নাথসাহিত্য
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম ধারা।

সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শিব উপাসকের মধ্যে এক শ্রেণীর যোগীর বিশ্বাস এবং ধর্মাচরণের সূত্রে তৈরি হয়েছিল শাক্ত ধর্মে। এই বিশ্বাসের সাথে বৌদ্ধ ধর্মের মিশ্রণের নতুন এই নাথ মতের উদ্ভব হয়েছিল। এই মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে সৃষ্ট সাহিত্যকর্মকে বলা হয় নাথসাহিত্য।

নাথ শব্দের অর্থ ‘প্রভু’।  প্রভুর দীক্ষান্তে নাথ মতালম্বীরা তাঁদের নামের শেষে 'নাথ' পদবী ব্যবহার করতেন। বিশেষ সাধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মোক্ষ লাভ করাটাই  ছিলই নাথ মতাবলম্বীদের প্রকৃত উদ্দেশ্য। নাথগুরুরা মনে করতেন, অ-বিদ্যা বা অ-জ্ঞান মানবজীবনে তত্ত্বজ্ঞানের পথে বাধা। তাই জীবনযাপনে অ-বিদ্যা বিতাড়িত করে মহাজ্ঞানে সিদ্ধি লাভের মাধ্যমে অগ্রসর হওয়াটাকে তাঁরা সবার উপরে স্থান দিয়েছিলেন।  তাঁদের মতে আধ্যাত্মিক মহাজ্ঞানের সাধনার মধ্য দিয়ে অমরত্ব লাভ করা সম্ভব। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে স্যার জর্জ গিয়ারসন 'ময়নামতীর গান' নামক একটি পালাগান সংগ্রহ করে এশিয়াটি সোসাইটির পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এই প্রকাশিত হয়েছিল দেবনাগরী অক্ষরে। ১৯১০-১১ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য 'গোপীচন্দ্রের গান' সংগ্রহ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে সংগৃহীত হয়েছিল ভবানী দাসের রচিত গোপীচন্দ্রের পাঁচালী। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘গোপীচন্দ্রের গান’ প্রথম খণ্ড এবং ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়।

নাথসাহিত্য ও তার রচয়িতা নাথসাহিত্যের প্রকৃতি লক্ষ্য করলে একটি ধারাবাহিক চিত্র পাওয়া যায়। যেমন নাথ-সাহিত্যের সূচনাপর্বে রচিত হয়েছিল- নাথধর্মের আদিগুরু মীননাথ এবং তাঁর শিষ্য গোরক্ষনাথের লৌকিক-অলৌকিক কাহিনি নিয়ে। এই পর্যায়ে পাওয়া যায় মীননাথের বন্দী দশা এবং সেই দশা থেকে কিভাবে তাঁর শিষ্য গোরক্ষনাথ উদ্ধার করলেন। এরপর পাওয়া যায় গোরক্ষনাথের রানি ময়নামতী আর তার পুত্র গোবিন্দচন্দ্রের কাহিনি।
 
নাথ সাহিত্যের কাহিনি, নাথ সাহিত্য ও  পুরাণাদির সূত্রে যা জানা যায়, তা হলো-
হিন্দু পৌরাণিক দেবতা শিব ছিলেন আদিগুরু। তাই নাথধর্ম মতে শিবের অপর নাম- আদিনাথ। ভৃগুবংশের জনৈক দম্পতির একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। এই সন্তান পিতৃমাতৃ-ঘাতী হবে জেনে, তাকে সমুদ্রের জলে নিক্ষেপ করে। এই সময় একটি বড় মাছ এই শিশুটিকে গিলে ফেলে। এই শিশুটি মাছের পেটে বৃদ্ধি পেতে থাকে। একদিন শিব-পার্বতী ক্ষীরোদ সাগরের একটি দ্বীপে অবস্থান কালে শিব পার্বতীকে যোগশাস্ত্র শোনান। এই সময়, মাছের পেটের এই শিশুটি তা শুনে ফেলে। বিষয়টি শিব জেনে ফেলে এবং মাছের পেট থেকে- শিশুটিকে উদ্ধার করে নাম দেন মৎসেন্দ্রনাথ বা মীননাথ। এরপর শিব প্রতিপালন করেন এবং যোগশাস্ত্রের সকল রহস্য তাঁকে শেখান। এরপর শিবের আদেশে মৎসেন্দ্রনাথ নাথধর্মের প্রচার শুরু করেন।

