গিয়াসউদ্দিন বলবন
ভারতবর্ষে আদি তুর্কি শাসনের নবম শাসক।

তাঁর পূর্বনাম ছিল বাহাউদ্দিন। তিনি তুর্কি ইলবেরি বংশের ছিলেন। শৈশবে তিনি মোঙ্গলদের হাতে বন্দি হন। পরে মোঙ্গলদের কাছ থেকে জামালউদ্দিন ক্রয় করে ইলতুৎমিস-এর কাছে বিক্রয় করেন। অল্পদিনেই তিনি যুদ্ধ এবং রাজনীতিতে বিশেষ পারদর্শী হয়ে উঠেন। এই সূত্রে তিনি ইলতুৎমিস-এর চল্লিশজন ক্রীতদাসের দলের অন্যতম সদস্যে পরিণত হন। সুলতানা রাজিয়া (১২৩৬-৪০খ্রিষ্টাব্দ)-র শাসনামলে তিনি আমির-ই-শিকার' পদ লাভ করেন। কিন্তু রাজিয়ার পতনের সময় তিনি তুর্কি আমিরদের পক্ষালম্বন করেছিলেন। এই কারণে বাহরাম শাহ্ (১২৪০-৪২ খ্রিষ্টাব্দ) ক্ষমতা লাভের পর, তাঁকে পাঞ্জাবের অন্তর্গত গুরগাঁ জেলার জায়গির দান করেছিলেন।

১২৪২ খ্রিষ্টাব্দে আমিররা বাহরাম শাহ্ অপসারিত করে, ইলতুৎমিস-এর অপর পুত্র  আলাউদ্দিন মাসুদ শাহকে সিংহাসনে বসান। গিয়াসউদ্দিন বিষয়টি সহজভাবে নেন নি। তিন ইলতুৎমিস-এর অপর পুত্র নাসিরউদ্দিন মাহমুদ-এর সাথে ষড়যন্ত্র করে, ১২৪৪ খ্রিষ্টাব্দে মাসুদ শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং নাসিরুদ্দিন মাহমুদকে দিল্লীর সিংহাসনে বসান।

নাসিরুদ্দিন মাহমুদ ছিলেন শান্তিপ্রিয় এবং ধর্মভীরু। এই কারণে তিনি অধিকাংশ সময় ধর্মচর্চার ভিতরেই থাকতেন। এই কারণে আমিরা তাঁকে সিংহাসনে বসিয়ে রেখে, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতেন। নাসিরুদ্দিন মাহমুদকে ক্ষমতায় আনার সাফল্যের কারণে, আমিরদের ভিতরে গিয়াসউদ্দিন মূল শাসন ক্ষমতায় চলে আসেন। তিনি নিজের আত্মীয়দের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে,  নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। একই সাথে তিনি কেন্দ্রীয় সুশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। নাসিরুদ্দিন মাহমুদ-এর রাজত্বের সময় যতগুলো বিদ্রোহ হয়েছে, তার সবই গিয়াসউদ্দিন বলবন সাফল্যের সাথে মোকাবেলা করেন। ফলে প্রকৃত সুলতান বলবনই হয়ে উঠেছিল। ১২৪৬ খ্রিষ্টাব্দে মুলতান থেকে  মোঙ্গলদের বিতারিত করার সময়, তিনি বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এর পুরস্কার স্বরূপ নাসিরুদ্দিন তাঁকে প্রধান মন্ত্রীত্বের পদ দান করেন। পরে তিনি তাঁর নিজ কন্যার সাথে গিয়াসউদ্দিনের বিবাহ দেন।

১২৪৯ খ্রিষ্টাব্দে মুলতানের শাসনকর্তা সৈফউদ্দিন হাসানকে পরাজিত করে, সেখানে কেন্দ্রের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। ১২৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মধ্য প্রদেশের  চান্দেরি শহর দখল করেছিলেন।

১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দে মুলতানের শাসনকর্তা কাস্‌লু খাঁ অযোধ্যার শাসনকর্তাকে সাথে নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ফলে বলবন কাস্‌লু খাঁ'র বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে তাঁকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন। উল্লেখ্য, এই সময় পাঞ্জাবের অধিকাংশ অঞ্চল মোঙ্গলদের অধিকারে ছিল।

