আমির খসরু

শিষ্যদের সাথে আমির খসরু

(১২৫৩-৫৪- ১৩২৫ খ্রিষ্টাব্দ)
প্রখ্যাত সঙ্গীত সাধক। তুর্কি বংশোদ্ভুত। ফার্সি ও হিন্দি ভাষার কবি। সুফি বাদে তিনি নিজামউদ্দীন আওলিয়ার শিষ্য ছিলেন। শেষ জীবনে সুফিবাদে তিনি এতটাই নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন যে, তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য হযরত আমির খসরু নামে ডাকা হতো।

মূল নাম আবুল হাসান ইয়ামিন উদ-দিন খসরু।  পিতার নাম আমির সাইফ উদ-দিন মাহমুদ। তুর্কি বংশোদ্ভুত হলেও তাঁর পিতা পারশ্যের খোরাসন অঞ্চলে বসবাস করতেন। যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে তিনি পারশ্য ছেড়ে ভারতবর্ষে আসেন। তৎকালীন ভারতের তুর্কি সম্রাট ইতুৎমিশের (১২১১-১২৩৬ খ্রিষ্টাব্দ) আমলে তিনি দিল্লিতে আসেন এবং সর্দার হিসেবে নিযুক্ত লাভ করেন। পরে তিনি এক রাজপুত কন্যাকে বিবাহ করেন।

১২৫৩-৫৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ভারতের বর্তমান পাতিয়ালা (বর্তমান পাঞ্জাব রাজ্যের একটি জেলার নাম ও জেলা শহর) নামক স্থানে আমির খসরু জন্মলাভ করেন। শৈশবে তাঁর নাম ছিল আবুল হোসেন।

১২৬৪ খ্রিষ্টাব্দের তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। পিতার মৃত্যুর পর তিনি তাঁর মায়ের সাথে মাতুলালয়ে যান এবং সেখানে বিদ্যার্জন করেন। নানারকম ঘটনার পর ১২৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তুর্কি বংশোদ্ভুত গিয়াসউদ্দীন বলবন দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। এর কিছুদিন পরে খসরু এই সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। অল্প বয়সে কবিতা রচনা করে তিনি শিক্ষিত সমাজে এবং রাজ দরবারে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। ১২৭১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'তুহফাতুস-সিঘ্র' রচনা করেন। ১২৭২ খ্রিষ্টাব্দে বলবনের ভ্রাতুষ্পুত্র মালিক চর্জ্জুর সাথে তিনি সভাকবি পদে অধিষ্ঠিত হন। ১২৭৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি বলবনের পুত্র বঘরা খাঁর সাথে কবিতা রচনায় বিশেষ মনোযোগী হয়ে উঠেন। ১২৭৮ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গদেশের শাসনকর্তা তুঘ্রাল খাঁর বিরুদ্ধে গিয়াসউদ্দীন অভিযান চালান। যুদ্ধে তুঘ্রাল ঘাঁ নিহত হলে, তিনি তাঁর পুত্র বঘরা খাঁকে বঙ্গদেশের শাসক হিসেবে নিযুক্ত করেন। ১২৮৯ খ্রিষ্টাব্দে খসরু রচনা করেন 'ওয়াস্তুল হায়াত' নামক দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। এই বৎসরে বঘরা খাঁর অনুরোধে তিনি বঙ্গদেশ ভ্রমণ করেন এবং তৎকালীন বাংলার রাজধানী লক্ষ্মণাবতীতে কিছুদিন কাটান।

১২৮৬ খ্রিষ্টাব্দে মোঙ্গলরা মুলতান আক্রমণ করে। সুলতান বলবন তাঁর পুত্র মহম্মদকে এই আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য সেখানে পাঠান। এই যুদ্ধে মহম্মদের সাথে খসরুও যান। যুদ্ধে  মহম্মদ নিহত হন এবং আমির খসরু মোঙ্গলদের হাতে বন্দী হন। ১২৮৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি বন্দীদশা থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। বলবন তাঁকে আগের মতই সমাদর করে সভাকবি হিসেবে দরবারে স্থান দেন।

পুত্রের মৃত্যু শোকে বলবন ‌১২৮৭ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগে সুলতান তাঁর দ্বিতীয় পুত্র বঘরা খাঁকে উত্তরাধিকার মনোনীত করেন। কিন্তু বঘরা খাঁ মূলত শিল্প-সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। শিল্পানুরাগী বঘরা খাঁ সিংহাসন গ্রহণ করতে অসম্মতি জানালে, সুলতান গিয়াসউদ্দীন  মহম্মদের পুত্র কাইখসরুকে সিংহাসন দান করেন। কিন্তু বলবনের মৃত্যু হলে, দরবারের আমিররা কাইখসরুকে বাদ দিয়ে বঘরা খাঁর পুত্র কায়কোবাদকে সিংহাসনে বসান। কিন্তু রাজ্য পরিচালনায় কায়কোবাদ ছিলেন অযোগ্য। এই সুযোগে দরবারে খাল্‌জি বংশীয়রা সিংহাসন দখলের ষড়যন্ত্রে মেতে উঠে। নানারকম দ্বন্দ্ব সংঘাতের ভিতর দিয়ে, শেষ পর্যন্ত ১২৯০ খ্রিষ্টাব্দে জালালউদ্দীন খাল্‌জি কায়কোবাদকে হত্যা করে সিংহাসন অধিকার করেন।