মৎসেন্দ্রনাথ নাথধর্মের প্রচারের সূত্রে কয়েকজন সিদ্ধা তৈরি হয়েছিল। এঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিলেন গোরক্ষনাথ। একদিন পার্বতী শিবকে জিজ্ঞাসা করেন যে, নাথপন্থীরা বিবাহ করে না কেন। উত্তরে শিব বলেন যে, নাথপন্থীরা যোগসাধক এবং ব্রহ্মচারী। এরপর পার্বতী শিবের অনুমতি নিয়ে- এঁদের পরীক্ষা করার উদ্যোগ নেন। তিনি পাঁচজন শিষ্যকে নিমন্ত্রণ করেন এবং মদনমোহিনী রূপ ধারণ করে খাদ্য পরিবেশন করেন। পার্বতীর এই রূপ দেখে গোরক্ষ ছাড়া অন্যান্যরা কামতাড়িত হয়ে বিচলিত হয়ে পড়েন। পার্বতী চারজন শিষ্যকে এই কারণে অভিশাপ দেন। এই সময় গোরক্ষ পার্বতীর মনোভাব বুঝতে পেরে, পার্বতীকে অভিশাপ দেন। এর ফলে পার্বতী রাক্ষসীতে পরিণত হন। তিনি প্রতিদিন একজন করে মানুষ খাওয়া শুরু করেন। শিব পার্বতীর বিরহে কাতর হয়ে, গোরক্ষের শরণাপন্ন হন। পরে গোরক্ষনাথের সহায়তায় পার্বতীকে পূর্ব রূপে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন।

এরপর শিব গোরক্ষনাথের উপর প্রতিশোধের জন্য, নানা কৌশল অবলম্বন করা শুরু করেন। এই সময় গন্ধর্ব নামক এক রাজার কন্যা 'বিরহিণী' পতিলাভের আশায় শিবপূজা শুরু করেন। শিব এই কন্যাকে তাঁর আকাঙ্ক্ষা কিনা জানতে ইচ্ছা করলে, বিরহিণী জানান যে, তিনি গোরক্ষনাথকে স্বামী হিসেবে পেতে চান। এমন বিবাহে গোরক্ষকে অপদ্স্থ করা যাবে এমনটা ভেবে, শিব বিরহিণীকে সেই বরই দিলেন। কিন্তু গোরক্ষনাথ এই বিষয়টি বুঝতে পেরে- যোগবলে নিজেকে ছয় মাসের শিশুতে পরিণত হয়ে- বিরহিণীকে মা বলে ডাকেন। এর ফলে বিরহিণী গোরক্ষনাথকে সন্তানতুল্য বিবেচনা করে এই বিবাহের ইচ্ছা ত্যাগ করেন।

গোরক্ষ-বিজয়’ থেকে জানা যায়, একবার গোরক্ষনাথের  গুরু মীননাথ আত্মবিস্মৃত হয়ে কদলী নামক প্রমীলারাজ্যে প্রবেশ করেন এবং সেখানকার ষোলোশত রমণীর ভোগচক্রে আবদ্ধ হয়ে পড়েন। গুরুর এই দশা থেকে উদ্ধারের জন্য গোরক্ষনাথ নর্তকীর বেশে ওই রাজ্যে যান। এরপর মৃদঙ্গবোলের সঙ্গত দ্বারা গুরুকে তাঁর যোগশিক্ষা স্মরণ করিয়ে দেন। এই সঙ্কেত বুঝতে পরে মৎস্যেন্দ্রনাথের চৈতন্য হয় এবং এই ভোগচক্র থেকে উদ্ধার পান। এই কাহিনি গোরক্ষবিজয় নামে অভিহিত হয়ে থাকে।