১২৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অপুত্রক অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। ফলে তাঁর মৃত্যুর পর, গিয়াসউদ্দিন বলবন সিংহাসনে লাভ করেন। ১২৬৬ খ্রিষ্টাব্দে গৌড়ের অধিকার গিয়াসউদ্দিনের ছিল। তিনি আমিন খাঁকে শাসনকর্তা এবং মুঘিসউদ্দিন তুঘ্রালকে সহকারী-শাসনকর্তা পদে নিযুক্ত করেন। আমিন খাঁ নামে মাত্র শাসনকর্তা ছিলেন। তাঁর নামে বাংলার শাসক হয়ে উঠেন তুঘ্রাল। তিনি ঢাকা,  ফরিদপুর এবং ত্রিপুরা দখলের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। এছাড়া তিনি বরিশাল অঞ্চলে দনুজ রাই নামক কায়স্থ রাজার সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। এই যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। উড়িষ্যা আক্রমণ করে সেখানে লুটতরাজ চালান। বাংলদেশের রাঢ় অঞ্চলেও তিনি অভিযান চালিয়ে দখল করেন।

তুঘ্রালের এই সকল বিজয়ের পর তিনি নিজেকে অত্যন্ত শক্তিশালী শাসক হিসেবে ভাবা শুরু করেন। এর ভিতর গিয়াসউদ্দিন বলবন-এর মিথ্যা মৃত্যু সংবাদ প্রচারতি হলে, নিজেকে স্বাধীন সুলতান হিসেবে ঘোষণা দেন এবং আমিন খাঁকে বিতারিত করেন। ফলে ১২৮০ খ্রিষ্টাব্দে তুঘ্রালকে শায়েস্তা করার জন্য বাংলা আক্রমণ করেন। তুঘ্রাল দিল্লীর সেনাবাহিনীর মুখোমুখী না হয়ে লক্ষ্মণাবতী ত্যাগ করেন। সুলতানের বাহিনী লক্ষ্মণাবতী দখল করেন এবং তুঘ্রালকে বন্দী করার জন্য তাঁর পশ্চাদানুসরণ করেন। উড়িষ্যা সীমান্তের কাছে, সুলতান বাহিনী তাঁকে আকস্মিকভাবে আক্রমণ করেন। যুদ্ধে তিনি পরাজিত হলে, তাঁকে বন্দী করে লক্ষ্মণাবতীতে আনা হয়। ১২৮৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সুলতান তাঁকে সপরিবারে হত্যা করেন। তুঘ্রালের পতনের পর,  গিয়াসউদ্দিন কিছুদিন লক্ষ্মণাবতীতে কাটান। তারপর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র বখরা খাঁর কাছে বাংলার শাসনভার ন্যস্ত করে তিনি দিল্লীতে ফিরে যান।

১২৮৬ খ্রিষ্টাব্দে মোঙ্গলরা মুলতান আক্রমণ করে। এই সময় মুলতানের শাসনকর্তা ছিলেন গিয়াসউদ্দিনের প্রথম পুত্র সুলতান মহম্মদ। সুলতান মহম্মদ মোঙ্গলদের যথাসাধ্য বাধা দিয়েও পরাজিত ও নিহত হন। ফলে বৃদ্ধ বয়সে তিনি নিজে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং মুলতানের রাজধানী লাহোর পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু তাঁর পুত্রের মৃত্যুতে অত্যন্ত শোকাহত হন। তিনি বাংলার শাসক বঘরা খাঁকে দিল্লীর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করেন। বঘরা খাঁ এই দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করলে, তিনি প্রথম পুত্র সুলতান মহম্মদ-এর পুত্র কাইখসরুকে উত্তরাধিকারী করে যান। এরপর ১২৮৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

কিন্তু গিয়াসউদ্দিন বলবন-এর মৃত্যুর পর, আমিররা কাইখুস্‌রুকে বাতিল করে বঘরা খাঁ'র পুত্র কায়কোবাদকে সিংহাসনে বসান। কায়কোবাদ ১৮ বৎসর বয়সে রাজত্ব লাভ করেন। তিনি রাজ্য চালনায় অনভিজ্ঞ ছিলেন এবং ইন্দ্রিয়পরায়ণ ছিলেন। ফলে কেন্দ্রীয় শাসন ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সময় তুর্কি এবং খলজিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই দ্বন্দ্বে তুর্কিরা পরাজিত হলে, খলজিরা ক্ষমতা দখল করে। এরা কাবকোবাদকে হত্যা করে এবং তাঁর শিশুপুত্র কায়ুমার্সকে কারাগারে নিক্ষেপ করে। এই সময় খলজি নেতা জালালউদ্দিন নিজেকে সুলতান হিসেবে ঘোষণা দেন। এই সূত্রে দিল্লীতে খলজি শাসন  শুরু হয়।


সূত্র :
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।