ইতিমধ্যে ১২৮৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে খসরু রচনা করেন 'কিরানুস-স'দাইন' নামক কাব্যবগ্রন্থ। সিংহাসন দখলের পর জালালউদ্দীন রাজদরবারের পুরানো অনেক কর্মীদের বরখাস্ত করলেও, আমির খসরু সমাদরেই থেকে যান এবং দিল্লীর দরবারকে কাব্য ও সঙ্গীতে মুখর করে রাখেন। জালালউদ্দীন খাল্‌জি তাঁর কাব্য ও সঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে "আমারত" উপাধিতে সম্মানিত করেন। তখন থেকেই তিনি 'আমারত খসরু' বা 'আমির খসরু' নামে পরিচিত লাভ করেন। ১২৯০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি রচনা করেন 'মিফতাহুল ফুতুহ' নামক কাব্যগ্রন্থ। আর ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে রচনা করেন 'ঘিরাতুল-কামাল' নামক কাব্য।

১২৯৬ খ্রিষ্টাব্দে আলাউদ্দীন খিলজি তাঁর চাচা এবং তার প্রতপালক জালালউদ্দীন খাল্‌জিকে হত্যা করে দিল্লির সিংহাসনে দখল করেন। এই সময় আমির খসরু সসম্মানে দরবারে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

১২৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি 'খামসা-ই-নিজামি' কাব্য শেষ করেন। ১৩১০ খ্রিষ্টাব্দে রচনা করেন 'খজাইন - উল -ফুতুহ' নামক কাব্য। ১৩১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি  "দুভাল - রানি - খিজার - খান" কাব্য লেখা শেষ করেন। অনেকে মনে করেন, ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি পারশ্যের তবল নামক যন্ত্রটির সংস্কার করে ভারতীয় তবলা যন্ত্রের উদ্ভাবন করেন।

১৩১৬ খ্রিষ্টাব্দে আলাউদ্দীন-এর মৃত্যুর পর নানা সংঘাতের পর ১৩২০ খ্রিষ্টাব্দে গিয়াসউদ্দীন তুঘলক দিল্লীর সিংহাসন অধিকার করেন। এই সময়ে আমির খসরু দিল্লীর দরবারে সর্বোচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই সময় তিনি মাসিক হাজার টাকা সম্মানী পেতেন রাজদরবার থেকে। সঙ্গীত এবং কাব্যে তাঁকে গুরু হিসেবে মান্য করা হতো। ১৩২১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি 'তুঘলকনামা' রচনায় হাত দেন।

১৩২৩ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গদেশে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য গিয়াসউদ্দীন বঙ্গদেশে আসেন। এই সময় তাঁর সাথে ছিলেন আমির খসরু। ১৩২৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর সুফি গুরু নিজামউদ্দীন আওলিয়া মৃত্যবরণ করেন। এই সংবাদ শোনার পর তিনি অত্যন্ত শোকাহত হন। এরপর তিনি বঙ্গদেশ ত্যাগ করে দিল্লী চলে আসেন। অনেকে মনে করেন, গুরুর মৃত্যু শোকেই তিনি ১৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যবরণ করেন।

কাব্যগ্রন্থ রচনা করে হিন্দি এবং ফার্সি ভাষাকে তিনি সমৃদ্ধ করেন। সেতারতবলা আবিষ্কার করেন বলেও অনেক গবেষক দাবি করেন। এ দুটির বাদনশৈলীর আদিরূপ আমির খসরু তৈরি করেছিলেন।

প্রাচীন ভারতের মূর্চ্ছনা সূত্রে প্রাপ্ত ৭টি শুদ্ধ স্বর ও ৫টি বিকৃত স্বরের বিন্যাসিত করে ১২ স্বরের কাঠামোকে সুনির্দিষ্ট করেছিলেন আমির খসরু। তাঁর আমলে দিল্লির নিকটবর্তী অঞ্চলে আঞ্চলিক কাওয়াল গানের সাথে রাগের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে খেয়াল গানের আদি রূপ তৈরি করেছিলেন।

আমির খসরুর সৃষ্ট রাগ
আমির খসরু, সুলতান আলাউদ্দীন খিলজির সময় ভারতীয় দুই সঙ্গীত সাধক গোপাল নায়ক এবং বৈজু বাওরার সংস্পর্শে আসেন। এই দুই ভারতীয় সঙ্গীতসাধকের দ্বারা ভারতীয় সঙ্গীতের প্রাচীন ধারা 'ধ্রুবা গান'-এর সাথে বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে উঠেন।

তিনি পারস্যের সঙ্গীতের সাথে ভারতীয় সঙ্গীতের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে ভারতীয় রাগসঙ্গীতকে ভিন্ন মাত্রা দান করেন।  তিনি ভারতীয় রাগ সঙ্গীতকে ১২টি মুকামে ভাগ করেন। তিনি কওল, তিলানা, তিরবট, খেয়াল গায়ন রীতি প্রবর্তন করেন।

তিনি পারশ্যের রাগকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় কাঠামোতে তৈরি করেছিলেন ইমন রাগ। পরে এই রাগের সাথে অন্যান্য রাগের মিশ্রণ ঘটিয়ে তৈরি করেছিলেন ইমন-পুরিয়া, ইমন-ভূপালী, ইমন-বিলাবল, ইমন বেহাগ, ইমন কল্যাণ।  ফকিরুল্লা'র রাগ দর্পণ গ্রন্থ থেকে ১২টি এরূপ ১২টি রাগের তালিকা পাওয়া যায়। এর বাইরে পাওয়া যায়, এছাড়া তিনি প্রণয়ন করেছিলেন- ঝিঁঝিট, যমনী, তুরস্ক-গৌড়, তুরস্ক টোড়ি, বাহার, আলাইয়া বিলাবল, সাহানা, অাড়ানা, মোহনী. সুহ. সুখরাই, রুলীক, মারু, পিলু, বারওয়া, লুম ইত্যাদি।
সূত্র :