্রয়ের জন্য একটি বড় দোকান খোলেন।

১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই জুলাই তিনি অক্রূর দত্ত লেনে 'হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রডাক্টাস এ্যান্ড ভ্যারাইটিস্ সিন্ডিকেট লিমিটেড' নামে একটি প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশন করেন । এই কোম্পানি থেকে যে রেকর্ড প্রকাশিত হয়, তার নাম ছিল 'হিন্দুস্থান'। রেকর্ডিং-এর মান উন্নয়নের জন্য তিনি রাইচাঁদ বড়াল, বাণীকুমার, পঙ্কজকুমার মল্লিকের সাহায্য নিয়েছিলেন। প্রথমে তিনি এই তিন গুণীজনকে রেডিও থেকে হিন্দুস্থানের অফিসে নিয়ে যান এবং আধুনিক রেকর্ডিং পদ্ধতির বিষয় হাতকলমে দেখান । পরে এঁদের সহযোগিতায় তিনি উন্নতমানে শব্দধারণ করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ফলে সেকালের অন্যান্য রেকর্ডের চেয়ে হিন্দুস্থানের রেকর্ডিং মান ছিল বেশ উচ্চস্থানে।

এই রেকর্ডের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে। এই বছরের ৫ই এপ্রিল রবীন্দ্রনাথ হিন্দুস্থান-এর নিজস্ব স্টুডিওতে গিয়ে কবিতা ও গান রেকর্ড করেন। ১৯৩২ থেকে ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে বেশ কয়েকবার রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর গ্রহণ করা হয়। নিচে এর তালিকা দেওয়া হলো

রবীন্দ্রনাথের রেকর্ড করার পর তিনি অতুলপ্রসাদ সেনের স্বকণ্ঠে গাও দুটি গানের রেকর্ড প্রকাশ করেন। গান দুটি ছিল- 'মিছে তুই ভাবিস মন' ও জানি জানি তোমারে গো রঙ্গরাণী'। এরপর হিন্দুস্থান রেকর্ডে কণ্ঠ দেন কুন্দনলাল সায়গল, শচীনদেব বর্মণ, পঙ্কজকুমার মল্লিক, সুধীরলাল চক্রবর্তী, কৃষ্ণচন্দ্র দে, দিলীপকুমার রায়, রেণুকা দাশগুপ্তাম সাবিত্রী দেবী, সুপ্রভা ঘোষ (সরকার, অনুপম ঘটক, আঙুরবালা প্রমুখ। এই সময় কোম্পানির পক্ষে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে ছিলেন তিমিরবরণ, অনুপম ঘটক, হিমাংশু দত্ত। উল্লেখ্য শচীনদেব বর্মণ ও সায়গলের প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল হিন্দুস্থান থেকেই। রাগসঙ্গীত জগতের শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ, শ্রীকৃষ্ণ রতনঝঙ্কার, পণ্ডিত দিলীপচাঁদ বেদী। ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ, ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁর প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছিল হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে।


সূত্র: