প্রোটেরোজোয়িক কাল
ইংরেজি : Proterozoic eon
(২৫০ কোটি বৎসর থেকে ৫৪.১ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)

আর্কিয়ান কালের শেষে এই কালের শুরু হয়েছে।
Proterozoic নামটি গৃহীত হয়েছে গ্রিক শব্দ থেকে। এর অর্থ হলো 'আদি জীবনকাল'। এই সময় সাগরের পানিতে আদি ব্যাক্টেরিয়ার পুরু স্তরের সৃষ্টি হয়েছিল। সে সময় বাতাসে মুক্ত অক্সিজেনের পরিমাণ ছিল অতি সামান্য। এই কারণে, অক্সিজেন গ্রহণকারী জীবের বিকাশও সৃষ্টি হয় নি।
 

এই কালকে মোট তিনটি যুগে ভাগ করা হয়েছে। এই ভাগ তিনটি হলো

১. প্যালেপ্রোটারোজোয়িক যুগ:  ২৫০ থেকে ১৬০ কোটি পূর্বাব্দ।
২. মেসোপ্রোটারোজোয়িক যুগ
: ১৬০ থেকে ১০০ কোটি পূর্বাব্দ।
৩.
নিওপ্রোটারোজোয়িক যুগ: ১০০ কোটি বৎসর থেকে ৫৪.১ পূর্বাব্দ।

নানাদিক বিবেচনা করে বিজ্ঞানীর এই তিনটি যুগকে আবার ৭টি অধিযুগে ভাগ করেছেন। নিচে যুগ ও অধিযুগের বিভাজন তুলে ধরা হলো।

 ১. প্যালেপ্রোটারোজোয়িক যুগ
(২৫০ থেকে ১৬০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। এই যুগ মোট চারটি অধিযুগে বিভাজিত। এই অধিযুগগুলো হলো—  

১.১ সিডেরিয়ান অধিযুগ: ২৫০-২৩০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ।
১.২.
হৃয়াসিয়ান অধিযুগ: ২৩০-২০০.৫ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ।
১.৩.
ওরোসিরিয়ান অধিযুগ: ২০০.৫-১৮০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ।
১.৪.
স্টাথেরিয়ান অধিযুগ:  ১৮০-১৬০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ।
২. মেসোপ্রোটারোজোয়িক যুগ (১৬০-১০০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)। এই যুগ তিনটি অধিযুগে বিভাজিত। এই অধিযুগগুলো হলো-

২.১. ক্যালিম্মিয়ান অধিযুগ: (১৬০-১৪০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
২.২.
এক্টাসিয়ান অধিযুগ: (১৪০-১২০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
২.৩.
স্টেনিয়ান অধিযুগ: (১২০-১০০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)

৩. নেওপ্রোটারোজোয়িক যুগ (১০০-৫৪.১ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ): এই যুগ তিনটি অধিযুগে বিভাজিত।  এই অধিযুগগুলো হলো-

৩.১. টোনিয়ান অধিযুগ:  (১০০-৮৫ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
৩.২. ক্রাইয়োজেনিয়ান অধিযুগ: (৮৫-৬৩.৫ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)
৩.৩. এডিয়াকারান অধিযুগ: (৬৩.৫-৫৪.১ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ)



মহাদেশীয় অবস্থা
পৃথিবীর আদিম দশায় গ্যাসীয় ছিল। ক্রমান্বয়ে শীতল হয়ে গ্যাসীয় পৃথিবী তরল রূপ লাভ করেছিল। এরপর ধীরে ধীরে আরও শীতল হয়ে কঠিন আকার ধারণ করলে, কঠিন অংশগুলো কিছু বড়ো বড়ো খণ্ডের সৃষ্টি করেছিল। এই খণ্ডগুলোকে বলা হয় প্লেট। গোড়ার দিকে এই প্লেটের উপর স্থাপিত ভূভাগ একত্রিত হয়ে একটি বিশাল আকারের ভূভাগের জন্ম দিয়েছিল। এই বিশাল ভূখণ্ডকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন মহা-মহাদেশ (supercontinent)

৩৬০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে আর্কিয়ান কাল-এ মহা-মহাদেশের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ৩১০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে এই ভূখণ্ডটি একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করেছিল। বিজ্ঞানীর এ নামকরণ করেছেন ভাল্বারা মহা-মহাদেশ এই মহা-মহাদেশে দক্ষিণ আফ্রিকার কাপ্পালা ক্রেটন ( Kaapvaal craton) আর পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া পিলবারা ক্রেটন (Pilbara craton) একত্রিত ছিল। এই মহা-মহাদেশটি ছিল পাথুরে। এই মহা-মহাদেশে গঠনের ১০ কোটি বৎসর পরে, অর্থাৎ ৩০০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এমনি আরও একটি মহা-মহাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল। এই মহা-মহাদেশটিকে বলা হয় উর

ক্রমান্বয়ে পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগের তাপমাত্রা হ্রাস পেতে শুরু করেছিল। আবার এই সময়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল যথেষ্ঠ উত্তপ্ত ছিল। ফলে পৃথিবীর উপরিভাগে বিশালাকারের পাথুরে খণ্ড মাধ্যাকর্ষণের কারণে কেন্দ্রের দিকে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল। একসময় এই অখণ্ড শিলায় ফাটল ধরেছিল। এই ফাটলের ফাঁক দিয়ে অগ্ন্যুৎপাতের দ্বারা ম্যাগ্‌মা উপরের দিকে উত্থিত হয়ে উঁচু ভূমি তৈরি করেছিল। আবার এই উঁচু ভূমির কঠিন শিলা নিচের দিকে বসে গিয়ে একটি ভিত্তি তৈরি করেছিল। একই সাথে এসকল কাণ্ড ঘটার কারণে, আর্কিয়ান কাল-এর শেষের দিকে (২৮০-২৫০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ভাল্বারা মহা-মহাদেশ বিভক্ত হয়েছিল। এই বিভাজনের সূত্রে ২৭০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দে কেনোরল্যান্ড মহা-মহাদেশ -এর সৃষ্টি হয়েছিল। ২৫০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দে একটি স্বতন্ত্র মহাদেশ হিসেবে জন্মলাভ করেছিল আর্ক্টিকা (Arctica) মহাদেশ।

২০০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দে
উর এই মহামহাদেশের সাথে যুক্ত হওয়ার পথে অগ্রসর হয়। শেষ পর্যন্ত ১৮০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে নতুন কলাম্বিয়া মহা-মহাদেশ (Columbia supercontinent) সৃষ্টি হয়। এরপর প্রায় ১৫০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দিকে কলাম্বিয়া বিভাজিত হয়ে রোডিনা মহা-মহাদেশের সৃষ্টি হয়

আবহাওয়া ও জীবজগৎ
আর্কিয়ান কালে সু-প্রাণকেন্দ্রীয় কোষ-ভিত্তিক জীবের জৈবিক কার্যক্রমের সূত্রে বাতাসে জমে উঠছিল হাইড্রোজেন সালফাইড। এই কালে সায়ানোব্যাক্টেরিয়া সূত্রে বাতাসে মুক্ত অক্সিজেনের  পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিল পূর্ববর্তী আর্কিয়ান কালে যেখানে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ ছিল ১%, সেখানে এই যুগে (১৮০ কোটি বৎসরের আগে) বাতাসে অক্সিজেনের  পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল ১৫%। প্রোটেরোজোয়িক যুগের শেষে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ ২০%-এ উন্নীত হয়েছিল। পরে এই অক্সিজেন থেকে সৃষ্টি হয়েছিল ওজোন নামক গ্যাস। এই গ্যাস উর্ধ্বাকাশে ওজোন স্তর তৈরি করেছিল। পরবর্তীকালে, জীবজগতের ক্রমবিবর্তনে এই ওজনস্তর ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল। কারণ, ওজোন স্তর সূর্য-রশ্মির সাথে আগত জীবের জন্য ক্ষতিকারক অতি বেগুনীরশ্মিকে প্রতিরোধ করা শুরু করলে, জীবজগতের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়েছিল। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ক্রমেই শীতল হয়ে উঠে এবং তাপমাত্রা এতটাই কমে গিয়েছিল যে পৃথিবীর অনেক অঞ্চলই বরফে ঢাকা পড়ে যায়। এই বরফযুগকে বলা হয় হুরোনিয়ান বরফযুগ

এই সময় জীব জগতের জন্য ক্ষতিকারক অপর একটি উপাদান আয়রন অক্সাইড
(Fe3O4) প্রচুর পরিমাণে মাটির উপরে জমে উঠেছিল। তাই স্থলচর প্রাণীর বিকাশ তখনো শুরু হয় নি। অক্সিজেনকে শ্বসন প্রক্রিয়ায় ব্যবহার করতে পারে এমন ব্যাক্টেরিয়া বিকাশ ঘটেছিল এই সময়এই সূত্রে ৫০-০ কোটি বৎসর আগে পানিতে সু-প্রাণকেন্দ্রিক  কোষ (Eukaryotic cell) যুক্ত আদি উদ্ভিদ ও প্রাণীর উদ্ভব হয়েছিল। এই সময় গ্রাইপানিয়া (Grypania spiralis) নাম শৈবালের উদ্ভব হয়েছিল। এও ধারণা করা হয় যে, এই যুগেই নিউকিলয়াসযুক্ত শৈবাল ও প্রোটোজোয়া পর্বের প্রাণীসমূহের আর্বিভাব ঘটেছিল।

এই যুগের ১৪০ কোটি থেকে ১২০ কোটি খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ভিতরে, প্রথম জীবজগতে যৌন-আচরণযুক্ত বংশবিস্তার শুরু হয়েছিল। ফলে পুং ও স্ত্রী যৌনাঙ্গ বিকশিত হয়েছিল। এর আগে জীবের বংশ বিস্তার হতো শুধু কোষ বিভাজন প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় বংশগতিতে বিশেষ পরিবর্তন দেখা যেতো না। কিন্তু যৌন-বংশবিস্তারের কারণে দুটি পৃথক জীবের মিশ্র বৈশিষ্ট্যযুক্ত জীবের তৈরি হওয়া শুরু হয়।