নাথ সাহিত্যের দ্বিতীয় পর্যায়ে পাওয়া যায়- মাণিকচন্দ্র, ময়নামতী ও গোপীচন্দ্রের গল্প। মাণিকচন্দ্র ছিলেন ভোগ-বিলাসী রাজা। বৃদ্ধ বয়সে রাজা অল্পবয়সী পাঁচটি সুন্দরী যুবতী কিবাহ করেন। এই কারণে রাজার বৃদ্ধা রাণী ময়নামতীর সাথে কলহের সৃষ্টি হয়। পরে রাজা ময়নামতীকে রাজপ্রাসাদ থেকে নির্বাসিত করেন। ময়নামতী রাজপ্রাসাদ থেকে বিতারিত হয়ে ফেরুসা নামক একটি স্থানে বসবাস শুরু করেন। এখানে তাঁর সাথে গোরক্ষনাথের সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি গোরক্ষনাথের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সাধন-ভজন করা শুরু করেন। এদিকে রাজা মাণিকচাঁদ মৃত্যুকাল উপস্থিত হলে, ময়নামতী প্রাসাদে ফিরে এসে, স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। শেষপর্যন্ত সব চেষ্টা ব্যর্থ করে, রাজা মৃত্যুবরণ করেন। এর কিছুদিন পর, ময়নামতীর গর্ভে গোপীচাঁদেরচ জন্ম হয়।

গোপীচন্দ্র যৌবনে পদার্পণ করলে, হরিচন্দ্র নামক রাজার কন্যা অদুনাকে বিবাহ করেন। এই সময় অদুনা ছোট বোন পদুনাকে যৌতুক হিসেবে লাভ করেন। আনুষ্ঠানিভাবে পদুনাকে বিবাহ না করলেও তিনি তাঁকে রাণীর মর্যাদায় রাখেন। গোপীচাঁদ এই দুই পত্নীকে নিয়ে ভোগবিলাসী জীবন শুরু করেন। এই সময় ময়নামতী গণনা করে দেখলেন- গোপী যদি ১২ বৎসর সন্ন্যাস ধর্ম পালন না করেন, তাহলে তাঁর অকাল মৃত্য হবে। তাই ময়নামতী তাঁকে ১২ বৎসরের জন্য সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করার আদেশ দেন। কিন্তু গোপীচন্দ্র মায়ের আদেশ অমান্য করেন। এমনকি মাকে ব্যাভিচারিণী হিসেবে আখ্যয়িত করেন। কিন্তু ময়নামতী তাঁর মত প্রত্যাহর করলেন না। শেষ পর্যন্ত গোপীচাঁদ সন্ন্যাসধর্ম গ্রহণ করতে রাজী হন। এই সময় ময়নামতী তাঁর গুরুভাই হাড়িপাকে গোপীচন্দ্রের সঙ্গী করে দেন।

সাজপ্রাসাদ ত্যাগ করার পর, হড়িপা তাঁকে হীরা নামক এক গণিকার ঘরে ১২ বৎসরের জন্য রেখে যান। গণিকা গোপীর সাথে দৈহিক সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করলে, তিনি তাঁর দুই স্ত্রীর প্রেমে মগ্ন থাকায়, গণিকার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে হীরা প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে নানা ধরণের দুঃখ যন্ত্রণার মধ্যে ফেলেন। গোপী সবকিছু জয় করে, বার বৎসর পরে রাজধানীতে ফিরে আসেন।

তথ্যসূত্র :